সকালে ঘুম ভাঙিয়া দেখি ব্যোমকেশ টেবিলে বসিয়া পরম মনোযোগের সহিত চিঠি লিখিতেছে। গা ঝাড়া দিয়া উঠিয়া বসিলাম‌, আড়মোড়া ভাঙিয়া বলিলাম‌, ‘কাকে চিঠি লিখছি? সত্যবতীকে? দুদিন যেতে না যেতেই বিরহ চাগাড় দিল নাকি?’

ব্যোমকেশ লিখিতে লিখিতে বলিল‌, ‘বিরহ নয়-বিকাশ।’

‘বিকাশ।’

‘বিকাশ দত্ত।’

‘ও–বিকাশ। তাকে চিঠি লিখছ কেন?’

‘বিকাশের জন্যে একটা চাকরি যোগাড় করেছি। কয়লাখনির ডাক্তারখানায় আদলির চাকরি। তাই তাকে আসতে লিখছি।’

‘বুঝেছি।’

ব্যোমকেশ আবার চিঠি লেখায় মন দিল। সে বিকাশকে আনিয়া কয়লাখনিতে বসাইতে চায়‌, নিজে দূরে থাকিয়া কয়লাখনির তত্ত্ব সংগ্রহ করিবে। আপনি রইলেন ডরপানিতে পোলারে পাঠাইলেন চর।

প্রাতরাশের সময় লক্ষ্য করিলাম আজ ইন্দিরার মুখ অনেকটা প্রফুল্ল; দ্বিধা সংশয়ের মেঘ ফুড়িয়া সূর্যের আলো ঝিকমিক করিতেছে। ফণীশ তাহাকে বোমকেশের আশ্বাসের কথা বলিয়াছে।

আজও আমরা দু’জনে প্রাতরাশ গ্রহণ করিতেছি‌, দুই কত বহু পূর্বেই কর্মস্থলে চলিয়া গিয়াছেন। ব্যোমকেশ টেস্ট চিবাইতে চিবাইতে ইন্দিরার প্রতি কটাক্ষপাত করিল‌, বলিল‌, ‘তোমার কতটি একেবারে ছেলেমানুষ।’

ইন্দিরা লজ্জিতভাবে চক্ষু নত করিল; তারপর তাহার চোখে আবার উদ্বেগ ও শঙ্কা ফিরিয়া আসিল। এই মেয়েটির মনে স্বামী সম্বন্ধে আশঙ্কার অন্ত নাই; ব্যোমকেশ তাহাকে ভরসা দিয়া বলিল‌, ‘ভাবনা নেই‌, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা এখন বেরুচ্ছি।’

ইন্দিরা চোখ তুলিয়া বলিল‌, ‘কোথায় যাকেন?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এই এদিক ওদিক। ফিরতে বোধ হয় দুপুর হবে। কর্তা  যদি জিগ্যোস করেন‌, বোলো শহর দেখতে বেরিয়েছি।’

যাহার শেষ হইলে আমরা উঠিলাম। মোটর-ড্রাইভার আসিয়া জানাইল‌, দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি।

গাড়িতে উঠিয়া ব্যোমকেশ ড্রাইভারকে হুকুম দিল, আগে পোস্ট-অফিসে চল।’

পোস্ট-অফিসে গিয়া চিঠিখানাতে এক্সপ্রেস ডেলিভারি টিকিট সাঁটিয়া ডাকে দিল‌, তারপর ফিরিয়া আসিয়া ড্রাইভারকে বলিল‌, ‘এবার থানায় চল। সদর থানা।’

থানার সিংহদ্বারে কনস্টেবলের পাহারা। ব্যোমকেশ বড় দারোগাবাবুর সাক্ষাৎ প্রার্থনা করিলে সে একখণ্ড কাগজ বাহির করিয়া বলিল‌, ‘নাম আর দরকার লিখে দিন–এত্তালা পাঠাচ্ছি।’

ব্যোমকেশ কাগজে লিখিল‌, ‘গগন মিত্র। মণীশ চক্রবর্তীর কয়লাখনি সম্পর্কে।’

অল্পক্ষণ পরে কনস্টেবল ফিরিয়া আসিয়া বলিল‌, ‘আসুন।’

ভিতরের একটি ঘরে ইউনিফর্ম-পরা দারোগাবাবু টেবিলের সামনে বসিয়া আছেন, আমরা প্রবেশ করিলে মুখ তুলিলেন‌, তারপর লাফাইয়া আসিয়া ব্যোমকেশের হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিলেন‌, ‘এ কি কাণ্ড! আপনি গগন মিত্র হলেন কবে থেকে।’

গলার স্বর শুনিয়া চিনিতে পারিলাম-প্রমোদ বরাট। কয়েক বছর আগে গোলাপ কলোনী সম্পর্কে কিছুদিনের জন্য ঘনিষ্ঠতা হইয়াছিল। পুলিশের চাকরি ভবঘুরের চাকরি, তিনি ঘুরিতে ঘুরিতে এই শহরের সদর থানার দারোগাবাবু হইয়া আসিয়াছেন। নিকষকৃষ্ণ চেহারা এই কয় বছরে একটু ভারী হইয়াছে; মুখের ধার কিন্তু লেশমাত্র ভোঁতা হয় নাই।

সমাদর করিয়া আমাদের বসাইলেন। কিছুক্ষণ অতীত-চর্বণ চলিল‌, তারপর ব্যোমকেশ আমাদের এই শহরে আসার কারণ বলিল। শুনিয়া প্রমোদবাবু বলিলেন‌, ‘হঁ‌, ফুলঝুরি কয়লাখনির কেসটা আমাদের ফাইলে আছে‌, কিন্তু কিছু করা গেল না। এসব কাজ পুলিসের দ্বারা ভাল হয় না; আমাদের অনেক লোক নিয়ে কাজ করতে হয়‌, মন্ত্রগুপ্তি থাকে না। আপনি পারবেন।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বিকাশ দত্তকে মনে আছে? তাকে ডেকে পাঠালাম‌, সে কয়লাখনিতে থেকে সুলুক-সন্ধান নেবে।’

প্রমোদবাবু বলিলেন‌, ‘বিকাশকে খুব মনে আছে। চৌকশ ছেলে। তা আমাকে দিয়ে যদি কোনো কাজ হয়—’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আপনার কাছে। ও-কাজের জন্যে আমি আসিনি‌, প্রমোদবাবু। সম্প্রতি এখানে একটা খুন হয়েছে‌, প্ৰাণহরি পোদ্দার নামে এক বৃদ্ধ—’

‘আপনি তার খবরও পেয়েছেন?’

‘না পেয়ে উপায় কি! আমরা যাঁর বাড়িতে অতিথি তাঁর ছেলেই তো আপনার একজন আসামী।’

প্রমোদ বরাট মুখের একটি করুণ ভঙ্গী করিয়া বলিলেন‌, ‘বড় মুশকিলে পড়েছি‌, ব্যোমকেশবাবু। যে চারজনের ওপর সন্দেহ তারা সবাই এ শহরের হতকতা‌, প্রচণ্ড দাপট। তাই ভারি সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। সাক্ষী-সার্বুদ নেই‌, সবই circumstantial evidence‌, এদের কাউকে যদি ভুল করে গ্রেপ্তার করি‌, আমারই গর্দান যাবে।’

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘এই চারজনের মধ্যে কার ওপর আপনার সন্দেহ?’

প্রমোদবাবু ভাবিতে ভাবিতে বলিলেন‌, চারজনেরই মোটিভ সমান‌, চারজনেরই সুযোগ সমান। তবু মনে হয় এ অরবিন্দ হালদারের কাজ।’

‘চারজনে এক জোট হয়ে খুন করতে গিয়েছিল এমন মনে হয় না?’

‘না।’

‘বাড়িতে একটা দাসী ছিল‌, তার কথা ভেবে দেখেছেন?’

‘দেখেছি। তার সুযোগ ছিল সবচেয়ে বেশি কিন্তু মোটিভ খুঁজে পাইনি।’

‘হুঁ। আপনি যা জানেন সব আমাকে বলুন‌, হয়তো আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি।’

‘সাহায্য করবেন আপনি? ধন্যবাদ। আপনার সাহায্য পাওয়া তো ভাগ্যের কথা‌, ব্যোমকেশবাবু।’

অতঃপর প্রমোদ বরাট যাহা বলিলেন তাহার মর্মার্থ এই—

যে-রাত্রে প্রাণহরি পোদ্দার মারা যান সে-রত্রে দশটার সময় উলুডাঙা কোলিয়ারির দিক হইতে একটা ট্রাক আসিতেছিল। ট্রাক-ড্রাইভার হঠাৎ গাড়ি থামাইল‌, কারণ একটা স্ত্রীলোক রাস্তার মাঝখানে দাঁড়াইয়া হাত নাড়িয়া তাহাকে থামিতে বলিতেছে। গাড়ি থামিলে স্ত্রীলোকটা ছুটিয়া আসিয়া বলিল‌, শীগগির পুলিসে খবর দাও‌, এ বাড়ির মালিককে কারা খুন করেছে।’

ট্রাক-ড্রাইভার আসিয়া থানায় খবর দিল। আধঘণ্টার মধ্যে ইন্সপেক্টর বিরাট সাঙ্গোপাঙ্গ লইয়া অকুস্থলে উপস্থিত হইলেন। মেয়েটা তখনও ব্যাকুল চক্ষে রাস্তার ধারে দাঁড়াইয়া আছে। তাহার নাম মোহিনী‌, প্রাণহোরর গৃহে সেই একমাত্র দাসী‌, অন্য কোনও ভৃত্য নাই।

ইন্সপেক্টর বরাট বাড়ির দ্বিতলে উঠিয়া লাশ দেখিলেন; তাঁহার অনুচরেরা বাড়ি খানাতল্লাশ করিল। বাড়িতে অন্য কোনও লোক নাই। মোহিনীকে প্রশ্ন করিয়া জানা গেল সে নীচের তলায় রান্নাঘরের পাশে একটি কুঠুরিতে শয়ন করে; কর্তাবাবু শয়ন করেন উপরের ঘরে। আজ সন্ধ্যার সময় শহর হইতে ফিরিয়া তিনি নীচের ঘরে বসিয়া চা পান করিয়াছিলেন‌, তারপর উপরে উঠিয়া গিয়াছিলেন। মোহিনী রান্না আরম্ভ করিয়াছিল। বাবু ন’টার পর নীচে নামিয়া আসিয়া আহার করেন‌, আজ কিন্তু তিনি নামিলেন না। আধঘণ্টা পরে মোহিনী উপরে ডাকিতে গিয়া দেখিল ঘরের মেঝোয়। কর্তাবাবু মরিয়া পড়িয়া আছেন।

লাশ চালান দিয়া বিরাট মোহিনীকে আবার জেরা করিলেন। জেরার উত্তরে সে বলিল‌, সন্ধ্যার পর বাড়িতে কেহ আসে না; কিছুদিন যাবৎ চারজন বাবু রাত্রে তাস খেলিতে আসিতেন; যেদিন তাঁহাদের আসিবার কথা সেদিন বাবু শহর হইতে মাছ মাংস কিমা ইত্যাদি কিনিয়া আনিতেন‌, মোহিনী তাহা রাঁধিয়া বাবুদের খাইতে দিত। আজ বাবুরা আসেন নাই‌, রন্ধনের আয়োজন ছিল না। বাবুরা চারজনই যুবপুরুষ‌, কতর্বিাবুর মত বুড়ো নয়। তাঁহারা মোটরে চড়িয়া আসিতেন; সাজপোশাক হইতে তাঁহাদের ধনী বলিয়া মনে হয়। মোহিনী তাঁহাদের নাম জানে না। আজ সে যখন রান্না করিতেছিল তখন কেহ বাড়িতে আসিয়াছিল। কিনা তাহা সে বুলিতে পারে না। বাড়িতে লোক আসিলে প্ৰাণহরি নীচের তলায় তাহদের সঙ্গে দেখা করিতেন‌, উপরের ঘরে কাহাকেও লইয়া যাইতেন না। কর্তাবাবু আজ নীচে নামেন নাই‌, নামিলে মোহিনী কথাবার্তৰ্গর আওয়াজ শুনিতে পাইত।

জেরা শেষ করিয়া বরাট বলিলেন‌, ‘তুমি এখন কি করবে? শহরে তোমার জানাশোনা লোক আছে?’

মোহিনী বলিল‌, ‘না‌, এখানে আমি কাউকে চিনি না।’

বরাট বলিলেন‌, ‘তাহলে তুমি আমার সঙ্গে চল‌, রাত্তিরটা থানায় থাকবে‌, কাল একটা ব্যবস্থা করা যাবে। তুমি মেয়েমানুষ‌, একলা এ বাড়িতে থাকতে পারবে কেন?’

মোহিনী বলিল‌, ‘আমি পারব। নিজের ঘরে দোর বন্ধ করে থাকব। আমার ভয় করবে না।’

সেইরূপ ব্যবস্থা হইল। বরাট একজন কনস্টেবলকে পাহারায় রাখিয়া প্রস্থান করিলেন।

প্রাণহরি সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিয়া প্রমোদবাবু জানিতে পারিলেন‌, প্রাণহরি কয়লা ক্লাবের মেম্বর ছিলেন। সেখানে গিয়া খবর পাইলেন‌, প্ৰাণহরি চারজন মেম্বরের সঙ্গে নিয়মিত তাস খেলিতেন। ব্যাপার খানিকটা পরিষ্কার হইল; এই চারজন যে প্ৰাণহারির বাড়িতে তাস খেলিতে যাইতেন তাহা অনুমান করা গেল।

প্রমোদবাবু চারজনকে পৃথকভাবে জেরা করিলেন। তাহারা স্বীকার করিল যে মাঝে মাঝে প্রাণহোরর বাড়িতে তাস খেলিতে যাইত‌, কিন্তু প্ৰাণহোরর মৃত্যুর রাত্রে তাহার বাড়িতে গিয়াছিল। একথা দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করিল।

তাহাদের চারজন মোটর-ড্রাইভারকে প্রমোদ বরাট প্রশ্ন করিলেন। তিনজন ড্রাইভার বলিল সে-রাত্রে বাবুরা মোটরে চড়িয়া প্রাণহারির বাড়িতে যান নাই। কেবল একজন বলিল‌, বাবুরা রাত্রি আন্দাজ আটটার সময় একসঙ্গে ক্লাব হইতে বাহির হইয়াছিলেন‌, কিন্তু মোটরে না গিয়া পদব্রজে গিয়াছিলেন‌, এবং ঘণ্টাখানেক পরে ফিরিয়া আসিয়াছিলেন। তাঁহার একসঙ্গে কোথায় গিয়াছিলেন তাহা সে জানে না।

বরাট তখন ট্যাক্সি-ড্রাইভারদের মধ্যে খোঁজ-খবর লইলেন‌, শহরে গোটা পঞ্চাশ ট্যাক্সি আছে। শেষ পর্যন্ত একজন ড্রাইভার অন্য একজন ড্রাইভারকে দেখাইয়া বলিল-ও সে-রাত্রে ভাড়ায় গিয়াছিল‌, ওকে জিজ্ঞাসা করুন। দ্বিতীয় ড্রাইভার তখন বলিল-উক্ত রাত্রে চারজন আরোহী লইয়া সে উলুডাঙা কয়লাখনির রাস্তায় গিয়াছিল। বরাট ড্রাইভারকে কয়লা ক্লাবে আনিয়া চুপিচুপি চারজনকে দেখাইলেন। ড্রাইভার চারজনকে সনাক্ত করিল।

তারপর বিরাট চারজনকে বার বার জেরা করিয়াছেন। কিন্তু তাহারা অটলভাবে সমস্ত কথা অস্বীকার করিয়াছে। পরিস্থিতি দাঁড়াইয়াছে এই যে‌, একটা ট্যাক্সি-ড্রাইভার ছাড়া অন্য সাক্ষী নাই; এ অবস্থায় শহরের চারজন গণ্যমান্য লোককে খুনের দায়ে গ্রেপ্তার করা যায় না।

বয়ান শেষ করিয়া বরাট বলিলেন‌, ‘আমি যতটুকু জানতে পেরেছি আপনাকে জানালাম। তবে একটা অবাস্তর কথা বোধ হয় আপনাকে জানিয়ে রাখা ভাল। অন্যতম আসামীর দাদা গোবিন্দ হালদার আমাকে পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ দিতে এসেছিলেন।’

‘তাই নাকি?’

‘হ্যাঁ। ভারী কৌশলী লোক। আমাকে আড়ালে ডেকে ইশারায় জানিয়েছিলেন যে‌, কেসটা যদি চাপা দিই তাহলে পাঁচ হাজার টাকা বিকশিশ পাব।’

 

ঘড়িতে দেখিলাম বেলা সাড়ে ন’টা।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আপনার এখন কোনো জরুরী কাজ আছে কি? অকুস্থলটা দেখবার ইচ্ছে আছে।’

বরাট বলিলেন‌, ‘বেশ তো‌, চলুন না।’

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘মেয়েটা এখনো ওখানেই আছে নাকি?’

বরাট বলিলেন‌, ‘আছে বৈকি। তার কোথাও যাবার নেই‌, ঐ বাড়িতেই পড়ে আছে।’

তিনজনে বাহির হইলাম; প্রমোদবাবু আমাদের গাড়িতেই আসিলেন। গাড়ি চলিতে আরম্ভ কুমিল্লামকেশ ড্রাইভারকে বলল‌, ‘যে বাড়িতে বাবুরা তাস খেলতে যেতেন সেই বাড়িতে নিয়ে চল।’

ড্রাইভারের নির্বিকার মুখে ভাবান্তর দেখা গেল না‌, সে নির্দেশ মত গাড়ি চালাইল।

দশ মিনিট পরে প্রাণহরি পোদ্দারের বাড়ির সামনে মোটর থামিল। বাড়ির সদরে কেহ নাই’। বাড়িটা দেখিতে একটু উলঙ্গ গোছের; চারিপাশে পাঁচিলের বেড়া নাই‌, রাস্তা হইতে কয়েক হাত পিছাইয়া আকুহীনভাবে দাঁড়াইয়া আছে। সদর দরজা খোলা।

বরাট ভ্রূ কুঞ্চিত করিলেন‌, এদিক ওদিক চাহিয়া বলিলেন‌, ‘হতভাগা কনস্টেবলটা গেল কোথায়?’

বরাট আগে আগে‌, আমরা তাঁহার পিছনে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিলাম। রান্নাঘরের দিক হইতে হেঁড়ে গলার আওয়াজ আসিতেছে। সেইদিকে অগ্রসর হইয়া দেখিলাম উর্দি-পরা পাহারাওলা গোঁফে চাড়া দিতে দিতে রান্নাঘরের দ্বারের সামনে দাঁড়াইয়া অন্তর্বর্তিনীর সহিত রসালাপ করিতেছে। আমাদের দেখিয়া একেবারে কাঠ হইয়া গেল।

বরাট আরক্ত চক্ষে তাহার পানে চাহিলেন‌, সে কলের পুতুলের মত স্যালুট করিল। বিরাট বলিলেন‌, ‘বাইরে যাও। সদর দরজা খোলা রেখে তুমি এখানে কি করছ?’

বরাটের প্রশ্নটা সম্পূর্ণ আলঙ্কারিক। অতি বড় নিরেট ব্যক্তিও বুঝিতে পারে পাহারাওলা এখানে কি করিতেছিল। মক্ষিকা মধু ভাণ্ডের কাছে কী করে?

পাহারাওলা আবার স্যালুট করিয়া চলিয়া গেল। বরাট তখন রান্নাঘরের ভিতরে সন্দিগ্ধ দৃষ্টি প্রেরণ করিলেন। মোহিনী মেঝোয় বসিয়া তরকারি কুটিতেছিল‌, তুরিতে উঠিয়া বরাটের পানে সপ্রশ্ননেত্ৰে চাহিল।

কালো মেয়েটার সারা গায়ে-মুখে চোখে অঙ্গসঞ্চালনে-কুহকভরা ইন্দ্বজাল‌, ভরা যৌবনের দুৰ্নিবার আকর্ষণ। যদি রঙ ফরসা হইত। তাহাকে অপূর্ব সুন্দরী বলা চলিত। তবু্‌, তাহার কালো রঙের মধ্যেও এমন একটি নিশীথ-শীতল মাদকতা আছে যে মনকে আবিষ্ট করিয়া ফেলে।

কিন্তু প্রমোদ বরাট কাঠখোট্টা মানুষ‌, তিনি বলিলেন‌, ‘তুমি তাজা তরকারি পেলে কোথায়?’

মোহিনী বলিল‌, ‘পাহারাওলাবাবু এনে দিয়েছেন। উনি নিজের সিধে তরিতরকারি আমাকে এনে দেন‌, আমি রোধে দিই। আমারও হয়ে যায়।’

বরাট গলার মধ্যে শব্দ করিয়া বলিলেন‌, ‘হুঁ ‌, ভারি দয়ার শরীর দেখছি পাহারাওলাবাবুর।’

মোহিনী বক্রোক্তি বুঝিল কিনা বলা যায় না‌, প্রশ্ন করিল‌, ‘আমাকে কি দরকার আছে‌, দারোগাবাবু?’

প্রমোদবাবু বলিলেন‌, ‘তুমি এখানেই থাকো। আমরা খানিক পরে তোমাকে ডাকব।’

‘আচ্ছা।’

আমরা সদর দরজার দিকে ফিরিয়া চলিলাম। চলিতে চলিতে ব্যোমকেশ স্মিতমুখে বলিল‌, ‘আপনি একটু ভুল করেছেন‌, ইন্সপেক্টর বরাট। আপনার উচিত ছিল একজন বুড়ো পাহারাওলাকে এখানে বসানো।’

বরাট বলিলেন‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, আপনি ওদের চেনেন না। পাহারাওলারা যত বুড়ো হয় তাদের রস তত বাড়ে।’

ব্যোমকেশ হাসিতে হাসিতে বলিল‌, ‘আর সুদখোর মহাজনেরা?’

বরাট চকিতে ব্যোমকেশের পানে চাহিলেন‌, তারপর নিম্নস্বরে বলিলেন‌, ‘সেটা ঠিক বুঝতে পারছি না‌, ব্যোমকেশবাবু। কিন্তু পরিস্থিতি সন্দেহজনক। আপনি মেয়েটাকে জেরা করে দেখুন না‌, বুড়োর সঙ্গে ওর কোনো রকম ইয়ে ছিল। কিনা।’

‘দেখব।’ সদর দরজার পাশে উপরে উঠিবার সিঁড়ি দিয়া আমরা উপরে উঠিলাম। সিঁড়ির মাথায় মজবুত ভারী দরজা‌, তাহাতে ইয়েল-লক লাগানো। বাড়ির অন্যান্য দরজার তুলনায় এ দরজা নূতন বলিয়া মনে হয়। হয়তো প্রাণহরি পোদ্দার বাডি ভাড়া লইবার পর এই ঘরে নূতন দরজা লাগাইয়াছিলেন।

বরাট পকেট হইতে চাবি বাহির করিয়া দ্বার খুলিলেন। আমরা অন্ধকার ঘরে প্রবেশ করিলাম। তারপর বিরাট একটা জানোলা খুলিয়া দিতেই রৌদ্রোজ্জ্বল আলো ঘরে প্রবেশ করিল।

ঘরে দু’টি জানালা দু’টি দ্বার। একটি দ্বার সিঁড়ির মুখে‌, অন্যটি পিছনের দেয়ালে। ঘরটি লম্বায় চওড়ায় আন্দাজ পনেরো ফুট চৌকশ।। ঘরে আসবাব বিশেষ কিছু নাই; একটা তক্তপোশের উপর বিছানা‌, তাহার শিয়রের দিকে দেয়াল ঘোষিয়া একটি জগদ্দল লোহার সিন্দুক। একটা দেয়াল-আলনা হইতে প্ৰাণহারির ব্যবহৃত জামা কাপড় ঝুলিতেছে। প্রাণহারির টাকার অভাব ছিল না‌, কিন্তু জীবন যাপনের পদ্ধতি ছিল নিতান্ত মামুলী। মাথার কাছে লোহার সিন্দুক লইয়া দরজায় ইয়েল-লক লাগাইয়া তিনি তক্তপোশের মলিন শয্যায় শয়ন করিতেন।

ব্যোমকেশ ঘরের চারিদিকে অনুসন্ধিৎসু চক্ষু বুলাইয়া জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘লাশ কোথায় ছিল?’

সিঁড়ির দরজা হইতে হাত চারেক দূরে মেঝের দিকে আঙুল দেখাইয়া বরাট বলিলেন‌, ‘এইখানে।’

ব্যোমকেশ নত হইয়া স্থানটা পরীক্ষা করিল‌, বলিল‌, ‘রিক্তের দাগ তো বিশেষ দেখছি না। সামান্য ছিটেফোঁটা।’

বরাট বলিলেন‌, ‘বুড়োর গায়ে কি রক্ত ছিল! চেহারাটা ছিল বেউড় বাঁশের মত।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘অবশ্য মাথার খুলি ভাঙলে বেশি রক্তপাত হয় না।–মারণাস্ত্রটা পাওয়া গেছে?’

না। ঘরে কোন অস্ত্র ছিল না। বাড়িতেও এমন কিছু পাওয়া যায়নি যাকে মারণাস্ত্র মনে করা ঘোড় পারে। বাড়ির চারপাশে বহু দূর পর্যন্ত খুঁজে দেখা হয়েছে‌, মরনাস্ত্রের সন্ধান পাওয়া যায়নি।’

‘যাক। সিন্দুক খুলে দেখেছিলেন নিশ্চয়। কি পেলেন?’

‘সিন্দুকের চাবি পোদ্দারের কোমরে ছিল। সিন্দুক খুলে পেলাম হিসেবের খেরো-বাঁধানো খাতা আর নগদ দশ হাজার টাকা।’

‘দশ হাজার টাকা।’

‘হ্যাঁ। বুড়োর মহাজনী কারবার ছিল তাই বোধহয় নগদ টাকা কাছে রাখতো।’

‘হুঁ। ব্যাঙ্কে টাকা ছিল?’

‘ছিল। এবং এখনো আছে। কে পাবে জানি না। টাকা কম নয়‌, প্ৰায় দেড় লাখ।’

‘তাই নাকি! আত্মীয়-স্বজনরা খবর পেয়েছে?’

‘বোধহয় কেউ নেই। থাকলে শকুনির পালের মত এসে জুটত।’

‘শহরে বুড়োর একটা অফিস ছিল শুনেছি। সেখানে তল্লাশ করে কিছু পেয়েছিলেন?’

‘অফিস মানে চোর-কুটুরির মত একটা ঘর।–দু’ চারটে খাতাপাত্তর ছিল‌, তা থেকে মনে হয় মহাজনী কারবার ভাল চলত না।’

ব্যোমকেশ চিন্তা করিতে করিতে কতকটা নিজমনেই বলিল‌, ‘মহাজনী কারবার ভাল চলত না‌, অথচ ব্যাঙ্কে দেড় লাখ এবং সিন্দুকে দশ হাজার-চিন্তা হইতে জাগিয়া উঠিয়া সে বলিল‌, ‘ওই অন্য দরজাটার বাইরে কি আছে?’

বরাট বলিলেন‌, ‘স্নানের ঘর ইত্যাদি।’

এ দরজাটাও নূতন মজবুত দরজা। প্রাণহরি পোদ্দার ঘরটিকে দুর্গের মত সুরক্ষিত করিয়াছিলেন‌, কারণ সিন্দুকে মাল আছে।

ব্যোমকেশ দরজা খুলিল। সঙ্কীর্ণ ঘরে পিছনের দেয়ালে একটি ঘুলঘুলি দিয়া আলো আসিতেছে‌, ঘুলঘুলির নীচে সরু একটি দরজা। ঘরে একটি শূন্য বালতি ও টিনের মগ ছাড়া আর কিছু নাই।

সরু দরজার উপরে-নীচে ছিটুকিনি লাগানো। ব্যোমকেশ ছিটুকিনি খুলিয়া কপাট ফাঁক করিল। উঁকি মারিয়া দেখিলাম‌, দ্বারের মুখ হইতে শীর্ণ লোহার। মই মাটি পর্যন্ত গিয়াছে। মেথরখাটা রাস্তা; প্রাণহারির দুর্গে প্রবেশ করিবার দ্বিতীয় পথ।

ব্যোমকেশ বরাটকে জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘আপনি সে-রাত্রে যখন প্রথম এসেছিলেন‌, এ দরজা দুটো বন্ধ ছিল?’

বরাট বলিলেন‌, ‘হ্যাঁ, দুটোই বন্ধ ছিল। কেবল সামনে সিঁড়ির দরজা খোলা ছিল।’ ব্যোমকেশ বলিল‌, চলুন‌, এবার নীচে যাওয়া যাক। মেয়েটাকে দুচারটে প্রশ্ন করে দেখি।’

 

ড্রয়িং-রুমের মত সাজানো নীচের তলার যে-ঘরটাতে তাস খেলা হইত। সেই ঘরে আমরা বসিয়াছি। মোহিনী একটা চেয়ারের পিঠে হাত রাখিয়া আমাদের সামনে দাঁড়াইয়া আছে‌, তাহার মুখে ভয় বা উদ্বেগের চিহ্ন নাই‌, ভাবভঙ্গী বেশ সংযত এবং সংবৃত।

মনে মনে প্রাণহারির নিরাভরণ শয়নকক্ষের সহিত সুসজ্জিত ড্রয়িং-রুমের তুলনা করিতেছি‌, ব্যোমকেশ মোহিনীকে প্রশ্ন করিল‌, ‘তুমি প্রাণহারিবাবুর কাছে কতদিন চাকরি করছ?’

মোহিনী বলিল‌, ‘দুবছরের বেশি।’

‘প্রাণহারিবাবু যখন কটকে ছিলেন তখন থেকে তুমি ওঁর কাছে আছ?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘প্রাণহারিবাবুর আত্মীয়-স্বজন কেউ আছে?’

‘জানি না। কখনো দেখিনি।’

‘তুমি কত মাইনে পাও?’

‘কটকে ছিল দশ টাকা মাইনে আর খাওয়া-পরা। এখানে আসার পর পাঁচ টাকা মাইনে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।’

‘প্রাণহরিবাবু কেমন লোক ছিলেন?’

একটু চুপ করিয়া থাকিয়া মোহিনী বলিল‌, ‘তিনি আমার মালিক ছিলেন‌, ভাল লোকই ছিলেন।’ অর্থাৎ‌, তিনি আমার মালিক ছিলেন তাঁহার নিন্দা করিব না‌, তোমরা বুঝিয়া লও।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তিনি কৃপণ ছিলেন?’

মোহিনী চুপ করিয়া রহিল। ব্যোমকেশ স্থিরনেত্রে তাহার পানে চাহিয়া বলিল‌, ‘তোমার সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধ কি রকম ছিল?

মোহিনী একটু বিস্ময়ভরে ব্যোমকেশের পানে চোখ তুলিল‌, তাহার ঠোঁটের কোণে যেন একটু চটুলতার ঝিলিক খেলিয়া গেল। তারপর সে শান্তস্বরে বলিল‌, ‘ভালই ছিল। তিনি আমাকে স্নেহ করতেন।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘হুঁ। তাঁর স্ত্রীলোক-ঘটিত কোনো দোষ ছিল?’

‘আজ্ঞে না। বুড়োমানুষ ছিলেন‌, ওসব দোষ ছিল না। কেবল তাস খেলার নেশা ছিল। একলা বসে বসে তাস খেলতেন।’

‘যাক। তুমি এখন নিজের কথা বল। প্রাণহারিবাবু খুন হয়েছেন‌, তা সত্ত্বেও তুমি একলা এ বাড়িতে পড়ে আছ কেন?

‘কোথায় যাব? এ শহরে তো আমার কেউ নেই।’

‘দেশে ফিরে যাচ্ছ না কেন?’

‘তাই যাব। কিন্তু দারোগাবাবু হুকুম দিয়েছেন যতদিন না খুনের কিনারা হয় ততদিন কোথাও যেতে পার না।’

‘দেশে তোমার কে আছে।’

‘বুড়ো মা-বাপ আছে।’

‘আর স্বামী?

মোহিনী চকিতে চোখ তুলিয়া আবার চোেখ নীচু করিয়া ফেলিল‌, প্রশ্নের উত্তর দিল না।

‘বিয়ে হয়েছে নিশ্চয়?’

মোহিনী নীরবে ঘাড় নাড়িল।

‘স্বামী কোথায়?’

মোহিনী ঘাড় তুলিয়াই ধীরে ধীরে উত্তর দিল‌, ‘স্বামী ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছে‌, আর ফিরে আসেনি।’

ব্যোমকেশ তাহার উপর দৃষ্টি নিবন্ধ রাখিয়া সিগারেট ধরাইল, ‘কতদিন হল স্বামী ঘরছাড়া হয়েছে?’

‘তিন বছর।’

‘স্বামী কী কাজ করত?

‘কল-কারখানায় কাজ করত।’

‘বিবাগী হয়ে গেল কেন?’

মোহিনীর অধরোষ্ঠ একটু প্রসারিত হইল‌, সে ব্যোমকেশের প্রতি একটি চকিত চপল কটাক্ষ হানিয়া বলিল‌, ‘জানি না।’

ইহাদের প্রশ্নোত্তর শুনিতে শুনিতে এবং মোহিনীকে দেখিতে দেখিতে ভাবিতেছি‌, মেয়েটার স্বভাব-চরিত্র কেমন? সচ্চরিত্রা‌, না স্বৈরিণী? সে যে-শ্রেণীর মেয়ে তাহদের মধ্যে একনিষ্ঠা ও পতিব্রত্যের স্থান খুব উচ্চ নয়। ঐহিক প্রয়োজনের তাড়নায় তাহাদের জীবন বিপথে-কুপথে সঞ্চরণ করে। অথচ মোহিনীকে দেখিয়া ঠিক সেই জাতীয় সাধারণ বি-চাকরানী শ্রেণীর মেয়ে বলিয়া মনে হয় না। কোথায় যেন একটু তফাৎ আছে। তাহার যৌবন-সুলভ চপলতা চটুলতার সঙ্গে চরিত্রের দৃঢ়তা ও সাহস আছে। এ মেয়ে যদি নষ্ট-দুষ্ট হয়‌, সজ্ঞানে জানিয়া বুঝিয়া নষ্ট-দুষ্ট হইবে‌, বাহ্য প্রয়োজনের তাগিদে নয়।

ব্যোমকেশ সিগারেটে দুটা লম্বা টান দিয়া বলিল‌, ‘যে চারজন বাবু এখানে তাস খেলতে আসতেন তাঁদের তুমি কয়েকবার দেখেছি–কেমন?

মোহিনীর চক্ষু দু’টি একবার দক্ষিণে-বামে সঞ্চরণ করিল‌, অধরোষ্ঠ ক্ষণকাল বিভক্ত হইয়া রহিল‌, যেন সে হাসিতে গিয়া থামিয়া গেল। তারপর বলিল‌, ‘হ্যাঁ‌, কয়েকবার দেখেছি।’ সে বুঝিয়াছে ব্যোমকেশের প্রশ্ন কোন দিকে যাইতেছে।

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘ওদের মধ্যে কে কেমন লোক তুমি বলতে পার?’

অব্যক্ত হাসি এবার পরিস্ফুট হইয়া উঠিল। মোহিনী একটু ঘাড় বাঁকাইয়া বলিল‌, ‘কে কেমন মানুষ তা কি মুখ দেখে বলা যায় বাবু? তবে একজন ছিলেন সবচেয়ে ছেলেমানুষ আর সবচেয়ে ভালোমানুষ। বাকি তিনজন’–সে থামিয়া গেল।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘হ্যাঁ‌, বাকি তিনজন কেমন লোক?’

হাসিমুখে জিভ কাটিয়া মোহিনী বলিল‌, ‘আমি জানি না বাবু।’

মোহিনীর একটা ক্ষমতা আছে‌, সে জানি না’ বলিয়া অনেক কথা জানাইয়া দিতে পারে।

ব্যোমকেশ সিগারেটের দগ্ধাংশ জানালার বাহিরে ফেলিয়া দিয়া বলিল‌, ‘এঁরা তাস খেলার সময় ছাড়াও অন্য সময়ে আসতেন কি?’

মোহিনী কড়িকাঠের দিকে চোখ তুলিয়া বলিল‌, ‘একজন আসতেন। কর্তাবাবু সকালবেলা আপিস চলে যাবার পর আসতেন।’

‘নাম জানি না বাবু। কালো মোটা মত চেহারা‌, খুব ছেঁদো কথা বলতে পারেন।’

বরাট অস্ফুটস্বরে বলিলেন‌, ‘অরবিন্দ হালদার।’

ব্যোমকেশ মোহিনীকে বলিল‌, ‘তাহলে তোমার সঙ্গেই তিনি দেখা করতে আসতেন?’

মোহিনী কেবল ঘাড় নাড়িল।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কোনো প্রস্তাব করেছিলেন?’

মোহিনীর দৃষ্টি হঠাৎ কঠিন হইয়া উঠিল‌, ‘সে তীক্ষ্ণ স্বরে বলিল‌, ‘সোনার আংটি দিতে এসেছিলেন‌, সিল্কের শাড়ি দিতে এসেছিলেন।’

‘তুমি নিয়েছিলে?’

না। আমার ইজৎ অত সস্তা নয়।’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ তাহাকে নিবিষ্টচক্ষে নিরীক্ষণ করিল‌, তারপর বলিল‌, ‘আচ্ছা‌, আজ এই পর্যন্ত। পরে যদি দরকার হয়। আবার সওয়াল করব। —তুমি উড়িষ্যার মেয়ে‌, কিন্তু পরিষ্কার বাংলা বলতে পারো দেখছি।’

সুন্টু সুব এবার নরম হইল। সে বলিল‌, ‘বাবু্‌, আমি ছেলেবেলা থেকে বাঙালীর বাড়িতে কাজ করেছি।’

ফিরিবার পথে ভাবিতে লাগিলাম‌, মোহিনী-বর্ণিত ছেলেমানুষ এবং ভালোমানুষ লোকটি অবশ্য ফণীশ। অন্য তিনজনের মধ্যে অরবিন্দ হালদার দু’কান-কাঁটা লম্পট। আর বাকি দু’জন? বোধ হয় অতটা বেহায়া নয়‌, কিন্তু মনে লোভ আছে; ডুবিয়া ডুবিয়া জল পান করেন। মোহিনী বলিয়াছিল‌, তাহার ইজ্জৎ অত সস্তা নয়। তাহার ইজ্জতের দাম কত? রূপযৌবনের অনুপাতেই কি ইজ্জতের দাম বাড়ে এবং কমে? কিংবা অন্য কোনও নিরিখ আছে? এ প্রশ্নের উত্তর একমাত্র বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিই দিতে পারেন।

থানার সামনে বিরাট নামিয়া গেলেন।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ওবেলা আবার আসব। সিভিল সার্জন-যিনি আটন্সি করেছেন—তাঁর সঙ্গে দেখা করতে হবে।’

বরাট বলিলেন‌, ‘আসবেন। আমি সিভিল সার্জনের সঙ্গে সময় ঠিক করে রাখব। পি এম রিপোর্ট অবশ্য তৈরি আছে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘পি এম রিপোর্টও দেখব।’

বরাট বলিলেন‌, ‘আচ্ছা। চারটে থেকে সাড়ে চারটের মধ্যে অ্যাপিয়েন্টমেন্ট করে রাখব।’

বাড়ি ফিরিলাম তখন বারোটা বাজিয়াছে। কিয়ৎকাল পরে মণীশবাবুরা ফিরিলেন। মণীশবাবু ভ্রূ তুলিয়া ব্যোমকেশের পানে চাহিলে সে বলিল‌, ‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন‌, যা করবার আমি করছি। পুলিসের সঙ্গে দেখা করেছি। একটা ব্যবস্থা হয়েছে‌, পরে আপনাকে সব জানাবো।’

মণীশবাবু সন্তুষ্ট হইয়া স্নান করিতে চলিয়া গেলেন। ফণীশ উৎসুকভাবে আমাদের আশেপাশে ঘুর ঘুর করিতে লাগিল। ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল‌, ‘তুমিও নিশ্চিন্ত থাকো‌, কাজ খানিকটা এগিয়েছে। বিকেলে আবার বেরুব।’

বেলা তিনটের সময় পিতাপুত্র আবার কাজে বাহির হইলেন। আমরা সুরপতি ঘটকের দপ্তরে গেলাম। সুরপতিবাবু আমাদের অফিস-ঘরে বসাইয়া কয়লাখনি চালানো সম্বন্ধে নানা তথ্য শুনাইতে লাগিলেন। তারপর দ্বারদেশে দুইটি যুবকের আবির্ভাব ঘটিল। খদ্দর-পরা শান্তশিষ্ট চেহারা‌, মুখে বুদ্ধিমত্তার সহিত বিনীত ভাব। সুরপতিবাবু বলিলেন‌, ‘এই যে তোমরা এসেছ! গগনবাবু্‌, এদেরই কথা আপনাকে বলেছিলাম। ওরা দুই ভাই‌, নাম বিশ্বনাথ আর জগন্নাথ। ওদের আমি নিজের হাতে কাজ শিখিয়েছি। বয়স কম বটে‌, কিন্তু কাজকর্মে একেবারে পোক্ত।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বেশ বেশ। এখানকার কাজ ছেড়ে অন্য জায়গায় যেতে আপনাদের আপত্তি নেই তো?’

বিশ্বনাথ ও জগন্নাথ মাথা নাড়িয়া জানাইল‌, আপত্তি নাই। সুরপতিবাবু বলিলেন‌, ‘ওদের দু’জনকে কিন্তু একসঙ্গে ছাড়তে পারব না‌, তাহলে আমার কাজের ক্ষতি হবে। ওদের মধ্যে একজনকে আপনারা নিন‌, যাকে আপনাদের পছন্দ।’

‘তাই সই বলিয়া ব্যোমকেশ পকেট হইতে নোটবুক বাহির করিয়া দু’জনের নাম-ধাম লিখিয়া লইল‌, বলিল‌, ‘যথাসময় আমি আপনাকে চিঠি দেব।’

বিশ্বনাথ ও জগন্নাথ নমস্কার করিয়া চলিয়া গেল। ব্যোমকেশ সুরপতিবাবুকে বলিল‌, দু’জনকেই আমার পছন্দ হয়েছে। আপনি যাকে দিতে চান তাকেই নেব।’

সুরপতিবাবু খুশি হইয়া বললেন‌, ‘ওরা দুই ভাই সমান কাজের লোক‌, আপনার যাকেই নিন ঠকবেন না।’

চারটে বাজিতে আর দেরি নাই দেখিয়া আমরা উঠিলাম।

বরাট অফিসে ছিলেন‌, বলিলেন‌, ‘সিভিল সার্জন সাড়ে চারটার সময় দেখা করবেন। এই নিন পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট।’

ব্যোমকেশ রিপোর্টে চোখ বুলাইয়া ফেরৎ দিল। তারপর আমরা হাসপাতালের দিকে রওনা হইলাম। সিভিল সার্জন মহাশয়ের অফিস হাসপাতালে।

সিভিল সার্জন বিরাজমোহন ঘোষাল অফিসে বসিয়া গড়গড়ায় তামাক টানিতেছিলেন। বয়স্থ ব্যক্তি‌, স্কুল গৌরবর্ণ সুদৰ্শন চেহারা‌, আমাদের দেখিয়া অট্টহাস্য করিয়া উঠিলেন। বলিলেন‌, ‘আপনার আসল নাম আমি জেনে ফেলেছি‌, ব্যোমকেশবাবু। ইন্সপেক্টর বরাট ধাপ্পা দেবার চেষ্টা করেছিলেন‌, কিন্তু ধাপ্পা টিকল না।’ বলিয়া আবার অট্টহাস্য করিলেন।

ব্যোমকেশ বিনীতভাবে বলিল‌, ‘বে-কায়দায় পড়ে পঞ্চ পাণ্ডবকে ছদ্মনাম গ্রহণ করতে হয়েছিল‌, আমি তো সামান্য লোক। একটা গোপনীয় কাজে এখানে এসেছি‌, তাই গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে হয়েছে।’

‘ভয় নেই‌, আমার পেট থেকে কথা বেরুবে না। বসুন।’

কিছুক্ষণ সাধারণভাবে আলাপ-আলোচনা হাস্য-পরিহাস চলিল। ডাক্তার ঘোষাল আনন্দময় পুরুষ, সারা জীবন মড়া ঘাঁটিয়াও তাঁহার স্বতঃস্ফূর্ত অট্টহাস্য প্রশমিত হয় নাই।

অবশেষে কাজের কথা আরম্ভ হইল। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘প্ৰাণহরি পোদ্দারের পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট আমি দেখেছি। আপনার মুখে অতিরিক্ত কিছু শুনতে চাই। লোকটি বুড়ো হয়েছিল‌, রোগা-পাটকা ছিল‌, তার দৈহিক শক্তি কি কিছুই অবশিষ্ট ছিল না?’

বিরাজবাবু বলিলেন, ‘দৈহিক শক্তি—’

‘মানে–যৌবন। পুরুষের যৌবন অনেক বয়স পর্যন্ত থাকতে পারে; একশো বছর বয়সে ছেলের বাপ হয়েছে এমন নজিরও পাওয়া যায়। প্রাণহরি পোদ্দারের দেহ-যন্ত্রটা সেদিক দিয়ে কি সক্ষম ছিল?’

বিরাজবাবু আবার অট্টহাস্য করিয়া বলিলেন‌, ‘ও-এই কথা জানতে চান? তা ডাক্তারের কাছে এত লজ্জা কিসের? না‌, প্রাণহরি পোদ্দারের শরীরে রস-কষ কিছু ছিল না‌, একেবারে শুষ্কং’কাষ্ঠং।’ দু’বার গড়গড়ায় টান দিয়া বলিলেন‌, ‘আমি লক্ষ্য করেছি। যারা রাতদিন টাকার ভাবনা ভাবে তাদের ওসব বেশি দিন থাকে না। প্রাণহরি পোদ্দার তো সুদখোর মহাজন ছিল।’

মনে হইল ব্যোমকেশ একটু নিরাশ হইয়াছে। ক্ষণেক ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া থাকিয়া সে বলিল‌, ‘আচ্ছা‌, ওকথা যাক। এখন মারণাস্ত্রের কথা বলুন। খুলির ওপর ওই একটা চোটু ছাড়া আর কোথাও আঘাতের দাগ ছিল না?’

‘না।’

‘এক আঘাতেই মৃত্যু ঘটেছিল?’

‘হ্যাঁ।’

‘অস্ত্রটা কী ধরনের ছিল?’

বিরাজবাবু কিছুক্ষণ গড়গড়া টানিলেন‌, ‘কী রকম অস্ত্র ছিল বলা শক্ত। অস্ত্রটা লম্বা গোছের‌, লম্বা এবং ভারী। কাটারির মত ধারালো নয়‌, আবার পুলিসের রুলের মত ভোঁতাও নয়—’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ইলেকট্রিক টর্চ হতে পারে কি?’

‘ইলেকট্রিক টর্চ!’ বিরাজবাবু মাথা নাড়িলেন‌, ‘না‌, তাতে এমন পরিষ্কার কাটা দাগ হবে না। এই ধরুন‌, কাটারির ফলার উল্টো পিঠ দিয়ে‌, অৰ্থাৎ শিরদাঁড়ার দিক দিয়ে যদি সজোরে মাথায় মারা যায় তাহলে ওইভাবে খুলির হাড় ভাঙতে পারে।’

‘রান্নাঘরের হাতা বেড়ি খুস্তি-?’

‘না‌, তার চেয়ে ভারী জিনিস।’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়া বসিয়া রহিল‌, তারপর বলিল‌, ‘অক্সটাই ভাবিয়ে তুলেছে। যাদের ওপর সন্দেহ তারা দা-কাটারি জাতীয় অস্ত্র নিয়ে খুন করতে গিয়েছিল ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। তবে একেবারে অসম্ভব নয়। আচ্ছা‌, আর একটা প্রশ্নের উত্তর দিন। আততায়ী সামনের দিক থেকে অস্ত্র চালিয়েছিল‌, না পিছন দিক থেকে?’

বিরাজবাবু তৎক্ষণাৎ বলিলেন‌, ‘সামনের দিক থেকে। কপাল থেকে মাথার মাঝখান পর্যন্ত হাড় ভেঙেছে‌, পিছন দিকের হাড় ভাঙেনি।’

‘পিছন দিক থেকে মারা একেবারেই সম্ভব নয়?’

বিরাজবাবু ভাবিয়া বলিলেন‌, ‘পোদ্দার যদি চেয়ারে বসে থাকত তাহলে ওভাবে মারা সম্ভব। হত‌, দাঁড়িয়ে থাকলে সম্ভব নয়। তবে যদি আততায়ী দশ ফুট লম্বা হয়—

ব্যোমকেশ হাসিতে হাসিতে উঠিয়া দাঁড়াইল‌, ‘দশ ফুট দ্রাঘিমার লোক এখানে থাকলে নজরে পড়ত। আচ্ছা‌, আজ চলি। নমস্কার।’

থানায় ফিরিয়া বরাট বলিলেন‌, ‘অতঃপর? বাকি তিনজন আসামীকে দর্শন করতে চান?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘চাই বৈকি। এখন তাদের বাড়িতে পাওয়া যাবে?’

বরাট বলিলেন‌, ‘না‌, এসময় তারা খেলাধুলো করতে ক্লাবে আসে।’

‘তাহলে এখন থাক। আপনার সঙ্গে ক্লাবে গেলে শিকার ভড়কে যাবে! ভাল কথা‌, পোদ্দারের হিসেবের খাতাটা দিতে পারেন? ওটা নেড়েচেড়ে দেখতে চাই‌, যদি কিছু পাওয়া যায়।’

‘অফিসেই আছে‌, নিয়ে যান। আর কিছু?’

‘আর-একটা কাজ করলে ভাল হয়। প্ৰাণহরি পোদ্দারের অতীত সম্বন্ধে কিছুই জানা দুই দেড়েক আগে বুড়ে কটকে ছিল। কটকের পুলিস দপ্তর থেকে কিছু খবর পাওয়া যায় না-কি?’

বরাট বলিলেন‌, ‘কটকের পুলিস দপ্তরে খোঁজ নিয়েছিলাম‌, প্রাণহরি পোদ্দারের পুলিস-রেকর্ড নেই। তবে তার সম্বন্ধে সাধারণভাবে যদি জানতে চান‌, আমার একজন চেনা অফিসার কয়েক বছর কটকে আছেন-ইন্সপেক্টর পট্টনায়ক। তাঁকে লিখতে পারি।’

‘তাই করুন। ইন্সপেক্টর পট্টনায়ককে টেলিগ্রাম করে দিন‌, যত শীগগির খবর পাওয়া যায়। আজ উঠলাম‌, কাল সকালেই আবার আসছি।’

Sharadindu Bandyopadhyay ।। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়