বাসায় ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘তোমার সন্দেহটা কার ওপর?’

ব্যোমকেশ পাঞ্জাবি খুলিতে খুলিতে বলিল‌, ‘তিনজনের ওপর।’

চমকিয়া বলিলাম‌, ‘তিনজন করা?’

‘ভোলা‌, মণিময় এবং মণিময়ের স্ত্রী–’ বলিয়া ব্যোমকেশ স্নান করিতে চলিয়া গেল।

বসিয়া ভাবিতে লাগিলাম। সুযোগের দিক দিয়া তিনজনকেই সন্দেহ করা যায়। রসময়ের দেরাজ হইতে নেকলেস সরানো তিনজনের পক্ষেই সম্ভব। আর মোটিভ? বড়মানুষের ছেলেদের সর্বদাই টাকার দরকার। মণিময় ক্লাবে গিয়া তাস-পাশা খেলে‌, নিশ্চয় বাজি রাখিয়া খেলে। হয়তো অনেক টাকা দেনা হইয়াছে‌, ভয়ে বাপের কাছে বলিতে পারিতেছে না।–’

আর মণিময়ের স্ত্রী? মেয়েটি দেখিতে শান্ত শিষ্ট‌, কিন্তু তাহার মুখের উদ্বেগের ব্যঞ্জনা প্রচ্ছন্ন রহিয়াছে। গহনার প্রতি স্ত্রীজাতির লোভ অবস্থা বিশেষে দুৰ্নিবার হইয়া উঠিতে পারে।

কিন্তু যে-ই চুরি করুক‌, চোরাই মাল বেমালুম সরাইয়া ফেলিল কী করিয়া? সেদিন দুপুরবেলা ব্যোমকেশ আরাম-কেদারায় লম্বা হইয়া সারাক্ষণ কড়িকাঠের শোভা নিরীক্ষণ করিল‌, কথাবার্তা বলিল না। আপারান্ত্রিক চা পানের পর হঠাৎ বলিল‌, ‘চল‌, একবার ঘুরে আসা যাক।’

‘কোথায় ঘুরবে?’

‘রসময়বাবুর বাড়ির সামনে ফুটপাথে! জায়গাটা ভাল করে দেখা হয়নি।’

পদব্রজে আমাদের বাসা হইতে রসময়বাবুর বাড়ির সামনে ফুটপাথে পৌঁছিতে কুড়ি মিনিট লাগিল। কাছাকাছি গিয়া ব্যোমকেশ এদিক ওদিক চাহিতে লাগিল। বাড়ির দরজার দুই পাশে দোকানগুলি খোলা রহিয়াছে। একটি হোমিওপ্যাথি ওষুধের দোকান‌, একটি ঘড়ির দোকান‌, দুইটি বস্ত্ৰালয়। সব দোকানেই খরিদ্দারের যাতায়াত। ফুটপাথে পথচারীর ভিড়।

রসময়ের বাড়ির তেতলায় গোটা চারেক জানালা; উহাদেরই একটা হইতে মণিময়ের বৌ পথের পানে চাহিয়া ছিল। চোখ নামাইয়া দেখিলাম‌, ব্যোমকেশ হঠাৎ থামিয়া গিয়াছে এবং একদৃষ্ট্রে রসময়ের সদর দরজার দিকে চাহিয়া আছে। তাহার দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া দেখিলাম‌, দরজা খুলিয়া মণিময় বাহির হইয়া আসিল। তাহার পরিধানে ধুতি‌, গেঞ্জি‌, হাতে একখানা খামের চিঠি। সে দরজার বাহিরে আসিয়াই পাশে দেয়ালে-গাঁথা পোস্ট-বক্সে চিঠি ফেলিয়া দিয়া আবার ফিরিয়া যাইবার উপক্রম করিল।

‘এই যে মণিময়বাবু! কাকে চিঠি লিখলেন?’

ব্যোমকেশের কণ্ঠস্বরে মণিময় চমকিয়া চাহিল। আমাদের দেখিয়া সবিনয়ে বলিল‌, ‘এ কী‌, আপনারা! কিছু খবর আছে নাকি?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আমার খবর পরে দেব। আপনি কাকে চিঠি লিখলেন?’

মণিময় একটু বিষগ্ন স্বরে বলিল‌, ‘মাকে খবরটা দিলাম। তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে লিখলাম‌, কিন্তু আজ আর চিঠিখানা যাবে না‌, ডাক বেরিয়ে গেছে। সেই কাল ভোরের ক্লিয়ারেন্সে যাবে।–কিন্তু আপনি নিশ্চয় কিছু ভাল খবর পেয়েছেন। সত্যি বলুন না।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বাড়ি থেকে যখন বেরিয়েছিলাম তখনও কিছু খবর পাইনি‌, কিন্তু এখন পেয়েছি।’

‘কী খবর? নেকলেসের সন্ধান পেয়েছেন?’

‘পেয়েছি। সব কথা পরে বলব‌, এখন আমাকে একটা জরুরী কাজে যেতে হবে।’

‘একবারটি ওপরে আসবেন না? বাবা আপনার কাছ থেকে খবর পাবার জন্যে অস্থির হয়ে রয়েছেন।’

ক্ষণেক চিন্তা করিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘না‌, জরুরী কাজটা আগে সারতে হবে। অজিত‌, তুমি বরঞ্চ ওপরে যাও। রসময়বাবুকে আমার পক্ষ থেকে বলে দিও‌, কাল সকালে তিনি নেকলেস ফিরে পাবেন।’ বলিয়া সে হনহন করিয়া চলিয়া গেল।

আমি মণিময়ের সঙ্গে উপরে গেলাম। রসময়বাবু বিলক্ষণ। হতাশ হইয়া পড়িয়াছিলেন‌, ব্যোমকেশের বাত শুনিয়া বার বার উদ্বেগভরে আমাকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন‌, ‘সত্যি পাব তো? ঠিক পাব তো?’

আমি বলিলাম, ‘ব্যোমকেশকে কখনও মিথ্যে আশ্বাস দিতে শুনিনি। সে যখন বলেছে পাবেন। তখন নিশ্চয় পাবেন।’ অতঃপর চা, কেক ও ৫৫৫ নম্বর সিগারেট সেবন করিয়া ক্যাডিল্যাকে চড়িয়া গৃহে ফরিলাম।

সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছিল, কিন্তু ব্যোমকেশ তখনও ফেরে নাই। আরও ঘণ্টাখানেক পরে ফিরিল। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘গিয়েছিলে কোথায়?’

সে বলিল, ‘থানায়। দারোগা অমরেশবাবুর সঙ্গে দরকার ছিল।’

‘কী দরকার?’

‘ভীষণ দরকার। তুমি তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়, কাল সকাল সকাল উঠতে হবে।’

আমার কৌতুহল চরিতার্থ করিবার ইচ্ছা তাহার নাই দেখিয়া আমি উঠিয়া পড়িলাম। আহারে বসিলে সত্যবতী আমার মুখ লক্ষ্য করিয়া বলিল, ‘মুখ গোমড়া কেন?’

বলিলাম, ‘তোমার পতিদেবতাটি একটি কচ্ছপ।’

সত্যবতী মুখ টিপিয়া হসিল, ‘এত জন্তু থাকতে কচ্ছপ কেন?’

‘কচ্ছপ কথা কয় না।’

ব্যাপার বুঝিয়া সত্যবতীর মুখ সহানুভূতিতে পূর্ণ হইয়া উঠিল, সে বলিল, ‘সত্যি বাপু। কী রাগ যে হয়। আচ্ছা, আমাদের না হয় বুদ্ধি একটু কম। তাই বলে কৌতুহল তো কম নয়।’

তাড়াতাড়ি খাওয়া সারিয়া শুইয়া পড়িলাম। ঘুম ভাঙিল রাত্রিশেষে, ব্যোমকেশ ঠেলা দিয়া ঘুম ভাঙাইয়া দিল, ‘অজিত, ওঠ ওঠ, এখনি বেরুতে হবে।’

চা প্ৰস্তুত ছিল, তাড়াতাড়ি গলাধঃকরণ করিয়া ব্যোমকেশের সহিত বাহির হইলাম। রাস্তার আলো তখনও নেভে নাই, ঘুমন্ত নগরকে সহস্ৰচক্ষু মেলিয়া পাহারা দিতেছে।

কোথায় চলিয়াছি তখনও জানি না; কিছুদূর অগ্রসর হইবার পর বুঝিলাম, রসময়বাবুর বাড়ির দিকে যাইতেছি। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘শেষরাত্রে রসময়বাবুর সঙ্গে কী দরকার?’

সে বলিল, ‘রসময়বাবুর সঙ্গে দরকার নেই।’

‘তবে? শেষরাত্রে বেরুবার দরকার ছিল কী?’

‘ছিল। জানই তো, ওস্তাদের মার শেষরাত্ৰে?’

‘সোজা কথা বলবে, না কেবল হেঁয়ালি করবে?’

ব্যোমকেশ মুচকি হাসিয়া বলিয়া, ‘রসময়বাবুর বাড়ির দেয়ালে যে ডাক-বাক্স আছে, তার প্রথম ক্লিয়ারেন্সের সময় হচ্ছে পাঁচটা। আজ যখন ডাক-বাক্স খোলা হবে তখন সেখানে উপস্থিত থাকতে চাই।’

মাথার মধ্যে দপদপ করিয়া কয়েকটা বাতি জ্বলিয়া উঠিল, কিন্তু অন্ধকার সম্পূর্ণ দূর হইল না। বলিলাম, তাহলে—?’

ব্যোমকেশ হাত তুলিয়া বলিল, ‘ধৈর্য মানো, সখা, ধৈর্য মানো।’

কয়েকটা গলিখুঁজির ভিতর দিয়া চলিবার পর রসময়বাবুর বাড়ির সম্মুখীন হইলাম। গলি যেখানে বড় রাস্তায় মিলিয়াছে সেখানে দুটা লোক প্রচ্ছন্নভাবে দাঁড়াইয়া আছে। ব্যোমকেশ তাহাদের সহিত ফিসফিস করিয়া কথা বলিল। তারপর আমরাও গলির মুখে প্রচ্ছন্ন হইয়া দাঁড়াইলাম।

হাতঘড়িতে দেখিলাম, পাঁচটা বাজিতে দশ মিনিট। এখনও রাস্তায় লোক চলাচল আরম্ভ হয় নাই, মাঝে মাঝে সক্তি-বোঝাই ট্রাক গুরুগম্ভীর শব্দে চলিয়া যাইতেছে। রসময়বাবুর বাড়ির অভ্যন্তর অন্ধকার, সম্মুখস্থ ল্যাম্পপোস্ট বন্ধ সদর-দরজার উপর আলো ফেলিয়াছে। দরজার পাশে দেয়ালে-গাঁথা ডাক-বোক্সর লাল রঙ অসংখ্য ইস্তাহারে চাপা পড়িয়া গিয়াছে। ওটা যে ডাক-বাক্স, তাহা সহজে নজরে পড়ে না।

একটি একটি করিয়া মিনিট কাটিতেছে। সঞ্চরমাণ মিনিটগুলির লঘু পদধ্বনি নিজের বক্ষ-স্পন্দনে শুনিতে পাইতেছি। …পাঁচটা বাজিল; শরীরের স্নায়ুপেশী শক্ত হইয়া উঠিল।

লোকটা কখন নিঃশব্দে ডাক-বাক্সের সামনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। যেন ভৌতিক আবির্ভাব। গায়ে খাকি পোশাক‌, কাঁধে দুটা বড় বড় ঝোলা! ঝোলা দুটা ফুটপাথে নামাইয়া সে পকেট হইতে চাবির গোছা বাহির করিল‌, তারপর ডাক-বাক্সের তালা খুলিতে প্রবৃত্ত হইল।

ব্যোমকেশ হাত নাড়িয়া ইশারা করিল‌, আমরা শিকারীর মত অগ্রসর হইলাম। গলির মুখ হইতে বাহির হইয়া দেখিলাম, রাস্তার দুই দিক হইতে আরও দুই জোড়া লোক আমাদেরই মত ডাক-বাক্সের দিকে অগ্রসর হইতেছে। নিঃসন্দেহে পুলিসের লোক‌, কিন্তু গায়ে ইউনিফর্ম নাই।

লোকটা ডাক-বাক্সের কবাট খুলিয়াছে‌, আমরা গিয়া তাহাকে ঘিরিয়া ধরিলাম। সে খোলা কবাট পিঠ দিয়া আড়াল করিয়া স্খলিত স্বরে বলিল‌, ‘কে‌, কী চাই?’

ব্যোমকেশ কড়া সুরে বলিল‌, ‘তোমার নাম ভূতনাথ দাস। তুমি ভোলার বড় ভাই!’

ভূতনাথ দাসের মুখখানা ভয়ে শীর্ণ-বিকৃত হইয়া গেল‌, চক্ষু দুটা ঠিকরাইয়া বাহির হইবার উপক্রম করিল। সে থারথার কম্পিত কণ্ঠে বলিল‌, ‘কে-কে আপনারা?’

অমরেশবাবু হুঙ্কার দিয়া বলিলেন‌, ‘আমরা পুলিস।’

অমরেশবাবু যে দলের মধ্যে আছেন তাহা প্রথম লক্ষ্য করিলাম। তিনি সামনে আসিয়া দৃঢ়ভাবে ভূতনাথের কাঁধে হাত রাখিলেন। অনুভব করিলাম‌, একটু নাটকীয় ভঙ্গীতে ভূতনাথকে ভয় পাওয়াইবার চেষ্টা হইতেছে। চেষ্টা ফলপ্রসূ হইল। ভূতনাথ একেবারে দিশহারা হইয়া গেল‌, হঠাৎ উগ্র তারস্বরে কাঁদিয়া উঠিল‌, ‘ওরে ভোলা‌, তুই আমার এ কী সর্বনাশ করলি রে! আমার চাকরি যাবে-আমি যে জেলে যাব রে।’

সে থামিতেই অমরেশবাবু তাহার কাঁধে একটা ঝাঁকানি দিয়া বলিলেন‌, ‘কোথায় রেখেছ চোরাই মাল‌, বের কর।’

ভূতনাথ অমরেশবাবুর পায়ের উপর উপুড় হইয়া পড়িল‌, ‘হুজুর‌, ও পাপ জিনিস। আমি ছুঁইনি। ডাক-বোক্সর মধ্যেই আছে।’

ক্ষণকাল স্তব্ধ হইয়া রহিলাম। পরশু মধ্যরাত্রি হইতে আজ সকাল পর্যন্ত নেকলেস রসময়বাবুর বাড়ির দেয়ালে-গাঁথা ডাক-বাক্সের মধ্যেই আছে।

অমরেশবাবু বলিলেন‌, ‘বের কর।’

ভূতনাথ উঠিয়া ডাক-বাক্সের দিকে ফিরিল। ডাক-বাক্সে অনেক চিঠি জমা হইয়াছিল‌, তাহার হাত ঢুকাইয়া বাক্সের পিছন দিকের কোণ হইতে একটি পার্সেল বাহির করিয়া আনিল। সাদা কাপড়ে সেলাই করা ব্ৰাউন ষোলপেজী বইয়ের মত আকার আয়তন। ভূতনাথ সেটি অমরেশবাবুর হাতে দিয়া কাতরস্বরে বলিল‌, ‘এই নিন বাবু। ধর্ম জানে এর ভেতর কী আছে‌, আমি চোখে দেখিনি।’

এই সময় রসময়ের সদর দরজা খুলিয়া গেল! লাঠিতে ভর দিয়া রসময় এবং তাঁহার পিছনে মণিময় ও বধূ। সকলের সদ্য-যুম-ভাঙা চোখে সবিস্ময় উদ্বেগ। রসময় বলিলেন‌, ‘অমরেশবাবু! ব্যোমকেশবাবু? কী হয়েছে? আমার নেকলেস–?’

ব্যোমকেশ অমরেশবাবুর হাত হইতে প্যাকেট লইয়া রসময়ের হাতে দিল, ‘এই নিন আপনার নেকলেস। খুলে দেখুন।’

Sharadindu Bandyopadhyay ।। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়