চোরাবালি

কুমার ত্ৰিদিবের বারম্বার সনির্বন্ধ নিমন্ত্রণ আর উপেক্ষা করিতে না পারিয়া একদিন পৌষের শীত-সুতীক্ষ্ণ প্ৰভাতে ব্যোমকেশ ও আমি তাঁহার জমিদারীতে গিয়া উপস্থিত হইয়াছিলাম। ইচ্ছা ছিল দিন সাত-আট সেখানে নির্ঝঞ্ঝাটে কাটাইয়া, ফাঁকা জায়গার বিশুদ্ধ হওয়ায় শরীর চাঙ্গা করিয়া লইয়া আবার কলিকাতায় ফিরিব।

আদর যত্নের অবধি ছিল না। প্রথম দিনটা ঘণ্টায় ঘণ্টায় অপব্যাপ্ত আহার করিয়া ও কুমার ত্ৰিদিবের সঙ্গে গল্প করিয়াই কাটিয়া গেল। গল্পের মধ্যে অবশ্য খুড়া মহাশয় স্যর দিগিন্দ্ৰই বেশি স্থান জুড়িয়া রহিলেন।

রাত্রে আহারাদির পর শয়নঘরের দরজা পর্যন্ত আমাদের পৌঁছাইয়া দিয়া কুমার ত্ৰিদিব বলিলেন, ‘কাল ভোরেই শিকারে বেরুনো যাবে। সব বন্দোবস্ত করে রেখেছি।’

ব্যোমকেশ সোৎসাহে জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘এদিকে শিকার পাওয়া যায় নাকি?’

ত্রিদিব বলিলেন‌, ‘যায়। তবে বাঘ-টাঘ নয়। আমার জমিদারীর সীমানায় একটা বড় জঙ্গল আছে‌, তাতে হরিণ‌, শুয়োর‌, খরগোশ পাওয়া যায়; ময়ূর‌, বনমুরগীও আছে। জঙ্গলটা চোরাবালির জমিদার হিমাংশু রায়ের সম্পত্তি। হিমাংশু আমার বন্ধু; আজ সকালে আমি তাকে চিঠি লিখে শিকার করবার অনুমতি আনিয়ে নিয়েছি। কোনো আপত্তি নেই তো?’

আমরা দুজনে একসঙ্গে বলিয়া উঠিলাম‌, ‘আপত্তি!’

ব্যোমকেশ যোগ করিয়া দিল‌, ‘তবে বাঘ নেই এই যা দুঃখের কথা।’

ত্রিদিব বলিলেন‌, ‘একেবারে যে নেই তা বলতে পারব না; প্রতি বছরই এই সময় দু’ একটা বাঘ ছিটকে এসে পড়ে—তবে বাঘের ভরসা করবেন না। আর বাঘ এলেও হিমাংশু আমাদের মারতে দেবে না‌, নিজেই ব্যাগ করবে।’ কুমার হাসিতে লাগিলেন—’জমিদারী দেখবার ফুরসৎ পায় না‌, তার এমনি শিকারের নেশা। দিন রাত হয় বন্দুকের ঘরে‌, নয় তো জঙ্গলে। যাকে বলে শিকার-পাগল। টিপও অসাধারণ–মাটিতে দাঁড়িয়ে বাঘ মারে।’

ব্যোমকেশ কৌতুহলী হইয়া জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘কি নাম বললেন জমিদারীর-চোরাবালি? অদ্ভুত নাম তো।’

‘হ্যাঁ‌, শুনছি। ওখানে নাকি কোথায় খানিকটা চোরাবালি আছে‌, কিন্তু কোথায় আছে‌, কেউ জানে না। সেই থেকে চোরাবালি নামের উৎপত্তি। * হাতের ঘড়ির দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন‌, শুরু কের নয়‌, শুয়ে পড়ুন। নইলে সকালে উঠতে কষ্ট হবে।’ বলিয়া একটা হই তুলিয়া প্ৰস্থান করিলেন।

একই ঘরে পাশাপাশি খাটে আমাদের শয়নের ব্যবস্থা হইয়াছিল। শরীর বেশ একটি আরামদায়ক ক্লান্তিতে ভরিয়া উঠিতেছিল; সানন্দে বিছানায় লেপের মধ্যে প্রবেশ করিলাম।

ঘুমাইয়া পড়িতেও বেশি দেরি হইল না। ঘুমাইয়া স্বপ্ন দেখিলাম-চোরাবালিতে ডুবিয়া যাইতেছি; ব্যোমকেশ দূরে দাঁড়াইয়া হাসিতেছে। ক্ৰমে ক্রমে গলা পর্যন্ত ডুবিয়া গেল; যতই বাহির হইবার জন্য হাঁকপাক করিতেছি‌, ততই নিম্নাভিমুখে নামিয়া যাইতেছি। শেষে নাক পর্যন্ত বালিতে তলাইয়া গেল। নিমেষের জন্য ভয়াবহ মৃত্যু-যন্ত্রণার স্বাদ পাইলাম। তারপর ঘুম ভাঙিয়া গেল।

দেখিলাম‌, লেপটা কখন অসাবধানে নাকের উপর পড়িয়াছে। অনেকক্ষণ ঘমাক্ত কলেবরে বিছানায় বসিয়া রহিলাম‌, তারপর ঠাণ্ডা হইয়া আবার শয়ন করিলাম। চিন্তার সংসৰ্গ ঘুমের মধ্যেও কিরাপ বিচিত্ৰভাবে সঞ্চারিত হয় তাহা দেখিয়া হাসি পাইল।

ভোর হইতে না হইতে শিকারে বাহির হইবার হুড়াহুড়ি পড়িয়া গেল। কোনোমতে হাফ-প্যান্ট ও গরম হোস চড়াইয়া লইয়া‌, কেক সহযোগে ফুটন্ত চা গলাধঃকরণ করিয়া মোটরে চড়িলাম। মোটরে তিনটা শট-গান‌, অজস্র কার্তুজ ও এক বেতের বাক্স-ভরা আহাৰ্য দ্রব্য আগে হইতেই রাখা হইয়াছিল। কুমার ত্রিদিব ও আমরা দুইজন পিছনের সীটে ঠাসাঠাসি হইয়া বসিতেই গাড়ি ছাড়িয়া দিল। কুয়াশায় ঢাকা অস্পষ্ট শীতল উষালোকের ভিতর দিয়া হু হু করিয়া ছুটিয়া চলিলাম।

কুমার ওভারকেটের কলারের ভিতর হইতে অস্ফুটম্বরে বলিলেন‌, ‘সুযোদয়ের আগে না। পৌঁছলে ময়ুর বনমোরগ পাওয়া শক্ত হবে। এই সময় তারা গাছের ডগায় বসে থাকে-চমৎকার ট্যাগেট।’

ক্ৰমে দিনের আলো ফুটিয়া উঠিতে লাগিল। পথের দু’ধারে সমতল ধানের ক্ষেত; কোথাও পাকা ধান শোয়াইয়া দেওয়া হইয়াছে‌, কোথাও সোনালী মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়া আছে। দূরে আকাশের পটমূলে পুরু কালির দাগের মত বনানী দেখা গেল; আমাদের রাস্তা তাহার একটা কোণ স্পর্শ করিয়া চলিয়া গিয়াছে। কুমার অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিলেন যে ঐ বনেই শিকার করিতে চলিয়াছি।

মিনিট কুড়ি পরে আমাদের মোটর জঙ্গলের কিনারায় আসিয়া থামিল। আমরা পকেটে কার্তুজ ভরিয়া লইয়া বন্দুক ঘাড়ে মহা উৎসাহে বনের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িলাম। কুমার ত্রিদিব একদিকে গেলেন। আমি আর ব্যোমকেশ এই সঙ্গে আর একদিকে চলিলাম। বন্দুক চালনায় আমার এই প্রথম হাতেখড়ি‌, তাই একলা যাইতে সাহস হইল না। ছাড়াছাড়ি হইবার পূর্বে স্থির হইল যে বেলা ন’টার সময় বনের পূর্ব সীমান্তে ফাঁকা জায়গায় তিনজনে আবার পুনর্মিলিত হইব। সেইখানেই প্রাতরাশের ব্যবস্থা থাকিবে।

প্ৰকাণ্ড বনের মধ্যে বড় বড় গাছ-শাল‌, মহুয়া‌, সেগুন‌, শিমূল‌, দেওদার-মাথার উপর যেন চাঁদোয়া টানিয়া দিয়াছে; তাহার মধ্যে অজস্র শিকার। নীচে হরিণ‌, খরগোশ-উপরে হরিয়াল‌, বনমোরগ‌, ময়ুর। প্রথম বন্দুক ধরিবার উত্তেজনাপূর্ণ আনন্দ-আওয়াজ করার সঙ্গে সঙ্গে বৃক্ষচুড়া হইতে মৃত পাখির পতন-শব্দ্‌্‌, ছররার আঘাতে উড্ডীয়মান কুকুটের আকাশে ডিগবাজী খাইয়া পঞ্চােত্ব প্রাপ্তি-একটা এপিক লিখিয়া ফেলিতে ইচ্ছা করিতেছে। কালিদাস সত্যই লিখিয়াছেন‌, বিধান্তি লক্ষ্যে চলে—সঞ্চরমান লক্ষ্যকে বিদ্ধ করা—এরূপ বিনোদ আর কোথায়? কিন্তু যাক-পাখি শিকারের বহুল বর্ণনা করিয়া প্রবীণ বাঘ-শিকারীদের কাছে আর হাস্যাস্পদ হইব না।

আমাদের থলি ক্ৰমে ভরিয়া উঠিতে লাগিল। বেলাও অলক্ষিতে বাড়িয়া চলিয়াছিল। আমি একবার এক কার্তুজে-দশ নম্বর-সাতটা হরিয়াল মারিয়া আত্মশ্লাঘার সপ্তমস্বর্গে চড়িয়া গিয়াছিলাম—দৃঢ় বিশ্বাস জন্মিয়ছিল আমার মত অব্যৰ্থ সন্ধান সেকালে অৰ্জ্জুনেরও ছিল না। ব্যোমকেশ দুইবার মাত্র বন্দুক চালাইয়া—একবার একটা খরগোশ ও দ্বিতীয়বার একটা ময়ুর মারিয়াই–থামিয়া গিয়াছিল। তাহার চক্ষু বৃহত্তর শিকারের অনুসন্ধান করিয়া ফিরিতেছিল। বনে হরিণ আছে; তা ছাড়া বাঘ না হোক‌, ভালুকের আশা সে সম্পূর্ণ ত্যাগ করিতে পারে নাই। তাই কুঞ্জ মহুয়া গাছে তখনও ফল পাকে নাই শুধু তাহার ভালুক সুৰক্ষা সেই দিকেই সতর্ক ইয়া কিন্তু বেলা যতই বাড়িতে লাগিল‌, জঙ্গলের বাতাসের গুণে পেটের মধ্যে অগ্নিদেব ততই প্রখর হইয়া উঠিতে লাগিলেন। আমরা তখন জঙ্গলের পূর্বসীমা লক্ষ্য করিয়া চলিতে আরম্ভ করিলাম।

কুমার ত্ৰিদিবের বন্দুকের আওয়াজ দূর হইতে বরাবরই শুনিতে পাইতেছিলাম‌, এখন দেখিলাম তিনিও পূর্বদিকে মোড় লইয়াছেন।

বনভূমির ঘন সন্নিবিষ্ট গাছ ক্রমে পাতলা হইয়া আসিতে লাগিল। অবশেষে আমরা রৌদ্রোজ্জ্বল খোলা জায়গায় নীল আকাশের তলায় আসিয়া দাঁড়াইলাম। সম্মুখেই বালুকার একটা বিস্তীর্ণ বলয়-প্ৰায় সিকি মাইল চওড়া; দৈর্ঘ্যে কতখানি তাহা আন্দাজ করা গেল না-বনের কোল ঘোষিয়া অর্ধচন্দ্রাকারে পড়িয়া আছে। বালুর উপর সূর্যকিরণ পড়িয়া চক চকু করিতেছে; শীতের প্রভাতে দেখিতে খুব চমৎকার লাগিল।

এই বালু-বলয় জঙ্গলকে পূর্বদিকে আর অগ্রসর হইতে দেয় নাই। কোনো সুদূর অতীতে হয়তো ইহা একটি স্রোতস্বিনী ছিল‌, তারপর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে-হয়তো ভূমিকম্পে-খাত উচু হইয়া জল শুকাইয়া গিয়া শুষ্ক বালুপ্ৰান্তরে পরিণত হইয়াছে।

আমরা বালুর কিনারায় বসিয়া সিগারেট ধরাইলাম।

অল্পকাল পরেই কুমার ত্রিদিব আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বলিলেন‌, ‘দিব্যি ক্ষিদে পেয়েছে।–না? ঐ যে দুযোধন পৌঁছে গেছে—চলুন।’

এতক্ষণ লক্ষ্য করি নাই‌, কুমার ত্ৰিদিবের ওড়িয়া বাবুর্চি মোটর হইতে বাস্কেট নামাইয়া ইতিমধ্যে হাজির হইয়াছিল। অনতিদূরে একটা গাছের তলায় ঘাসের উপর সাদা তোয়ালে বিছাইয়া খাদ্যদ্রব্য সাজাইয়া রাখিতে ছিল। তাহাকে দেখিয়া কুলায় প্রত্যাশী সন্ধ্যার পাখির মত আমরা সেই দিকে ধাবিত হইলাম।

আহার করিতে করিতে‌, কে কি পাইয়াছে তাহার হিসাব হইল। দেখা গেল‌, আমার এক কার্তুজে সাতটা হরিয়াল সত্ত্বেও‌, কুমার বাহাদুরই জিতিয়া আছেন।

আকণ্ঠ আহার ও অনুপান হিসাবে থার্মোফ্লাস্ক হইতে গরম চা নিঃশেষ করিয়া আবার সিগারেট ধরানো গেল। কুমার ত্রিদিব গাছের গুড়িতে ঠেসান দিয়া বসিলেন‌, সিগারেটে সুদীর্ঘ টান দিয়া অর্ধনিমীলিত চক্ষে কহিলেন‌, ‘এই যে বালুবন্ধ দেখছেন এ থেকেই জমিদারীর নাম হয়েছে চোরাবালি। এদিকটা সব হিমাংশুর।’ বলিয়া পূর্বদিক নির্দেশ করিয়া হাত নাড়িলেন।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আমিও তাই আন্দাজ করেছিলুম। এই বালির ফালিটা লম্বায় কতখানি? সমস্ত বনটাকেই ঘিরে আছে নাকি?’

কুমার বলিলেন‌, ‘না। মাইল তিনেক লম্বা হবে-তারপর আমার মাঠ আরম্ভ হয়েছে। এরই মধ্যে কোথায় এক জায়গায় খানিকটা চোরাবালি আছে—ঠিক কোনখানটায় আছে। কেউ জানে না‌, কিন্তু ভয়ে কোনো মানুষ বালির উপর দিয়ে হাঁটে না; এমন কি গরু বাছুর শেয়াল কুকুর পর্যন্ত একে এড়িয়ে চলে৷’

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘বালিতে কোথাও জল নেই বোধহয়?’

কুমার অনিশ্চিতভাবে মাথা নাড়িলেন‌, ‘বলতে পারি না। শুনেছি ঐদিকে খানিকটা জায়গায় জল আছে, তাও সব সময় পাওয়া যায় না।’ বলিয়া দক্ষিণ দিকে যেখানে বালুর রেখা বাঁকিয়া বনের আড়ালে অদৃশ্য হইয়াছে সেই দিকে আঙুল দেখাইলেন।

এই সময় হঠাৎ অতি নিকটে বনের মধ্যে বন্দুকের আওয়াজ শুনিয়া আমরা চমকিয়া উঠিয়া বসিলাম। আমরা তিনজনেই এখানে রহিয়াছি‌, তবে কে আওয়াজ করিল–বিস্মিতভাবে পরস্পরের মুখের দিকে চাহিয়া এই কথা ভাবিতেছি‌, এমন সময় একজন বন্দুকধারী লোক একটা মৃত খরগোশ কান ধরিয়া ঝুলাইতে ঝুলাইতে জঙ্গল হইতে বাহির হইয়া আসিল। তাহার পরিধানে যোধপুরী ব্রীচেস‌, মাথায় বয়-স্কাউটের মত খাকি টুপি‌, চামড়ার কোমরবন্ধে সারি সারি কার্তুজ আটা রহিয়াছে।

কুমার ত্রিদিব উচ্চহাস্য করিয়া বলিলেন‌, ‘আরো হিমাংশু‌, এস এস।’

খরগোশ মাটিতে ফেলিয়া হিমাংশুবাবু আমাদের মধ্যে আসিয়া বসিলেন; বলিলেন‌, ‘অভ্যর্থনা আমারই করা উচিত এবং করছিও। বিশেষত এদের।’ কুমার আমাদের পরিচয় করাইয়া দিলেন, তারপর হাসিয়া হিমাংশুবাবুকে বলিলেন‌, ‘তুমি বুঝি আর লোভ সামলাতে পারলে না? কিম্বা ভয় হল‌, পাছে তোমার সব বাঘ আমরা ব্যাগ করে ফেলি?’

হিমাংশুবাবু বলিলেন‌, ‘আরে বল কেন? মহা ফ্যাসাদে পড়া গেছে। আজই আমার ত্রিপুরায় যাবার কথা ছিল‌, সেখান থেকে শিকারের নেমস্তন্ন পেয়েছি। কিন্তু যাওয়া হল না‌, দেওয়ানজী আটকে দিলেন। বাবার আমলের লোক‌, একটু ছুতো পেলেই জুলুম জবরদস্তি করেন‌, কিছু বলতেও পারি না। তাই রাগ করে আজ সকালবেলা বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে পড়লুম। দুর্ত্তোর! কিছু না হোক দুটো বনপায়রাও তো মারা যাবে।’

কুমার বলিলেন‌, ‘হায় হায়–কোথায় বাঘ ভাল্লুক আর কোথায় বনপায়রা! দুঃখ হবার কথা বটে–কিন্তু যাওয়া হল না কেন?’

হিমাংশুবাবু ইতিমধ্যে খাবার বাক্সটা নিজের দিকে টানিয়া লইয়া তাহার ভিতর অনুসন্ধান করিতেছিলেন‌, প্ৰফুল্লমুখে কয়েকটা ডিম-সিদ্ধ ও কাটলেট বাহির করিয়া চর্বণ করিতে আরম্ভ করিলেন। আমি এই অবসরে তাঁহার চেহারাখানা ভাল করিয়া দেখিয়া লইলাম। বয়স আমাদেরই সমান হইবে; বেশ মজবুত পেশীপুষ্ট দেহ। মুখে একজোড়া উগ্র জামান গোঁফ মুখখানাকে অনাবশ্যক রকম হিংস্ৰ করিয়া তুলিয়াছে। চোখের দৃষ্টিতে পুরাতন বাঘ-শিকারীর নিষ্ঠুর সতর্কতা সর্বদাই উঁকি ঝুকি মারিতেছে। এক নজর দেখিলে মনে হয় লোকটা ভীষণ দুদন্তি। কিন্তু তবু বর্তমানে তাঁহাকে পরম পরিতৃপ্তির সহিত অৰ্ধমুদিত নেত্ৰে কাটলেট চিবাইতে দেখিয়া আমার মনে হইল‌, চেহারাটাই তাঁহার সত্যকার পরিচয় নহে; বস্তৃত লোকটি অত্যন্ত সাদাসিধা অনাড়ম্বর-মনের মধ্যে কোনো মারপ্যাঁচ নাই। সাংসারিক বিষয়ে হয়তো একটু অন্যমনস্ক; নিদ্রায় জাগরণে নিরস্তুর বাঘ ভালুকের কথা চিন্তা করিয়া বোধ করি বুদ্ধিটাও সাংসারিক ব্যাপারের অনুপযোগী হইয়া পড়িয়াছে।

কাটলেট ও ডিম্ব সমাপন্যান্তে চায়ের ফ্লাস্কে চুমুক দিয়া হিমাংশুবাবু বলিলেন‌, ‘কি বললে? যাওয়া হল না কেন? নেহাত বাজে কারণ; কিন্তু দেওয়ানজী ভয়ানক ভাবিত হয়ে পড়েছেন‌, পুলিসকেও খবর দেওয়া হয়েছে। কাজেই অনির্দিষ্ট কালের জন্য আমাকে এখানে ঘাঁটি আগলে বসে থাকতে হবে।’ তাঁহার কণ্ঠস্বরে বিরক্তি ও অসহিষ্ণুতা স্পষ্ট হইয়া উঠিল।

‘হয়েছে কি?’

‘হয়েছে আমার মাথা। জন তো‌, বাবা মারা যাবার পর থেকে গত পাঁচ বছর ধরে প্রজাদের সঙ্গে অনবরত মামলা মোকদ্দমা চলছে। আদায় তসিলও ভাল হচ্ছে না। এই নিয়ে অষ্টপ্রহর অশান্তি লেগে আছে্‌,–উকিল মোক্তার পরামর্শ‌, সে সব তো তুমি জানোই। যা হোক‌, আমমোক্তারনামা দিয়ে এক রকম নিশ্চিন্দি হওয়া গিছিল‌, এমন সময় আবার এক নূতন ফ্যাচাং—। মাস-কয়েক আগে বেবির জন্য একটা মাস্টার রেখেছিলুম‌, সে হঠাৎ পরশু দিন থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে; যাবার সময় নাকি খানকয়েক পুরনো হিসেবের খাতা নিয়ে গেছে। তাই নিয়ে একেবারে তুলাকালাম কাণ্ড। থানা পুলিস হৈ হৈ রৈ রৈ বেধে গেছে। দেওয়ানজীর বিশ্বাস‌, এটা আমার মামলাবাজ প্রজাদের একটা মারাত্মক প্যাঁচ।’

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘লোকটা এখনো ধরা পড়েনি?’

বিমৰ্ষভাবে ঘাড় নাড়িয়া হিমাংশুবাবু বলিলেন‌, ‘না। এবং যতক্ষণ না ধরা পড়ছে–হঠাৎ থামিয়া গিয়া কিছুক্ষণ বিস্ফারিত নেত্ৰে ব্যোমকেশের দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিয়া উঠিলেন‌, ‘আরে! এটা এতক্ষণ আমার মাথাতেই ঢোকেনি। আপনি তো একজন বিখ্যাত ডিটেকটিভ্‌্‌, চোর-ডাকাতের সাক্ষাৎ যম! (ব্যোমকেশ মৃদুস্বরে বলিল‌, সত্যান্বেষী) তাহলে মশায়‌, দয়া করে যদি দু’একদিনের মধ্যে লোকটাকে খুঁজে বার করে দিতে পারেন—তাহলে আমার ত্রিপুরার শিকারটা ফস্কায় না। কাল-পরশুর মধ্যে গিয়ে পড়তে পারলে—’

আমরা সকলে হাসিয়া উঠিলাম। কুমার ত্রিদিব বলিলেন‌, ‘চোরের মন পুঁই আদাড়ে। তুমি বুঝি কেবল শিকারের কথাই ভাবছ?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আমাকে কিছু করতে হবে না‌, পুলিসই খুঁজে বার করবে অখন। এসব জায়গা থেকে একেবারে লোপাট হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়; কলকাতা হলেও বা কথা ছিল।’

হিমাংশুবাবু মাথা নাড়িয়া বলিলেন‌, ‘পুলিসের কর্ম নয়। এই তিন দিনে সমস্ত দেশটা তারা তোলপাড় করে ফেলেছে‌, কাছাকাছি যত রেলওয়ে স্টেশন আছে সব জায়গায় পাহারা বসিয়েছে। কিন্তু এখনো তো কিছু করতে পারলে না। দোহাই ব্যোমকেশবাবু্‌, আপনি কেসটা হাতে নিন; সামান্য ব্যাপার‌, আপনার দুঘণ্টাও সময় লাগবে না।’

ব্যোমকেশ তাঁহার আগ্রহের আতিশয্য দেখিয়া মৃদুহাস্যে বলিল‌, ‘আচ্ছা‌, ঘটনাটা আগাগোড়া বলুন তো শুনি।’

হিমাংশুবাবু সাক্ষাতে হাত উল্টাইয়া বলিলেন‌, ‘আমি কি সব জানি ছাই! তার সঙ্গে বোধহয় সাকুল্যে পাঁচ দিনও দেখা হয়নি। যা হোক‌, যতটুকু জানি বলছি শুনুন। কিছুদিন আগে-বোধহয় মাস দুই হবে-একদিন সকালবেলা একটা ন্যালাখ্যাপী গোছের ছোকরা আমার কাছে এসে হাজির হল। তাকে আগে কখনো দেখিনি‌, এ অঞ্চলের লোক বলে বোধ হল না। তার গায়ে একটা ছেড়া কামিজ‌, পায়ে ছেড়া চটিজুতা-রোগা বেঁটে দুৰ্ভিক্ষ-পীড়িত চেহারা; কিন্তু কথাবাত শুনে মনে হয় শিক্ষিত। বললে‌, চাকরির অভাবে খেতে পাচ্ছে না‌, যা হোক একটা চাকরি দিতে হবে। জিজ্ঞাসা করলুম‌, কি কাজ করতে পার? পকেট থেকে বি-এসসি’র ডিগ্রি বার করে দেখিয়ে বললে‌, যে কাজ দেবেন। তাই করব। ছোকরার অবস্থা দেখে আমার একটু দয়া হল‌, কিন্তু কি কাজ দেব? সেরেস্তায় তো একটা জায়গাও খালি নেই। ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল‌, আমার মেয়ে বেবির জন্যে একজন মাস্টার রাখবার কথা গিন্নি কয়েকদিন আগে বলেছিলেন‌, বেবি এই সাতে পড়েছে‌, সুতরাং তাঁর পড়াশুনোর দিকে এবার একটু বিশেষভাবে দৃষ্টি দেওয়া দরকার।

‘তাকে মাস্টার বাহাল করলুম‌, কারণ‌, অবস্থা যাই হোক‌, ছোকরা শিক্ষিত ভদ্রসন্তান। বাড়িতেই বাইরের একটা ঘরে তার থাকবার ব্যবস্থা করে দিলুম। ছোকরা কৃতজ্ঞতায় একেবারে কেঁদে ফেললে। তখন কে ভেবেছিল যে–; নাম? নাম যতদূর মনে পড়ছে‌, হরিনাথ চৌধুরী–কায়স্থ।

‘যা হোক‌, সে বাড়িতেই রইল। কিন্তু আমার সঙ্গে বড় একটা দেখা-সাক্ষাৎ হত না। বেবিকে দুবেলা পড়াচ্ছে‌, এই পর্যন্তই জানতুম। হঠাৎ সেদিন শুনলুম‌, ছোকরা কাউকে না বলে কবে উধাও হয়েছে। উধাও হয়েছে‌, হয়েছে-আমার কোনো আপত্তি ছিল না‌, কিন্তু মাঝ থেকে কতকগুলো বাজে পুরনো হিসেবের খাতা নিয়ে গিয়েই আমার সর্বনাশ করে গেল। এখন তাকে খুঁজে বার না করা পর্যন্ত আমার নিস্তার নেই।’

হিমাংশুবাবু নীরব হইলেন। ব্যোমকেশ ঘাসের উপর লম্বা হইয়া শুইয়া শুনিতেছিল‌, কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘ছোকরা খেত কোথায়?’

হিমাংশুবাবু বলিলেন‌, ‘আমার বাড়িতেই খেত। আদর যত্নের ক্রুটি ছিল না‌, বেবির মাস্টার বলে গিন্নি তাকে নিজে—‘

এই সময় পিছনে একটা গাছের মাথায় ফট্‌ ফট্‌ শব্দ শুনিয়া আমরা মাথা তুলিয়া দেখিলাম‌, একটা প্ৰকাণ্ড বন-মোরগ নানা বর্ণের পুচ্ছ ঝুলাইয়া এক গাছ হইতে অন্য গাছে উড়িয়া যাইতেছে। গাছ দুটার মধ্যে ব্যবধান ত্ৰিশ হাতের বেশি হইবে না। কিন্তু নিমিষের মধ্যে বন্দুকের ব্রীচ্‌ খুলিয়া টোটা ভরিয়া হিমাংশুবাবু ফায়ার করিলেন। পাখিটা অন্য গাছ পর্যন্ত পৌঁছতে পারিল না‌, মধ্য পথেই ধপ্‌ করিয়া মাটিতে পড়িল।

আমি সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিলাম‌, ‘কি অদ্ভুত টিপ।’

ব্যোমকেশ সপ্ৰশংস নেত্ৰে চাহিয়া বলিল‌, ‘সত্যিই অসাধারণ।’

কুমার ত্রিদিব বলিলেন‌, ‘ও আর কি দেখলেন? ওর চেয়েও ঢের বেশি আশ্চর্য বিদ্যে ওর পেটে আছে!–হিমাংশু‌, তোমার সেই শব্দভেদী প্যাঁচটা একবার দেখাও না।’

‘আরে না না‌, এখন ওসব থাক। চল—আর একবার জঙ্গলে ঢোকা যাক—’

‘সে হচ্ছে না–ওটা দেখাতেই হবে। নাও–চোখে রুমাল বাঁধো।’

হিমাংশুবাবু হাসিয়া বলিলেন‌, ‘কি ছেলেমানুষী দেখুন দেখি। ও একটা বাজে ট্রীক‌, আপনারা কতবার দেখেছেন—‘

আমরাও কৌতুহলী হইয়া উঠিয়াছিলাম‌, বলিলাম‌, ‘তা হোক‌, আপনাকে দেখাতে হবে।’

তখন হিমাংশুবাবু বলিলেন‌, ‘আচ্ছা–দেখাচ্ছি। কিছুই নয়‌, চোখ বেঁধে কেবল শব্দ শুনে লক্ষ্যবোধ করা।’ বন্দুকে একটা বুলেট ভরিয়া বলিলেন‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, আপনিই রুমাল দিয়ে চোখ বেঁধে দিন–কিন্তু দেখবেন কান দুটো যেন খোলা থাকে।’

ব্যোমকেশ রুমাল দিয়া বেশ শক্ত করিয়া তাঁহার চোখ বাঁধিয়া দিল। তখন কুমার ত্রিদিব একটা চায়ের পেয়ালা লইয়া তাহার হাতলে খানিকটা সূতা বাঁধলেন। তারপর পা টিপিয়া টিপিয়া গিয়া–যাহাতে হিমাংশুবাবু বুঝিতে না পারেন তিনি কোনদিকে গিয়াছেন–প্ৰায় পাঁচশ হাত দূরে একটা গাছের ডালে পেয়ালাটা ঝুলাইয়া দিলেন।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘হিমাংশুবাবু্‌, এবার শুনুন।’

কুমার ত্রিদিব চামচ দিয়া পেয়ালাটায় আঘাত করিলেন‌, ঠুং করিয়া শব্দ হইল। হিমাংশুবাবু বন্দুক কোলে লইয়া যেদিক হইতে শব্দ আসিল সেই দিকে ঘুরিয়া বসিলেন। বন্দুকটা একবার তুলিলেন‌, তারপর বলিলেন‌, ‘আর একবার বাজাও।’

কুমার ত্রিদিব আর একবার শব্দ করিয়া ক্ষিপ্ৰপদে সরিয়া আসিলেন।

শব্দের রেশ সম্পূর্ণ মিলাইয়া যাইবার পূর্বেই বন্দুকের আওয়াজ হইল; দেখিলাম পেয়ালাটা চুৰ্ণ হইয়া উড়িয়া গিয়াছে‌, কেবল তাহার ডাঁটিটা ডাল হইতে ঝুলিতেছে।

মুগ্ধ হইয়া গেলাম। পেশাদার বাজীকরের সাজানো নাট্যমঞ্চে এরকম খেলা দেখা যায় বটে কিন্তু তাহার মধ্যে অনেক রকম জুয়াচুরি আছে। এ একেবারে নির্জলা খাঁটি জিনিস।

হিমাংশুবাবু চোখের রুমাল খুলিয়া ফেলিয়া বলিলেন‌, ‘হয়েছে?’

আমাদের মুক্তকণ্ঠ প্ৰশংসা শুনিয়া তিনি একটু লজ্জিত হইয়া পড়িলেন। ঘড়ির দিকে তাকাইয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন‌, বলিলেন‌, ‘ও কথা থাক‌, আপনাদের সুখ্যাতি আর বেশিক্ষণ শুনলে আমার গণ্ডদেশ ক্রমে বিলিতি বেগুনের মত লাল হয়ে উঠবে। এখন উঠন। চলুন‌, ইতর প্ৰাণীদের বিরুদ্ধে আর একবার অভিযানে বেরুনো যাক।’

Sharadindu Bandyopadhyay ।। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়