অন্নদাবাবু একান্তমনে আশা করিতেছিলেন–যোগেন্দ্র ভালো খবর লইয়া আসিবে, সমস্ত গোলমাল অতি সহজে পরিষ্কার হইয়া যাইবে। যোগেন্দ্র ও অক্ষয় যখন ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিল, অন্নদাবাবু ভীতভাবে তাহাদের মুখের দিকে চাহিলেন।
যোগেন্দ্র কহিল, “বাবা, তুমি যে রমেশকে এতদূর পর্যন্ত বাড়াবাড়ি করিতে দিবে, তাহা কে জানিত। এমন জানিলে আমি তোমাদের সঙ্গে তাহার আলাপ করাইয়া দিতাম না।”
অন্নদাবাবু। রমেশের সঙ্গে হেমনলিনীর বিবাহ তোমার অভিপ্রেত, এ কথা তুমি তো আমাকে অনেকবার বলিয়াছ। বাধা দিবার ইচ্ছা যদি তোমার ছিল, তবে আমাকে-
যোগেন্দ্র। অবশ্য একেবারে বাধা দিবার কথা আমার মনে আসে নাই, কিন্তু তাই বলিয়া-
অন্নদাবাবু। ঐ দেখো, ওর মধ্যে ‘তাই বলিয়া’ কোথায় থাকিতে পারে? হয় অগ্রসর হইতে দিবে, নয় বাধা দিবে, এর মাঝখানে আর কী আছে?
যোগেন্দ্র। তাই বলিয়া একেবারে এতটা-দূর অগ্রসর-
অক্ষয় হাসিয়া কহিল, “কতকগুলি জিনিস আছে, যা আপনার ঝোঁকেই অগ্রসর হইয়া পড়ে, তাহাকে আর প্রশ্রয় দিতে হয় না–বাড়িতে বাড়িতে আপনিই বাড়াবাড়িতে গিয়া পৌঁছায়। কিন্তু যা হইয়া গেছে তা লইয়া তর্ক করিয়া লাভ কী? এখন, যা করা কর্তব্য তাই আলোচনা করো।”
অন্নদাবাবু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করিলেন, “রমেশের সঙ্গে তোমাদের দেখা হইয়াছে?”
যোগেন্দ্র। খুব দেখা হইয়াছে–এত দেখা আশা করি নাই। এমন-কি, তার স্ত্রীর সঙ্গেও পরিচয় হইয়া গেল।
অন্নদাবাবু নির্বাক্‌ বিস্ময়ে চাহিয়া রহিলেন। কিছুক্ষণ পরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কার স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় হইল?”
যোগেন্দ্র। রমেশের স্ত্রী।
অন্নদাবাবু। তুমি কী বলিতেছ, আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। কোন্‌ রমেশের স্ত্রী?
যোগেন্দ্র। আমাদের রমেশের। পাঁচ-ছয় মাস আগে যখন সে দেশে গিয়াছিল, তখন সে বিবাহ করিতেই গিয়াছিল।
অন্নদাবাবু। কিন্তু তার পিতার মৃত্যু হইল বলিয়া বিবাহ ঘটিতে পারে নাই।
যোগেন্দ্র। মৃত্যুর পূর্বেই বিবাহ হইয়া গেছে।
অন্নদাবাবু স্তব্ধ হইয়া বসিয়া মাথায় হাত বুলাইতে লাগিলেন। কিছুক্ষণ ভাবিয়া বলিলেন, “তবে তো আমাদের হেমের সঙ্গে তাহার বিবাহ হইতেই পারে না।”
যোগেন্দ্র। আমরা তো তাই বলিতেছি-
অন্নদাবাবু। তোমরা তো তাই বলিলে, এ দিকে যে বিবাহের আয়োজন সমস্তই প্রায় ঠিক হইয়া গেছে–এ রবিবারে হইল না বলিয়া পরের রবিবারে দিন স্থির করিয়া চিঠি বিলি হইয়া গেছে–আবার সেটা বন্ধ করিয়া ফের চিঠি লিখিতে হইবে?

<

Rabindranath Tagore ।। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর