যোগেন্দ্র কহিল, “একেবারে বন্ধ করিবার দরকার কী–কিছু পরিবর্তন করিয়া কাজ চালাইয়া লওয়া যাইতে পারে।”
অন্নদাবাবু আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, “ওর মধ্যে পরিবর্তন কোন্খানটায় করিবে?”
যোগেন্দ্র। যেখানে পরিবর্তন করা সম্ভব সেইখানেই করিতে হইবে। রমেশের বদলে আর কোনো পাত্র স্থির করিয়া আসছে রবিবারেই যেমন করিয়া হউক কর্ম সম্পন্ন করিতে হইবে। নহিলে লোকের কাছে মুখ দেখাইতে পারিব না।
বলিয়া যোগেন্দ্র একবার অক্ষয়ের মুখের দিকে চাহিল। অক্ষয় বিনয়ে মুখ নত করিল।
অন্নদাবাবু। পাত্র এত শীঘ্র পাওয়া যাইবে?
যোগেন্দ্র। সে তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।
অন্নদাবাবু। কিন্তু হেমকে তো রাজি করাইতে হইবে।
যোগেন্দ্র। রমেশের সমস্ত ব্যাপার শুনিলে সে নিশ্চয় রাজি হইবে।
অন্নদাবাবু। তবে যা তুমি ভালো বিবেচনা হয় তাই করো। কিন্তু রমেশের বেশ সংগতিও ছিল, আবার
উপার্জনের মতো বিদ্যাবুদ্ধিও ছিল। এই পরশু আমার সঙ্গে কথা ঠিক হইয়া গেল, সে এটোয়ায় গিয়া প্র্যাক্টিস করিবে, এর মধ্যে দেখো দেখি কী কাণ্ড!
যোগেন্দ্র। সেজন্য কেন চিন্তা করিতেছ বাবা, এটোয়াতে রমেশ এখনো প্র্যাক্টিস করিতে পারিবে। একবার হেমকে ডাকিয়া আনি, আর তো বেশি সময় নাই।
কিছুক্ষণ পরে যোগেন্দ্র হেমনলিনীকে লইয়া ঘরে প্রবেশ করিল। অক্ষয় ঘরের এক কোণে বইয়ের আলমারির আড়ালে বসিয়া রহিল।
যোগেন্দ্র কহিল, “হেম, বোসো, তোমার সঙ্গে একটু কথা আছে।”
হেমনলিনী স্তব্ধ হইয়া চৌকিতে বসিল। সে জানিত তাহার একটা পরীক্ষা আসিতেছে।
যোগেন্দ্র ভূমিকাচ্ছলে জিজ্ঞাসা করিল, “রমেশের ব্যবহারে সন্দেহের কারণ তুমি কিছুই দেখিতে পাও না?”
হেমনলিনী কোনো কথা না বলিয়া কেবল ঘাড় নাড়িল। যোগেন্দ্র। সে যে বিবাহের দিন এক সপ্তাহ পিছাইয়া দিল, তাহার এমন কি কারণ থাকিতে পারে যাহা আমাদের কারো কাছে বলা চলে না!
হেমনলিনী চোখ নিচু করিয়া কহিল, “কারণ অবশ্যই কিছু আছে।”
যোগেন্দ্র। সে তো ঠিক কথা। কারণ তো আছেই, কিন্তু সে কি সন্দেহজনক না?
হেমনলিনী আবার নীরবে ঘাড় নাড়িয়া জানাইল, “না।”
তাহাদের সকলের চেয়ে রমেশের উপরেই এমন অসন্দিগ্ধ বিশ্বাসে যোগেন্দ্র রাগ করিল। সাবধানে ভূমিকা করিয়া কথা পাড়া আর চলিল না।
যোগেন্দ্র কঠিনভাবে বলিতে লাগলি, “তোমার তো মনে আছে, রমেশ মাস-ছয়েক আগে তাহার বাপের সঙ্গে দেশে চলিয়া গিয়াছিল। তাহার পরে অনেক দিন তাহার কোনো চিঠিপত্র না পাইয়া আশ্চর্য হইয়া গিয়াছিলাম। ইহাও তুমি জান যে, যে রমেশ দুই বেলা আমাদের এখানে আসিত, যে বরাবর আমাদের পাশের বাড়িতে বাসা লইয়া ছিল, সে কলিকাতায় আসিয়া আমাদের সঙ্গে একবারও দেখাও করিল না, অন্য বাসায় গিয়া গা-ঢাকা দিয়া রহিল–ইহা সত্ত্বেও তোমরা সকলে পূর্বের মতো বিশ্বাসেই তাহাকে ঘরে ডাকিয়া আনিলে! আমি থাকিলে এমন কি কখনো ঘটিতে পারিত?”
নৌকাডুবি ২০ (২)
- Details
- Rabindranath Tagore ।। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপন্যাস
- Category: নৌকাডুবি
- Read Time: 1 min
- Hits: 185