অন্নদা হঠাৎ উদ্দীপ্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “তোমাদের কেবলই জবর্দস্তি। তোমরা কেবল জেদ করিয়া অন্য লোকের মর্মান্তিক বেদনার উপর দিয়া নিজের ইচ্ছাকে জারি করিতে চাও। আমি অনেক দিন নীরবে সহ্য করিয়াছি, কিন্তু আর এরূপ চলিবে না। মা হেম, কাল হইতে উপরে আমার ঘরে তোতে-আমাতে চা খাইব।”
এই বলিয়া হেমকে লইয়া অন্নদা চলিয়া যাইবার উপক্রম করিলে হেম শান্তস্বরে কহিল, “বাবা, আর একটু বোসো। আজ তোমার ভালো করিয়া চা খাওয়া হইল না। অক্ষয়বাবু, কাগজে-মোড়া এই রহস্যটি কী জিজ্ঞাসা করিতে পারি কি?”
অক্ষয় কহিল, “শুধু জিজ্ঞাসা কেন, এ রহস্য উদ্ঘাটন করিতেও পারেন।”
এই বলিয়া মোড়কটি হেমনলিনীর দিকে অগ্রসর করিয়া দিল।
হেম খুলিয়া দেখিল, একখানি মরক্কো-বাঁধানো টেনিসন। হঠাৎ চমকিয়া উঠিয়া তাহার মুখ পাণ্ডুবর্ণ হইয়া উঠিল। ঠিক এই টেনিসন, এইরূপ বাঁধানো, সে পূর্বে উপহার পাইয়াছে এবং সেই বইখানি আজও তাহার শোবার ঘরের দেরাজের মধ্যে গোপন সমাদরে রক্ষিত আছে।
যোগেন্দ্র ঈষৎ হাসিয়া কহিল, “রহস্য এখনো সম্পূর্ণ উদ্ঘাটিত হয় নাই।”
এই বলিয়া বইয়ের প্রথম শূন্য পাতাটি খুলিয়া তাহার হাতে তুলিয়া দিল। সেই পাতায় লেখা আছে ঃ শ্রীমতী হেমনলিনীর প্রতি অক্ষয়শ্রদ্ধার উপহার।
তৎক্ষণাৎ বইখানা হেমের হাত হইতে একেবারে ভূতলে পড়িয়া গেল–এবং তৎপ্রতি সে লক্ষমাত্র না করিয়া কহিল, “বাবা, চলো।”
উভয়ে ঘর হইতে বাহির হইয়া চলিয়া গেল। যোগেন্দ্রের চোখদুটা আগুনের মতো জ্বলিতে লাগিল। সে কহিল, “না, আমার আর এখানে থাকা পোষাইল না। আমি যেখানে হোক একটা ইস্কুল-মাস্টারি লইয়া এখান হইতে চলিয়া যাইব।”
অক্ষয় কহিল, “ভাই, তুমি মিথ্যা রাগ করিতেছ। আমি তো তখনই সন্দেহ প্রকাশ করিয়াছিলাম যে তুমি ভুল বুঝিয়াছ। তুমি আমাকে বারংবার আশ্বাস দেওয়াতেই আমি বিচলিত হইয়াছিলাম। কিন্তু আমি নিশ্চয় বলিতেছি আমার প্রতি হেমনলিনীর মন কোনোদিন অনুকূল হইবে না। অতএব সে আশা ছাড়িয়া দাও। কিন্তু আসল কথা এই যে, উনি যাহাতে রমেশকে ভুলিতে পারেন সেটা তোমাদের করা কর্তব্য।”
যোগেন্দ্র কহিল, “তুমি তো বলিলে কর্তব্য, উপায়টা কী শুনি।”
অক্ষয় কহিল, “আমি ছাড়া জগতে আর বিবাহযোগ্য যুবাপুরুষ নাই নাকি? আমি দেখিতেছি, তুমি যদি তোমার বোন হইতে তবে আমার আইবড়ো নাম ঘোচাইবার জন্য পিতৃপুরুষদিগকে হতাশভাবে দিন গণনা করিতে হইত না। যেমন করিয়া হোক, একটি ভালো পাত্র জোগাড় করা চাই যাহার প্রতি তাকাইবামাত্র অবিলম্বে কাপড় রৌদ্রে দিবার ইচ্ছা প্রবল হইয়া না ওঠে।”
যোগেন্দ্র। পাত্র তো ফর্মাশ দিয়া মেলে না।
অক্ষয়। তুমি একেবারে এত অল্পেই হাল ছাড়িয়া দিয়া বসো কেন? পাত্রের সন্ধান আমি বলিতে পারি, কিন্তু তাড়াহুড়া যদি কর তবে সমস্তই মাটি হইয়া যাইবে। প্রথমেই বিবাহের কথা পাড়িয়া দুই পক্ষকে সশঙ্কিত করিয়া তুলিলে চলিবে না। আস্তে আস্তে আলাপ-পরিচয় জমিতে দাও, তাহার পরে সময় বুঝিয়া দিনস্থির করিয়ো।
যোগেন্দ্র। প্রণালীটি অতি উত্তম, কিন্তু লোকটি কে শুনি।
অক্ষয়। তুমি তাহাকে তেমন ভালো করিয়া জান না, কিন্তু দেখিয়াছ। নলিনাক্ষ ডাক্তার।
যোগেন্দ্র। নলিনাক্ষ!
অক্ষয়। চমকাও কেন? তাহাকে লইয়া ব্রাহ্মসমাজে গোলমাল চলিতেছে, চলুক-না। তা বলিয়া অমন পাত্রটিকে হাতছাড়া করিবে?
নৌকাডুবি ৩৯ (২)
- Details
- Rabindranath Tagore ।। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপন্যাস
- Category: নৌকাডুবি
- Read Time: 1 min
- Hits: 186