পরদিন হেমনলিনী প্রত্যুষে উঠিয়া যখন প্রস্তুত হইয়া বাহির হইল তখন দেখিল, অন্নদাবাবু তাঁহার শোবার ঘরের জানালার কাছে একটা ক্যাম্বিসের কেদারা টানিয়া চুপ করিয়া বসিয়া আছেন। ঘরে আসবাব অধিক নাই। একটি খাট আছে, এক কোণে একটি আলমারি, একটি দেয়ালে অন্নদাবাবু পরলোকগতা স্ত্রীর একটি ছায়াপ্রায় বিলীয়মান বাঁধানো ফোটোগ্রাফ–এবং তাহারই সম্মুখের দেয়ালে সেই তাঁহার পত্নীর স্বহস্তরচিত একখণ্ড পশমের কারুকার্য। স্ত্রীর জীবদ্দশায় আলমারিতে যে-সমস্ত টুকিটাকি শৌখিন জিনিস যেমনভাবে সজ্জিত ছিল আজও তাহারা তেমনি রহিয়াছে।
পিতার পশ্চাতে দাঁড়াইয়া পাকা চুল তুলিবার ছলে মাথায় কোমল অঙ্গুলিগুলি চালনা করিয়া হেম বলিল, “বাবা, চলো আজ সকাল-সকাল চা খাইয়া লইবে। তার পরে তোমার ঘরে বসিয়া তোমার সেকালের গল্প শুনিব–সে-সব কথা আমার কত ভালো লাগে বলিতে পারি না।”
হেমনলিনী সম্বন্ধে অন্নদাবাবুর বোধশক্তি আজকাল এমনি প্রখর হইয়া উঠিয়াছে যে, এই চা খাইতে তাড়া দিবার কারণ বুঝিতে তাঁহার কিছুমাত্র বিলম্ব হইল না। আর কিছু পরেই অক্ষয় চায়ের টেবিলে আসিয়া উপস্থিত হইবে; তাহারই সঙ্গ এড়াইবার জন্য তাড়াতাড়ি চা খাওয়া সারিয়া লইয়া হেম পিতার কক্ষে নিভৃতে আশ্রয় লইতে ইচ্ছা করিয়াছে, ইহা তিনি মুহূর্তেই বুঝিতে পারিলেন। ব্যাধভয়ে ভীত হরিণীর মতো তাঁহার কন্যা যে সর্বদা ত্রস্ত হইয়া আছে, ইহা তাঁহার মনে অত্যন্ত বাজিল।
নীচে গিয়া দেখিলেন, চাকর এখনো চায়ের জল তৈরি করে নাই। তাঁহার উপরে হঠাৎ অত্যন্ত রাগিয়া উঠিলেন; সে বৃথা বুঝাইবার চেষ্টা করিল যে, আজ নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই চায়ের তলব হইয়াছে। চাকররা সব বাবু হইয়া উঠিয়াছে, তাহাদের ঘুম ভাঙাইবার জন্য আবার অন্য লোক রাখার দরকার হইয়াছে, এইরূপ মত তিনি অত্যন্ত নিঃসংশয়ে প্রচার করিলেন।
চাকর তো তাড়াতাড়ি চায়ের জল আনিয়া উপস্থিত করিল। অন্নদাবাবু অন্যদিন যেরূপ গল্প করিতে করিতে ধীরে-সুস্থে আরামে চা-রস উপভোগ করিতেন আজ তাহা না করিয়া অনাবশ্যক সত্বরতার সহিত পেয়ালা নিঃশেষ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। হেমনলিনী কিছু আশ্চর্য হইয়া বলিল, “বাবা, আজ কি তোমার কোথাও বাহির হইবার তাড়া আছে?”
অন্নদাবাবু কহিলেন, “কিছু না, কিছু না। ঠাণ্ডার দিনে গরম চাঞ্চটা এক চুমুকে খাইয়া লইলে বেশ ঘামিয়া শরীরটা হালকা হইয়া যায়।”
কিন্তু অন্নদাবাবুর শরীরে ঘর্ম নির্গত হইবার পূর্বেই যোগেন্দ্র অক্ষয়কে লইয়া ঘরে প্রবেশ করিল। আজ অক্ষয়ের বেশভূষায় একটু বিশেষ পারিপাট্য ছিল। হাতে রুপাবাঁধানো ছড়ি, বুকের কাছে ঘড়ির চেন ঝুলিতেছে–বাম হাতে একটা ব্রাউন কাগজে-মোড়া কেতাব। অন্যদিন অক্ষয় টেবিলের যে অংশে বসে আজ সেখানে না বসিয়া হেমনলিনীর অনতিদূরে একটা চৌকি টানিয়া লইল; হাসিমুখে কহিল, “আপনাদের ঘড়ি আজ দ্রুত চলিতেছে।”
হেমনলিনী অক্ষয়ের মুখের দিকে চাহিল না, তাহার কথার উত্তরমাত্র দিল না। অন্নদাবাবু কহিলেন, “হেম, চলো তো মা, উপরে। আমার গরম কাপড়গুলা একবার রৌদ্রে দেওয়া দরকার।”
যোগেন্দ্র কহিল, “বাবা, রৌদ্র তো পালাইতেছে না, এত তাড়াতাড়ি কেন? হেম, অক্ষয়কে এক পেয়ালা চা ঢালিয়া দাও। আমারও চায়ের দরকার আছে, কিন্তু অতিথি আগে।”
অক্ষয় হাসিয়া হেমনলিনীকে কহিল, “কর্তব্যের খাতিরে এতবড়ো আত্মত্যাগ দেখিয়াছেন? দ্বিতীয় সার ফিলিপ-সিড্নি।”
হেমনলিনী অক্ষয়ের কথায় লেশমাত্র অবধান প্রকাশ না করিয়া দুই পেয়ালা চা প্রস্তুত করিয়া এক পেয়ালা যোগেন্দ্রকে দিল ও অপর পেয়ালাটি অক্ষয়ের অভিমুখে ঈষৎ একটু ঠেলিয়া দিয়া অন্নদাবাবুর মুখের দিকে তাকাইল। অন্নদাবাবু কহিলেন, “রৌদ্র বাড়িয়া উঠিলে কষ্ট হইবে, চলো, এইবেলা চলো।”
যোগেন্দ্র কহিল, “আজ কাপড় রৌদ্রে দেওয়া থাক্-না। অক্ষয় আসিয়াছে–”
নৌকাডুবি ৩৯
- Details
- Rabindranath Tagore ।। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপন্যাস
- Category: নৌকাডুবি
- Read Time: 1 min
- Hits: 186