ছুটে পালিয়ে এলুম বৌদিদির শূন্য ঘরে। ছবি তোলাতে তাঁর ভারী লজ্জা ছিল, শুধু ছিল একখানি লুকনো তাঁর আলমারির আড়ালে। আমারি তোলা ছবি। সুমুখে দাঁড়িয়ে বললুম, ধন্য হয়ে গেছি বৌদি, বুঝেচি তোমার হুকুম। এত শীঘ্র চলে যাবে ভাবিনি, কিন্তু কোথাও যদি থাক দেখতে পাবে তোমার আদেশ অবহেলা করিনি। শুধু এই শক্তি দিও, তোমার শোকে কারো কাছে আমার চোখের জল যেন না পড়ে। কিন্তু আজ এই পর্যন্তই থাক তাঁর কথা।
এবার আমি। যাবার সময় অনুরোধ করেছিলেন বিবাহ করতে। কারণ, এত ভার একলা বইতে পারব না—সঙ্গীর দরকার। সেই সঙ্গী হবে মৈত্রেয়ী এই ছিল আপনার মনে। আপত্তি করিনি, ভেবেছিলুম সংসারে পনেরো—আনা আনন্দই যদি ঘুচলো এক—আনার জন্যে আর টানাটানি করবো না। কিন্তু সে—ও আর হয় না,—বৌদিদির মৃত্যু এনে দিলে অলঙ্ঘ্য বাধা। বাধা কিসের? মৈত্রেয়ী ভার নিতে পারে, পারে না সে বোঝা বইতে। এটা জানতে পেরেছি। কিন্তু আমার এবার সেই বোঝাই হলো ভারী। তবু বলব বিপদের দিনে সে আমাদের অনেক করেছে, তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। সময় যদি আসে তার ঋণ ভুলবো না।
কাল অনেক রাত্রে ঘুম ভেঙ্গে বাসু উঠলো কেঁদে। তাকে ঘুম পাড়িয়ে গেলুম দাদার ঘরে। দেখি তখনো জেগে বসে বই পড়চেন। কি বই দাদা? দাদা বই মুড়ে রেখে হেসে বললেন, কি করতে এসেছিস বল? তাঁর পানে চেয়ে যা বলতে এসেছিলুম বলা হলো না। ভাবলুম ঘুমের ঘোরে বাসু কেঁদেছে, তাতে বিপ্রদাসের কি? অন্য কথা মনে এলো, বললুম, শ্রাদ্ধের পরে আপনি কোথা থাকবেন দাদা? কলকাতায়?
বললেন, না রে, যাব তীর্থভ্রমণে।
ফিরবেন কবে?
দাদা আবার একটু হেসে বললেন, ফিরবো না।
স্তব্ধ হয়ে তাঁর মুখের পানে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। সন্দেহ রইলো না যে এ সঙ্কল্প টলবে না। দাদা সংসার ত্যাগ করলেন।
কিন্তু অনুনয়-বিনয় কাঁদা-কাটা কার কাছে? এই নিষ্ঠুর সন্ন্যাসীর কাছে? তার চেয়ে অপমান আছে?
কিন্তু বাসু?
দাদা বললেন, হিমালয়ের কাছে একটা আশ্রমের খোঁজ পেয়েছি। তারা ছোট ছেলেদের ভার নেয়। শিক্ষা দেয় তারাই।
তাদের হাতে তুলে দেবেন ওকে? আর আমি করলুম মানুষ? তারপর দুই হাতে কান চেপে পালিয়ে এলুম ঘর থেকে। তিনি কি জবাব দিলেন শুনিনি।
বাসুর পাশে বসে সমস্ত রাত ভেবেচি। কোথায় যে এর কূল কিছুতে খুঁজে পাইনি। মনে পড়ল আপনাকে। বলে গিয়েছিলেন, বন্ধুর যখন হবে সত্যিকার প্রয়োজন তখন ভগবান আপনি পৌঁছে দেবেন তাকে দোরগোড়ায়। বলেছিলেন এ কথা বিশ্বাস করতে। কে বন্ধু, কবে সে আসবে জানিনে, তবু বিশ্বাস করে আছি আমার এই একান্ত প্রয়োজনে একদিন সে আসবেই।
দ্বিজদাস
পড়া শেষ হইলে দেখা গেল সাহেবের চোখ দিয়া জল পড়িতেছে। রুমাল বাহির করিয়া মুছিয়া, বলিলেন, আজই যাও মা, আমি বাধা দেব না। দরোয়ান আর তোমার বুড়ো হিমুও সঙ্গে যাক।
বন্দনা হেঁট হইয়া তাঁহার পায়ের ধূলা লইল, বলিল, যাবার উদ্যোগ করি গে বাবা, আমি উঠি।
উপন্যাস : বিপ্রদাস Chapter : 25 Page: 143
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: বিপ্রদাস
- Read Time: 1 min
- Hits: 168