ছাব্বিশ

ম্যানেজার বিরাজ দত্ত মোটর লইয়া স্টেশনে উপস্থিত ছিলেন। বন্দনাকে সসম্মানে ট্রেন হইতে নামাইয়া গাড়িতে আনিয়া বসাইলেন।

বন্দনা জিজ্ঞাসা করিল, মা আজও বাড়ি এসে পৌঁছন নি দত্তমশাই?

না দিদি।

মৈত্রেয়ী?

না, তাঁকে ত কেউ আনতে যায়নি।

বাসু ভাল আছে?

আছে।

মুখুয্যেমশাই? দ্বিজুবাবু?

বড়বাবু ভাল আছেন, কিন্তু ছোটবাবুকে দেখলে তেমন ভালো বোধ হয় না।

বন্দনা জিজ্ঞাসা করিল, জ্বর-টর হয়নি ত?

দত্ত বলিলেন, ঠিক জানিনে দিদি। কিন্তু সমস্ত কাজকর্ম করেই ত বেড়াচ্চেন।

বন্দনা কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া বলিল, দত্তমশাই, আমার মনে হয় মা হয়ত এ দুঃখের মধ্যে আর আসবেন না। কিন্তু দুঃখ যতই হোক, শ্রাদ্ধের আয়োজন ত করতে হবে। কিছু হচ্চে কি?

হচ্চে বৈ কি দিদি। কর্তাবাবুর শ্রাদ্ধে যেমন হয়েছিল প্রায় তেমনি ব্যবস্থাই হচ্চে।

কথাটা ভাল বুঝিতে না পারিয়া বন্দনা সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল, কার মত বলচেন, মুখুয্যেমশায়ের পিতৃশ্রাদ্ধের মত? তেমনি বড় আয়োজন?

দত্ত বলিলেন, হাঁ, প্রায় তেমনিই। গেলেই দেখতে পাবেন। বড়বাবু ডেকে বললেন, দ্বিজু, পাগলামি করিস নে, সব জিনিসেরই একটা মাত্রা আছে। ছোটবাবু বললেন, মাত্রা আছে জানি, কিন্তু মাত্রাবোধ ত সকলের এক নয় দাদা। বড়বাবু হেসে বললেন, কিন্তু তুই যে সকলের সকল মাত্রাই ডিঙিয়ে যাচ্ছিস দ্বিজু। ছোটবাবু বললেন, তাহলে আপনাদের কাছে মিনতি এই একটিবারের জন্যে আমাকে ক্ষমা করুন। আমি মাত্রা লঙ্ঘন করতে পারবো, কিন্তু বৌদিদির মর্যাদা লঙ্ঘন করতে পারবো না।

এর পরে আর কেউ কথা কয়নি, এখন আপনি যদি কিছু করতে পারেন। খরচ বিশ-পঁচিশ হাজারের কমে যাবে না।

খরচ কি সব ছোটবাবুর?

হাঁ, তাই ত।

বন্দনা জিজ্ঞাসা করিল, এ কি তাঁর পক্ষে খুব বেশী মনে হয় দত্তমশাই?

বিরাজ দত্ত বলিলেন, খুব বেশী না হলেও সম্প্রতি গেলও যে অনেক দিদি। এখন সামলে চলার প্রয়োজন। এর উপর নতুন বিপদ আসতেই বা কতক্ষণ?

আবার নতুন বিপদ কিসের?

দত্ত ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া বলিলেন, আপনি কি শোনেন নি জামাইবাবুর সঙ্গে মামলা বেধেছে? এ-সব বস্তুর পরিণাম ত জানেন, ফলাফল বলতে কেউ পারে না।

তবে নিষেধ করেন নি কেন?

নিষেধ? এ ত বড়বাবু নয় দিদি, যে নিষেধ মানবেন। এঁকে নিষেধ করতে শুধু একজনই ছিলেন তিনি এখন স্বর্গে। এই বলিয়া বিরাজ দত্ত নিশ্বাস ফেলিলেন।

বন্দনা আর কোন প্রশ্ন করিল না। বাড়ির কাছে আসিয়া দেখিল সুমুখের মাঠের একদিকে কাঠ কাটিয়া স্তূপাকার করা হইয়াছে। যে-সকল চালাঘর দয়াময়ীর ব্রতোপলক্ষে সেদিন তৈরি হইয়াছিল, সেগুলা মেরামত হইতেছে, বাহির প্রাঙ্গণে বিরাট মণ্ডপ নির্মিত হইতেছে, তথায় বহু লোক বহুবিধ কাজে নিযুক্ত। বিরাজ দত্ত অত্যুক্তি করে নাই বন্দনা তাহা বুঝিল।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়