অন্নদা একটু থামিয়া বলিতে লাগিল, রাত্রি বোধ করি তখন বারোটা, আমার দোরে ঘা পড়ল। কে রে? বাইরে থেকে জবাব এলো, অনুদিদি আমি। দোর খোলো। এত রাত্রে দ্বিজু ডাকে কেন, ব্যস্ত হয়ে দোর খুলে বেরিয়ে এলুম,—দ্বিজুর এ কি মূর্তি! চোখ কোটরে ঢুকেছে, গলা ভাঙ্গা, শরীর কাঁপচে,—কিন্তু তবু হাসি। বললে, দিদি, মানুষ করেছিলে তাই তোমার ঘুম ভাঙ্গালুম। যদি চোখ বুজতেই হয় তোমার কোলেই মাথা রেখে বুজবো। এই বলিয়া অন্নদা ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। তাহার কান্না যেন থামিতে চাহে না এমনি ভিতরের অদম্য আবেগ। আপনাকে সামলাইতে তাহার অনেকক্ষণ লাগিল, তারপরে কহিল, বুকে করে তাকে ঘরে নিয়ে গেলুম, কিন্তু যেমন কাট বমি তেমনি পেটের যন্ত্রণা—মনে হলো রাত বুঝি আর পোহাবে না, কখন নিশ্বাসটুকু বা বন্ধ হয়ে যায়। ডাক্তারদের খবর দেওয়া হলো, তাঁরা সব এসে পড়লেন, ফুঁড়ে ওষুধ দিলেন, গরম জলের তাপ-সেঁক চলতে লাগলো—চাকররা সব জেগে বসে—ভোরবেলায় দ্বিজু ঘুমিয়ে পড়লো। ডাক্তাররা বললে আর ভয় নেই। কিন্তু কিভাবে যে রাতটা কেটেছে দিদিমণি, ভাবলে মনে হয় বুঝি দুঃস্বপ্ন দেখেচি—ও-সব কিছুই হয়নি! এই বলিয়া অন্নদা আবার আঁচলে চোখ মুছিয়া ফেলিল।

বন্দনা আস্তে আস্তে বলিল, আমি কিছুই জানতে পারিনি, আমাকে তুললে না কেন অন্নদা?

অন্নদা কহিল, সকালে ঐ একটা অশান্তি গেলো, আর তোমাকে ব্যস্ত করলুম না দিদিমণি। নইলে দ্বিজু বলেছিল।

বন্দনা এ প্রসঙ্গ ছাড়িয়া দিল, কহিল, দ্বিজুবাবু এখন কেমন আছেন?

অন্নদা কহিল, ভালো আছে, ঘুমোচ্চে। ডাক্তাররা বলে গেছেন, হয়ত সন্ধ্যার আগে আর ঘুম ভাঙ্গবে না। বড়বাবু এসে পড়লে বাঁচি দিদি।

তাঁকে কি খবর দেওয়া হয়েছে?

না। দত্তমশাই বললেন তার আবশ্যক নেই, তিনি আপনিই আসবেন।

ও-ঘরে লোক আছে ত?

হাঁ দিদিমণি, দু’জন বসে আছে।

ডাক্তার আবার কখন আসবেন?

সন্ধ্যার আগেই আসবেন। বলে গেছেন আর ভয় নেই।

চিকিৎসকেরা অভয় দিয়ে গেছেন বন্দনার এইটুকুই সান্ত্বনা। এছাড়া তাহার কি-ই বা করিবার আছে!

বন্দনা গিয়া পিতাকে দ্বিজদাসের পীড়ার সংবাদ দিল, কিন্তু বেশি বলিল না।

তিনি সেইটুকু শুনিয়াই ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন,—কৈ আমি ত কিছুই জানতে পারিনি?

না, আমাদের ঘুম ভাঙ্গানো কেউ উচিত মনে করেনি।

কিন্তু সেটা ত ভালো হয়নি!

বন্দনা চুপ করিয়া রহিল, তিনি ক্ষণেক পরে নিজেই বলিলেন, টিকিট কিনতে পাঠান হয়েছে, গাড়ি রিজার্ভ হয়ে গেছে, আমাদের যাওয়ায় ত দেখচি একটু বিঘ্ন ঘটল।

বন্দনা বলিল, কেন বিঘ্ন হবে বাবা, আমরা থেকেই বা তাঁদের কি উপকার করবো?

না, উপকার নয়, কিন্তু তবু—

না বাবা, এমনি করে কেবলি দেরি হয়ে যাচ্চে, আর তুমি মত বদলিয়ো না। এই বলিয়া বন্দনা বাহির হইয়া আসিল।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়