বেলা পড়িয়া আসিতেছে, বন্দনার ঘরে ঢুকিয়া অন্নদা মেঝের উপর বসিল। তাঁহাদের যাত্রা করিতে তখনও ঘণ্টা-দুয়েক দেরি। বন্দনা জিজ্ঞাসা করিল, দ্বিজুবাবু ভাল আছেন?
হাঁ দিদি, ভাল আছে, ঘুমুচ্চে।
বন্দনা কহিল, আমাদের যাবার সময়ে কারও সঙ্গে দেখা হলো না। একজনের তখনো হয়ত ঘুম ভাঙবে না, আর একজন যখন বাড়ি এসে পৌঁছবেন তখন আমরা অনেক দূর চলে গেছি।
অন্নদা সায় দিয়া বলিল, হাঁ, বড়দাদাবাবু আসবেন প্রায় নটা রাত্তিরে। একটু পরে কহিল, তিনি এসে পড়লে সবাই বাঁচি। সকলের ভয় ঘোচে।
কিন্তু ভয় ত কিছু নেই অন্নদা!
অন্নদা বলিল, নেই সত্যি, কিন্তু বড়দাদাবাবুর বাড়িতে থাকাই আলাদা জিনিস দিদি। তখন কারও আর কোন দায়িত্ব নেই, সব তাঁর। যেমন বুদ্ধি, তেমনি বিবেচনা, তেমনি সাহস, আর তেমনি গাম্ভীর্য! সকলের মনে হয় যেন বটগাছের ছায়ায় বসে আছি।
সেই পুরাতন কথা, সে বিশেষণের ঘটা। মনিবের সম্বন্ধে এ যেন ইহাদের মজ্জাগত হইয়াছে। অন্য সময় হইলে বন্দনা খোঁটা দিতে ছাড়িত না, কিন্তু এখন চুপ করিয়া রহিল।
অন্নদা বলিতে লাগিল, আর এই দ্বিজু! দুই ভায়ে যেন পৃথিবীর এ-পিঠ ও-পিঠ।
বন্দনা আশ্চর্য হইয়া কহিল কেন?
অন্নদা বলিল, তা বৈ কি দিদি। না আছে দায়িত্ববোধ, না আছে ঝঞ্ঝাট, না আছে গাম্ভীর্য। বৌদি বলেন, ও হচ্চে শরতের মেঘ, না আছে বিদ্যুৎ, না আছে জল। উড়ে উড়ে বেড়ায়, ব্যাপার যত গুরুতর হোক, হেসে খেলে ও কাটাবেই কাটাবে। না গৃহী না বৈরিগী, কত খাতক যে ওর কাছে ‘বুঝিয়া পাইলাম’ লিখিয়ে নিয়ে পরিত্রাণ পেয়েছে তার হিসেব নেই।
বন্দনা কহিল, মুখুয্যেমশাই রাগ করেন না?
করেন না? খুব করেন। বিশেষ মা। কিন্তু ওকে পাওয়া যাবে কোথায়? কিছুদিনের মতো এমন নিরুদ্দেশ হয় যে বৌদি কান্নাকাটি শুরু করে দেন, তখন সবাই মিলে খুঁজে ধরে আনে। কিন্তু এমন করেও ত চিরদিন কাটতে পারে না দিদি, ওরও বিয়ে হবে, ছেলেপুলে হবে, তখন যে এ ব্যবস্থায় একেবারে দেউলে হতে হবে!
বন্দনা কহিল, এ কথা তোমরা ওঁকে বলো না কেন?
অন্নদা কহিল, ঢের বলা হয়েছে, কিন্তু ও কান দেয় না। বলে, তোমাদের ভাবনা কেন? দেউলেই যদি হই বৌদিদি ত আর দেউলে হবে না, তখন সকলে মিলে ওঁর ঘাড়ে গিয়ে চাপবো।
বন্দনা হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করিল, মেজদি কি বলেন?
অন্নদা কহিল, দেওরের ওপর তাঁর আদরের শেষ নেই। বলেন, আমরা খাবো আর দ্বিজু উপোস করবে নাকি? আমার পাঁচ শ টাকা আয় ত আর কেউ ঘুচোতে পারবে না, আমাদের গরিবী-চালে তাতেই চলে যাবে। বড়বাবু তাঁর লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়ে সুখে থাকুন আমরা চাইতে যাবো না।
শুনিয়া বন্দনার কি যে ভালো লাগিল তাহার সীমা নাই। যে বলিয়াছে সে তাহারই বোন। অথচ যে সমাজে, যে আবহাওয়ার মধ্যে সে নিজে মানুষ, সেখানে এ কথা কেহ বলে না, হয়ত ভাবিতেও পারে না। বলার কখনো প্রয়োজন হয় কিনা তাই বা কে জানে।
উপন্যাস : বিপ্রদাস Chapter : 15 Page: 65
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: বিপ্রদাস
- Read Time: 1 min
- Hits: 149