নীলাম্বর উদ্দীপ্ত হইয়া বলিল, তাই বল্ বোন; সে আসতে চায়, পায় না। সে যে কি শাস্তি পুঁটি, তা তোরা দেখতে পাসনে বটে, কিন্তু চোখ বুঝলে আমি তা দেখি! সেই দেখাই আমাকে নিত্য ক্ষয় করে আনচে রে, আর কিছুই নয়।
পুঁটি কাঁদিয়া ফেলিল।
নীলাম্বর হাত দিয়া নিজের চোখ মুছিয়া লইয়া বলিল, সে তার দুটো সাধের কথা আমাকে যখন-তখন বলত। এক সাধ, শেষ সময়ে আমার কোলে যেন মাথা রাখতে পায়; আর সাধ, সীতা-সাবিত্রীর মত হয়ে মরণের পরে যেন তাদের কাছেই যায়। হতভাগীর সব সাধই ঘুচেচে।
পুঁটি চুপ করিয়া শুনিতে লাগিল।
নীলাম্বর রুদ্ধকন্ঠ পরিষ্কার করিয়া লইয়া বলিল, তোরা সবাই তার অপরাধ দিস্, বারণ করতে পারিনে বলে আমিও চুপ করে থাকি, কিন্তু ভগবানকে ফাঁকি দিই কি করে বল্ দেখি? তিনি ত দেখচেন, কার ভুল, কার অপরাধের বোঝা মাথায় নিয়ে সে ডুবে গেল। তুই বল্, আমি কোন্ মুখে তার দোষ দিই, আমি তাকে আশীর্বাদ না করে কি করে থাকি? না বোন, সংসারের চোখে সে যত কলঙ্কিনীই হোক, তার বিরুদ্ধে আমার কোন ক্ষোভ, কোন নালিশ নেই। নিজের দোষে এ জন্মে তাকে পেয়েও হারালুম, ভগবান করুন, যেন পরজন্মেও তাকে পাই। সে আর বলিতে পারিল না, এইখানে তাহার গলা একেবারে ধরিয়া গেল।
পুঁটি তাড়াতাড়ি উঠিয়া বসিয়া আঁচল দিয়া দাদার চোখ মুছাইয়া দিতে গিয়া নিজেও কাঁদিয়া ফেলিল,সহসা তাহার মনে হইল, দাদা যেন কোথায় সরিয়া যাইতেছে। কাঁদিয়া বলিল, যেখানে ইচ্ছে চল দাদা, কিন্তু, আমি তোমাকে একটি দিনও কোথাও একলা ছেড়ে দেব না।
নীলাম্বর মুখ তুলিয়া একটুখানি হাসিল।
বিরাজ জগন্নাথের পথে ফিরিয়া আসিতেছিল। এই পথ ধরিয়া যখন সে অনুদ্দিষ্ট মৃত্যুশয্যার অনুসন্ধানে গিয়াছিল, সেই যাওয়ায় আর এই আসায় কি প্রভেদ! এখন সে বাড়ি যাইতেছে। তাহার দুর্বল দেহ পথে যতই সকাতরে বিশ্রাম-ভিক্ষা চাহিতে লাগিল, সে ততই ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত হইয়া উঠিতে লাগিল। কোন কারণে কোথাও বিলম্ব করিতে সে সম্মত নয়। তাহার কাশি যক্ষ্মায় পরিণত হইয়াছে, ইহা সে টের পাইয়াছিল, তাই আশঙ্কার অবধি ছিল না, পাছে যাওয়া না ঘটে। ছেলেবেলা হইতে একটা বিশ্বাস তাহার বড় দৃঢ় ছিল, দেহ নিষ্পাপ না হইলে কেহ স্বামীর পায়ে মরিতে পায় না। সে এই উপায়ে মরণের পূর্বে একবার নিজের দেহটাকে যাচাই করিয়া লইতে চায়—তাহার প্রায়শ্চিত্ত সম্পূর্ণ হইয়াছে কি না। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইতে পারিলে সে নির্ভয়ে, মহানন্দে জীবনের পরপারে দাঁড়াইয়া তাঁর জন্য অপেক্ষা করিয়া বসিয়া থাকিবে। কিন্তু দামোদরের এধারে আসিয়া তাহার হাত-পা ফুলিয়া উঠিল, মুখ দিয়া অধিক পরিমাণে রক্ত পড়িতে লাগিল—আর কিছুতেই পা চলিল না। সে হতাশ হইয়া একটা গাছতলায় ফিরিয়া আসিয়া ভয়ে কাঁদিতে লাগিল। এ কি ভয়ানক অপরাধ যে, এত করিয়াও তাহার শেষ আশা মিটিল না! তাহার এ-জন্ম গেল, পরজন্মেও আশা নাই, তবে সে আর কি করিবে! আশা নাই, তবুও সে গাছতলায় পড়িয়া সারাদিন হাতজোড় করিয়া স্বামীর পায়ে মিনতি জানাইতে লাগিল।
পরদিন তারকেশ্বরের কাছাকাছি কোথায় হাটবার ছিল। প্রভাত হইতে সেই পথে গরুর গাড়ি চলিতে লাগিল। সে সাহসে ভর করিয়া এক বৃদ্ধ গাড়োয়ানকে আবেদন করিল। বুড়ো মানুষ তাহার কান্না দেখিয়া, সম্মত হইয়া তাহাকে গাড়ি করিয়া তারকেশ্বরে পৌঁছাইয়া দিয়া গেল। বিরাজ স্থির করিল, এই মন্দিরের আশেপাশে কোথাও সে পড়িয়া থাকিবে। এখানে কত লোক আসে যায়, যদি কোন উপায়ে একবার ছোটবৌর কাছে সংবাদ পাঠাইতে পারে।
উপন্যাস : বিরাজবউ Chapter : 17 Page: 70
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: বিরাজবউ
- Read Time: 1 min
- Hits: 175