দাদার কথা শুনিয়া পুঁটি অধিকতর কাঁদিয়া উঠিয়া বলিল, কেন তুমি সদাসর্বদা তাকে এমন করে ভাববে? শুধু ভেবেই ত এমন হয়ে যাচ্চ।

কে বললে আমি তাকে সর্বদা ভাবি?

পুঁটি তেমনই ভাবে জবাব দিল, কে আবার বলবে, আমি নিজেই জানি।

তুই তাকে ভাবিস নে?

পুঁটি চোখ মুছিয়া উদ্ধতভাবে বলিল, না, ভাবিনে। তাকে ভাবলে পাপ হয়।

নীলাম্বর চমকিত হইল—কি হয়?

পাপ হয়। তার নাম মুখে আনলে মুখ অশুচি হয়, মনে আনলে স্নান করতে হয়,—বলিয়াই সে সবিস্ময়ে চাহিয়া দেখিল, দাদার স্নেহকোমল দৃষ্টি একনিমেষে পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে। নীলাম্বর বোনের মুখের দিকে চাহিয়া কঠিনস্বরে বলিল, পুঁটি!

ডাক শুনিয়া সে ভীত ও অত্যন্ত কুন্ঠিত হইয়া পড়িল। সে দাদার বড় আদরের বোন, ছেলেবেলাতেও সহস্র অপরাধে কখনও এমন চোখ দেখে নাই, এমন গলা শুনে নাই। এখন বড়বয়সে বকুনি খাইয়া তাহার ক্ষোভে ও অভিমানে মাথা হেঁট হইয়া গেল।

নীলাম্বর আর কিছু না বলিয়া উঠিয়া গেলে, সে চোখে আঁচল দিয়া ফুঁপাইয়া কাঁদিতে লাগিল। দুপুরবেলা দাদার আহারের সময় কাছে গেল না, অপরাহ্নে দাসীর হাতে খাবার পাঠাইয়া দিয়া আড়ালে দাঁড়াইয়া রহিল।

নীলাম্বর ডাকিল না, কথাটি বলিল না।

সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। নীলাম্বর আহ্নিক শেষ করিয়া সেই আসনে চুপ করিয়া বসিয়া আছে, পুঁটি নিঃশব্দে ঘরে ঢুকিয়া পিছনে আসিয়া হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া দাদার পিঠের উপর মুখ রাখিল। এটা তাহার নালিশ করার ধরন। ছেলেবেলায় অপরাধ করিয়া বৌদির তাড়া খাইয়া এমনই করিয়া সে অভিযোগ করিত। নীলাম্বরের সহসা তাহা মনে পড়িয়া দুই চোখ সজল হইয়া উঠিল, মাথায় হাত দিয়া কোমলস্বরে বলিল, কি রে?

পুঁটি পিঠ ছাড়িয়া দিয়া কোলের উপর উপুড় হইয়া মুখ গুঁজিয়া কাঁদিতে লাগিল। নীলাম্বর তাহার মাথায় উপর একটা হাত রাখিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। বহুক্ষণ পরে পুঁটি কান্নার সুরে বলিল, আর বলব না দাদা!

নীলাম্বর হাত দিয়া তাহার চুলগুলি নাড়িতে নাড়িতে বলিল, না, আর ব’ল না।

পুঁটি চুপ করিয়া পড়িয়া রহিল। নীলাম্বর তাহার মনের কথা বুঝিয়া মৃদুস্বরে কহিল, সে তোর গুরুজন। শুধু সম্পর্কে নয় পুঁটি, তোকে মায়ের মত মানুষ ক’রে তোর মায়ের মতই হয়েচে। অপরে যা ইচ্ছে বলুক, কিন্তু তোর মুখের ও-কথায় গভীর অপরাধ হয়। পুঁটি চোখ মুছিতে মুছিতে বলিল, কেন সে আমাদের এমন করে ফেলে রেখে গেল!

কেন যে গেল পুঁটি, সে শুধু আমি জানি, আর যিনি সর্বযামী তিনি জানেন। সে নিজেও জানত না—তখন সে পাগল হয়েছিল, তার এতটুকু জ্ঞান থাকলে সে আত্মহত্যাই করত, এ কাজ করত না।

পুঁটি আর একবার চোখ মুছিয়া ভাঙ্গা গলায় বলিল, কিন্তু—এখন, তবে কেন আসে না দাদা?

কেন আসে না? আসবার জো নেই বলেই আসে না দিদি, বলিয়া সে নিজেকে জোর করিয়া সংবরণ করিয়া লইয়া ক্ষণকাল পরেই বলিল, যে অবস্থায় আমাকে ফেলে রেখে গেছে, তার এতটুকু ফেরবার পথ থাকলে সে ফিরে আসত—একটা দিনও কোথাও থাকত না। এ কথা কি তুই নিজেই বুঝিস নে পুঁটি?

পুঁটি মুখ ঢাকিয়া রাখিয়াই ঘাড় নাড়িয়া বলিল, বুঝি দাদা।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়