সমবেত গান
দাঁড়াও ক্ষণিক পথিক হে
যেও না চলে,
অরুণ-আলো কে যে দেবে
যাও গো বলে।
ফেরো তুমি যাবার বেলা;
সাঁঝ-আকাশে রঙের মেলা—
দেখছ কী কেমন ক’রে
আগুন হয়ে উঠল জ্বলে।
পুব-গগনের পানে বারেক তাকাও
বিরহেরই ছবি কেন আঁকাও
আঁধার যেন দৈত্য সম আসছে বেগে,
শেষ হয়ে যাক তারা তোমার ছোঁয়াচ লেগে।
থামো ওগো, যেও না হয়
সময় হলে॥
আবৃত্তি
সূর্যদেব,
আজি এই বৈশাখে খরতপ্ত তেজে
পৃথিবী উন্মত্ত যবে তুমি এলে সেজে
কনক-উদয়াচলে প্রথম আবেগে
ফেলিলে চরণচিহ্ন, তার স্পর্শ লেগে
ধরণী উঠিল কাঁপি গোপন স্পন্দনে
সাজাল আপন দেহ পুষ্প ও চন্দনে
তব পূজা লাগি। পৃথিবীর চক্ষুদান
হল সেই দিন। অন্ধকার অবসান,
যবে দ্বার খুলে প্রভাতের তীরে আসি
বলিলে, হে বিশ্বলোক তোরে ভালবাসি,
তখনি ধরিত্রী তার জয়মাল্যখানি
আশীর্বাদসহ তব শিরে দিল আনি—
সস্মিত নয়নে। তারে তুমি বলেছিলে,
জানি এ যে জয়মাল্য, মোরে কেন দিলে?
কতবার তব কানে পঁচিশে বৈশাখ
সুদূরের তরে শুধু দিয়ে গেল ডাক,
তুমি বলেছিলে চেয়ে সম্মুখের পানে
“হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে।”
উদয়ন
শোনো ওগো বিদেশের কন্যা
ব্যাধি দুর্ভিক্ষের বন্যা
আমরাই প্রাণ দিয়ে বাঁধব—
তোমাদের কান্নায় আমরাও যোগ দিয়ে কাঁদব।
ইন্দ্রসেন
আমরা তোমায় তুলে দেবো অন্ন বস্ত্র অর্থ
তুমি কেবল গান শোনাবে এই আমাদের শর্ত।
সত্যকাম
ওই দ্যাখ আসে হেথা রাজ্যের কোতোয়াল
ইয়া বড় গোঁফ তার, হাতে বাঁকা তরোয়াল;
ওর কাছে গিয়ে তুমি পাতো দুই হস্ত
ও দেবে অনেক কিছু ও যে লোক মস্ত!
কোতোয়ালের প্রবেশ
সংকলিতা (আঁচল তুলে)
ওগো রাজপ্রতিনিধি,
তুমি রাজ্যের বিধি।
তুমি দাও আমাদের অন্ন,
আমরা যে বড়ই বিপন্ন।
কোতোয়াল
যা চ’লে ভিখারী মেয়ে যা চ’লে
দেব না কিছুই তোর আঁচলে।
সংকলিতা
তুমি যদি না দেবে তো কে দেবে এ রাজ্যে?
সবারে রক্ষা করা তোমাদের কাজ যে।
কোতোয়াল
চুপ কর হতভাগী, বড় যে সাহস তোর?
এখুনি বুঝিয়ে দেব আমার গায়ের জোর।
সংকলিতা
তোমরা দেখাও শুধু শক্তি,
তাইতো করে না কেউ ভক্তি;
করো না প্রজার কোনো কল্যাণ,
তোমরা অন্ধ আর অজ্ঞান।
বর্ণনা
হঠাৎ আলোর আভাস পেয়ে কেঁপে উঠল
ভোরবেলা, কোন্ পুলকে, কোন্ অজানা সম্ভাবনায়?
রুদ্ধশ্বাসে প্রতীক্ষা করে অন্ধকার।
শিউলি বকুল ঝ’রে পড়ে শেষ রাত্রির কান্নার মতো,
হেমন্ত-ভোরের শিশিরের মতো।
অস্পষ্ট হল অন্ধকার; স্বচ্ছ আরও স্বচ্ছ
মৃতপ্রায়ের আগ্রহের মতো পাণ্ডুর আলো এসে পড়ে
আশীর্বাদের মতো ঝরা ফুলের মরা চোখে,
শুভ্র কপোলে,—ঘুমন্ত হাসির মতো তার মায়া।
পৃথিবীর ছেলেমেয়েরা এল উচ্ছ্বসিত বন্যার বেগে,
হাতে তাদের আহরণী-ডালা;
তারা অবাক হয়ে দেখলে
একী! নতুন ফুল ফুটেছে তাদের আঙিনায়
রবির প্রথম আলো এসে পড়েছে তার মুখে,
ওরা বললে, ওতো সূর্যমুখী।
পিলু-বারোয়াঁর সুর তখনও রজনীগন্ধার বনে
দীর্ঘশ্বাসের মতো সুরভিত-মওতায় হা- হা করছে;
কিন্তু তাও গেল মিলিয়ে। শুধু জাগিয়ে দিয়ে
গেল হাজার সূর্যমুখীকে।
সূর্য উঠল। অচেতন জড়তার বুকে ঠিকরে
পড়তে লাগল, বন্ধ জানলায় তার কোমল
আঘাত, অজস্র দীপ্তিতে বিহ্বল।
পৃথিবীর ছেলেমেয়েরা ফিরে গেল উজ্জ্বল, উজ্জ্বল হয়ে
বুকে তাদের সূর্যমুখীর
অদৃশ্য সুবাস।
গান
ওগো কবি, তুমি আপন ভোলা—
আনিলে তুমি নিথর জলে ঢেউয়ের দোলা,
মালিকাটি নিয়ে মোর
একী বাঁধিলে অলখ-ডোর
নিবেদিত প্রাণে গোপনে তোমার কি সুর তোলা,
জেনেছ তো তুমি সকল প্রাণের নীরব কথা,
তোমার বাণীতে আমার মনের এ ব্যাকুলতা
পেয়েছ কি তুমি সাঁঝের বেলাতে
যখন ছিলাম কাজের খেলাতে
তখন কি তুমি এসেছিলে, ছিল যে দুয়ার খোলা?
সমবেত গান
আমাদের ডাক এসেছে
এবার পথে চলতে হবে,
ডাক দিয়েছে গগন-রবি
ঘরের কোণে কেই বা রবে।
ডাক এসেছে চলতে হবে আজ সকালে
বিশ্বপথে সবার সাথে সমান তালে,
পথের সাথী আমরা রবির
সাঁঝ-সকালে চলরে সবে।
ঘুম থেকে আজ সকালবেলা ওঠ রে
ডাক দিল কে পথের পানে ছোট রে,
পিছন পানে তাকাস নি আজ চল সমুখে
জয়ের বাণী নূতন প্রাতে বল ও-মুখে
তোদের চোখে সোনার আলো
সফল হয়ে ফুটবে কবে।
আবৃত্তি
কবিগুরু আজ মধ্যাহ্নের অর্ঘ্য
দিলাম তোমায় সাজায়ে,
পৃথিবীর বুকে রচেছ শান্তিস্বর্গ
মিলনের সুর বাজায়ে।
যুগে যুগে যত আলোক-তীর্থযাত্রী
মিলিবে এখানে আসিয়া,
তোমার স্বর্গ এনে দেবে মধুরাত্রি
তাহাদের ভালবাসিয়া।
তারা দেবে নিতি শান্তির জয়মাল্য
তোমার কণ্ঠে পরায়ে,
তোমার বাণী যে তাহাদের প্রতিপাল্য,
মর্মেতে যাবে জড়ায়ে।
তুমি যে বিরাট দেবতা শাপভ্রষ্ট
ভুলিয়া এসেছ মর্তে;
পৃথিবীর বিষ পান করে নাই এখনো তোমার ওষ্ঠ
ঝঞ্ঝা-প্রলয়-আবর্তে।
আজিকার এই ধূলিময় মহাবাসরে
তোমারে জানাই প্রণতি,
তোমার পূজা কি শঙ্খ ঘন্টা কাঁসরে?
ধূপ-দীপে তব আরতি?
বিশ্বের আজ শান্তিতে অনাসক্তি,
সভ্য মানুষ যোদ্ধা,
চলেছে যখন বিপুল রক্তারক্তি,
তোমারে জানাই শ্রদ্ধা।
বর্ণনা
কিন্তু মধ্যাহ্ন তো পেরিয়ে যায়
সন্ধ্যার সন্ধানে, মেঘের ছায়ায়
বিশ্রাম করতে করতে, আকাশের
সেই ধূ-ধূ করা তেপান্তরের মাঠ।
আর সূর্যও তার অবিরাম আলোকসম্পাত
ক’রে ঢলে পড়ল সাঁঝ-গগনে।
সময়ের পশ্চাতে বাঁধা সূর্যের গতি
কী সূর্যের পিছনে বাঁধা সময়ের গতি
তা বোঝা যায় না।
দিন যায় ভাবীকালকে আহ্বান করতে।
একটা দিন আর একটা ঢেউ,
সময় আর সমুদ্র।
তবু দিন যায়
সূর্যের পিছনে, অন্ধকারে অবগাহন
করতে করতে।
যেতে হবে।
প্রকৃতির কাছে এই পরাভবের লজ্জায়
আর বেদনায় রক্তিম হল
সূর্যের মুখ,
আর পৃথিবীর লোকেরা;
তাদের মুখ পুব-আকাশের মতো
কালো হয়ে উঠল।
সমবেত গান
দাঁড়াও ক্ষণিক পথিক হে
যেও না চলে,
অরুণ-আলো কে যে দেবে
যাও গো বলে।
ফেরো তুমি যাবার বেলা;
সাঁঝ-আকাশে রঙের মেলা—
দেখছ কী কেমন ক’রে
আগুন হয়ে উঠল জ্বলে।
পুব-গগনের পানে বারেক তাকাও
বিরহেরই ছবি কেন আঁকাও
আঁধার যেন দৈত্য সম আসছে বেগে,
শেষ হয়ে যাক তারা তোমার ছোঁয়াচ লেগে।
থামো ওগো, যেও না হয়
সময় হলে॥