আবৃত্তি

বেলাশেষে শান্তছায়া সন্ধ্যার আভাসে

বিষন্ন মলিন হয়ে আসে,

তারি মাঝে বিভ্রান্ত পথিক

তৃপ্তিহীন খুঁজে ফেরে পশ্চিমের দিক।

পথপ্রান্তে

প্রাচীন কদম্বতরুমূলে,

ক্ষণতরে স্তব্ধ হয়ে যাত্রা যায় ভুলে।

আবার মলিন হাসি হেসে

চলে নিরুদ্দেশে।

রজনীর অন্ধকারে একটি মলিন দীপ হাতে

কাদের সন্ধান করে উষ্ণ অশ্রুপাতে

কালের সমাধিতলে।

স্মৃতির সঞ্চয় করে জীবন-অঞ্চলে;

মাঝে মাঝে চেয়ে রয় ব্যথা ভরা পশ্চিমের দিকে,

নির্নিমিখে।

যেথায় পায়ে চিহ্ন পড়ে আছে অমর অক্ষরে

যেথায় কাদের আর্তনাদ বারংবার বৈশাখীর ঝড়ে।

আবার সম্মুখপানে

যাত্রা করে রাত্রির আহ্বানে।

ক্ষীণদীপ উর্বর আলোতে

চিরন্তন পথের সংকেত

রেখে যায় প্রভাতের কানে।

অকস্মাৎ আত্মবিস্মৃতির অন্তঃপুরে,

ভেসে ওঠে মানসমুকুরে

উত্তরকালের আর্তনাদ,—

“কবিগুরু

আমাদের যাত্রা শুরু

কালের অরণ্য পথে পথে

পরিত্যক্ত তব রাজ-রথে

আজি হতে শতবর্ষ আগে

অস্ত গোধূলির সন্ধ্যারাগে

যে দিগন্ত হয়েছে রক্তিম,

সেথা আজ কারো চিত্তবীণা

তন্ত্রীতে বাজে কিনা

সে কথা শুধাও?

শুধু দিয়ে যাও

ক্ষণিকের দক্ষিণ বাতাসে তোমার সুবাস

বাণীহীন অন্তরের অন্তিম আভাস।

তাই আজ বাধামুক্ত হিয়া

অজস্র উপেক্ষাভরে বিস্মৃতিরে পশ্চাতে ফেলিয়া

ছিন্নবাধা বলাকার মতো

মত্ত অবিরত,

পশ্চাতের প্রভাতের পুষ্প-কুঞ্জবনে

আজ শূণ্য মনে।”

তাই উচ্চকিত পথিকের মন

অকারণ

উচ্ছলিত চঞ্চল পবনে

অনাগত গগনে গগনে।

ক্লান্ত আজ প্রভাতের উৎসবের বাঁশি;

পুরবাসী নবীন প্রভাতে

পুরাতন জয়মাল্য হাতে

অস্তাচলে পথিকের মুখে মূর্ত হাসি॥

গান

ও কে যায় চলে কথা না বলে, দিও না যেতে

তাহারই তরে আসন ঘরে রেখেছি পেতে।

কত কথা আছে তার মনেতে সদাই,

তবু কেন রবি কহে আমি চলে যাই;

রামধনু রথে

বিদায়ের পথে

উঠিল মেতে।

রঙে রঙে আজ গোধূলি গগন

রঙিন কী হল, বিলাপে মগন।

আমি কেঁদে কই যেও না কোথাও,

সে যে হেসে কয় মোরে যেতে দাও

বাড়ায়ে বাহু

মরণ-রাহু

চাহিছে পেতে॥

বর্ণনা

হঠাৎ বুঝি তোমার রথের সাতটি ঘোড়া উঠল

হ্রেষা-রবে চঞ্চল হয়ে, যাবার ডাক শুনি?

অস্তপথ আজ তোমারই প্রত্যাশায় উন্মুখ, হে কবি,

কখন তুমি আসবে?

কবে, কখন তুমি এসে দাঁড়ালে

অস্তপথের সীমানায়, কেউ জানল না; এমন কী

তুমিও না!

একবার ভেবে দেখেছ কি,

হে ভাবুক, তোমার চলমান ঘোড়ার শেষ পদক্ষেপের

আঘাতে কেমন ক্ষত-বিক্ষত হয়ে উঠবে আমাদের

অন্তরলোক?

তোমার রচিত বাণীর মন্দিরে কোন্

নূতন পূজারী আসবে জানি না, তবু তোমার আসন হবে

শূন্য আর তোমার নিত্য-নূতন পূজাপদ্ধতি, অর্ঘ্য-উপচার

আর মন্দিরের বেদী স্পর্শ করবে না। দেউলের ফাটল

দিয়ে কোন্ অশ্বত্থ-তরু চাইবে আকাশ, চাইবে তোমার

মন্দিরে তার প্রতিষ্ঠা, জানি না। রবু একদিন তা

সম্ভব, তুমিও জানো। সেই দিনকার কথা

ভেবে দেখছ কি, হে দিগন্ত-রবি?

তোমার বেণুতে আজ শেষ সুর কেঁপে উঠল।

তুমি যাবে আমাদের মথিত করে। কোন্ মহাদেশের

কোন্ আসনে হবে তোমার স্থান? বিশ্ববীণার তারে আজ

কোন্ সুর বেজে উঠেছে, জানো? সে তোমারই বিদায়

বেদনায় সকরুণ ওপারের সুর। এই সুরই চিরন্তন,

সত্য এবং শাশ্বত। যুগের পর যুগ যে সুর ধ্বনিত হয়ে

আসছে, আবহমানকালের সেই সুর। সৃষ্টি-সুরের

প্রত্যুত্তর এই সুরের নাম লয়। তান-লয় নিয়ে তোমার

খেলা চলেছে, কতকাল, আজ সেই লয়ের তান রণরণিত হচ্ছে

কোন্ অদৃশ্য তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে, জানি না।

কোন্ যুগান্তরেরে পারেও ধ্বনিত হবে সেই সুর

কতদূর-তা কে জানে।

আবৃত্তি

অমৃতলোকের যাত্রী হে অমর কবি, কোন্ প্রস্থানের

পথে তোমার একাকী অভিযান। প্রতিদিন তাই

নিজেরে করেছ মুক্ত, বিদায়ের নিত্য আশঙ্কায়

পৃথ্বীর বন্ধন ভিত্তি নিশ্চিহ্ন করিতে বিপুল প্রয়াস

তব দিনে দিনে হয়েছে বর্ধিত। এই হাসি গান,

ক্ষণিকের অনিশ্চিত বুদ্বুদের মতো; নশ্বর জীবন

অনন্ত কালের তুচ্ছ কণিকার প্রায় হাসি ও ক্রন্দনে

ক্ষয় হয়ে যায় তাই ওরা কিছু নয়, তুমিও জানিতে,

‘কালস্রোতে ভেসে যায় জীবন-যৌবন-ধন মা’,

তবু তুমি শিল্পীর তুলিকা নিয়ে করেছ অঙ্কিত

সভ্যতার প্রত্যেক সম্পদ, সুন্দরের সুন্দর অর্চনা।

বিশ্বপ্রদর্শনী মাঝে উজ্জ্বল তোমার সৃষ্টিগুলি

পৃথিবীর বিরাট সম্পদ। স্রষ্টা তুমি, দ্রষ্টা তুমি

নূতন পথের। সেই তুমি আজ পথে পথে,

প্রয়াণের অস্পষ্ট পরিহাসে আমাদের করেছ

উন্মাদ। চেয়ে দেখি চিতা তব জ্বলে যায় অসহ্য

দাহনে, জ্বলে যায় ধীরে ধীরে প্রত্যেক অন্তর।

তুমি কবি, তুমি শিল্পী, তুমি যে বিরাট, অভিনব

সবারে কাঁদায়ে যাও চুপি চুপি এ কী লীলা তব॥

গান

ঝুলন-পূর্ণিমাতে

নীরব নিঠুর মরণ সাথে

কে তুমি ওগো মিলন-রাখী

বাঁধিলে হাতে?

শ্রাবণদিনে উদাস হাওয়া

কাঁদিল একী,

পথিক রবির চলে যাওয়া

চাহিয়া দেখি,

ব্যাকুল প্রাণে সজলঘন

নয়ন পাতে॥

বিদায় নিতে চায় কে ওরে

বাঁধরে তারে বজ্রডোরে

আলোর স্বপন ভেঙেছে মোর,

আঁধার যেথায় শ্রাবণ-ভোর

ঘুম টুটে মোর সকল-হারা

এই প্রভাতে॥

সমবেত গান

নমো রবি, সূর্য দেবতা

জয় অগ্নি-কিরণময় জয় হে

সহস্র-রশ্মি বিভাসিত,

চির অক্ষয় তব পরিচয় হে।

জয় ধ্বান্ত-বিনাশক জয় সূর্য

দিকে দিকে বাজে তব জয়-তূর্য

অনুক্ষণ কাঁদে মন, অকারণ অকারণ

কোথা তুমি মহামঙ্গলময় হে।

কোথা সৌম্য শান্ত তব দীপ্ত ছবি

কোথা লাবণ্যপুঞ্জ হে ইন্দ্র রবি,

তুমি চিরজাগ্রত তুমি পুণ্য

রবিহীন আজি কেন মহাশূন্য

যুগে যুগে দাও তব আশিস অভয় হে॥

Sukanta Bhattacharya ।। সুকান্ত ভট্টাচার্য