বিলাস। বলতে পারি না।

বিজয়া। আপনি রাগ করলেন নাকি?

বিলাস। রাগ না করলেও পিতার অপমানে পুত্রের ক্ষুণ্ণ হওয়া বোধ করি অসঙ্গত নয়।

বিজয়া। কিন্তু এতে তাঁর অপমান হয়েছে এ ভুল ধারণা আপনার কোত্থেকে জন্মালো? তিনি স্নেহবশে মনে করেছেন আমার কষ্ট হবে। কিন্তু কষ্ট হবে না এইটাই শুধু ভদ্রলোককে জানিয়ে দিলুম। এতে মান-অপমানের ত কিছুই নেই বিলাসবাবু!

বিলাস। ওটা কথাই নয়! বেশ, আপনার স্টেটের দায়িত্ব নিজে নিতে চান নিন। কিন্তু এর পরে বাবাকে আমার সাবধান করে দিতেই হবে। নইলে পুত্রের কর্তব্যে আমার ত্রুটি হবে।

বিজয়া। এই সামান্য বিষয়টাকে যে আপনি এমন করে নিয়ে এ রকম গুরুতর করে তুলবেন এ আমি মনেও করিনি। ভাল, আমার বোঝবার ভুলে যদি অন্যায়ই হয়ে গিয়ে থাকে আমি অপরাধ স্বীকার করছি। ভবিষ্যতে আর হবে না।

বিলাস। তা হলে পূর্ণ গাঙ্গুলীকে জানিয়ে পাঠান যে, রাসবিহারীবাবু যে হুকুম দিয়েছেন তা অন্যথা করা আপনার সাধ্য নয়।

বিজয়া। সেটা কি ঢের বেশী অন্যায় হবে না? আচ্ছা আমি নিজেই চিঠি লিখে আপনার বাবার অনুমতি নিচ্ছি।

বিলাস। এখন অনুমতি নেওয়া না-নেওয়া দুই-ই সমান। আপনি যদি বাবাকে সমস্ত দেশের কাছে উপহাসের পাত্র করে তুলতে চান, আমাকেও তা হলে অত্যন্ত অপ্রিয় কর্তব্য পালন করতে হবে।

বিজয়া। (আত্মসংযম করিয়া) এই অপ্রিয় কর্তব্যটা কি শুনি?

বিলাস। আপনার জমিদারি শাসনের মধ্যে তিনি যেন আর হাত না দেন।

বিজয়া। আপনার নিষেধ তিনি শুনবেন মনে করেন?

বিলাস। অন্ততঃ, সেই চেষ্টাই আমাকে করতে হবে।

বিজয়া। (ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া) বেশ! আপনি যা পারেন করবেন, কিন্তু অপরের ধর্মেকর্মে আমি বাধা দিতে পারব না।

বিলাস। আপনার বাবা কিন্তু এ কথা বলতে সাহস পেতেন না।

বিজয়া। (ঈষৎ রুক্ষস্বরে) বাবার কথা আপনার চেয়ে আমি ঢের বেশী জানি বিলাসবাবু। কিন্তু সে নিয়ে তর্ক করে ফল নেই—আমার স্নানের বেলা হলো, আমি উঠলুম। (গমনোদ্যত)

বিলাস। মেয়েমানুষ জাতটা এমনই নেমকহারাম।

[বিজয়া পা বাড়াইয়াছিল। বিদ্যুৎবেগে ফিরিয়া দাঁড়াইয়া পলকমাত্র বিলাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া নিঃশব্দে ঘর হইতে চলিয়া গেল। এমনি সময় বৃদ্ধ রাসবিহারী ধীরে ধীরে প্রবেশ করিতেই পুত্র বিলাসবিহারী লাফাইয়া উঠিল]

বিলাস। বাবা, শুনেছ এইমাত্র কি ব্যাপার ঘটলো? পূর্ণ গাঙ্গুলী এবারও ঢাক ঢোল কাঁসি বাজিয়ে দুর্গাপূজা করবে, বারণ করা চলবে না। এইমাত্র তার কে একজন ভাগনে এসেছিল প্রতিবাদ করতে, বিজয়া তাকে হুকুম দিলেন পূজো হোক।

রাসবিহারী। তা তুমি এত অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলে কেন?

বিলাস। হব না? তোমার হুকুমের বিরুদ্ধে হুকুম দেবে বিজয়া? এবং আমার আপত্তি করা সত্ত্বেও?

রাস। কিন্তু এই নিয়ে তার সঙ্গে রাগারাগি করলে নাকি?

বিলাস। কিন্তু উপায় কি? আত্মসম্মান বজায় রাখতে—

রাস। দেখ বাপু, তোমার এই আত্মসম্মানবোধটা দিনকতক খাটো কর, নইলে আমি ত আর পেরে উঠিনে। বিয়েটা হয়ে যাক, বিষয়টা হাতে আসুক, তখন ইচ্ছে মত আত্মসম্মান বাড়িয়ে দিও, আমি নিষেধ করব না।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়