[বিজয়ার প্রবেশ]

রাসবিহারী। এই যে মা বিজয়া!

বিজয়া। আপনাকে আসতে দেখে আমি ফিরে এলুম কাকাবাবু। শুনে হয়ত আপনি রাগ করবেন, কিন্তু মোটে তিনদিন বৈ ত নয়, হোক গে গোলমাল—আমি অনায়াসে সইতে পারব, কিন্তু গাঙ্গুলীমশায়ের দুর্গাপূজায় বাধা দিয়ে কাজ নেই। আমি অনুমতি দিয়েছি।

রাস। সে কথাই বিলাস আমাকে বোঝাচ্ছিলেন! বুড়োমানুষ, শুনে হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠেছিলুম যে ভবিষ্যতে এ রকম পুনর্বার ঘটলে ত চলবে না। তখন আত্মসম্মান বজায় রাখতে তোমার বিষয় থেকে নিজেকে তফাত করতেই হবে। কিন্তু বিলাসের কথায় রাগ গেছে মা; বুঝেচি, অজ্ঞান ওরা—করুক পূজো। বরং পরের জন্য দুঃখ সওয়াটাই মহত্ত্ব! আশ্চর্য প্রকৃতি এই বিলাসের। ওর বাক্য ও কর্মের দৃঢ়তা দেখলে হঠাৎ বোঝা যায় না যে হৃদয় ওর এত কোমল। তা সে যাক, কিন্তু জগদীশের দরুন বাড়িটা যখন তুমি সমাজকেই দান করলে মা, তখন আর বিলম্ব না করে, এই ছুটির মধ্যেই এর সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ করে ফেলতে হবে। কি বল?

বিজয়া। আপনি যা ভাল বুঝবেন তাই হবে। টাকা পরিশোধের মেয়াদ ত তাদের শেষ হয়ে গেছে?

রাস। অনেকদিন। শর্ত ছিল, আট বৎসরের, কিন্তু এটা নয় বৎসর চলছে।

বিজয়া। শুনতে পাই তাঁর ছেলে নাকি এখানে আছেন। তাঁকে ডেকে পাঠিয়ে আরও কিছুদিনের সময় দিলে হয় না? যদি কোন উপায় করতে পারেন?

রাস। (মাথা নাড়িতে নাড়িতে) পারবে না—পারবে না—পারলে—

বিলাস। পারলেই বা আমরা দেব কেন? টাকা নেবার সময় সে মাতালটার হুঁশ ছিল না কি শর্ত করেছি? এ শোধ দেব কি করে?

বিজয়া। (বিলাসের প্রতি মাত্র একবার দৃষ্টিপাত করিল। রাসবিহারীর মুখের দিকে চাহিয়া শান্ত-দৃঢ়কণ্ঠে কহিল) তিনি বাবার বন্ধু ছিলেন, তাঁর সম্বন্ধে সসম্মানে কথা কইতে বাবা আমাকে আদেশ করে গেছেন।

বিলাস। (সগর্জনে) হাজার আদেশ করলেও সে যে একটা—

রাস। আহা চুপ কর না বিলাস। পাপের প্রতি তোমার আন্তরিক ঘৃণা যেন না পাপীর ওপর গিয়ে পড়ে। এইখানেই যে আত্মসংযমের সবচেয়ে প্রয়োজন বাবা।

বিলাস। না বাবা, এই-সব বাজে sentiment আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারিনে তা সে কেউ রাগই করুক আর যাই করুক। আমি সত্য কথা কইতে ভয় পাইনে, সত্য কাজ করতে পেছিয়ে দাঁড়াই নে।

রাস। তা বটে, তা বটে। তোমাকেই বা দোষ দেব কি। আমাদের বংশের এই স্বভাবটা যে বুড়ো বয়স পর্যন্ত আমারই গেল না! অন্যায় অধর্ম দেখলেই যেন জ্বলে উঠি। বুঝলে না মা বিজয়া, আমি আর তোমার বাবা এই জন্যই সমস্ত দেশের বিরুদ্ধে সত্যধর্ম গ্রহণ করতে ভয় পাইনি। জগদীশ্বর তুমিই সত্য। (এই বলিয়া দুই হাত কপালে ঠেকাইয়া উদ্দেশে নমস্কার করিলেন)

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়