তিন

কে রে, বিমল? আয় বোন বোস! বলিয়া নরেন্দ্র শয্যার উপরে উঠিয়া বসিল। তাহার উভয় ওষ্ঠপ্রান্তে ব্যথার যে চিহ্নটুকু প্রকাশ পাইল, তাহা বিমলার দৃষ্টি এড়াইল না।

অনেক দিন দেখিনি দিদি, ভাল আছিস ত?

বিমলার চোখ দুটি ছলছল করিয়া উঠিল। সে ধীরে ধীরে শয্যাপ্রান্তে আসিয়া বলিল, কেন দাদা, তোমার অসুখের কথা আমাকে এতদিন জানাও নি?

অসুখ তেমন কিছুই ছিল না বোন, শুধু সেই বুকের ব্যাথাটা একটু—

বিমলা হাত দিয়া এক ফোঁটা চোখের জল মুছিয়া ফেলিয়া বলিল, একটু বৈ কি! উঠে বসতে পার না—ডাক্তার কি বললে?

ডাক্তার? ডাক্তার কি হবে রে, ও আপনি সেরে যাবে।

এ্যাঁ! ডাক্তার পর্যন্ত ডাকাও নি? ক’দিন হল?

নরেন্দ্র একটুখানি হাসিয়া বলিল, ক’দিন? এই ত সেদিন রে। দিন-সাতেক হবে বোধ হয়।

সাত দিন! তা হলে বৌ সমস্ত দেখেই গেছে!

না না, দেখে যায়নি বোধ হয়—অসুখ আমার নিশ্চয় সে বুঝতে পারেনি। আমি তার যাবার দিনও উঠে গিয়ে বাইরে বসে ছিলুম। না না, হাজার হোক তাই কি তোরা পারিস বোন?

বৌ তা হলে রাগ করে গেছে, বল?

না, রাগ নয়, দুঃখ-কষ্ট—কত অভাব জানিস ত? ওদের এ-সব সহ্য করা অভ্যাস নেই, দেহটাও তার বড় খারাপ হয়েচে, নইলে অসুখ দেখলে কি তোরা রাগ করে থাকতে পারিস?

বিমলা অশ্রু চাপিয়া কঠিনস্বরে বলিল, পারি বৈ কি দাদা, আমাদের অসাধ্য কাজ কিছু নেই। না হলে, তোমরা বিছানায় না শোয়া পর্যন্ত আর আমাদের চোখে পড়ে না! ভোলা, পালকি এলো রে?

আনতে পাঠিয়েছি মা।

এর মধ্যেই যাবি দিদি? এখনো ত সন্ধ্যে হয়নি, আর একটু বোস না?

না দাদা, সন্ধ্যে হলে হিম লাগবে। ভোলা, পালকি একেবারে ভিতরে আনিস।

ভিতরে কেন, বিমল?

ভেতরেই ভাল দাদা। এই ব্যাথা নিয়ে তোমার বাইরে গিয়ে উঠতে কষ্ট হবে।

আমাকে নিয়ে যাবি? এই পাগল দেখ! কি হয়েচে যে, এত কাণ্ড করতে হবে? এ ত আমার প্রায়ই হয়। প্রায়ই সেরে যায়।

তাই যাক দাদা। কিন্তু ভাই ত আমার আর নেই যে, তোমাকে হারালে আর একটি পাব। ঐ যে পালকি—এই র‍্যাপারখানা বেশ করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ো। ভোলা, আর একটু এগিয়ে আনতে বল—না দাদা, এ সময়ে তোমাকে চোখে চোখে না রাখতে পারলে আমার তিলার্ধ স্বস্তি থাকবে না।

কিন্তু, নিয়ে যেতে চাইবি বুঝলে যে তোকে আমি খবরই দিতুম না।

বিমলা মুখপানে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, তোমাদের বোঝা তোমাদেরই থাক দাদা, আমাকে আর শুনিয়ো না। আচ্ছা, কি করে মুখে আনলে বল ত? এই অবস্থায় তোমাকে একলা ফেলে রেখে যেতে পারি? সত্যি কথা বল!

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়