চার
দিন-পনের পরে দুপুরের গাড়িতে ইন্দু মেয়ে লইয়া মেদিনীপুর হইতে ফিরিয়া আসিল। স্ত্রী ও কন্যাকে সুস্থ সবল দেখিয়া নরেন্দ্রর শীর্ণ পাণ্ডুর মুখ মুহূর্তে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। সাগ্রহে ঘুমন্ত কন্যাকে বুকে টানিয়া লইয়া প্রশ্ন করিল, কেমন আছ ইন্দু?
বেশ আছি। কেন?
তোমার জ্বরের মত হয়েছিল শুনে ভারী ভাবনা হয়েছিল। সেরে গেছে?
না হলে ডাক্তার ডাকাবে না কি?
নরেন্দ্রর হাসিমুখ মলিন হইল। কহিল, না, তাই জিজ্ঞাসা করচি।
কি হবে করে? এদিকে ত পঞ্চাশটি টাকা পাঠিয়ে চিঠির ওপর চিঠি যাচ্ছিল—কেমন আছ—কেমন আছ—সাবধানে থেকো—সাবধানে থেকো। আমি কি কচি খুকি, না, পঞ্চাশটি টাকা দাদা আমাকে দিতে পারতেন না? ও টাকা পাঠিয়ে সকলের কাছে আমার মাথা হেঁট করে দেবার কি দরকার ছিল? সেদিন বাড়িতে যেন একটা হাসি পড়ে গেল।
নরেন্দ্র ম্লান মুখ আরো ম্লান করিয়া অস্ফুটে কহিল, যোগাড় করতে পারলুম না।
না পাঠিয়ে তাই কেন লিখে দিলে না? উঃ—আবার সেই নিত্য নেই নেই—দাও দাও—বেশ ছিলুম এতদিন। বাস্তবিক বড়লোকের মেয়ে গরীবের ঘরে পড়ার মত মহাপাপ আর সংসারে নেই, বলিয়া সেই পরম সত্যে স্বামীর হৃদয় পূর্ণ করিয়া দিয়া ইন্দু অন্যত্র চলিয়া গেল।
মাসাধিক পরে স্বামী-স্ত্রীর এই প্রথম সাক্ষাৎ।
বাহিরে আসিয়া ইন্দু ইতস্ততঃ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া, নিজের শোবার ঘরে ঢুকিয়া ভারি আশ্চর্য হইয়া দেখিল, বাড়ির অন্যান্য স্থানের মত এখানেও সমস্ত বস্তু রীতিমত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হইতেছে। জিজ্ঞাসা করিল, এত ঝাড়ামোছা হচ্ছে কেন রে?
নূতন ঝি বলিল, আপনি আসবেন বলে।
আমি আসব বলে?
হাঁ মা, বাবু তাই ত বলে দিলেন। আপনি ময়লা কিছু দেখতে পারেন না—আজ তিন দিন থেকে তাই—
ইন্দু অন্তরের মধ্যে একটা বড়-রকমের গর্ব অনুভব করিল। কিন্তু সহজভাবে বলিল, ময়লা আবার কে দেখতে পারে? তবু ভাল যে—
হাঁ মা, লোক লাগিয়ে ওপর-নীচে সমস্ত সাফ করা হয়েচে।
ঝি, রামটহলটাকে একবার ডেকে দাও ত, বাজার থেকে কিছু ফলমূল কিনে আনুক।
ফলটল ত সব আছে মা। বাবু আজ সকালে নিজে বাজারে গিয়ে সমস্ত খুঁটিয়ে কিনে এনেছেন।
ডাব আছে? আঙুর—
আছে বৈ কি। এখনি নিয়ে আসচি, বলিয়া দাসী চলিয়া গেল। ইন্দুর মুখের উপর হইতে বিরক্তির মেঘখানা সম্পূর্ণ উড়িয়া গেল। বরং অনতিপূর্বে স্বামীর মলিন মুখখানা বুকের কোথায় যেন একটু খচখচ করিতেও লাগিল।
বিশ্রাম করিয়া ঘণ্টা-দুই পরে সে প্রসন্নমুখে স্বামীর বসিবার ঘরে ঢুকিয়া দেখিল, নরেন্দ্র চশমা খুলিয়া খুব ঝুঁকিয়া বসিয়া কি লিখিতেছে। কহিল, অত মন দিয়ে কি লেখা হচ্ছে?—কবিতা?
গল্প : দর্পচূর্ণ Chapter : 4 Page: 9
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: কবিতার বিষয়
- Read Time: 1 min
- Hits: 254