শিরোমণি। (এককড়ির প্রতি) বলি, অত্যধিক মদ্যপান করে নেই ত? তা হলে না হয়—

এককড়ি। মদ তিনি খান না! (হঠাৎ কণ্ঠস্বর সংযত করিয়া) কিন্তু যেতেও আর হবে না। হুজুর নিজেই আসছেন।

[জীবানন্দ ও প্রফুল্ল তর্ক করিতে করিতে প্রবেশ করিলেন]

জনার্দন। (কাছে গিয়া স্বাভাবিক ব্যাকুলতার সহিত) হুজুর, সমস্ত ব্যাপার একবার মনে করে দেখুন।

জীবানন্দ। কিসের রায়মশায়?

জনার্দন। জমি-বিক্রির ব্যাপারে হাকিম নিজে আসছেন তদন্ত করতে। হয়ত ভারী মকদ্দমাই বাধবে। কিন্তু আপনি নাকি—

জীবানন্দ। ওঃ! কিন্তু উপায় কি রায়মশায়? সাহেব জমি ছাড়তে চায় না, সে সস্তায় কিনেচে। মকদ্দমা ত বাধবেই। সুতরাং মামলা জেতা ছাড়া প্রজাদের আর ত পথ দেখিনে।

জনার্দন। (আকুল হইয়া) কিন্তু আমাদের পথ?

জীবানন্দ। (ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া) সে ঠিক, আমাদের পথও খুব দুর্গম মনে হয়।

জনার্দন। (মরিয়া হইয়া) এককড়ি তা হলে সত্যই বলেছে! কিন্তু হুজুর, পথ শুধু দুর্গম নয়—জেল খাটতে হবে, এবং আমরা একা নয়, আপনিও বাদ যাবেন না।

জীবানন্দ। (একটুখানি হাসিয়া) তাই বা কি করা যাবে রায়মশায়! শখ করে যখন গাছ পোঁতা গেছে, ফল তার খেতে হবে বৈ কি!

জনার্দন। (চীৎকার করিয়া) এ আমাদের সর্বনাশ করবে এককড়ি।

[পাগলের মত ঝড়ের বেগে জনার্দন বাহির হইয়া গেল, তাহার পিছনে এককড়ি নিঃশব্দে প্রস্থান করিল, নেপথ্যে কোলাহল]

জীবানন্দ।(ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে থাকিয়া) কারা যায় প্রফুল্ল?

প্রফুল্ল। বোধ হয় আপনার মাটি-কাটা ধাঙড়-কুলীর দল।

জীবানন্দ। একবার ডাক ত, ডাক ত হে। শুনি আজ বাঁধের কাজ কতখানি করলে।

প্রফুল্ল। (ঈষৎ অগ্রসর হইয়া) ওহে, ও সর্দার? শোন শোন, একবার শুনে যাও।

[স্ত্রী ও পুরুষ কুলীদের প্রবেশ]

সর্দার। কি রে, ডাকচিস্ কেনে?

জীবানন্দ। বাবারা, কোথায় চলেচিস বল্ ত?

সর্দার। ভাত খাবার লাগি রে।

জীবানন্দ। দেখিস বাবারা, আমার বাঁধের কাজ যেন বর্ষার আগেই শেষ হয়।

সকলে। (সমস্বরে) সব হোয়ে যাবে রে, সব হোয়ে যাবে। তুই কিছু ভাবিস্‌ না। চল্।

[কুলীদের প্রস্থান

[নির্মল প্রবেশ করিল]

জীবানন্দ। (সাদরে) আসুন, আসুন, নির্মলবাবু।

নির্মল। (নমস্কার করিয়া) আপনার সঙ্গে আমার একটু কাজ আছে।

জীবানন্দ। আর একদিন হলে হয় না?

নির্মল। না, আমার বিশেষ প্রয়োজন।

জীবানন্দ। তা বটে। অকাজের বোঝা টানতে যাঁকে আটক থাকতে হয় তাঁর সময় নষ্ট করা চলে না।

নির্মল। অকাজ মানুষে করে বলেই ত সংসারে আমাদের প্রয়োজন চৌধুরীমশাই।

জীবানন্দ। কিন্তু কাজের ধারণা ত সকলের এক নয় নির্মলবাবু। রায়মশায়ের আমি অকল্যাণ কামনা করিনে, এবং আপনার উদ্দেশ্য সফল হলে আমি বাস্তবিকই খুশী হব, কিন্তু আমার কর্তব্যও আমি স্থির করে ফেলেছি, এ থেকে নড়চড় করা আর সম্ভব হবে না।

নির্মল। এ কথা কি সত্য যে আপনি সমস্তই স্বীকার করবেন?

জীবানন্দ। সত্য বৈ কি।

নির্মল। এমন ত হতে পারে আপনার কবুল জবাবে আপনিই শুধু শাস্তি পাবেন, কিন্তু আর সকলে বেঁচে যাবেন।

জীবানন্দ। খুব সম্ভব বটে। কিন্তু সেজন্যে আমার কোন অভিযোগ নেই নির্মলবাবু। নিজের কৃতকর্মের ফল আমি একা ভোগ করলেই যথেষ্ট। নইলে রায়মশায় নিস্তার লাভ করে সুস্থদেহে সংসার-যাত্রা নির্বাহ করতে থাকুন এবং আমার এককড়ি নন্দীমশায়ও আর কোথাও গোমস্তাগিরি-কর্মে উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি লাভ করতে থাকুন, কারও প্রতি আমার আক্রোশ নেই।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়