তাহার কণ্ঠস্বরে বাহিরে হইতেও বুঝা গেল মেয়েটির চোখ দিয়া জল পড়িতেছে। বিজয় দুঃখিত হইল, মনে মনে খুশীও হইল। সে ভাবিয়াছিল ইহাকে বে-দখল করিতে না জানি কত সময় ও কত হাঙ্গামাই পোহাইতে হইবে, কিন্তু কিছুই হইল না, সে অশ্রুজলে শুধু দয়া ভিক্ষা চাহিল। তাহার পকেটের পিস্তল এবং দরোয়ানদের লাঠিসোঁটা তাহাকে গোপনে তিরস্কার করিল, কিন্তু দুর্বলতা প্রকাশ করাও চলে না। বলিল, থাকতে দিতে আপত্তি ছিল না, কিন্তু বাড়িতে আমার নিজের বড় দরকার। যেখানে আছি সেখানে খুব অসুবিধে, তা ছাড়া আমাদের বাড়ির মেয়েরা নিজের একবার দেখতে আসতে চান।
মেয়েটি বলিল, বেশ ত আসুন না। বাইরের ঘরগুলোতে আপনি স্বচ্ছন্দে থাকতে পারেন, এবং ভিতরে দোতলায় অনেকগুলো ঘর। মেয়েরা অনায়াসে থাকতে পারবেন কোন কষ্ট হবে না। আর বিদেশে তাঁদের ত লোকের আবশ্যক, আমি অনেক কাজ করে দিতে পারব।
এবার বিজয় সলজ্জে আপত্তি করিয়া কহিল, না না, সে কি কখনো হতে পারে! তাঁদের সঙ্গে লোকজন সবাই আসবে, তোমাকে কিছুই করতে হবে না। কিন্তু ভিতরের ঘরগুলো কি আমি একবার দেখতে পারি?
উত্তর হইল, কেন পারবেন না, এ ত আপনারই বাড়ি। আসুন।
ভিতরে ঢুকিয়া বিজয় পলকের জন্য তাহার সমস্ত মুখখানি দেখিতে পাইল। মাথায় কাপড় আছে কিন্তু ঘোমটায় ঢাকা নয়। পরনে একখানি আধময়লা আটপৌরে কাপড়, গায়ে গহনা নাই, শুধু দু’হাতে কয়েকগাছি সোনার চুড়ি—সাবেক কালের।আড়াল হইতে তাহার অশ্রু-সিঞ্চিত কণ্ঠস্বর বিজয়ের কানে বড় মধুর ঠেকিয়াছিল, ভাবিয়াছিল, মানুষটিও হয়ত এমনি হইবে। বিশেষতঃ, দরিদ্র হইলেও সে ত বড়ঘরের মেয়ে, কিন্তু দেখিতে পাইল তাহার প্রত্যাশার সঙ্গে কিছুই মিলিল না। রঙ ফরসা নয়, মাজা শ্যাম। বরঞ্চ একটু কালোর দিকেই। সাধারণ পল্লীগ্রামের মেয়ে আরও পাঁচজনকে যেমন দেখিতে তেমনি। শরীর কৃশ কিন্তু বেশ দৃঢ় বলিয়াই মনে হয়। শুইয়া বসিয়া ইহার আলস্যে দিন কাটে নাই তাহাতে সন্দেহ হয় না। শুধু বিশেষত্ব চোখে পড়িল ইহার ললাটে—একেবারে আশ্চর্য নিখুঁত গঠন।
মেয়েটি কহিল, বিনোদদা, বাবুকে তুমি সব দেখিয়ে আনো, আমি রান্নাঘরে আছি।
তুমি সঙ্গে যাবে না রাধুদিদি?
না।
উপরে উঠিয়া বিজয় ঘুরিয়া ঘুরিয়া সমস্ত দেখিল। ঘর অনেকগুলি। সাবেক কালের অনেক আসবাব এখনো ঘরে ঘরে, কতক ভাঙ্গিয়াছে, কতক ভাঙ্গার পথে। এখন তাহাদের মূল্য সামান্যই, কিন্তু একদিন ছিল। সদরবাটীর মত এ-ঘরগুলিও জরাজীর্ণ, হাড়পাঁজরা বার করা। দারিদ্র্যের দাগ সকল বস্তুতেই গাঢ় হইয়া পড়িয়াছে।
বিজয় নীচে নামিয়া আসিলে অনুরাধা রান্নাঘরের দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। দরিদ্র ও দুর্দশাপন্ন হইলেও ভদ্রঘরের মেয়ে, এবার তুমি বলিয়া সম্বোধন করিতে বিজয়ের লজ্জা করিল, কহিল, আপনি কতদিন এ-বাড়িতে থাকতে চান?
গল্প : অনুরাধা Chapter : 2 Page: 7
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: কবিতার বিষয়
- Read Time: 1 min
- Hits: 173