নরেন বলিল, কি জান মামী, হেবো টিফিনের সময় আমার খাবার নিয়ে যায় ত, সে ছুটে এসে বলে, কি খাবার দেখি নরেনদা? মা শুনে বলে, অমূল্য নজর দেয়।

অমূল্যর কেউ খাবার নিয়ে যায় না?

নরেন কপালে একবার হাত ঠেকাইয়া বলিল, কোথা পাবে মামী, তারা গরীব মানুষ, সে পকেটে করে দুটি ছোলা-ভাজা নিয়ে যায়, তাই টিফিনের সময় ওদিকের গাছতলায় নুকিয়ে বসে খায়।

বিন্দুর চোখের উপর ঘরবাড়ি সমস্ত সংসার দুলিতে লাগিল; সে সেইখানে বসিয়া পড়িয়া বলিল, নরেন তুই যা।

সেরাত্রে অনেক ডাকাডাকির পর বিন্দু খাইতে বসিয়া কোনমতেই হাত মুখে তুলিতে পারিল না, শেষে অসুখ করিতেছে বলিয়া উঠিয়া গেল। পরদিনও প্রায় উপবাস করিয়া পড়িয়া রহিল, অথচ কাহাকেও কোন কথা বলিতেও পারিল না, একটা উপায়ও খুঁজিয়া পাইল না। তাহার কেবলি ভয় করিতে লাগিল, পাছে কথা কহিলেই তাহার নিজের অপরাধ আরও বাড়িয়া যায়। অপরাহ্নে স্বামীর আহারের সময় অভ্যাসমত কাছে গিয়া বসিয়া অন্যদিকে চাহিয়া রহিল। কোনরূপ ভোজ্য পদার্থের দিকে কাল হইতে সে চাহিয়া দেখিতেও পারিল না।

ঘরে বাতি জ্বলিতেছে, মাধব নিমীলিত চোখে চুপ করিয়া পড়িয়া ছিলেন, বিন্দু আসিয়া পায়ের কাছে বসিল। মাধব চাহিয়া দেখিয়া বলিলেন, কি?

বিন্দু নতমুখে স্বামীর পায়ের একটা আঙুলের নখ খুঁটিতে লাগিল।

মাধব স্ত্রীর মনের কথাটা অনুমান করিয়া লইয়া আর্দ্র হইয়া বলিলেন,—আমি সমস্তই বুঝি বিন্দু, কিন্তু আমার কাছে কাঁদলে কি হবে? তাঁর কাছে যাও।

বিন্দু সত্যই কাঁদিতেছিল—বলিল, তুমি যাও।

আমি গিয়ে তোমার কথা বলব, দাদা শুনতে পাবেন না?

বিন্দু সে কথার জবাব না দিয়া বলিল—আমি ত বলচি, আমার দোষ হয়েচে—আমি ঘাট মানচি, তুমি তাঁদের বল গে।

আমি পারব না, বলিয়া মাধব পাশ ফিরিয়া শুইলেন।

বিন্দু আরও কতক্ষণ আশা করিয়া বসিয়া রহিল, কিন্তু মাধব কোন কথাই আর যখন বলিলেন না, তখন সে ধীরে ধীরে উঠিয়া গেল; স্বামীর ব্যবহারে তাহার বুকের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত একটা প্রস্তর-কঠিন ধিক্কার যোজন-ব্যাপী পর্বতের মত একনিমেষের মধ্যে পরিব্যাপ্ত হইয়া গেল। আজ সে নিঃসংশয়ে বুঝিল, তাহাকে সবাই ত্যাগ করিয়াছে।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়