বলবার হয়ত অনেক কিছু আছে, কিন্তু আজকের দিনে আমি সাহিত্য-বিচারে প্রবৃত্ত হব না।

শেষেরটা একটা নিবেদন। শ্রদ্ধা ও স্নেহের অভিনন্দন মন দিয়ে গ্রহণ করতে হয়, তার জবাব দিতে নেই।

আপনারা আমার পরিপূর্ণ হৃদয়ের কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করুন। ( ৫৫তম বাৎসরিক জন্মতিথিতে প্রেসিডেন্সি কলেজে বঙ্কিম-শরৎ সমিতি প্রদত্ত অভিনন্দনের উত্তরে পঠিত। )

যতীন্দ্র-সম্বর্ধনা

সামতাবেড়. পানিত্রাস
জেলা হাবড়া

কল্যাণীয়েষু,—

ভাই কালিদাস, তোমার চিঠি পেলাম। আমার একটা দুর্নাম আছে যে, আমি জবাব দিইনে। নেহাৎ মিথ্যে বলতে পারিনে, কিন্তু যে বিষয়টি নিয়ে তুমি নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছো তারও যদি সাড়া না দিই ত শুধু যে অসৌজন্যের অপরাধ হবে তাই নয়,কোন দিক থেকেই যে যতীনকে সমাদর করবার অংশ নিতে পারলাম না যে দুঃখের অবধি থাকবে না। অনেকেই জানে না যে, যতীনকে আমি সত্যই ভালোবাসি। শুধু কেবল কবি বলে নয়, তাঁর ভেতরে এমনি একটি স্নেহ-সরস, বন্ধু-বৎসল, ভদ্র মন আছে যে, তার স্পর্শে নিজের মনটাও তৃপ্তিতে ভরে আসে।

যতীন জানেন, আমি তাঁর কবিতার একান্ত অনুরাগী। যখন যেখানেই তাদের দেখা পাই, বার বার করে পড়ি। স্নিগ্ধ সকরুণ নির্ভুল ছন্দগুলি কানে কানে যেন কত-কি বলতে থাকে।

কারও সম্বন্ধেই নিজের অভিমত আমি সহজে প্রকাশ করিনে, আমার সঙ্কাচ বোধ হয়। ভাবি, আমার মতামতের মূল্যই বা কি, কিন্তু যদি কখনো বলতেই হয় ত সত্যি কথাই বলি! যতীনকে স্নেহ করি, কিন্তু স্নেহের অতিশয়োক্তি দিয়ে তাঁকেও খুশী করতে পারতাম না সত্যি না হলে। যাক এ কথা।

তোমাদের অনুষ্ঠানটি ছোট;—হবেই ত ছোট। কিন্তু তাই বলে তার দামটি ছোট নয়।

এ ত ঢেঁটরা দিয়ে বহুলোক ডেকে এনে উচ্চ কোলাহলে “জয়, যতীন বাগচী কী জয়!” বলার ব্যাপার নয়, এ তোমাদের ছোট্ট রসচক্রের প্রীতি-সম্মিলন। অর্থাৎ, কোন একটি বিশেষ দিনে ও বিশেষ স্থানে জন-কয়েক সত্যিকার সাহিত্য-রসিক ও সাহিত্য-সেবী এক সঙ্গে মিলে আর একজন সত্যিকার সাহিত্য-সেবককে সাদরে আহ্বান করে এনে বলা—“কবি, আমরা তোমার সাহিত্য-সাধনায় আনন্দলাভ করেচি, তোমার বাণীপূজা সার্থক হয়েছে,—তুমি সুখী হও, তুমি দীর্ঘায়ুঃ হও, আমরা তোমাকে সর্বান্তঃকরণে ধন্যবাদ দিই—তুমি আমাদের অভিনন্দন গ্রহণ কর।” এই ত? আয়োজন সামান্য বলে তোমরা ক্ষুণ্ণ হোয়ো না।

কিন্তু তবুও সম্মিলনে একটুখানি ত্রুটি ঘটলো,—আমি যেতে পারলাম না। কারণ আমি বোধ করি তোমাদের সকলের চেয়ে বয়সে বড়।

এ অঞ্চলটায় ব্যারাম-স্যারাম নেই, কিন্তু হঠাৎ কোথা থেকে হতভাগ্য ডেঙু এসে জুটেচে। সকাল থেকে ছোট ছেলেমেয়ে-দুটির চোক ছলছল করচে, চাকর জন-দুই ছাড়া সবাই বিছানা নিয়েছে, আমার এক নাক বন্ধ, অন্যটায় টিউব-ওয়েলের লীলা শুরু হয়েছে, রাত্রি নাগাদ বোধ হয় দেহ-মন-প্রাণ উৎসবে যোগ দিবেন, আভাস-ইশারায় তার খবর পৌঁছোচ্চে। নইলে এ অনুষ্ঠানে আমার নামে তোমাকে গর-হাজিরির ঢ্যারা টানতে দিতাম না।

অনেকে উপস্থিত আছো, এই সুযোগে একটা দুঃখের অনুযোগ জানাই। কালিদাস, তুমিও তো প্রায় সাবালক হতে চললে। আগেকার দিনের সকল কথা তোমার স্মরণ না থাকলেও কিছু কিছু হয়ত মনে পড়বে, এ দিনের মত সেদিনে আমরা এমন করে পরস্পরের ছিদ্র খুঁজে বেড়াতাম না, এক-আধটা ব্যতিক্রম হয়ত ঘটেচে, কিন্তু এখনকার সঙ্গে তার তুলনাই হয় না।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়