সাহিত্য-সেবকদের মাঝখানে ভাবের আদান-প্রদান, একের কাছে অপরের দেওয়া এবং পাওয়া চিরদিনই চলে আসচে এবং চিরদিনই চলবে। কিন্তু তরুণ দলের মধ্যে আজকাল এ কি হতে চললো? নিন্দে করার এ কি উদ্দাম উৎসাহ, গ্লানি প্রচারের এ কি নির্দয় অধ্যবসায়! কেবলি একজন আর একজনকে চোর প্রতিপন্ন করতে চায়। খবরের কাগজে কাগজে যত দেখি ততই যেন মন লজ্জায় দুঃখে পরিপূর্ণ হয়ে আসে। ক্ষমা নেই, ধৈর্য নেই, বেদনা বোধ নেই, হানাহানির নিষ্ঠুরতার যেন শেষ হতেই চায় না। কোথায় কার সঙ্গে কতটুকু মিলচে, কার লেখা থেকে কে কতটুকু নকল করেচে, রুক্ষ কটুকণ্ঠে এই খবরটা বিশ্বের দরবারে ঘোষণা করে যে এরা কি সান্ত্বনা অনুভব করে আমি ভেবেই পাইনে। ঘরে বাইরে কেবলি জানাতে চায় যে বাঙ্গালা দেশের সাহিত্যিকদের বিদেশের চুরি-করা ছাড়া আর কোন সম্বলই নেই।
যতীনকে জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারবে অতি পরিশ্রমে খুঁজে খুঁজে এই গোয়েন্দাগিরির কাজটা তখনও আমাদের সাহিত্যিক মহলে প্রচলিত হয় উঠেনি! যাই হোক কামনা করি তোমাদের রসচক্রের রসিকদের মধ্যে যেন এ ব্যাধি কখনও প্রবেশ করবার দরজা খুঁজে না পায়।
কবি নই, মনের মধ্যে কথা জমে উঠলেও তোমাদের মত প্রকাশের ভাষা খুঁজে পাইনে, গুছিয়ে বলা হয় না। তাই চিঠি লেখা হয়ে যায় আমার চিরদিনই এলোমেলো।
তা হোক গে এলোমেলো, তবু এমনি করেই বলি, তোমাদের রসচক্রের জয় হোক, তোমাদের আজকের আয়োজন সফল হোক, এবং যতীনকে বোলো শরৎদা তাঁকে এই চিঠির মারফৎ স্নেহাশীর্বাদ পাঠিয়েছেন। ইতি—৫ই ভাদ্র, ১৩৩৮। ( কলকাতার সাহিত্যিক ও শিল্পীদের সংস্থা ‘রসচক্রের’ পক্ষ থেকে কবি যতীন্দ্রনাথ বাগচীকে সম্বর্ধনা জানাবার ব্যবস্থা হলে, শরৎচন্দ্র তখন রসচক্রের সম্পাদক কবি কালিদাস রায়কে এই চিঠিটি লিখেছিলেন। )
শরৎদা।
শেষ প্রশ্ন
কল্যাণীয়াসু,—
হাঁ, ‘শেষ প্রশ্ন’ নিয়ে আন্দোলনের ঢেউ আমার কানে এসে পৌঁচেছে। অন্ততঃ, যেগুলি অতিশয় তীব্র এবং কটু সেগুলি যেন না দৈবাৎ আমার চোখ কান এড়িয়ে যায়, যাঁরা অত্যন্ত শুভানুধ্যায়ী তাঁদের সেদিকে প্রখর দৃষ্টি। লেখাগুলি সযত্নে সংগ্রহ করে লাল-নীল-সবুজ-বেগনী নানা রঙের পেন্সিলে দাগ দিয়ে, তাঁরা ডাকের মাশুল দিয়ে অত্যন্ত সাবধানে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এবং পরে আলাদা চিঠি লিখে খবর নিয়েছেন পৌঁছল কিনা। তাঁদের আগ্রহ, ক্রোধ ও সমবেদনা হৃদয় স্পর্শ করে।
নিজে তুমি কাগজ পাঠাও নি বটে, কিন্তু তাই বলে রাগও কম করোনি। সমালোচকের চরিত্র, রুচি, এমন কি পারিবারিক জীবনকেও কটাক্ষ করেছো। একবারও ভেবে দেখোনি যে শক্ত কথা বলতে পারাটাই সংসারে শক্ত কাজ নয়! মানুষকে অপমান করায় নিজের মর্যাদাই আহত হয় সব চেয়ে বেশি। জীবনে এ যারা ভোলে তারা একটা বড় কথাই ভুলে থাকে। তা ছাড়া এমন ত হতে পারে ‘পথের দাবী’ এবং ‘শেষ প্রশ্ন’ এর সত্যিই খুব খারাপ লেগেছে। পৃথিবীতে সব বই সকলের জন্যে নয়,—সকলেরই ভাল লাগবে এবং প্রশংসা করতে হবে এমন ত কোন বাঁধা নিয়ম নেই। তবে, সেই কথাটা প্রকাশ করার ভঙ্গীটা ভালো হয়নি, এ আমি মানি। ভাষা অহেতুক রূঢ় এবং হিংস্র হয়ে উঠেছে, কিন্তু এইটেই ত রচনা-রীতির বড় সাধনা।
প্রবন্ধ : স্বদেশ ও সাহিত্য Chapter : 1 Page: 63
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: কবিতার বিষয়
- Read Time: 1 min
- Hits: 179