ভৈরব আসিয়া বলিল, অমূল্যবাবু ইস্কুলে নেই।

বিন্দু তাহার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিল, হতভাগা! ছেলেরা রাত্রি পর্যন্ত ইস্কুলে থাকে? নূতন লোক তুমি? ও-বাড়িতে গিয়ে একবার দেখতে পারনি?

ভৈরব বলিল, সে-বাড়িতেও তিনি নেই।

বিন্দু চেঁচাইয়া বলিল, কোথায় কোন্‌ ছোটলোকদের ছেলের সঙ্গে ডাংগুলি খেলচে। আর কি তার প্রাণে ভয়-ডর আছে, এইবার একটা চোখ কানা হলেই বড়গিন্নীর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়! তা হলে দশ হাত বার করে খায়—যা, যেখানে পাস খুঁজে আন।

অন্নপূর্ণা ভাঁড়ারের দোরে বসিয়া আর পাঁচজন বর্ষীয়সীর সহিত কথাবার্তা কহিতেছিলেন। ছোটবৌর তীক্ষকন্ঠ শুনিতে পাইলেন।

ঘন্টা-খানেক পরে ভৈরব আসিয়া জানাইল, অমূল্যবাবু ঘরে আছে, এল না। বিন্দু বিশ্বাস করিতে পারিল না।

এল না কি রে? আমি ডাকচি বলেছিলি?

ভৈরব মাথা নাড়িয়া বলিল, হ্যাঁ, তবু এল না।

বিন্দু এক মুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, তার দোষ কি? যেমন মা, তেমনি ছেলে হবে ত! আমারো কটু দিব্যি রইল যে, অমন মা-ব্যাটার মুখ দর্শন করব না।

অনেক রাত্রে অন্নপূর্ণা বাটী ফিরিতে উদ্যত হইলে, পৌঁছাইয়া দিবার জন্য মাধব নিজে আসিয়া উপস্থিত হইল। বিন্দু দ্রুতপদে অদূরে আসিয়া স্বামীকে উদ্দেশ করিয়া ভীষণ-কন্ঠে বলিল, পৌঁছে দিতে ত যাচ্ছ, উনি জলস্পর্শ করেন নি, তা জান?

মাধব বলিল, সে তোমার জানবার কথা—আমার নয়। সমস্ত নষ্ট হয় দেখে, নিজে গিয়ে ডেকে এনেছিলাম, এখন নিজে পৌঁছে দিতে যাচ্ছি।

বিন্দু বলিল, বেশ ভাল কথা। তা হলে দেখচি তুমিও ঐদিকে।

মাধব জবাব না দিয়া বলিল, চল বৌঠান, আর দেরি ক’রো না।

চল ঠাকুরপো; বলিয়া অন্নপূর্ণা পা বাড়াইতেই বিন্দু গর্জন করিয়া বলিল, লোকে কথায় বলে দেইজী শত্রু। নিজের যা মুখে এলো, দশটা মিথ্যে সাজিয়ে বললে—কটকট করে দিব্যি করলে, চার দিন চার রাত ছেলের মুখ দেখতে দিলে না—ভগবান এর বিচার করবেন।

বলিয়া মুখে আঁচল গুঁজিয়া কান্না রোধ করিয়া রান্নাঘরের বারান্দায় আসিয়াই উপুড় হইয়া মূর্ছিত হইয়া পড়িল। একটা গোলমাল উঠিল; মাধব অন্নপূর্ণা দুইজনেই শুনিতে পাইলেন। অন্নপূর্ণা ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, কি হ’ল দেখি!

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়