কদম শশব্যস্তে পলায়ন করিল।

খানিক পরে মাধব আসিয়া কয়েকবার ডাকাডাকি করিয়া বলিল, ওগো শুনতে পাচ্ছ?

বিন্দু কাছে সরিয়া আসিয়া ঝঙ্কার দিয়া বলিয়া উঠিল, পাচ্ছি না। আমি পারব না। পারব না। পারব না! হ’ল?

মাধব অবাক হইয়া চাহিয়া রহিল।

বিন্দু বলিল, কি করবে? আমার গলায় ফাঁসি দেবে? না হয় তাই দাও, বলিয়া কাঁদিয়া দ্রুতপদে সরিয়া গেল।

বেলা বাড়িয়া উঠিতে লাগিল।

বিন্দু বিনা কাজে ছটফট করিয়া এ-ঘর ও-ঘর করিয়া কেবলি লোকের দোষ ধরিয়া বেড়াইতে লগিল। কে তাড়াতাড়ি পথের উপর কতকগুলো বাসন রাখিয়া গিয়াছিল, বিন্দু টান মারিয়া সেগুলো উঠানের উপর ফেলিয়া দিয়া, কি করিয়া কাজ করিতে হয় শিখাইয়া দিল; কার ভিজা কাপড় শুকাইতেছিল, উড়িয়া তাহার গায়ে লাগিবামাত্র টানিয়া খন্ড খন্ড করিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিয়া, কি করিয়া কাপড় শুকাইতে হয়, বুঝাইয়া দিল। যে কেহ তাহার সামনে পড়িল, সে-ই সভয়ে পাশ কাটাইয়া দাঁড়াইল।

পুরোহিত-বেচারা নিজে ভিতরে আসিয়া বলিলেন, তাই ত! বেলা বাড়তে লাগল—কোন বিলি-ব্যবস্থাই দেখিনে।—

বিন্দু আড়ালে দাঁড়াইয়া কড়া করিয়া জবাব দিল, কাজকর্মের বাড়িতে বেলা একটু হয়ই।বলিয়া আর একটা বাসন পা দিয়া ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়া আর একটা ঘরের মেঝের উপর নির্জীবের মত বসিয়া রহিল। মিনিট-দশেক পরে হঠাৎ তাহার কানে একটা পরিচিত কণ্ঠের শব্দ যাইবামাত্রই সে ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া দরজা দিয়া মুখ বাড়াইয়া দেখিল, অন্নপূর্ণা আসিয়া প্রাঙ্গণে দাঁড়াইলেন।

বিন্দু দুঃখে অভিমানে কাঁদিয়া ফেলিল। চোখ মুছিয়া সশব্দে সুমুখে আসিয়া গলায় আঁচল দিয়া হাতজোড় করিয়া বলিল, বেলা দশটা-এগারটা বাজে,আর কত শত্রুতা করবে দিদি? আমি বিষ খেলে তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয় ত তাই না হয় বাড়ি গিয়ে এক বাটি পাঠিয়ে দাও। বলিয়া চাবিব গোছাটা ঝনাৎ করিয়া তাঁহার পায়ের নীচে ফেলিয়া দিয়া নিজের ঘরে গিয়া দোর দিয়া মাটির উপর লুটাইয়া পড়িয়া কাঁদিতে লাগিল।

অন্নর্পূণা নিঃশব্দে চাবির গোছা তুলিয়া লইয়া দোর খুলিয়া ভাঁড়ারে গিয়া ঢুকিলেন।

অপরাহ্নে লোকজনের যাতায়াত, খাওয়ানো-দাওয়ানো ভিড় কমিয়া গিয়াছিল; তবুও বিন্দু কিসের জন্য কেবলি অস্থির হইয়া ঘর-বার করিতে লাগিল।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়