মহামহোপাধ্যায় স্বর্গীয় চন্দ্রকান্ত তর্কালঙ্কার মহাশয় তাঁহার শ্রীগোপাল মল্লিক ফেলোশিপের দ্বিতীয় লেক্চারে নামকরণ প্রণালীর মধ্যে বলিয়াছেন, “কেহ কেহ বলেন, মেরুতন্ত্রে লণ্ডন নগরের উল্লেখ আছে, অতএব উহা নিতান্ত আধুনিক। কিন্তু তাঁহাদের বিবেচনা করা উচিত যে, পুরাণাদিতে অনেক ভবিষ্যদুক্তি আছে। মেরুতন্ত্রেও ভবিষ্যদুক্তি স্থলেই লণ্ডন নগরের উল্লেখ আছে। সুতরাং তদ্দ্বারা মেরুতন্ত্রের আধুনিকত্ব প্রতিপন্ন হইতে পারে না। উহা যে ভবিষ্যদুক্তি, তাহা দেখাইবার জন্য মেরুতন্ত্র হইতে কিয়দংশ উদ্ধৃত হইতেছে—
“পূর্ব্বাম্নায়ে নবশতং ষড়শীতিঃ প্রকীর্ত্তিতা
ফিরিঙ্গি ভাষয়া মন্ত্রা যেষাং সংসাধনাৎ কলৌ।
অধিপামণ্ডলানাঞ্চ সংগ্রামেষ্বপরাজিতাঃ।
ইংরেজা নবষট্ পঞ্চ লণ্ড্রজাশ্চাপিভাবিনঃ।“
অথচ, স্বর্গীয় অক্ষয় দত্ত মহাশয় ছদ্ম শাস্ত্রকারগণের জুয়াচুরি সপ্রমাণ করিতে মেরুতন্ত্রের এই শ্লোকটাই তাঁহার ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়ে’র উপক্রমণিকায় উদ্ধৃত করিয়া গিয়াছেন। ইঁহাদের উভয়ের পাণ্ডিত্যই অতি গভীর ছিল, অথচ একজন যে শ্লোকের অস্তিত্বে শ্লাঘা বোধ করিয়াছেন, আর একজন তাহাকেই ঘৃণার সহিত বর্জন করিয়াছেন। এস্থলে কাহার বিচার সমীচীন, তাহা বুঝিতেও যেমন বিলম্ব হয় না, স্বর্গীয় মহামহোপাধ্যায় মহাশয়ের মত দেশপ্রসিদ্ধ পণ্ডিত চূড়ামণির মুখে এমন কথা, সংস্কৃত শ্লোকের উপর এতবড় অন্ধবিশ্বাস দেখিয়াও আর আশা-ভরসার স্থান থাকে না। পণ্ডিত মহাশয় আবার নিজেই বলিয়াছেন—মেরুতন্ত্রের প্রামাণ্যে সন্দেহ করিবার অন্য কারণ আছে। তাহা এই _পারস্য ভাষায় ও ফিরিঙ্গি ভাষায় যে সকল মন্ত্রের কথা বলা হইয়াছে, তত্তদ্ভাষাবিদেরা জানেন যে, বস্তুগত্যা উহাদের অস্তিত্ব নাই।
এইখানে অতি অনিচ্ছায় তাঁহার মনে একটু খটকা বাজিয়াছে। তা সে কিছুই নয়। পুরাণাদিতে যখন যোগবলে হাত গণিয়া ভবিষ্যৎ বলা হইয়াছে, মেরুতন্ত্রের গ্রন্থকারও তেমন হাত গণিয়া লণ্ডন নগরের এবং কলিকালের মন্ত্রসিদ্ধ ইংরাজের পরাক্রমের কথা বলিবেন, ইহা বিচিত্র কি? এইজন্য তিনি পূর্ব হইতেই সন্দেহকারীকে সতর্ক করিয়া পুরাণাদির ভবিষ্যদুক্তির কথা পাড়িয়াছেন। ধন্য বিশ্বাস! ধন্য যুক্তি! আমি জানি, আমার কথাগুলা অনেকেরই ভাল লাগিতেছে না এবং বিরুদ্ধ তর্ক করিবার ইচ্ছা থাকিলে অনেক রকমেই করা যাইবে। কিন্তু ইহা তর্কের কথা নহে, বিবাদ-বিসংবাদের বস্তু নহে; ভাবিবার বিষয়, কাজ করিবার সামগ্রী! স্বদেশ-বিদেশের শাস্ত্রে, ইতিহাসে, যাবতীয় জাতির আচার-ব্যবহার সম্বন্ধে আমার চেয়ে যাঁহার পড়াশুনা অধিক, তর্ক করিবার ইচ্ছা করিলে আমাকে পরাস্ত করিতে পারিবেন জানি, কিন্তু যে সত্য আমি হৃদয়ের ব্যথার ভিতর দিয়া বাহির করিলাম, সে সত্যকে কোন মহামহোপাধ্যায় যে উড়াইয়া দিতে সক্ষম হইবে না, তাহা নির্ভয়ে বলিতে পারি।
প্রবন্ধ : নারীর মূল্য Chapter : 1 Page: 15
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: কবিতার বিষয়
- Read Time: 1 min
- Hits: 322