বাস্তবিক, আমার হারজিত যাহাই কেন না হউক, এ কথাটা কিন্তু নিশ্চয় করিয়া দেখিবার সময় আসিয়াছে, যথার্থ সামাজিক প্রশ্নের মীমাংসার ভার সমাজের কাহাদের হাতে থাকা উচিত। যাঁহারা জোর করিয়া এতদিন করিয়া আসিয়াছেন, তাঁহারাও করুন। দুর্গাপূজার মহাষ্টমী দুই দণ্ড আগে বসিবে, কি পরে বসিবে, বিড়াল মারার প্রায়শ্চিত্ত এক কাহন কিংবা পাঁচ কাহন কড়ি প্রশস্ত, মহান্ত মহারাজেরা বেশ্যা রাখিলে স্বর্গে যায় কিংবা বিবাহ করিলে পতিত হয়, এ-সব মীমাংসা তাঁহারাই করিতে থাকুন, কিছুমাত্র আপত্তি করি না, কিন্তু সমাজের ভালো-মন্দ কিসে হয় না-হয়, কোন্ নিয়ম রাখিলে বা পরিবর্তন করিলে আধুনিক সমাজের কল্যাণ বা অকল্যাণ হইবে, স্বদেশের কাজে বিলাত গেলে জাতি যাইবে, কি যাইবে না, এ-সমস্ত দুরূহ বিষয়ে তাঁহাদের হাত দিতে যাওয়া অনধিকারচর্চা। এ-সমস্ত প্রশ্ন নিষ্পত্তি করার অধিকার দেশের শুধু তাঁহাদেরই জন্মিয়াছে, শিক্ষা যাঁহাদের হৃদয় প্রশস্ত করিয়া সার্থক হইয়াছে। স্বর্গীয় বিদ্যাসাগরের মত যাঁহাদিগকে সমাজের ভালো-মন্দ স্থির করিয়া দিতে ভগবান নিজের হাতে গড়িয়া পাঠাইয়াছেন, যাঁহাদিগকে দেশের লোক বড় বলিয়া মানিয়া লইয়াছে, এ-সমস্ত সামাজিক প্রশ্নের ভারও দেশের সেই-সমস্ত মহৎ লোকের উপর, ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতের উপর নহে। কেমন করিয়া জানিবে ইহারা, শাস্ত্র কেন শাস্ত্র? কোন্টা প্রতারণা? কি করিয়া বুঝিবে ইহারা, তখন কি দোষ-গুণ সমাজে বিদ্যমান ছিল, এখন কি দোষ-গুণ আছে? কোন্ টোলে এ আলোচনা হয়? কোন্ স্মৃতিরত্নের এ আলোচনা করিবার ধৈর্য এবং সাহস আছে? নিজের দলটি ছাড়া ইহাদের কাছে সবাই ম্লেচ্ছ, সবাই অশুচি। নিজেদের মতটি ছাড়া সমস্তই অশাস্ত্রীয়। নিজেদের আচার-ব্যবহার ভিন্ন জগতের সমস্ত আচার-ব্যবহারই কদর্য এবং হীন। এক কথায় নিজেরা ছাড়া আর কেহ মানুষই নয়। কালের সঙ্গে সঙ্গে যে নিয়মও বদলায়, এ সত্যের ইহারা কোন ধার ধারে না। তাই সময়োপযোগী কোন একটা নূতন পন্থা অবলম্বনের চেষ্টা হইবামাত্রই ইহারা ভয়ে সারা হইয়া যায়। কাঁদকাঁদ হইয়া জানায় শাস্ত্রের শ্লোকে খুঁজিয়া মিলিতেছে না, এবং প্রাণপণে বাধা দিয়া মনে করে, দেশের উপকার হইতেছে—শাস্ত্র বজায় হইতেছে।
অথচ ইহারাই কি সমস্ত শাস্ত্র মানিয়া চলে? শাস্ত্রে আছে, রাক্ষস বিবাহ। শাস্ত্রে আছে, আসুর বিবাহ। শাস্ত্রে আছে, ক্ষেত্রজ সন্তানের বিধি! আধুনিক সমাজে এইগুলা শুরু হইয়া গেলে ইহারা কি ভাল মনে করে? অথচ কেন করে না, জিজ্ঞাসা করিলেও ঠিক মত জবাব দিতে পারে না, তখন ঘুরাইয়া ফিরাইয়া নানারকম করিয়া বলিবার চেষ্টা করে, দেশাচার নয়—তেমন আবশ্যকও নয়—ভাল নয়—মানুষের নৈতিক বুদ্ধি অনুমোদন করে না, ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ এ কথা শাস্ত্রে থাকে থাক, আর একটা শাস্ত্রে উলটা শ্লোকও ত আছে! গান্ধর্ব বিবাহ, ক্ষেত্রজ সন্তানাদি নিজেদের সংসারে যখন কোনমতেই পছন্দ করি না, তখন আর কেহ করিলেও যত পারিব তত গালি দিব।
প্রবন্ধ : নারীর মূল্য Chapter : 1 Page: 16
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: কবিতার বিষয়
- Read Time: 1 min
- Hits: 204