শেষ-কথাটা অন্নপূর্ণাকে তীক্ষ্ণভাবে বিঁধিল, তথাপি তিনি নিরুত্তরে বসিয়া রহিলেন। কিন্তু বিন্দু যত বকিতেছিল, তাঁহার ক্রোধ উত্তরোত্তর ততই বাড়িতেছিল। সে পুনরায় চেঁচাইয়া বলিল, সব কথায় তুমি ন্যাকা সেজে বল, এইবারটি মাপ কর, কিন্তু দোষ তার তত নয়, যত তোমার। তোমাকে আমি মাপ করব না।

পাটীর দাসী-চাকরেরাও আড়ালে দাঁড়াইয়া শুনিতেছিল।

অন্নপূর্ণার আর সহ্য হইল না, তিনি বলিলেন, কি করবি—ফাঁসি দিবি?

বহ্নিতে আহুতি পড়িল, বিন্দু বারুদের মত জ্বলিয়া উঠিয়া বলিল, সেই তোমার উপযুক্ত শাস্তি।

নিজের ছেলেকে দুটো টাকা দিয়েছি, এই ত অপরাধ?

কি কথায় কি কথা আসিয়া পড়িল, বিন্দু আসল কথা ভুলিয়া বলিয়া বসিল, তাই বা দেবে কেন? নষ্ট করবার টাকা আসে কোথা থেকে?

অন্নপূর্ণা বলিলেন, টাকা তুই নষ্ট করিস নে?

আমি করি আমার টাকা, তুমি নষ্ট কর কার টাকা শুনি?

অন্নপূর্ণা এবার ভয়ঙ্কর ক্রদ্ধ হইয়া উঠিলেন। তিনি নিঃস্ব ঘরের মেয়ে ছিলেন। মনে করিলেন, বিন্দু সেই ইঙ্গিতই করিয়াছে। দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিলেন, তুই না হয় মস্ত বড় লোকের মেয়ে, কিন্তু তাই বলে আর কেউ যে দুটো টাকাও দিতে পারে না, সে অহঙ্কার করিস নে।

বিন্দু বলিল, সে অহঙ্কার আমি করিনে, কিন্তু তুমিও ভেবে দেখো একটা পয়সাও দিতে গেলে তুমি কার পয়সা দাও।

অন্নপূর্ণা চেঁচাইয়া উঠিলেন, কার পয়সা দিই? তোর যা মুখে আসে তাই বলিস? যা, দূর হয়ে যা সামনে থেকে।

বিন্দু বলিল, দূর—আমি রাত পোহালেই হব, কিন্তু কার পয়সা খরচ কর, সেটা দেখতে পাও না? কার রোজগারে খাচ্চ-পরচ, সেটা জান না?

হঠাৎ কথাটা বলিয়া ফেলিয়া বিন্দু স্তব্ধ হইয়া থামিল।

অন্নপূর্ণার মুখ সাদা হইয়া গিয়াছিল। তিনি ক্ষণকাল নির্নিমেষ-চোখে ছোটবৌয়ের মুখের প্রতি চাহিয়া বলিলেন, তোমার স্বামীর রোজগারে খাচ্চি-পরচি। আমি তোমার দাসী-বাঁদী, উনি তোমার চাকর-বাকর। এই না তোর মনের কথা? তা এতদিন বলিস নি কেন?

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়