মাধব বলিল, হয় আমি, না হয় ভগ্নীপতি প্রিয়বাবু করবেন। দাদা আসতে পারবেন না।

বিন্দু ক্রুদ্ধ হইয়া বলিল, আসতে পারবেন না বললেই হ’ল? তিনি থাকতে কি কারো অধিকার আছে? না না, সে হবে না—তিনি ছাড়া আমি কাউকে কিছু করতে দেব না।

মাধব বলিল, তবে বন্ধ থাক। তিনি বাড়ি নেই, কাজে গেছেন।

এ-সমস্ত বড়গিন্নীর মতলব! তা হলে সেও আসবে না দেখচি। বলিয়া বিন্দু কাঁদ-কাঁদ হইয়া চলিয়া গেল। তাহার কাছে পূজা-অর্চনা, উৎসব-আয়োজন, খাওয়ান-দাওয়ান, সমস্তই একমুহূর্তে একেবারে মিথ্যা হইয়া গেল। তিনদিন ধরিয়া অনুক্ষণ সে এই চিন্তাই করিয়াছে, আজ বঠ্‌ঠাকুর আসিবেন, দিদি আসিবেন, অমূল্য আসিবে। আজিকার সমস্তদিনব্যাপী কাজকর্মের উপর সে যে মনে মনে তাহার কতখানি নির্ভর করিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া বসিয়া ছিল, সে কথা সে ছাড়া আর কেহই জানিত না। স্বামীর একটা কথায় সে-সমস্ত মরীচিকার মত অন্তর্ধান হইয়া যাইবামাত্রই উৎসবের বিরাট পণ্ডশ্রম পাষাণের মত তাহার বুকের উপর চাপিয়া বসিল।

এলোকেশী আসিয়া বলিলেন, ভাঁড়ারের চাবিটা একবার দাও ছোটবৌ, ময়রা সন্দেশ নিয়ে এসেচে।

বিন্দু ক্লান্তভাবে বলিল, ঐখানে কোথাও এখন রাখ ঠাকুরঝি, পরে হবে।

কোথায় রাখব বৌ, কাকে-টাকে মুখ দেবে যে!

তবে ফেলে দাও গে, বলিয়া বিন্দু অন্যত্র চলিয়া গেল।

পিসিমা আসিয়া বলিলেন, হাঁ বিন্দু, এ-বেলা কতখানি ময়দা মাখবে, একবার যদি দেখিয়ে দিতিস।

বিন্দু মুখ ভার করিয়া বলিল, কতখানি মাখবে তার আমি কি জানি? তোমরা গিন্নী-বান্নী, তোমরা জান না?

পিসিমা অবাক হইয়া বলিলেন, শোন কথা! কত লোক তোদের এ-বেলা খাবে, আমি তার কি জানি?

বিন্দু রাগিয়া বলিল, তবে বল গে ওঁকে। সে ছিল দিদি; অমূল্যধনের পৈত্যের সময় তিনদিন ধরে শহরের সমস্ত লোক খেলে, তা একবার বলেনি, ছোটবৌ ওটা কর্‌ গে, সেটা দেখ্‌ গে! তার একটা হাড়ের যা যোগ্যতা, এ বাড়ির সমস্ত লোকের তা নেই। বলিয়া আর একটা ঘরে চলিয়া গেল।

কদম আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, দিদি, জামাইবাবু বলচেন পূজোর কাপড়-চোপড়গুলো—

তাহার কথা শেষ হইবার পূর্বেই বিন্দু চেঁচাইয়া উঠিল, খেয়ে ফ্যাল্‌ আমাকে, তোরা খেয়ে ফ্যাল্‌! যা দূর হ সামনে থেকে।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়