রমেশ। (পুনশ্চ তাহার মুখের প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া) তোমার কথার ভাবে মনে হয়, না গেলে আমার বিপদের সম্ভাবনা। ভালো, যাই-ই যদি তাতে তোমার লাভ কি? আমাকে বিপদে ফেলতে তুমি নিজেও ত কম চেষ্টা করোনি যে, আজ আর একটা বিপদে সতর্ক করতে এসেচো। সে-সব কাণ্ড এত পুরোনো হয়নি যে তোমার মনে নেই। বরঞ্চ খুলে বলো আমি চলে গেলে তোমার নিজের কি সুবিধে হয়,—হয়ত তোমার জন্যে আমি রাজী হতেও পারি।

রমা। (এই কঠিন আঘাতে রমার মুখ বিবর্ণ হইয়া উঠিল, কিন্তু আপনাকে সে সামলাইয়া লইল) আচ্ছা, খুলেই বলচি। আপনি গেলে আমার লাভ কিছুই নেই, কিন্তু না গেলে অনেক ক্ষতি। আমাকে সাক্ষী দিতে হবে।

রমেশ। এই? মাত্র এইটুকু? কিন্তু সাক্ষী না দিলে?

রমা। না দিলে আমার মহামায়ার পূজোয় কেউ আসবে না, আমার যতীনের উপনয়নে কেউ খাবে না, আমার বারব্রত, ধর্মকর্ম,—না রমেশদা, আপনি যান আমি মিনতি করচি। থেকে, সব দিক দিয়ে আমাকে নষ্ট করবেন না।

রমেশ। (একমুহূর্ত মৌন থাকিয়া) বেশ, আমি যাবো। আমার আরব্ধ কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই যাবো,—কিন্তু নিজের কাছে নিজেকে কি জবাব দেব?

রমা। জবাব নেই। আর কেউ হলে জবাবের অভাব ছিল না, কিন্তু এক অতি ক্ষুদ্র নারীর অখণ্ড স্বার্থপরতার উত্তর আপনি কোথায় খুঁজে পাবেন রমেশদা! আপনাকে নিরুত্তরেই যেতে হবে।

রমেশ। বেশ, তাই হবে। কিন্তু আজ আমার সাধ্য নেই।

রমা। সত্যিই সাধ্য নেই?

রমেশ। না। তোমার সঙ্গে কে আছে তাকে ডাকো।

রমা। সঙ্গে আমার কেউ নেই। আমি একাই এসেচি।

রমেশ। একা এসেছো? সে কি কথা রানী,—একলা এলে কোন্‌ সাহসে?

রমা। সাহস এই ছিল যে, আমি নিশ্চয় জানতাম এই পথে আপনার দেখা পাবো। তার পরে আর আমার ভয় কিসের?

রমেশ। ভালো করোনি রমা, সঙ্গে অন্ততঃ তোমার দাসীকেও আনা উচিত ছিল। এই নিস্তব্ধ জনহীন পথে আমাকেও ত তোমার ভয় করা কর্তব্য।

রমা। তোমাকে? ভয় করবো আমি তোমাকে?

রমেশ। নয় কেন?

রমা। (মাথা নাড়িয়া) না, কোনমতেই না। আর যা খুশি উপদেশ দাও রমেশদা, সে আমি শুনবো। কিন্তু তোমাকে ভয় করবার ভয় আমাকে দেখিয়ো না।

রমেশ। আমাকে তোমার এতই অবহেলা?

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়