মনু, পরাশর, হারীত—মিথ্যাই ইহাদের দোহাই পাড়া! এই যে পুরুষের চোখের উপরে অন্যায় অধর্ম করিবে, অথচ সতীত্ব বজায় রাখিবার জন্য তাহার স্ত্রী কথাটি মাত্র বলিতে পারিবে না (শাস্ত্র-বাক্য!), এমন কি, তাহার বীভৎস জঘন্য ব্যাধিগুলা পর্যন্ত জানিয়া শুনিয়া নিজ দেহে সংক্রামিত করিয়া লইতে হইবে, এর চেয়ে নারীর অগৌরবের কথা আর কি হইতে পারে?
তথাপি অন্যান্য দেশে আছে divorce—তথাকার রমণীর কতকটা উপায় আছে, কিন্তু আমাদের এই যে স্বয়ং ভগবানের দেশ, যে দেশের শাস্ত্রের মত শাস্ত্র নাই, ধর্মের মত ধর্ম নাই, যেখানে জন্মাইতে না পারিলে মানুষ মানুষই হয় না, সে দেশের নারীর জন্য এতটুকু পথ উন্মুক্ত রাখা হয় নাই। এ-দেশের পুরুষ রমণীকে হাত-পা বাঁধিয়া ঠেঙ্গায়, সে বেচারী নড়িতে চড়িতে পারে না। তাই পুরুষ বাহিরে আস্ফালন করিয়া বলিতে পায়, এ দেশের নারীর মত সহিষ্ণু জীব জগতে আর কোথায় আছে?
নাই, তাহা মানি। কিন্তু যে জন্য নাই, সে কারণটা কি পুরুষের বড়াই করিবার মত? বিদেশের সংবাদপত্রে যাই খবর বাহির হয়, অমুক অমুকের সহিত স্বামী-স্ত্রীর সম্বন্ধ ছেদ করিবার জন্য মকদ্দমা রুজু করিয়াছে, স্বদেশী কাগজওয়ালার তখন আর আহ্লাদ ধরে না—চেঁচাইয়া সে গাঁ ফাটাইতে থাকে, দেখ, চেয়ে দেখ, বিলাতী সভ্যতা!
তাহাদের মনের ভাব এই যে, পরের দোষগুলা প্রচার করিতে পারিলেই নিজেদের গুণগুলা মাথা ঝাড়া দিয়া উঠিবে। Divorce জিনিসটা যে বাঞ্ছনীয় নয়, সে কথা তাহারও বোঝে, কিন্তু মার খাইয়া তাহারা চুপ করিয়া থাকিতে পারে না—মারামারি করে। মারামারি জিনিসটা নিঃশব্দে হইবার বস্তু নয়, তাই সে কথা বাহিরের লোকে শোনে, এবং তাই শত্রুপক্ষ দাঁত বাহির করিয়া হাসিয়া আকুল হইয়া উঠিবার অবকাশ পায়। কিন্তু যদি জিজ্ঞাসা করা যায়, যে-কারণে ও-অঞ্চলে এ মকদ্দমা রুজু হয়, সে-কারণ কি হিন্দুর ঘরে ঘটে না? আমার বিশ্বাস, যে অতিবড় নির্লজ্জ, সেও বোধ করি, না বলিবে না। যদি তাই হয় তবে আহ্লাদ করিবার হেতু কোন্খানে থাকে? মকদ্দমাই কি আসল বস্তু, কারণটা কিছু নয়? ও-দেশেও এক সময় divorce ছিল না, কিন্তু মধ্যযুগের অকথ্য হীনতার মধ্যে পড়িয়াই এক সময় তাহাদের চৈতন্য হইয়াছিল। “Church’s irrational rigidity as regards divorce tended to foster disorder and shame. Sexual disorder increased. Woman became cheaper in the esteem of men, and the narrowing of her interest to domestic work the desire to please men proceeded apace.” শাস্ত্রের এই গোঁড়ামি নারীজাতিকে যে কত দুঃখে, কত নীচে নামাইয়া আনিয়াছিল, আচার্য K. Pearson তাঁহার Ethic of Free Thought গ্রন্থে অনেক রকমে তাহার আলোচনা করিয়া দেখাইয়া গিয়াছেন—নারী মাত্রকেই একবার তাহা পড়িতে অনুরোধ করি।
কিন্তু তাই বলিয়া আমাকে যেন এমন ভুল না বুঝা হয় যে, আমি divorce বস্তুটাকেই ভাল বলিতেছি।
প্রবন্ধ : নারীর মূল্য Chapter : 1 Page: 22
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: কবিতার বিষয়
- Read Time: 1 min
- Hits: 235