মারামারি জিনিসটাও ভাল জিনিস নয়, সমাজের মধ্যে ওটা ঘটিতে থাকে এ কামনা কেহ করে না, কিন্তু স্ত্রী-ত্যাগ বলিয়া একটা ব্যাপার যখন আমাদের মধ্যে আছে, তখন উভয় পক্ষেই ও-জিনিসটা কেন থাকা উচিত নয়, তাহা বলিতে পারি না।

অবশ্য পুরুষ এ কথা কিছুতেই মানিবে না যে, তাহার মত ত্যাগ করিবার ক্ষমতা তাহার স্ত্রীরও থাকে। কিন্তু কেন থাকিবে না, কেন অন্যান্য দেশের নারীর মত এই ন্যায্য অধিকার তাহাকে দেওয়া হইবে না, ইহারও সে কোন সঙ্গত কারণ নির্দেশ করিতে পারিবে না, শুধু জ্বলিয়া উঠিয়া জবাব দিবে, “দূর,—এও কি একটা কথা!”

এটা কথা নয়, কারণ তাহার অপরাধ করিবার অবাধ স্বাধীনতা খর্ব হয় ইহা সে চাহে না। বিশেষ করিয়া এ-দেশের পুরুষ, সে নিজে কাপুরুষ, ভীরু,—অন্যান্য দেশের পুরুষের তুলনায় যে নারীর মতই নিরুপায়, যে নারীর কাছে পুরুষ বলিয়া পরিচয় দিবার যথার্থ ক্ষমতা হইতে বঞ্চিত, সে কাপুরুষের মত তাহার অপেক্ষা দুর্বল ও নিরুপায়কেই পীড়ন করিয়া কর্তৃত্ব করার আনন্দ উপলব্ধি করিতে চাহিবে, তাহা স্বভাববিরুদ্ধ ব্যাপার নহে। সে যে মরিয়া গেলেও স্বেচ্ছায় এ অধিকারের এক পাইও ছাড়িয়া দিতে চাহিবে না, তাহা বুঝিতে পারা কঠিন নয়। সে যে শাস্ত্র আওড়াইবে, বিজ্ঞানের দোহাই পাড়িবে, সুনীতির ছদ্ম অভিনয় করিবে, তাহাও জানা কথা। কিন্তু নারীরও বুঝিয়া দেখার সময় হইয়াছে। যে পুরুষ স্ত্রীকে পথে রক্ষা করিতে পারিবে না জানিয়াই শাস্ত্র বানাইয়াছে, “পথি নারী বিবর্জিতা,” তাহার শাস্ত্রের ততটুকু মূল্যই দেওয়া উচিত এবং ইহাই সুবিচার।

আমার মনে হইতেছে, আমার কথাগুলা পুরুষদিগের ভাল লাগিতেছে না, এবং অন্তঃপুরেও এগুলা পৌঁছায় ইহাও তাহাদিগের ইচ্ছা হইতেছে না। কিন্তু যে দেশে অর্থশূন্য অত্যাচার-অবিচারের একটা সীমা পর্যন্ত নাই, সেদেশে কোন-না-কোনদিন নারী কারণ জানিতে চাহিবেই, পুরুষ তাহা পছন্দ করুক, আর নাই করুক। ফ্রান্সের নেপোলিয়নও একদিন ম্যাডাম কন্‌ডোরসেটকে বলিয়াছিলেন, “I do not like woman to meddle with Politics.” তাহাতে ম্যাডামও জবাব দিয়াছিলেন, “You are right General, but in a country where it is the custom to cut off the heads of woman, it is natural that they should wish to know the reason, why.”

মানুষ যখন মানুষ হইয়া উঠে নাই, তাহার পূর্বেও সে যে কার্য-কারণের অবিচ্ছিন্ন সম্বন্ধের আভাস পাইয়াছিল, আজকাল পণ্ডিতেরা তাহা আর অস্বীকার করেন না। সে যখন শামুক ছিল, তখনই অকস্মাৎ মেঘের ছায়ায় সূর্যের আলো মলিন দেখিয়া ভয়ে মুখ বুজিয়া আত্মরক্ষার চেষ্টা করিয়াছিল,—সে টের পাইয়াছিল ছায়া শুধু ছায়া নয়, তার সঙ্গে আর কিছু একটা আসিতেছে। যে আসিতেছে সে প্রবল, সে সন্নিকটবর্তী, হয়ত অপকার করিবে এই তার ভয়। ছায়ার কারণ দেখিয়া সে কার্য অনুমান করিয়াই দুর্গদ্বার আঁটিয়া বদ্ধ করিয়া দিয়াছিল।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়