ষোড়শী। কি আমাকে আপনি করতে বলেন?

জীবানন্দ। তোমাকে? (ক্ষণকাল স্তব্ধ থাকিয়া, দীপশিখা পুনরায় উজ্জ্বল করিয়া দিয়া) তা হলে এঁরা সকলে যে তোমাকে অসতী বলে—

ষোড়শী। এঁদের বিরুদ্ধে আপনার কাছে ত আমি নালিশ জানাই নি। আমাকে কি করতে হবে তাই বলুন। কারণ দেখাবার প্রয়োজন নেই।

জীবানন্দ। তা বটে। কিন্তু সবাই মিথ্যা কথা বলে, আর তুমি একাই সত্যবাদী এই কি আমাকে তুমি বোঝাতে চাও অলকা?

[ষোড়শী নিরুত্তর]

জীবানন্দ। একটা উত্তর দিতেও চাও না?

ষোড়শী। (মাথা নাড়িয়া) না।

জীবানন্দ। অর্থাৎ আমার কাছে কৈফিয়ত দেওয়ার চেয়ে দুর্নামও ভালো। বেশ, সমস্তই স্পষ্ট বোঝা গেছে! (এই বলিয়া তিনি ব্যঙ্গ করিয়া হাসিলেন)

ষোড়শী। স্পষ্ট বোঝা যাবার পরে কি করতে হবে তাই শুধু বলুন!

[তাহার এই উত্তরে জীবানন্দের ক্রোধ ও অধৈর্য শতগুণে বাড়িয়া গেল]

জীবানন্দ। কি করতে হবে সে তুমি জানো, কিন্তু আমাকে দেবমন্দিরের পবিত্রতা বাঁচাতেই হবে। এর যথার্থ অভিভাবক তুমি নয়, আমি। পূর্বে কি হতো জানিনে, কিন্তু এখন থেকে ভৈরবীকে ভৈরবীর মতই থাকতে হবে, না হয় তাকে যেতে হবে।

ষোড়শী। বেশ তাই হবে। যথার্থ অভিভাবক কে সে নিয়ে আমি বিবাদ করব না। আপনারা যদি মনে করেন আমি গেলে মন্দিরের ভালো হবে আমি যাব।

জীবানন্দ। তুমি যে যাবে সে ঠিক। কারণ, যাতে যাও সে আমি দেখব।

ষোড়শী। কেন রাগ করচেন, আমি ত সত্যিই যেতে চাচ্চি। কিন্তু আপনার ওপর এই ভার রইল যেন মন্দিরের যথার্থই ভাল হয়।

জীবানন্দ। কবে যাবে?

ষোড়শী। যখনই আদেশ করবেন। কাল, আজ, এখন—

জীবানন্দ। কিন্তু নির্মলবাবু? জামাইসাহেব?

ষোড়শী। (কাতর-কণ্ঠে) তাঁর নাম আর করবেন না।

জীবানন্দ। আমার মুখে তাঁর নামটা পর্যন্ত তোমার সহ্য হয় না। ভাল। কিন্তু কি তোমাকে দিতে হবে?

ষোড়শী। কিছুই না।

জীবানন্দ। এ ঘরখানা পর্যন্ত ছাড়তে হবে জানো? এও দেবীর।

ষোড়শী। জানি। যদি পারি, কালই ছেড়ে দেব।

জীবানন্দ। কোথায় যাবে ঠিক করেছ?

ষোড়শী। এখানে থাকব না, এর বেশি কিছুই ঠিক করিনি। একদিন কিছু না জেনেই আমি ভৈরবী হয়েছিলাম, আজ বিদায় নেওয়ার বেলাতেও এর বেশি ভাবব না। আপনি দেশের জমিদার, চণ্ডীগড়ের ভালোমন্দের ভার আপনার পরে রেখে যেতে শেষ সময়ে আর আমি দ্বিধা করব না। কিন্তু আমার বাবা ভারী দুর্বল, তাঁর উপরে নির্ভর করে যেন আপনি নিশ্চিন্ত হবেন না।

জীবানন্দ। তুমি কি সত্যিই চলে যেতে চাও নাকি?

ষোড়শী। আর আমার দুঃখী দরিদ্র ভূমিজ প্রজারা। একদিন তাদের সমস্তই ছিল—আজ তাদের মত নিঃস্ব নিরুপায় আর কেউ নেই। ডাকাত বলে বিনাদোষে লোকে তাদের জেল দিয়েছে। এদের সুখ-দুঃখের ভারও আমি আপনাকেই দিয়ে গেলাম।

জীবানন্দ। আচ্ছা, তা হবে হবে। কি তারা চায় বল ত?

ষোড়শী। সে তারাই আপনাকে জানাবে।

[এই বলিয়া সে সহসা জানালা দিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া দড়ির আলনা হইতে গামছা ও কাপড় হাতে লইল]

ষোড়শী। আমার স্নান করতে যাবার সময় হলো।

জীবানন্দ। স্নানের সময়? এই রাত্রে?

ষোড়শী। রাত আর নেই—এবার আপনি বাড়ি যান। (এই বলিয়া সে যাইতে উদ্যত হইল)

জীবানন্দ। (ব্যগ্রকণ্ঠে) কিন্তু আমার সকল কথাই যে বাকী রয়ে গেল?

ষোড়শী। থাক, আপনি বাড়ি যান।

জীবানন্দ। না। কোথায় যেন আমার মস্ত ভুল হয়ে গেছে অলকা, কথা আমার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি—

ষোড়শী। না সে হবে না, আপনি বাড়ি যান। আমার বহু ক্ষতিই করেছেন, এ জীবনের শেষ সর্বনাশ করতে আর আপনাকে দেব না।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়