ষোড়শী। কিন্তু আপনার যে কি কাজের কথা ছিল?

জীবানন্দ। কাজের কথা? কিন্তু কি যে ছিল আমার আর মনে পড়চে না। শুধু এই কথাই মনে পড়চে, তোমার সঙ্গে কথা কহাই আমার কাজ। অলকা, তোমার কি সত্যিই আবার বিয়ে হয়েছিল?

ষোড়শী। আবার কিরকম? সত্যি বিয়ে আমার একবার মাত্রই হয়েছে।

জীবানন্দ। আর তোমার মা যে তোমাকে আমাকে দিয়েছিলেন সেটাই কি সত্যি নয়?

ষোড়শী। না, সে সত্যি নয়। মা আমার সঙ্গে যে টাকাটা দিয়েছিলেন আপনি তাই শুধু নিয়েছিলেন, আমাকে নেননি। ঠকানো ছাড়া তার মধ্যে লেশমাত্র সত্য কোথাও ছিল না।

জীবানন্দ। (কিছুক্ষণ ধ্যানমগ্নের মত বসিয়া; যেন কতদূর হইতে কথা কহিল) অলকা, এ কথা তোমার সত্য নয়।

ষোড়শী। কোন্ কথা?

জীবানন্দ। তুমি যা জেনে রেখেচ। ভেবেছিলাম সে কাহিনী কখনো কাউকে বলব না, কিন্তু সেই কাউকের মধ্যে আজ তোমাকে ফেলতে পারচি নে! তোমার মাকে ঠকিয়েছিলাম, কিন্তু ভগবান তোমাকে ঠকাবার সুযোগ আমাকে দেননি। আমার একটা অনুরোধ রাখবে?

ষোড়শী। বলুন?

জীবানন্দ। আমি সত্যবাদী নই; কিন্তু আজকের কথা আমার তুমি বিশ্বাস কর। তোমার মাকে আমি জানতাম, তাঁর মেয়েকে স্ত্রী বলে গ্রহণ করবার মতলব আমার ছিল না—ছিল কেবল তাঁর টাকাটাই লক্ষ্য। কিন্তু সে রাত্রে হাতে হাতে তোমাকে যখন পেলাম, তখন না বলে ফিরিয়ে দেওয়ার ইচ্ছেও আর হলো না॥

ষোড়শী। তবে কি ইচ্ছে হলো?

জীবানন্দ। থাক, সে তুমি আর শুনতে চেয়ো না। হয়ত শেষ পর্যন্ত শুনলে আপনিই বুঝবে, এবং সে বোঝায় ক্ষতি বৈ লাভ আমার হবে না। কিন্তু এরা তোমাকে যা বুঝিয়েছিল তা তাই নয়, আমি তোমাকে ফেলে পালাই নি।

ষোড়শী। আপনার না পালানোর ইতিবৃত্ত এখন ব্যক্ত করুন।

জীবানন্দ। আমি নির্বোধ নই, যদি ব্যক্তই করি, তার সমস্ত ফলাফল জেনেই করব। তোমার মায়ের এতবড় ভয়ানক প্রস্তাবেও কেন রাজি হয়েছিলাম জানো? একজন স্ত্রীলোকের হার আমি চুরি করি; ভেবেছিলাম টাকা দিয়ে তাকে শান্ত করব। সে শান্ত হলো, কিন্তু পুলিশের ওয়ারেন্ট শান্ত হলো না। ছ’মাস জেলে গেলাম—সেই যে শেষ রাত্রে বার হয়েছিলাম, আর ফেরবার অবকাশ হলো না।

ষোড়শী। (রুদ্ধ-নিশ্বাসে) তার পরে?

জীবানন্দ। (মৃদু হাসিয়া) তার পরেও মন্দ নয়। জীবানন্দবাবুর নামে আরও একটা ওয়ারেন্ট ছিল। মাস-কয়েক পূর্বে রেলগাড়িতে একজন বন্ধু সহযাত্রীর ব্যাগ নিয়ে তিনি অন্তর্হিত হন। অতএব আরও দেড় বৎসর। একুনে বছর-দুই নিরুদ্দেশের পর বীজগাঁয়ের ভাবী জমিদারবাবু যখন রঙ্গমঞ্চে পুনঃপ্রবেশ করলেন, তখন কোথায় বা অলকা আর কোথার বা তার মা! (দু’জনেই ক্ষণিক নিস্তব্ধ হইয়া রহিল) আর একবার সভায় যেতে হবে। অলকা, আসি তা হলে!

ষোড়শী। সভায় আপনার অনেক কাজ, না গেলেই নয়। কিন্তু কিছু না খেয়েও ত যেতে পারবেন না।

জীবানন্দ। পারব না? তা হলে আনো। কিন্তু মস্ত বদ অভ্যেস আমার, খেয়ে আর নড়তে পারিনে।

ষোড়শী। না পারেন এখানেই বিশ্রাম করবেন।

জীবানন্দ। বিশ্রাম করব! যদি ঘুমিয়ে পড়ি অলকা?

ষোড়শী। (হাসিয়া) সে সম্ভাবনা ত রইলই। কিন্তু পালাবেন না যেন! আমি খাবার নিয়ে আসি।

[প্রস্থান

[গৃহকোণে একখানা পত্রের খণ্ডাংশ পড়িয়া ছিল, জীবানন্দের দৃষ্টি পড়িতেই তাহা সে তুলিয়া লইয়া দীপালোকে পড়িয়া ফেলিল। তাহার মুহূর্তকাল পূর্বের সরস ও প্রফুল্ল মুখের চেহারা গম্ভীর ও অত্যন্ত কঠিন হইয়া উঠিল। ষোড়শী খাবারের পাত্র লইয়া প্রবেশ করিল। তাহার মনে পড়িল ঠাঁই করা হয় নাই, তাই সে পাত্রটি তাড়াতাড়ি একধারে রাখিয়া আসনের অভাবে কম্বলই পুরু করিয়া পাতিল এবং নিজের একখানি বস্ত্র পাট করিয়া দিতেছিল, এমনি সময়ে জীবানন্দ কথা কহিলেন।]

জীবানন্দ। ও কি হচ্ছে?

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়