আমরা পাকা চুল এবং ন্যাড়া মাথা এক সঙ্গে গলা ফাটিয়ে বলচি ও-দু’টো অগুরু, চন্দনের সঙ্গে ল্যাভেন্ডার, ওডিকলোনের মত পরস্পরবিরোধী! উঃ! অগুরু চন্দন ও ল্যাভেন্ডার ওডিকলোন! এতবড় যুক্তির পরে দিলীপকুমারের আর কি বক্তব্য থাকিতে পারে আমরা তা ভাবিয়া পাই না।
অতঃপর বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় নালিশ করিতেছেন, “খাড়া পর্দা হতে খাড়া পর্দার উপরে সেইভাবে লাফিয়ে পড়া, যেভাবে কোন বীরপুঙ্গব স্বর্ণলঙ্কার এক ছাদ হতে আর এক ছাদে লাফিয়ে পড়েছিলেন ... ইত্যাদি ইত্যাদি।”
ইহা অতিশয় ভয়ের কথা! এবং প্রমথবাবুর সহিত আমি একযোগে ঘোরতর আপত্তি করি। যেহেতু ছাদের উপর নৃত্য শুরু করিলে আমরা, যাহারা নীচে সুনিদ্রায় মগ্ন, তাহাদের অত্যন্ত ব্যাঘাত ঘটে। তদ্ভিন্ন অন্য আশঙ্কাও কম নয়। কারণ আমরা যদিচ ন্যাড়ামাথা, কিন্তু স্বর্ণলঙ্কার প্রতি যিনি বিরূপ তিনি যদি বাঁড়ুয্যে মশায়ের পাকা চুলকে গায়ের সাদা লোম ভাবিয়া ছাদে লম্ফ দিতে বাধ্য করেন, ত বিপদের অবধি থাকিবে না।
প্রমথবাবু কহিতেছেন, “ধ্রুপদ ও খেয়াল দুই-ই ভারত-সঙ্গীতের দু’টি বিচিত্র ও মৌলিক বিকাশ, কিন্তু এ দুয়ের মধ্যে ধ্রুপদই যে অধিক সৌন্দর্যশালী, তা নিরপেক্ষ সঙ্গীতজ্ঞ মাত্রেই স্বীকার করবেন।”
স্বীকার করিতে বাধ্য! স্বীকার না করিলে তিনি হয় নিরপেক্ষ নহেন, না হয় সঙ্গীতজ্ঞ নহেন। হেতু? হেতু এই যে, একজন পাকাচুল এবং একজন ন্যাড়ামাথা উভয়ে সমস্বরে বলিতেছি! জোর করিয়া বলিতেছি! ইহার পরেও যে সংসারে কি যুক্তি থাকিতে পারে আমরা ত ভাবিয়া পাই না! আমরা পুনশ্চ বলিতেছি যে, “ধ্রুপদ হচ্চে সব রীতির গানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ, গরিষ্ঠ ও পূজ্যতম!” দুনিয়ায় এমন অর্বাচীন কে আছে যে, এতবড় অখণ্ড যুক্তির সম্মুখেও লজ্জায় অধোবদন না হয়! তবু ত শক্তিশেল হানিলাম না। বাঁড়ুয্যে মহাশয়ের ‘মুখপাতের’ যুক্তিটা চাপিয়া গেলাম।
আমাদের ওস্তাদদের সম্বন্ধে দিলীপকুমার বলিয়াছেন যে, আমরা ছাত্রদের পক্ষে মাছিমারা নকলের পক্ষপাতী, অর্থাৎ ছাত্রদের আমরা গ্রামোফোন করিয়াই রাখিতে চাই, দিলীপকুমারের এ অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
প্রমথবাবু ত স্পষ্টই বলিতেছেন, “আমি ত কোন দিনই আমার ছাত্রদের নিজস্ব ব্যক্তিত্বকে দাবিয়ে রাখবার চেষ্টা করিনি,—কেন না, স্বাধীন স্ফূর্তির অবসর না দিলে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়।...ইত্যাদি।”
আমার নিজের ছাত্রদের সম্বন্ধেও আমার ঠিক ইহাই অভিমত। এবং শিক্ষাদানের যথার্থ উদ্দেশ্য বিফল হইয়া যায় তাহা আমরা কেহই চাহি না। (অবশ্য কিঞ্চিৎ অবান্তর হইলেও এ কথা বোধ করি এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আমার নিজের ছাত্র নাই। কারণ, যথেষ্ট চেষ্টা করা সত্ত্বেও কোন ছাত্রই আমার কাছে শিখিতে চাহে না। লোকের মুখে-মুখে শুনিতে পাই, এমন দুর্বিনীত ছাত্রও আছে, যে বলে যে ওঁর কাছে শেখার চেয়ে বরঞ্চ প্রমথবাবুর কাছে গিয়া শিখিব।)
সে যাই হউক, কিন্তু ছাত্রদের সম্বন্ধে আমরা উভয়েই দিলীপকুমারের অভিযোগের পুনঃ পুনঃ প্রতিবাদ করি। এইরূপ হীন পন্থা আমরা কেহই অবলম্বন করি না। উনিও না, আমিও না।
প্রবন্ধ : স্বদেশ ও সাহিত্য Chapter : 1 Page: 44
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: কবিতার বিষয়
- Read Time: 1 min
- Hits: 215