তিনি স্পষ্টই বলেন, সা রে গা মা আর কিছুই নয়, সা’র পরে জোরে চেঁচাইলেই রে হয়, এবং আরও একটু চেঁচাইলে গা হয়, এবং আর ও জোর করিয়া একটুখানি চেঁচাইলে গলায় মা সুর বাহির হয়। খুব সম্ভব, তাঁহারও মতে উচ্চ সঙ্গীত ‘ভাবগত’, ‘পর্দাগত’ নয়। এবং ইহাই সপ্রমাণ করিতে হারমোনিয়মের চাবি টিপিয়া ধরিয়া নাগ মহাশয় ভাবগত হইয়া যখন উচ্চাঙ্গ-সঙ্গীতের শব্দ-পরম্পরা সৃজন করিতে থাকেন, সে এক দেখিবার শুনিবার বস্তু। শ্রীযুক্ত প্রমথবাবুর সঙ্গীত-তত্ত্বের সহিত তাঁহার যে এতাদৃশ মিল ছিল, আমিও এতদিন তাহা জানিতাম না। আর তখন দ্বারদেশে যে প্রকারের ভিড় জমিয়া যায় তাহাতে প্রমথবাবুর উল্লিখিত ওস্তাদজীর রেয়াজের গল্পটির সহিত এমন বর্ণে বর্ণে যে সাদৃশ্য আছে তাহাও লক্ষ্য করিবার বিষয়।

প্রমথবাবু বলিতেছেন, “যে চালের ধ্রুপদ লুপ্তপ্রায় হয়েছে, এবং যা লুপ্ত হয়ে গেলেও দিলীপকুমারের মতে আক্ষেপ করবার কিছুই নেই, আমার মতে সেই হচ্চে খাঁটি উঁচুদরের ধ্রুপদ। এ ধ্রুপদের নাম খাণ্ডারবাণী ধ্রুপদ!”

ঠিক তাহাই। আমারও মতে ইহাই খাঁটি উঁচুদরের ধ্রুপদ। এবং, মনে হইতেছে নাগ মহাশয় সম্প্রতি এই খাণ্ডারবাণী ধ্রুপদের চর্চাতেই নিযুক্ত আছেন। তাঁহার জয় হউক।

বৈশাখের ‘ভারতী’তে দিলীপকুমার কোন্‌ ওস্তাদজীকে মল্লযোদ্ধা এবং কোন্‌ ওস্তাদজীর গলায় বেসুরা আওয়াজ বাহির হইবার কথা লিখিয়াছেন, আমি পড়ি নাই কিন্তু অনেকের সম্বন্ধেই যে এই দু’টি অভিযোগই সত্য, তাহা আমিও আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় সত্য বলিয়া জানি। প্রমথবাবু বাঙ্গালাদেশের প্রতি প্রসন্ন নহেন। চাটুয্যে-বাঁড়ুয্যে মশায়ের মুখের গান তাঁহার ভাল লাগে না, কিন্তু বেশিদিনের কথা নয়, এই দেশেরই একজন চক্রবর্তীমশাই ছিলেন, প্রমথবাবুর বোধ করি তাঁহাকে মনে নাই।

প্রমথবাবু লিখিতেছেন, “যে জন্য আলাপের পর ধ্রুপদ, ধ্রুপদের পর খেয়াল এবং খেয়ালের পর টপ্পা ঠুংরির সৃষ্টি হয়েছিল, সেই জন্যই ওই-সবের পর বাঙ্গালা দেশে কীর্তন, বাউল ও সারি গানের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এই শেষোক্ত তিন রীতির সঙ্গীত আমার খাঁটি বাঙ্গালার জিনিস হলেও উচ্চ-সঙ্গীতের তরফ থেকে আমি তাদের বিকাশকে অভিনন্দন করতে পারি না। কেন?”

কেন? কেননা আমরা বলচি যে “তারা অতীতের সঙ্গে যোগভ্রষ্ট!”

কেন? কেননা আমরা বলচি “তারা অনেকটা ভুঁই-ফোঁড়ের মত নিজের বিচ্ছিন্ন অহঙ্কারে ঠেলে উঠেছে।” এমন কি একজনের পাকা চুল এবং আর একজনের ন্যাড়া মাথার অহঙ্কারের উপরেও।

কেন? কেননা, “আজকাল এইটেই বড় মজা দেখতে পাই যে, অতীতকে তুচ্ছ করে কেবল প্রতিভার জোরে ভবিষ্যৎ গড়তে আমরা সকলেই ব্যগ্র!”

শুধু প্রতিভার জোরে ভবিষ্যৎ গড়বে? সাধ্য কি! আমরা পাকা চুল এবং ন্যাড়া মাথা বলচি সে হবে না! বাধা আমরা দেবই দেব!

“আজকাল প্রতীচ্যের অনেক বিজাতীয় সঙ্গীতের স্রোত এমনি ভাবে আমাদের মনের মধ্যে ঢুকে পড়েচে যে, আমরা যখনই আমাদের প্রাচ্য সঙ্গীতের চাল বা প্রকাশ-ভঙ্গীকে এতটুকু বিচিত্র করতে যাই তখনই তা একটা জগাখিচুড়ি হয়ে ওঠে।”

কেন? কেননা আমরা বলচি, তা জগাখিচুড়ি হয়ে ওঠে!

কেন? কেননা আমরা বলচি,—একশ’বার বলচি, ও দু’টো তেল-জলের মত পরস্পরবিরোধী।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়