ভৈরব। ভগবান যেন আপনাকে দীর্ঘজীবী করেন, ভগবান যেন আপনাকে রাজা করেন―

[ইত্যাদি বলিতে বলিতে ভৈরবের প্রস্থান]

রমেশ। (দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া) সরকারমশাই, এই আমাদের গর্বের ধন। এই আমাদের শুদ্ধশান্ত ন্যায়নিষ্ঠ বাঙলার পল্লীসমাজ।

গোপাল। হাঁ, এই। সবাই জানবে এ কাজ বেণীবাবুর, সবাই গোপনে জল্পনা করে বেড়াবে, কিন্তু মুখ ফুটে কেউ এ অত্যাচারের প্রতিবাদ করবে না। সেবার গাঙ্গুলীমশাই বিধবা বড়ভাজকে মেরে বাড়ি থেকে বার করে দিলে, কিন্তু বেণীবাবু সহায় বলে সবাই চুপ করে রইল। সে কেঁদে সকলকে জানালে, সকলেই বললে, আমরা কি কোরব। ভগবানকে জানাও তিনিই এর বিচার করবেন।

রমেশ। তার পরে?

গোপাল। তার পরে সেই গাঙ্গুলীমশাই-ই সকলের জাত মেরে বেড়াচ্চেন। মৃত পল্লীসমাজ কথাটি বলবার সাহস রাখে না। অথচ, আমিই ছেলেবেলায় দেখেচি বাবু, এমন ধারা ছিল না। বিধবা বড়ভাজের গায়ে হাত দিয়ে কেউ সহজে নিস্তার পেত না। তখন সমাজ দণ্ড দিত, এবং সে দণ্ড অপরাধীকে মাথা পেতে নিতে হতো।

রমেশ। তবে কি পল্লীসমাজ বলে কিছুই আর নেই?

গোপাল। যা আছে সে ত এসে পর্যন্ত স্বচক্ষেই দেখচেন। যা আর্তকে রক্ষে করে না, দুঃখীকে শুধু দুঃখের পথেই ঠেলে দেয়, তাকেই সমাজ বলে কল্পনা করার মহাপাপ। আমাদের নিয়ত রসাতলের দিকেই টেনে নিয়ে যাচ্চে।

রমেশ। (আশ্চর্য হইয়া) সরকারমশাই, এ-সকল কথা আপনি জানলেন কার কাছে?

গোপাল। আমার স্বর্গীয় মনিবের কাছে। এইমাত্র যে ভৈরবকে উদ্ধার করতে চাইলেন, এ শক্তি আপনি পেলেন কোথায়? এ তাঁরই দয়া। এমনি কোরে বিপন্নকে উদ্ধার করতে তাঁকে যে আমি বহুবার দেখেচি ছোটবাবু।

রমেশ। (দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া) বাবা—

গোপাল। রাত প্রায় শেষ হয়ে এল বাবু, আপনি একটু শোন।

রমেশ। হাঁ শুই। আপনি বাড়ি যান সরকারমশাই।

[গোপাল সরকার প্রস্থান করিলেন। রমেশ শয়নের আয়োজন করিতেছিল,
সহসা দ্বারের কাছে কি একটা দেখিতে পাইয়া চমকিয়া প্রশ্ন করিল—]

রমেশ। কে? কে দাঁড়িয়ে?

[যতীন দ্বারের কাছে মুখ বাড়াইয়া]

যতীন। ছোড়দা, আমি।

রমেশ। (কাছে গিয়া) যতীন? এত রাত্রে? আমায় ডাকচ?

যতীন। হাঁ, আপনাকে।

রমেশ। আমাকে ছোড়দা বলতে তোমাকে কে বলে দিলে?

যতীন। দিদি।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়