রমেশ। রমা! তিনি কি তোমাকে কিছু বলতে পাঠিয়েছেন?

যতীন। না। দিদি বললেন, আমাকে সঙ্গে কোরে তোর ছোড়দার বাড়িতে নিয়ে চল্‌। ঐ যে ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন।

[এই বলিয়া সে দরজার বাহিরে চাহিল]

রমেশ। (ব্যস্ত হইয়া সরিয়া আসিয়া) আজ আমার একি সৌভাগ্য! কিন্তু আমাকে ডেকে না পাঠিয়ে এত রাত্রে নিজে এলে কেন? এস, ঘরে এস।

[রমা অত্যন্ত দ্বিধাভরে ভিতরে প্রবেশ করিয়া দ্বারের অনতিদূরে মেঝের উপর বসিয়া পড়িল। যতীন দিদির কাছে আসিয়া বসিতে যাইতেছিল, কিন্তু রমেশ তাহাকে একটি আরাম-কেদারায় আনিয়া শোয়াইয়া দিল]

রমা। রাত আর নেই, ভোর হয়ে এসেছে, (অধোমুখে) শুধু একটি জিনিস আপনার কাছে ভিক্ষে চেয়ে নেবো বলে আপনার বাড়িতে এসেচি। দেবেন বলুন?

রমেশ। আমার কাছে ভিক্ষে চাইতে? আশ্চর্য! কি চাই বল?

রমা। (মুখ তুলিয়া ক্ষণকাল অপলক-চক্ষে রমেশের মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল) আগে কথা দিন।

রমেশ। (মাথা নাড়িয়া) তা পারিনে। তোমাকে কোন প্রশ্ন না করেই কথা দেবার শক্তি যে তুমি নিজের হাতেই ভেঙ্গে দিয়েচ রমা।

রমা। আমি ভেঙ্গে দিয়েচি?

রমেশ। তুমিই। তুমি ছাড়া এ শক্তি সংসারে আর কারু ছিল না। রমা, আজ তোমাকে একটা সত্যি কথা বলব।—ইচ্ছে হয় বিশ্বাস কোরো, ইচ্ছে না হয় কোরো না। কিন্তু জিনিসটা যদি না মরে একেবারে নিঃশেষ হয়ে যেতো, হয়ত এ কথা তোমাকে কোনদিন শোনাতে পারতাম না। কিন্তু আজ নাকি আর কোন পক্ষেই লেশমাত্র ক্ষতির সম্ভাবনা নেই, তাই আজ জানাচ্চি, সেদিন পর্যন্তও তোমাকে অদেয় আমার কিছুই ছিল না। কিন্তু কেন জানো?

রমা। (মাথা নাড়িয়া জানাইল) না।

রমেশ। কিন্তু শুনে রাগ কোরো না। লজ্জাও পেয়ো না। মনে করো এ কোন পুরাকালের একটা গল্প শুনচ মাত্র। তোমাকে ভালবাসতাম রমা। মনে হয়, তেমন ভালবাসা বোধ হয় কেউ কখনো বাসেনি। ছেলেবেলায় মা’র মুখে শুনেছিলাম আমাদের বিয়ে হবে। তারপরে, যেদিন সমস্ত ভেঙ্গে গেল, সেদিন—কত বছর কেটে গেল, তবু মনে হয় সে বুঝি কালকের কথা।

[রমা তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া পলকের জন্য শিহরিয়া
আবার স্তব্ধ অধোমুখে নিশ্চল হইয়া রহিল]

রমেশ। তুমি ভাবছ তোমাকে এ-সব কাহিনী শোনানো অন্যায়। আমার মনেও এ সন্দেহ ছিল বোলেই সেদিন তারকেশ্বরে যখন একটি দিনের সমাদরে আমার সমস্ত জীবনের ধারা বদলে দিয়ে গেলে, সেদিনও চুপ করেই ছিলাম। চুপ করেই ছিলাম, কিন্তু সে নীরবতার ব্যথা মাপবার মানদণ্ড হয়ত শুধু অন্তর্যামীর হাতেই আছে।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়