বিজয়া। দয়ালবাবু, আপনি তা হলে এখন আসুন। নমস্কার।

[দয়ালের প্রস্থান

দয়ালবাবু গেছেন, এখন বলুন কি বলছিলেন?

বিলাস। বলছিলুম, আমি দরকারী কাজ সেরে রাখবার হুকুম দিয়েছিলুম, হয়নি কেন তার কৈফিয়ত চাই; বিপদের খবর জানতে চাইনে।

বিজয়া। দেখুন বিলাসবাবু, জগতের সবাই মিথ্যাবাদী নয়। সবাই মিথ্যা বিপদের দোহাই দেয় না, অন্ততঃ মন্দিরের আচার্য দেন না। সে যাক, কিন্তু আপনাকে জিজ্ঞাসা করি আমি, যখন জানেন দরকারী কাজ হওয়া চাই-ই তখন নিজে কেন সেরে রাখেন নি? আপনি কেন চারদিন কাজ কামাই করলেন? কি বিপদ আপনার হয়েছিল শুনি?

বিলাস। (হতবুদ্ধি হইয়া) আমি নিজে খাতা সেরে রাখব! আমি কামাই করলুম কেন?

বিজয়া। হাঁ আমি তাই জানতে চাই। মাসে মাসে দুশো টাকা মাইনে আপনি নেন। সে টাকা ত আমি শুধু শুধু আপনাকে দিইনে,—কাজ করবার জন্যই দিই।

বিলাস। আমি চাকর? আমি তোমার আমলা?

বিজয়া। কাজ করবার জন্যে যাকে মাইনে দিতে হয়, তাকে ও ছাড়া আর কি বলে? আপনার অসংখ্য অত্যাচার আমি নিঃশব্দে সয়ে এসেছি। কিন্তু যত সহ্য করেচি, অন্যায়-উপদ্রব ততই বেড়ে গেছে। যান, নীচে যান। প্রভু-ভৃত্যের সম্বন্ধ ছাড়া আজ থেকে আপনার সঙ্গে আর আমার কোন সম্বন্ধ থাকবে না। যে নিয়মে আমার অপর কর্মচারীরা কাজ করে, ঠিক সেই নিয়মে কাজ করতে পারেন করবেন, নইলে আপনাকে আমি জবাব দিলুম, আমার কাছারিতে আর ঢোকবার চেষ্টা করবেন না।

বিলাস। (লাফাইয়া উঠিয়া—দক্ষিণ হস্তের তর্জনী কম্পিত করিতে করিতে) তোমার এত দুঃসাহস?

বিজয়া। দুঃসাহস আমার নয়, আপনার। আমার এস্টেটেই চাকরি করবেন, আর আমার উপরেই জুলুম করবেন! আমাকে ‘তুমি’ বলবার অধিকার কে আপনাকে দিয়েছে? আমার চাকরকে আমারই বাড়িতে জবাব দেবার—আমার অতিথিকে আমারই চোখের সামনে অপমান করবার—এ-সকল স্পর্ধা আপনার কোথা থেকে জন্মাল?

বিলাস। (ক্রোধে উন্মত্তপ্রায় হইয়া) অতিথির বাপের পুণ্য যে সেদিন তার একটা হাত ভেঙ্গে দিইনি! নচ্ছার, বদমাইশ, জোচ্চোর, লোফার কোথাকার! আর কখনো যদি তার দেখা পাই—

[চিৎকার-শব্দে ভীত হইয়া কানাই সিং প্রভৃতি দরজায় আসিয়া উঁকি মারিয়া
দেখিতে লাগিল—বিজয়া লজ্জিত হইয়া কণ্ঠস্বর সংযত এবং স্বাভাবিক
করিয়া লইল]

বিজয়া। আপনি জানেন না, কিন্তু আমি জানি, সেটা আপনারই কত বড় সৌভাগ্য যে, তাঁর গায়ে হাত দেবার অতি-সাহস আপনার হয়নি। তিনি উচ্চশিক্ষিত ভদ্রলোক। সেদিন তাঁর গায়ে হাত দিলেও হয়ত তিনি একজন পীড়িত স্ত্রীলোকের ঘরের মধ্যে বিবাদ না করে সহ্য করেই চলে যেতেন। কিন্তু এই উপদেশটা আমার ভুলবেন না যে, ভবিষ্যতে তাঁর গায়ে হাত দেবার ইচ্ছা যদি আপনার থাকে ত পিছন থেকে দেবেন, সুমুখে এসে দেবার দুঃসাহস করবেন না। কিন্তু অনেক চেঁচামেচি হয়ে গেছে—আর না। নীচে থেকে চাকর-বাকর, দরোয়ান পর্যন্ত ভয় পেয়ে উপরে উঠে এসেছে—যান নীচে যান।

[বিলাস ক্রোধে বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হইয়া রহিল। তাহার অনলবর্ষী দৃষ্টি বিজয়ার গমনপথের
দিকে দৃঢ়-নিবদ্ধ রহিল। ব্যস্ত হইয়া রাসবিহারী প্রবেশ করিলেন]

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়