দয়াল। স্নেহ করি—খুবই করি সত্যি। তবু কথাটা আমার বাড়াবাড়ি নয় মা। অতবড় পণ্ডিত লোক, কিন্তু কথাগুলি যেমন মিষ্টি তেমনি শিশুর মত সরল। কিছুতে যেতে দিতে ইচ্ছে করে না, মনে হয় আরও কিছুক্ষণ ধরে রেখে দিই।

বিজয়া। ধরে রেখে দেন না কেন?

দয়াল। (হাসিয়া) সে কি হয় মা, তাঁর কত কাজ, কত পরিশ্রম তাঁকে করতে হয়। তবু গরীব বলে আমাদের ওপর কত দয়া। স্ত্রী রুগ্ন, তাঁকে দেখতে প্রায় ওঁকে আসতে হয়।

[বিলাস প্রবেশ করিল]

বিলাস। (বিজয়ার প্রতি) কেমন আছ আজ?

বিজয়া। ভালো আছি।

বিলাস। ভালো ত তেমন দেখায় না। (দয়ালের প্রতি) আপনি এখানে করছেন কি?

দয়াল। মাকে একবার দেখতে এলাম।

বিলাস। (টেবিলের উপর prescription-টার প্রতি দৃষ্টি পড়ায় হাতে তুলিয়ে লইয়া) prescription দেখচি যে। কার? (পরীক্ষা করিয়া) নরেনের নাম দেখচি যে! স্বয়ং ডাক্তারসাহেবের। কিন্তু এটা এল কি করে? (বিজয়া ও দয়াল উভয়েই নীরব)

বিলাস। শুনি না এল কি করে? ডাকে নাকি? হুঁ। ডাক্তার ত নরেন ডাক্তার? তাই বুঝি এদের ওষুধ খাওয়া হয় না; শিশির ওষুধ শিশিতেই পচে, তারপর ফেলে দেওয়া হয়? তা না হয় হলো—কিন্তু এই কলির ধন্বন্তরীটি কাগজখানি পাঠালেন কি করে? কার মারফতে? কথাটা আমার শোনা দরকার। (দয়ালের প্রতি) আপনি ত এতক্ষণ খুব lecture দিচ্ছিলেন—সিঁড়ি থেকেই গলা শোনা যাচ্ছিল—বলি, আপনি কিছু জানেন? একেবারে যে ভিজে বেড়ালটি হয়ে গেলেন। বলি জানেন কিছু?

দয়াল। আজ্ঞে হাঁ।

বিলাস। ওঃ—তাই বটে! কোথায় পেলেন সেটাকে?

দয়াল। আজ্ঞে তিনি আমার স্ত্রীকে দেখতে আসেন কিনা—আর বেশ সুন্দর চিকিৎসা করেন—তাই আমি বলেছিলুম, মা বিজয়ার জন্যে যদি একটা—

বিলাস। তাই বুঝি এই ব্যবস্থাপত্র? আপনি দাঁড়িয়েছেন মুরুব্বি? হুঁ। (একমুহূর্ত পরে) আপনাকে গেল বছরের হিসাবটা সারতে বলেছিলুম,—সেটা সারা হয়েছে?

দয়াল। আজ্ঞে, দু’দিনের মধ্যেই সেরে ফেলব।

বিলাস। হয়নি কেন?

দয়াল। বাড়িতে ভারী বিপদ যাচ্ছিল—নিজ হাতে রাঁধতে হতো—আসতেই পারিনি।

বিলাস। (বিদ্রূপ করিয়া) আসতেই পারিনি! তবে আর কি—আমাকে রাজা করেছেন। আমি তখনই বাবাকে বলেছিলুম—এ-সব বুড়ো-হাবড়া নিয়ে আমার কাজ চলবে না। এদের আমি চাইনে।

বিজয়া। (অনুচ্চ কঠিন-স্বরে) দয়ালবাবুকে এখানে কে এনেছে জানেন? আপনার বাবা নন—এনেচি আমি।

বিলাস। যেই আনুক, আমার জানবার দরকার নেই। আমি কাজ চাই—কাজের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ।

বিজয়া। যাঁর বাড়িতে বিপদ, তিনি কি করে কাজ করতে আসবেন?

বিলাস। অমন সবাই বিপদের দোহাই পাড়ে, কিন্তু সে শুনতে গেলে আমার চলে না। আমি দরকারী কাজ সেরে রাখতে হুকুম দিয়েছিলুম, হয়নি কেন, সেই কৈফিয়ত চাই। বিপদের খবর জানতে চাইনে।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়