ডায়রি লেখার অভ্যেস আমার মোটেও নেই। নতুন বছরের আগে আগে বেশ অনেক ডায়রি মেলে। প্রতিটি নতুন বছর আসার আগে ভাবি নিয়মিত রোজনামচা লিখব। এমন নয় যে শুরু করি না। প্রথম দিন লিখতে গিয়ে পুরো পাতা ভরে গেল, এমনকী মার্জিনেও লিখতে হল, এত কথা মনে। দ্বিতীয় দিনেও তাই। তৃতীয় দিনে মার্জিনে লেখার প্রয়োজন হল না। চতুর্থ দিনে পাতা অর্ধেক ভরল। পঞ্চম দিনে ভুলে গেছি লিখতে। ষষ্ঠ দিনের দিন বসে পঞ্চম আর ষষ্ঠ দুদিনের কথা লিখতে গিয়ে দেখা যায় কিছু খুঁজে পাচ্ছি না লেখার। অর্ধেকের চেয়ে কম ভরল পাতা। এরপর পুরো তিন দিন রোজনামচা লেখার কথা বেমালুম ভুলে বসে থাকি। হঠাৎ তিন দিন পর দুটো বাক্য লেখার পর তৃতীয় বাক্যটি অসমাপ্ত রেখে তখনকার জন্য ডায়রির চেয়ে অধিক জরুরি কোনও একটি বিষয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ক্রমে ক্রমে ডায়রির খাতাটির ওপর আরও বই খাতা জমে খাতাটি অদৃশ্য হয়ে থাকে কয়েক সপ্তাহ। তার পর একদিন টেবিল ঝেড়ে মুছে গোছাতে গিয়ে ধুলোর আস্তর জমে ওঠা ডায়রিটি হাতে পড়তে এক ঝলক আলো নাচে চোখে, মনে মনে বলি জ্ঞওহ তাই তো, আমার তো কথা ছিল প্রতিদিন এতে লিখব।’ কথা তো কত কিছুই থাকে। কটি কথা আর মানা হয়! টেবিল শেষ পর্যন্ত গোছানো হয় না, ডায়রির পাতা উল্টে উল্টে লেখাগুলো পড়ি। পড়তে পড়তে ভাবি, এখন থেকে বাকি দিনগুলোর কথা লিখে রাখব, জীবনের কত কথা ভুলে যাচ্ছি দিন দিন । যেদিন মনে হল, সেদিনের কথা দু ছষেন লিখে রেখে দিই, এর পর দিন লেখা আর হয় না। ভাবি এক সময় লেখা যাবে, এ আর এমন কী! মনে তো আছেই সব কিছু। মনে থাকবে। যে সব কাণ্ড ঘটে গেল, তা কি আর ভোলার মত। কিন্তু, আমার মস্তিষ্কটি আমার সঙ্গে প্রতারণা করে খুব। যে ঘটনাটি কখনও ভোলার নয় বলে বিশ্বাস করি, সেটিই কদিন পর মনেই পড়ে না কখনও ঘটেছিল। মন এক আশ্চর্য জিনিস। কোনও এক দুপুরে একটি লাল জামা পরে জামগাছের তলে দাঁড়িয়ে জাম খাচ্ছিল!ম, সেটি স্পষ্ট মনে আছে। কিন্তু কোন বছর আমি ডাক্তারি পাশ করেছি, সেটি দিব্যি ভুলে বসে আছি, এর ওর কাছে জিজ্ঞেস করতে হয়। প্রয়োজনের কথাটি মনে থাকে না, অপ্রয়োজনীয় কথায় মন বোঝাই হয়ে থাকে। মন জিনিসটি অদ্ভুত। কী জিনিস মন নেবে, কী নেবে না, তা আমার সাধ্য নেই অনুমান করি।

প্যারিসের দিনগুলির কিছু কিছু কথা জানি না কি কারণে লিখে রেখেছিলাম। কলকাতার দিনগুলির গল্প লিখে রাখলে সে গল্প শেষ হত না সহজে। কলকাতা প্যারিস নয়, কলকাতা আমাকে চেনে বেশি, প্যারিসের চেয়ে অনেক আপন এই কলকাতা, কলকাতা আমাকে নির্ভুল অনুবাদ করে। সবচেয়ে বড় কথা কলকাতাকে কখনও আমার বিদেশ বলে মনে হয় না। কলকাতায় পৌঁছে দেশে ফেরার মত আনন্দ হয় আমার। হোটেলে পৌঁছে সুটকেসটা রেখে বেরিয়ে যাবো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে এরকম ইচ্ছে নিয়ে হোটেলের ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখি ঘরের দরজায় লোহা লককর লাগানো, দরজার কাছে পুলিশ বসা।

–এ কী রে বাবা, এসব কেন?

–মেটাল ডিটেকটর লাগানো হয়েছে। এ তোমার নিরাপত্তার জন্য।

–কলকাতায় আমাকে কে কি করবে? কলকাতার মত নিরাপদ জায়গা পৃথিবীর আর কোথায় আছে?

–কলকাতায় মুসলমান মৌলবাদীর সংখ্যা কম নয়, তাদের মনে কী আছে কে জানে, সাবধানে থাকা ভাল।

মেটাল ডিটেকটর, পুলিশ পাহারা এসব আমাকে এমন লজ্জায় ফেলে যে মুখ গুঁজে বসে থাকি ঘরে। যেদিকে দু চোখ যায় সেদিকে যাবার, টই টই করে বাইরে ঘুরে বেড়াবার ইচ্ছেজ্ঞটর পায়ে একটি রূপোর শেকল পরানো হয়েছে। কিন্তু শেকল আমার ভাল লাগবে কেন! পুলিশের দরকার নেই আমার, এ কথাটি জোর গলায় বলার পরও কেউ আমার কথা মানলেন না। দরজার পুলিশদের আমি চাইলেও বিদেয় করতে পারি না।

আমার কলকাতায় থাকার আয়োজনটি আনন্দবাজার থেকে করা হয়েছে। যেদিন পত্রিকা আপিসে যাই চেনা পরিচিতদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য, অভীক সরকারের সঙ্গে দেখা হয়। খুব ব্যস্ত মানুষ তিনি। গণ্ডা গণ্ডা পত্রিকার মালিক হলে ব্যস্ততা থাকেই। অভীক সরকারের সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা কখনও হয় না, সম্ভব নয়। তাঁর সময় নেই। দুমিনিট কী তিনমিনিটের জন্য তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময় পাওয়াটাই সৌভাগ্য, সেটিরই ব্যবস্থা করতে অনেকদিন লেগে যায়। অভীক সরকার আমাকে একটি পরামর্শ দেন, কোনও সাংবাদিকের সঙ্গে যেন কথা না বলি। এদিকে কিন্তু সাংবাদিকরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, যেন আর কোনও কাজ নেই জগত সংসারে, এক আমার সঙ্গে কথা বলাই এ মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি। আমার ওপর এমন আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ার মূল কারণটি হল ফতোয়া। পবিত্র কোরান ও মহানবী হযরত মুহম্মদ সম্পর্কে আমার বইগুলোতে যেসব কথা আছে, সেসব পছন্দ হয়নি বলে সিলেটের হাবীবুর রহমান আমার মাথার মূল্য ঘোষণা করেছেন। এছাড়া কলকাতায় আমি এখন জনপ্রিয় এক লেখক, আমার লজ্জা বইটি নিয়ে বিতর্ক চলেছে বছর ভর। এত সব কারণের পর সাংবাদিকরা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে না এ ভাবাই যায় না। বেশি কিছু নয়, একটি সাক্ষাৎকার চায় তারা, আধ ঘন্টা না হলে কুড়ি মিনিট, তা না হলেও অন্তত পাঁচ মিনিট। কিন্তু গণহারে সকলকে বিদেয় করা হল। কী বলতে আবার কী বলে ফেলি, কী লিখতে তারা আবার কী লিখে ফেলে, ওদিকে বাংলাদেশের হাওয়া তেতে আছে আগে থেকেই, সুতরাং মৌলবাদী থেকে তো সাবধান থাকতেই হবে, সাংবাদিক থেকেও সাবধান।

একদিন টেলিভিশনের লোক এল, সঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমার সাক্ষাৎকার নেবেন। তাঁকে না বলে দিই কী করে! আনন্দবাজারের কর্তারাও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম শুনলে না বলতে পারেন না। আমি শরমে মরে যাই, আমি তো এত বড় হইনি যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমার সাক্ষাৎকার নেবেন! কিন্তু তিনি যখন নেবেনই, এবং আমার সাধ্য নেই তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া, অতএব প্রশ্নোত্তর (আমি কি জানি নাকি সব প্রশ্নের উত্তর!) বা সাক্ষাৎকারের মত না হয়ে আমিই প্রস্তাব করলাম এটি একটি আড্ডা হতে পারে। হল। দুই লেখকের আলাপচারিতা, এভাবেই ব্যাপারটিকে ধরে নেওয়া হল। কেবল তো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ই বন্ধু নন, সাংবাদিকদের মধ্যেও তো বন্ধু আছেন, তাঁদের যখন একের পর এক তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল, বড় অপ্রতিভ বোধ করছিলাম। কতদিন পর দেখা, সাক্ষাৎকার না হোক, দুটো কথা হোক না! কবি গৌতম ঘোষ দস্তিদার প্রতিদিন পত্রিকায় সাংবাদিকতা করছেন, চোখের সামনে তাঁকেও তাড়ানো হল। বাহারউদ্দিনকে তো নিচ তলা থেকে ওপরে উঠতেই দেওয়া হয় নি। এ কি কাণ্ড। বন্ধুরাই তো তবে শষনু হয়ে যাবে! এভাবে গণহারে তাড়ানো হচ্ছে সাংবাদিকদের! গৌতম ঘোষ দস্তিদার, যে আমার বিষম প্রশংসা করে লজ্জা বইটির সমালোচনা লিখেছিলেন, তিনিই কিন্তু এরপর চোখ উল্টে দিলেন। এ নিতান্তই ভুল বোঝাবুঝি। সাক্ষাৎকার না দিলে পত্রিকায় আমার সম্পর্কে লেখালেখি বন্ধ থাকবে, তা তো নয়, বরং বানিয়ে লেখা হবে। কথা বললে বরং বানানো গল্প থেকে নিস্তার পাওয়া যায়। নিখিল সরকারকে জানাই ঘটনা। তিনি বললেন, দুএকটি ভাল পত্রিকায় তাহলে দাও সাক্ষাৎকার। টাইমস অব ইণ্ডিয়া, টেলিগ্রাফ। স্টেটসম্যানও যোগ হল। ফোন আসছে মিনিট পর পর, অন্যান্য সাংবাদিকরা পাগল হয়ে যাচ্ছেন। দিল্লি বোম্বে থেকে এসে বসে আছেন। মায়া তাঁদের জন্যও হয়। হাতে গোনা জিনিস আর হাতে গোনার মধ্যে থাকে না। সাংবাদিকদের সঙ্গে একই রকম আলোচনা আর তাঁদের প্রায় একই ধরনের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। ক্লান্তি কাটে বন্ধুদের সঙ্গে সাহিত্যিক আলোচনা আর আড্ডায়। হোসেনুর রহমান কলকাতা ক্লাবে নিয়ে গেলেন একদিন, ওখানে তাঁর লেখক বুদ্ধিজীবী বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ হল। হোসেনুর রহমান ঢাকায় আমার বাড়ি গিয়েছিলেন একবার, তখনই তাঁর সঙ্গে পরিচয়। ঢাকা শহরে দিব্যি তিনি ধুতি পরে ঘুরে বেরিয়েছেন। কলকাতার যে কজন মুসলমান নামের মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে আমার, সকলকেই দেখেছি জাত ধর্ম না মানা মানুষ, বড় গৌরব বোধ করি তাঁদের নিয়ে। যে ইলা মিত্রকে কোনওদিন দূর থেকে দেখারও আমার সৌভাগ্য হবে বলে ভাবিনি, সেই ইলা মিত্র হঠাৎ একদিন হোটেলে এলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে, অনেকক্ষণ ছিলেন, মন খুলে কথা বলতে পারিনি, একের পর এক সাক্ষাৎপ্রার্থী এসে ভিড় করলে কথা কারও সঙ্গে ঠিক হয় না। দশ রকম মানুষের সঙ্গে একই সঙ্গে কথা বলা যায় কি! রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক, নারীবাদী, শিল্পী, অনুরাগী পাঠক, এই পাঠকদের মধ্যে ব্যবসায়ী থেকে বিজ্ঞানী সকলেই আছেন– একজনের সঙ্গে কিছু কথা হল তো আরেকজনের সঙ্গে হল না। আমার ইচ্ছে করে সবার সঙ্গে কথা বলতে। কাউকে আমার ফিরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে না। কত কিছু জানার আছে শেখার আছে ওঁদের থেকে। ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতাগুলো, জীবনদর্শনগুলো শুনতে ইচ্ছে করে। নারীবাদী লেখিকা মৈষেনয়ী চট্টোপাধ্যায় আমাকে অবাক করলেন আমাকে জড়িয়ে ধরে, ভেবেছিলাম তিনি বুঝি আমার মুখদর্শন কোনওদিন করবেন না। বললেন তিনিও পথে নেমেছেন আমার সমর্থনে। অন্নদাশংকর রায়ের বাড়িতে গেলাম এক সন্ধেয়, ওখানে অপেক্ষা করছিলেন অপরাজিতা গোপ্পীসহ তাঁর দল। সকলেই দেখা করতে চান, সকলেই কথা বলতে চান। কিন্তু সময়ের অভাবে কারও সঙ্গে খুব বেশি কথা বলা হয় না। এক রাতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে নেমন্তন্ন, সৌমিত্র মিত্র, মুনমুন মিত্র, বাদল বসু, কুমকুম বসু সহ খানা পানা গানা ভানায় রাত গভীর হয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মদ খেতে খেতে হাত মাথা নেড়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে থাকেন একের পর এক। গলাটা যেমন তেমন, সুর ভাল। স্বাতী, সুনীলের স্ত্রী বলেন, সুনীল তো রবীন্দ্রসঙ্গীত বানায়, কেউ ধরতেও পারে না। তা ঠিক, কত আর মুখস্ত থাকে সব গানের সব কলি, কোথাও ভুলে গেলে গান থামিয়ে না দিয়ে তিনি বানিয়ে গেয়ে যান। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে কী ধরনের শব্দ ব্যবহার করতেন, তা তো খুব অজানা নয়! ঘটে রবিজ্ঞান কিছু থাকলে য়চ্ছন্দে চালিয়ে নেওয়া যায়। কলেজের পরীক্ষার খাতাতেও রবীন্দ্রনাথ এই লিখেছেন সেই লিখেছেন বলে পাতার পর পাতা নিজের কথা লিখে যেতেন। কোন পরীক্ষকের সময় আছে খুঁজে দেখার রবীন্দ্রনাথ তাঁর কোন বইয়ে কোন কথাটি লিখেছিলেন! কেবল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্য সময় খরচ করে ফেললেই তো চলে না। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে তাঁর বাড়িতে একবার যেতেই হয়। যাই। নিখিল সরকারের বাড়িতে নেমন্তন্ন, ওখানে শান্ত হয়ে বসো, ধীরে সুস্থে কথা বলো, লেখালেখি কেমন হচ্ছে বলো, দেশের অবস্থা বলো, দেশের বন্ধুরা এই দুঃসময়ে পাশে আছে কী না বলো। জীবনের সব কথা খুলে বলি নিখিল সরকারকে। তিনি আপন। খুব আপন। এত আপন আমার আর কাউকে মনে হয় না। আসলে আপন হতে গেলে আত্মীয় হতে হয় না। না হয়েও নিজের বাবার চেয়ে ভাইয়ের চেয়ে আপন হতে পারে কেউ কেউ। নিখিল সরকারের একটি ছেলে ছিল, পাপু নাম। পাপু যখন তার মাত্র আট বছর বয়স, রাস্তায় খেলতে গিয়ে গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেছে। অসম্ভব প্রতিভাবান ছেলে ছিল পাপু। ওই বাচ্চা বয়সেই ছবি আঁকত, ছড়া লিখত। আজও মীরা সরকার, নিখিল সরকারের স্ত্রী পাপুর কথা ভেবে চোখের জল ফেলেন, প্রতিদিন। প্রতিদিন তিনি দেয়ালে পাপুর ছবি আর পাপুর আঁকা ছবিগুলোর ধুলো নিজের আঁচল দিয়ে মোছেন। এখনও। এখনও প্রদীপ জ্বেলে দেন প্রতি সন্ধেবেলা পাপুর ছবির সামনে। হ্যাঁ এখনও। মীরা সরকারের বেদনা আমাকে এমনই স্পর্শ করেছিল যে একদিন বলেছিলাম, ধরে নিন আমিই আপনাদের পাপু, পাপু তো বেঁচে থাকলে আমার বয়সীই হত। পাপুর লেখা ছড়া আর ছবির একটি বই জ্ঞানকোষ প্রকাশনীকে দিয়ে বাংলাদেশে বের করেছি। বইটি নিখিল সরকারের হাতে দিয়ে আমার আনন্দ হয় খুব। নিখিল সরকার, ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার ছেলে এখন কলকাতা বিশেষজ্ঞ, অনেকগুলো বই লিখেছেন কেবল কলকাতা নিয়েই। যত নিখিল সরকারকে দেখি, তত আমি মুগ্ধ হই। বাড়িভর্তি বই, পড়ছেন, কেবল পড়ছেন। নানা বিষয়ে আগ্রহ তাঁর। দেশি বিদেশি ইতিহাস ভূগোল সাহিত্য শিল্পকলার কোনও ভাল বইএর নাম শুনলেই তিনি তা যে করেই হোক যোগাড় করে পড়ে নেন। তাঁর এই একটিই নেশা, পড়া। নিখিল সরকারের কাছে এলে নিজের অজ্ঞানতা মূর্খতা দাঁত মেলে প্রকাশিত হয়, তবু তিনি আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেন না। মহীরূহর পাশে তুচ্ছ তৃণ, তবু আমি ভালবাসা পাই তাঁর। ভালবাসা পেয়েছি অন্নদাশংকর রায়ের, শিবনারায়ণ রায়ের, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের। নিজের সৌভাগ্যের দিকে মাঝে মাঝে বড় বিস্ময়-চোখে তাকাই। সবই অলীক বলে মনে হয়, যেন সত্যি নয়, যেন এ ঘটছে না, যেন এ কেবলই একটি স্বপ্ন। জেগে দেখব আমি সেই আমি, লোকের থু থু খাচ্ছি, লাথি খাচ্ছি, ঘৃণা আর নিন্দার কাদার তলে অর্ধেক ডুবে আছি। বাংলাদেশের জন্য নিখিল সরকারের অদ্ভুত এক ভালবাসা কাজ করে। বাংলাদেশের ভাল সাহিত্যিকরা যেন আনন্দ পুরস্কার পান, সে ব্যবস্থা তিনি তৈরি করে দিতে চান। ডক্টর আনিসুজ্জামানকে পুরস্কার কমিটির সদস্য করার পেছনে তিনিই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ঐতিহ্যের অঙ্গীকার নামে অনেকগুলো অসাধারণ ক্যাসেট করার জন্য যে বছর নরেন বিশ্বাস এবং আনিসুজ্জামানকে আনন্দ পুরস্কার দেবার সিদ্ধান্ত হল, এক ঝড়জলের রাতে বহু কষ্টে বাড়ি খুঁজে খুঁজে সুখবরটি দিয়ে এসেছিলাম নরেন বিশ্বাসকে। যেবার শামসুর রাহমান পেলেন, সেবার যে কী ভীষণ আনন্দ হয়েছিল! দৌড়োদৌড়ি লেগে গেল আমার,খবর নিচ্ছি, দিচ্ছি। শামসুর রাহমানের পাসপোর্ট নাও, ভিসা কর। বিমান বন্দরে পৌঁছে দিয়ে এসো। তখন নিজের পাসপোর্টটি থাকলে আনন্দ পুরস্কার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঠিকই চলে আসতাম কলকাতায়। তিনি যোগ্য এই পুরস্কার পাওয়ার। আমি যে এ পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য ছিলাম না, সে আমি জানি। আনন্দ পুরস্কার পাওয়ার আনন্দ যত ছিল, এটি পাওয়ার লজ্জা আমার কিছু কম ছিল না। আনন্দ পুরস্কার নয়, এই পশ্চিমবঙ্গে আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া কিছু অসামান্য মানুষের স্নেহ আর ভালবাসা। এটি অমূল্য সম্পদ। আনন্দ পুরস্কারের টাকা খরচ হয়ে যাবে হাবিজাবিতে, পুরস্কারের সনদ ধূসর হতে থাকবে দিন দিন, কিন্তু ভালবাসা থেকে যাবে, বন্ধুত্ব উজ্জ্বল হতে থাকবে যত দিন যাবে।

স্টেটসম্যানে আমার সাক্ষাৎকারটি যেদিন ছাপা হল, সেদিন সকালেই নিখিল সরকার আমার হোটেলে ফোন করলেন। বেশ রুষ্ট হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি স্টেটসম্যানের সাংবাদিককে বলেছো যে তুমি কোরান সংশোধন করতে চাও?

— না তো!

–লিখেছে তো!

–কি বলছেন এসব! কোরান সংশোধন? কোরান আবার সংশোধন করা যায় নাকি? এরকম উদ্ভট কথা আমার মাথায় কোনওদিন আসেনি। বলার প্রশ্ন ওঠে না। আমি কোরান বিশ্বাস করি না, আমি কেন এর সংশোধন চাইব! কোরান বিশ্বাস করলে তো কোরান সংশোধনের প্রশ্ন আসে।

–বলনি, তাহলে লিখল কেন? নিশ্চয়ই এধরনের কিছু বলেছো!

–শরিয়া আইনের কথা বলেছিলাম। না এর সংশোধন চাইনি। কারণ সংশোধনে কাজের কাজ সত্যিকার হয় না। বলেছিলাম শরিয়া আইন পাল্টাতে চাই। মানে একে বিদেয় করতে চাই। এই আইনের বদলে নারী পুরুষে সমান অধিকার আছে এমন আইনের কথা বলেছিলাম।

–কী বলতে যে কী বল!

–কী বলতে কী নয়। আমি যা বলেছি, স্পষ্ট করে বলেছি। এটা কোনও নতুন কথা নয়। এ কথা আমি দীর্ঘদিন থেকে বলে আসছি। লিখে আসছি। আমি নিশ্চিত, যে মেয়েটি সাক্ষাৎকার নিতে এসেছিল, সে জানেনা কোরান আর শরিয়ার মধ্যে পার্থক্য। শরিয়া বলতে সে কোরান বুঝেছে।

–যাই হোক, দেরি কোরো না। এক্ষুনি একটা সংশোধনী পাঠিয়ে দাও।

–এরকম কত ভুল লেখে পত্রিকায়, তার জন্য সংশোধনী তো কোনওদিন পাঠাইনি!

–এ যে সে ভুল নয়। এই মন্তব্য নিয়ে বিপদ হতে পারে।

দেরি না করে নিখিল সরকারের আপিসে গিয়ে স্টেটসম্যান সম্পাদকের কাছে চিঠি লিখে দিই যে আমি কোরান সংশোধনের কথা বলিনি, এ কথা বলার প্রশ্নও ওঠে না কারণ আমি ধর্মে বিশ্বাস করি না। সব ধর্মগ্রন্থই আমি মনে করি এ যুগের জন্য অচল। সব রকম ধর্মীয় আইন সরিয়ে, যেহেতু ধর্মীয় আইনে নারী তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, নারী পুরুষের মধ্যে বৈষম্যহীন একটি আইন ব্যবস্থার দাবি আমি দীর্ঘ দিন থেকে করছি। ধর্মই যদি না মানি, তবে কোরান সংশোধনের বিষয়টি সম্পূর্ণই অপ্রাসঙ্গিক। — এটি লিখে আমার স্বস্তি হয়। স্টেটসম্যানের লেখাটি পড়ার পর সত্যি আমার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল, একটি ভুল বাক্য আমাকে কী রকম আস্তিক বানিয়ে ছাড়ল। ধর্মে বিশ্বাস করলেই তো প্রশ্ন আসে ধর্মগ্রন্থ সংশোধনের। একটু পাল্টে পুল্টে একে মেনে চল, একে মাথায় তুলে রাখো। ছিঃ, আমি কি তাই বিশ্বাস করি নাকি! এতকাল ধরে তবে কিসের সংগ্রাম করছি আমি! আমি কি ক্রমাগতই বলে চলছি না যে পুরুষতন্ত্র আর ধর্মের শেকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা না পর্যন্ত মেয়েদের সত্যিকার মুক্তি নেই!

আবৃত্তিলোক থেকে একটি অনুষ্ঠান করা হল, সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান বলা যায় একে। কবিতা পাঠ হবে। কে কবিতা পড়বে? আমি। আর কেউ? না, আর কেউ নয়, একা আমি। এর কোনও মানে হয়! ওঁরা বললেন, মানে হয়। শক্তি চট্টোপাধ্যায় বসলেন আমার বামে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ডানে। আপনারাও পড়ুন কবিতা, আমি কাতর অনুরোধ করি। না, আজ আমরা তোমার কবিতা শুনব। শক্তি বলেন। আমি সংকোচে মরি। বাংলা সাহিত্যের দুজন শ্রেষ্ঠ কবির মাঝখানে বসে কবিতা পড়তে যে মনের শক্তি লাগে, সেটি আমার নেই। নেই, তবু বসতে হয় কবিতা পড়তে। মুখে পড়ছি কবিতা আর মনে মনে বলছি ধরণী দ্বিধা হও। ধরণী দ্বিধা হয়নি। আমাকে বোধহয় আকাশে ছুঁড়ে না দিয়ে ধরণীর শান্তি নেই। কবিতা পাঠের পর খাওয়া দাওয়া, খাওয়া দাওয়ার আগে অবশ্য চিরাচরিত মদ্যপান। সন্ধের পর এই মদ্যপানটি কলকাতার উμচজ্ঞবত্ত আর মধ্যবিত্তের অনেকটা নিয়মিত ব্যাপার। ঘরে ঘরে মদ নিয়ে বসে যাচ্ছেন স্বামী, এমনকী স্ত্রীও। অতিথি এলে তো কথাই নেই, আর কিছু না চলুক, মদ চলবেই। সন্ধের অতিথিকে ঢাকার শিল্পাঙ্গনের মধ্যবিত্তরা সম্ভবত এখনও চা দিয়েই আপ্যায়ন করেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় সামান্য মদ্যপান করেই, লক্ষ্য করি, আমার পেছন পেছন হাঁটছেন আর বলছেন, তসলিমা তোমাকে আমি এত ভালবাসি কেন, বল তো! এই সেরেছে। এই তুচ্ছ মানুষটিকে এত আদর যত্ন করা হচ্ছে, এমনকী আকাশে তোলা হচ্ছে, তারপর কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় যদি এখন এই ভরা আসরে এমন হুট করে আমার প্রেমে পড়ে যান, তবে এত আমি সামলাবো কি করে! কান দুটো ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল। লজ্জায় আমি কোথায় মুখ লুকোবো তার জায়গা খুঁজে পাচ্ছি না। আমি শক্তিদা কিছু খাবেন, আমি আপনার জন্য খাবার নিয়ে আসি, বলে তাঁর পাশ থেকে দ্রুত সরে যাই, যেন এর মধ্যে তিনি তাঁর প্রেমকে আপাতত স্থগিত রাখার প্রয়াস পান। তাঁর জন্য খাবার আনতে যাই, যেন মুখে খাবার পুরতেই তিনি ব্যস্ত থাকেন, যেন প্রেমের বাক্য আওড়ানোর কোনও সময় তাঁর না জোটে। কিন্তু পেছন পেছন আবার তিনি, ফিসফিস করে বলছেন, তোমাকে কেন এত ভালবাসি আমি! খাবারের থালাটি তাঁর হাতে দিই, তিনি বাধ্য শিশুর মত বসে খেতে শুরু করলেন। লক্ষ করি ঠিকমত তিনি খেতে পাচ্ছেন না, খাবারগুলো মুখে তুলতে গেলে ছড়িয়ে পড়ছে এদিক ওদিক। মীণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়, শক্তির স্ত্রী ছিলেন খানিকটা দূরে। তাঁর কাছেই দৌড়ে যাই, বৌদি, শিগগিরি আসুন, শক্তিদা কেমন যেন করছেন। খেতে পাচ্ছেন না।

ও কিছু না! বলে মীণাক্ষী যার সঙ্গে মন দিয়ে গল্প করছিলেন, করতে লাগলেন। শক্তির কেমন করাকে তিনি মোটে পাত্তাই দিলেন না। আমি এদিকে মহা মুশকিলে পড়েছি। একা আমি শক্তির প্রেম সামাল দিতে পারছি না। তিনি তো খাওয়া দাওয়া ফেলে আবার আমাকে বলতে শুরু করেছেন যে তিনি আমাকে খুব ভালবাসেন। কেন আমাকে তিনি এত ভালবাসেন, তা বারবারই আমাকে জিজ্ঞেস করছেন। আমি কি করে জানব তা! আমার কাছে তো উত্তর নেই। এ এমনই এক অস্বস্তিকর ব্যাপার যে আমি না পারছি বসে বসে শুনতে তাঁর প্রেমের প্রলাপ, না পারছি কাউকে বলতে। এমন বোকা কি যেখানে সেখানে মেলে! বুঝতে আমার দুদিন লেগেছে যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় সত্যি সত্যিই আমার প্রেমে পড়েননি। পেটে মদ পড়লে তিনি একটু উল্টো পাল্টা বকেন, এই যা।

কলকাতায় সময় ফুরোতে থাকে দ্রুত, খুব দ্রুত। ইচ্ছে করে আঁচলের খুঁটে বেঁধে রাখি দুরন্ত সময়টিকে, পারি না। সময় কর্পুরের মত হাওয়ায় উড়ে যায়। দেশে ফিরে যাওয়ার আগে আগে কলকাতায় সময় সত্যিই দ্রুত ফুরোয়। কলকাতাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না, কিন্তু যেতে হয়।

ঢাকায় ফেরার পর দেখি তাণ্ডব শুরু হয়েছে সারা দেশে। স্টেটসম্যান পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয়েছে বাংলাদেশের পত্রিকায়। আমি কোরান সংশোধন করতে চাই, এ খবরটি ফলাও করে প্রচার করে মৌলবাদীরা এক ভয়ংকর আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এ হচ্ছে কি! আমি তো কোরান সংশোধনের কথা বলিনি। আমার কথা কে শোনে! ভেবেছিলাম লজ্জা বাজেয়াপ্ত হওয়ার পর মৌলবাদীদের পালে যে হাওয়া লেগেছিল, ফতোয়া জারির পর সরকারের নিষিক্রয়তা যেমন উসকে দিয়েছিল আগুন, সে হাওয়ার জোর, সে আগুনের তাপ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। কমেওছিল কিছু। পুলিশ পাহারাও অনেকটা আছে আছে নেই নেই রকম ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে হাওয়া ক্ষিপ্ত, তপ্ত, নতুন করে দ্বিগুণ তেজে ত্রিগুণ বেগে ধাবিত হচ্ছে! আমার কত বড় স্পর্ধা যে আমি পবিত্র কোরান শরীফে কাঁটাছেড়া করতে চাইছি, স্বয়ং আল্লাহর বাণী সংশোধন করতে চাইছি! এর মানে এই যে আমি মনে করছি আল্লাহ সঠিক কথা বলেননি, আল্লাহ ভুল বলেছেন, আমি সর্বশক্তিমান আল্লাহর চেয়ে বেশি জ্ঞান রাখি, আমি আল্লাহর চেয়ে নিজেকে বেশি ক্ষমতাবান মনে করছি। মৌলবাদীদের কাছে এর চেয়ে বড় অস্ত্র আর কী থাকতে পারে! দেশী বিদেশি সাংবাদিকদের ভিড়, প্রশ্নের পর প্রশ্ন, আদৌ কি আমি বলেছিলাম কোরান সংশোধনের কথা? আমি কি পাগল হয়েছি যে কোরান সংশোধন করতে চাইব! ধরুন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একটি বই লিখেছেন। সেটির আমি সমালোচনা করতে পারি, কিন্তু সেটি আমি সংশোধন করতে পারি না। আমার বইয়ের কথাই বলছি, আমার বই সংশোধন করার অধিকার একমাত্র আমার আছে, অন্য কারওরই নেই। আমার মৃত্যু হলেও আমার বই যে সব ভুল ষনুটি নিয়ে আছে, সেভাবেই থাকবে। এরকমই তো নিয়ম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে লিখেছিলেন, আমরা কেউ কি চাইব ভেঙে মোর ঘরের চাবির বদলে ভেঙে মোর ঘরের তালা করে দিতে? না। চাইব না। প্রশ্নই ওঠে না। কোরানে তো লেখাই আছে যে এর কোনও শব্দও পরিবর্তন করা যাবে না। কোরান একটি বহুল পঠিত গ্রন্থ, আমি কোন ছার যে এটি সংশোধনের দাবি করব! এ ব্রহ্মাণ্ডের কেউ এ দাবি করতে পারে না।

আমি আর যে সব বইয়ের উদাহরণ দিলাম, তা মানুষের লেখা, কিন্তু কোরান তো আল্লাহ তায়লার লেখা। আমি তুলনা করি কি করে কোরানের সঙ্গে মানুষের লেখা বইয়ের? তুলনা করি এই জন্য যে কোরানও মানুষেরই লেখা। ক্ষমতালোভী, স্বার্থা−ন্বষী, নারীবিদ্বেষী,নিষ্ঠুর নির্দয় পুরুষের লেখা। এ মানুষের নির্বুদ্ধিতা যে মানুষ বিশ্বাস করে আল্লাহ জিবরাইলকে পাঠিয়েছেন মুহম্মদের কাছে তাঁর কথাগুলো পৌঁছে দিতে। মুহম্মদ জিবরাইলকে দেখতে পেতেন না, কিন্তু আওয়াজ শুনতেন জিবরাইলের গমগমে কণ্ঠস্বরের। তিনি যা শুনতেন, তা লিখে নিতেন। নিজে তো লিখতে পড়তে জানতেন না, অন্যকে লিখতে বলতেন। সে যুগে, আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগে অন্ধতা, অজ্ঞানতা, মূর্খতা চারদিক ছেয়ে ছিল, তখন অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস করত লোকে, এ কোনও অবাক করা ব্যাপার নয়। কিন্তু এই বিংশ শতাব্দির শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে, এই বিজ্ঞানের যুগে, যখন মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি যুক্তি চিন্তা অনেক অগ্রসর, মানুষ কী করে বিশ্বাস করে এসব রূপকথা?

তবে কিসের সংশোধনের দাবি করছেন? শরিয়া নামের বর্বর আইনকে বিদেয় করার দাবি করছি। এই আইনের সংশোধন এ যাবৎ অনেক হয়েছে, কোনও সংশোধনই নারী পুরুষের বৈষম্য দূর করেনি। নারী পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা শরিয়া আইনের মূল লক্ষ্য নয়, বরং এর উল্টো। কোনও সংশোধনই মূল লক্ষ্যের পরিবর্তন ঘটাবে না। যদি আমরা রাষ্ট্রের সংবিধানটি অক্ষত রাখি, যে সংবিধান বলে যে সব মানুষের অধিকার সমান, তবে আইনটি রক্ষা করার কোনও যুক্তি নেই।

সব পত্রিকায় আমার বিবৃতি ছাপা হয়েছে যে আমি কোরান সংশোধনের কথা বলিনি তারপরও তাণ্ডব থামার কোনও লক্ষণ নেই। মৌলবাদীরা আর্তনাদ করছে, ইসলাম ভেসে গেল, কোরান ধ্বংস হয়ে গেল। কে ভাসাচ্ছে, কে ধ্বংস করছে? তসলিমা। সুতরাং জ্বালাও পোড়াও, ফাঁসি চাও, আন্দোলনে নামো। মুসলমান তোমরা যে যেখানে আছো বেরিয়ে পড়ো, বজ্রকণ্ঠে স্লোগান দাও, তসলিমার ফাঁসি চাই। তসলিমার মৃত্যু চাই। হ্যাঁ, আমার মৃত্যু চাওয়ার লোকের সংখ্যা বাড়ছে। মিছিলে লোক আগের চেয়ে অনেক বেশি। সময় গেলে বেশির ভাগ আন্দোলনের তেজ এ দেশে কমে আসে জানতাম। কিন্তু যত সময় যাচ্ছে, তত বাড়ছে তেজ। চারদিকে কেবল একটিই হুংকার, তসলিমাকে হত্যা কর, ইসলাম বাঁচাও। রাজনৈতিক অরাজনৈতিক যত ইসলামী সংস্থা সংগঠন আছে দেশে, সবখানেই ফুঁসে ওঠা লোকের ভিড়, জোট বাঁধো, পথে নামো, ইসলাম বাঁচাও। প্রতিদিন আমার ফাঁসি চেয়ে জঙ্গী মিছিল বেরোচ্ছে। প্রতিদিন। লিফলেট বিলি হচ্ছে, হাজার হাজার লিফলেট —

Taslima Nasrin ।। তসলিমা নাসরিন