পরদিন সকালের কাগজে আবার এক চাঞ্চল্যকর খবর প্রকাশিত হল। তুলসী মিত্তির গার্ডেন লেনের এক বাড়িতে গভীর রাতে রহস্যজনকভাবে চুরি হয়েছে। টাকাকড়ি এবং সোনার গয়না মিলিয়ে প্রায় বিশ হাজার টাকার মতো চুরি। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, এ ক্ষেত্রেও চােরের পদচিহ্ন শুধুমাত্র ঘরে, বারান্দায় এবং ছাদের ওপর পাওয়া গেছে। এর বাইরে আর কোথাও নয়। প্রথম খুনির পায়ের ছাপের সঙ্গে এই পায়ের ছাপা হুবহু মিলে যাচ্ছে।

খবরটা দেখেই পাণ্ডব গোয়েন্দারা দলবদ্ধভাবে ছুটিল ঘটনাস্থলে। গলির মুখে একটা ছোটখাটো ভিড় হয়ে আছে। সেখানে বাবলুর চেনা জানা একজন ছিল।

বাবলু। তাকে জিজ্ঞেস করল, কাদের বাড়ি চুরি হয়েছে?

সে একজন বেঁটে কালো লোককে দেখিয়ে দিল। বাবলু চিনল লোকটাকে। রেলের ক্যান্টিনে কাজ করে। অনেকদিন আগে যখন ওদের পাড়ায় ভাড়া থাকত লোকটা তখন একবার ক্যান্টিন থেকে আনা চপ কাটলেট ওদের খাইয়েছিল। বাবলু ভেবে পেল না লোকটা এর মধ্যে এত টাকা কী করে করল। যাই হোক, এ রকম চুরি সত্যিই অভাবিত।

ওরা অনেকক্ষণ ধরে আশপাশে ঘোরাঘুরি করল। কিন্তু কে-ই বা ওদের পাত্তা দেবে? ওরা নিজের মনেই আর একটু এগিয়ে গেল। হঠাৎ এক জায়গায় ডুগ ডুগ ডুগ ডুগ আওয়াজ।

ডুগডুগির আওয়াজ শুনে এগিয়ে গেল ওরা।

দেখল যে মাঠে শীতলা পুজো হয় সেই মাঠের ওপর খেলা দেখাচ্ছে সেই ইরানি যাযাবর আর সেই জিপসি মেয়েটা। অপূর্ব সুন্দরী। ইরানিটাও যেন লালমুখো একটা দানব। একসঙ্গে কুড়িটা সোডার বোতল সে একটা ছুড়ছে একটা লুফছে। কী অপূর্ব ব্যালান্স। বোতলগুলো যেন শূন্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। অথচ সে একের পর এক ডান হাতে বাঁ হাতে লুফেই ছুড়ে দিচ্ছে। সে দৃশ্য দেখবার মতো। সেই কুকুর, ছাগল, বাঁদর সবই আছে। জিপসি মেয়েটা ডুগডুগি বাজিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে চারিদিকে।

পাণ্ডব গোয়েন্দারা প্রথমটা মহাবিস্ময়ে সেই খেলা দেখতে লাগল। বিলু, ভোম্বল, বাচ্ছু, বিচ্ছু অবাক হয়ে বোতলের ম্যাজিক দেখছে। আর বাবলু একদৃষ্টে চেয়ে আছে ইরানিটার পায়ের দিকে। পায়ের প্রতিটি ছাপ ধুলোর মাঠে আঁকা হয়ে যাচ্ছে প্রতিটি পদক্ষেপ।

বাবলু বিলুর গায়ের কাছে ঘেঁষে দাড়িয়ে ওর মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে চুপি চুপি বলল, কালকের রহস্যজনক চুরিও এই ব্যাটাই করেছে।

সে তো জানা কথা। ’ আমি একে ফলো করব। তোরা এক কাজ করা, এখানে আর থাকিস না। ঘরে গিয়ে স্নান খাওয়া করে তৈরি হয়ে নে! ভোম্বল, তুই বরং খেয়েদেয়েই চট করে চলে আয়। তুই এলে তারপর আমি যাব। বিলু, বাচু আর বিচ্ছু মিত্তিরদের বাগানে থাকবি। পঞ্চুও থাকবে তোদের সঙ্গে। আমি খবর দিলেই চলে আসবি। কেমন?

বেশ তাই। এই বলে ওরা চলে যেতেই বাবলু দর্শকদের ভেতর মিশে খেলা ও খেলোয়াড়কে তীক্ষ্ণচোখে দেখতে লাগল।

বোতলের খেলা শেষ হতেই একটার পর একটা পয়সা পড়তে লাগল। মাঠের ওপর। দশ, পাঁচ, সিকি।

ইরানি যাযাবরটা তখন ঘিমাক্ত কলেবরে একটা গাছতলায় বসে বিশ্রাম নিতে লাগল।

বাবলুও নিজের মনে এটা সেটা দেখার ছলে লক্ষ করতে লাগল চারদিকে।

ইরানিটা হঠাৎ বাজখাই গলায় বলল, এই কী চাই তোমার?

বাবলু বলল, কিছু না। তোমার বোতলের খেলা আমার খুব ভাল লেগেছে।

বিকেলে আবার হবে। দেখতে এসো। এখন যাও। আমরা এবার রান্না করে খাওয়া-দাওয়া করব। বিকেলে তোমাদের আরও সব বন্ধুবান্ধব থাকে তো ডেকে আনবে, বুঝলে?

বাবলু হ্যাঁ বলে ওর সামনে থেকে চলে এল। তবে দূরে একটা মোড়ের মাথায় বসে রইল চুপচাপ। ভোম্বল না। আসা পর্যন্ত ওইভাবেই থাকবে ও তারপর ভোম্বলকে পাহারায় রেখে খেতে যাবে।

ভোম্বল এল প্ৰায় ঘণ্টা দেড়েক পরে।

নিজের জায়গায় ভোম্বলকে বসিয়ে বাবলু ঘরে চলে গেল। বাবলুর মনে জোর প্রতিজ্ঞা, খুনি-তস্কর ইরানিটাকে আজই বামাল সমেত ও ধরাবেই ধরাবে।

বিলু, বাচ্চু আর পঞ্চু অপেক্ষা করছিল মিত্তিরদের বাগানে। বাবলু গিয়ে ওদের ডাকল। ওরা সকলেই খেয়েদেয়ে একদম তৈরি।

বিলু বলল, কী খবর?

ভাল। আজ বিকেলে বোতলের খেলা আবার হবে। সেই খেলা দেখার ভেতরেই আমাদেরকে আমাদের কাজ করে ফেলতে হবে।

কী করে কী করবি?

কিছুই ঠিক করিনি। ঘটনা যেভাবে ঘটবে বা সুযোগ যখন যেমন পাব তেমনি কাজে লাগাব। বলতে বলতে ওরা সেই মাঠটার কাছে গেল।

কিন্তু এ কী! কোথায় বা ভোম্বল, আর কোথায় সেই ইরানি যাযাবর ও জিপসি মেয়ে। তাদের তাঁবুরও কোনও চিহ্ন নেই।

বাবলু বলল, ওরা নিশ্চয়ই পাততাড়ি গুটিয়েছে। এবং ভোম্বল ওদের পিছু নিয়েছে। কিন্তু কোন দিকে যে গেল ওরা তা কী করে জানা যায়?

বিলু বলল, ভোম্বল না ফেরা পর্যন্ত কিছুই জানা যাবে না।

বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, তার মানে আজ আর কিছুই হচ্ছে না।

বাবলু বলল, তবে একটা কাজ হবে।

 বিলু বলল, কী কাজ?

খুনির পায়ের ছাপ এবং এই ইরানির পায়ের ছাপ মিলছে কিনা জানা যাবে।

বলেই বাবলু সেই কাঠিটা দিয়ে মেপে দেখল পায়ের ছাপ। আর মেপে দেখেই সোল্লাসে চিৎকার করে উঠল, হুরররে। মিলেছে, ছাপা হুবহু মিলে গেছে।

বাচ্ছু-বিচ্ছু বলল, তা হলে এখনই পুলিশকে জানাই চলো। আর দেরি করা কোনওমতেই ঠিক হবে না।

এখনই নয়। আমাদের কাজ আরও একটু এগিয়ে গেলে তারপর ডাকব পুলিশ।

এমন সময় হঠাৎ রাস্তার ওপর কী যেন দেখে চেঁচিয়ে উঠল বিলু, বাবলু। শিগগির আয়।

বাবলু যাবার আগেই বাচ্চু-বিচ্ছু ঝুঁকে পড়েছে। বাবলুও গিয়ে ঝুঁকে পড়ে দেখল রাস্তার তেমাথার মোড়ে ছোট ইটের টুকরো ঘষে কে যেন একটা তিরচিহ্ন এঁকে পথ-সংকেত করে রেখেছে।

বিলু বলল, এ নিশ্চয় ভোম্বলের কাজ।

বাবলু বলল, অবধারিত। এই চিহ্ন যদি রাস্তার প্রত্যেক মোড়ে থাকে, তা হলে জানিব ভোম্বল ছাড়া এ কাজ আর অন্য কারও নয়।

ওদের অনুমানই ঠিক। সেই চিহ্ন ধরে যেতে যেতেই পরপর কয়েকটি মোড়ে পথ-সংকেত দেখতে পেল। সেই চিহ্ন শেষ হল চ্যাটার্জিহাটের কাছে। একটা বড় মাঠে দেখা গেল। ইরানি যাযাবর তার তাবু ফেলছে। জিপসি মেয়েটা কেমন এক সুন্দর ভঙ্গিতে বসে বসে কাঁঠালপাতা খাওয়াচ্ছে ছাগলটাকে। আর এই ছাগলটাকে লক্ষ করতে গিয়েই বাচ্ছু বলে উঠল, বাবলুদা, ওই দেখ, আমাদের সেই দড়িটা। সেই দড়িটাকেই কেটে ছোট করে ছাগল বেঁধেছে।

বাবলু বলল, আরে তাই তো। কিন্তু ভোম্বল কোথায়? ভোম্বলকে দেখছি না কেন?

বিচ্ছু বলল, সে বোধহয় আমাদের খোঁজেই গেছে।

 বাবলু বলল, হয়তো।

বিলু বলল, চোরাই মালগুলো সব এদের তাঁবুর ভেতরেই আছে। একবার কোনওরকমে ঢুকে দেখতে পারলে হত।

কিন্তু কী করে যে ঢুকবে তা ওরা ভেবেও পেল না। তাঁবুর মুখেই বাঁধা আছে অ্যালসেশিয়ানটা। পঞ্চুকে দেখে সে লেজ নাড়ছে। পঞ্চুও লেজ নাড়ছে তাকে দেখে।

ওরা দূর থেকে ওদের লক্ষ করতে লাগল।

আরও অনেক ছেলেমেয়ে ও দু-চারজন বড় লোকের ভিড়ও জমতে শুরু করেছে সেখানে।

এমন সময় হঠাৎ ভোম্বল হাফাতে হাফাতে এসে হাজির হল সেখানে।

বাবলু বলল, কী রে, কোথায় গেছলি? আমাদের ডাকতে?

দূর। তোদের ডাকতে যাব কেন? তোদের জন্যে তো পথ-নির্দেশ করেই রেখেছিলাম। আমি গিয়েছিলাম অন্য কাজে।

কী কাজে?

যে কাজে গিয়েছিলাম তাতে সাকসেসফুল হয়ে এসেছি। ব্যাটা ইরানির ষষ্ঠীপুজো করব আজ। আজই ধরব ব্যাটাকে। একটু রাত্রি হোক।

কী করে কী করবি? ওই অ্যালসেশিয়ানটাকে বাগাতেই তো হিমসিম খেয়ে যেতে হবে।

আরে আমার নাম ভোম্বল। জানিদের রকে পল্টন বসেছিল। ওকে বলতেই ও গিয়ে ঠাকুর ফার্মেসি থেকে এক শিশি ক্লোরোফর্ম জাতীয় কড়া ওষুধ ম্যানেজ করে এনেছে।

বাবলু যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না, এইভাবে বলল, সত্যি! তা যদি হয় তবে এটা ছেড়া ন্যাকড়ায় ঢেলে সেটা কুকুরটার দিকে ছুড়ে দিলেই তো ও ব্যাটা শুকবে। আর তার পরেই হবে কেল্লা ফতে।

বিলু বলল, শুধু তাই নয়। ওই ন্যাকড়া ইরানিটা এবং ওই জিপসি মেয়েটাকে শোঁকানো হবে। তা হলেই সুবিধে হবে আমাদের।

পাণ্ডব গোয়েন্দারা জয়ের গৌরবটা মনে মনে কল্পনা করেই আনন্দে অধীর হয়ে উঠল প্ৰথমে। তারপর অপেক্ষা করতে লাগল। কতক্ষণে সেই শুভক্ষণটি আসে তার জন্য।

দেখতে দেখতে সন্ধে হল।

তারপর অন্ধকারের কালো যবনিকায় ঢেকে গেল চারদিক। যাযাবর তাঁবুতে আলো জ্বলে উঠল। জিপসি মেয়েটা নিশ্চয়ই ইরানিটার বউ। সে আলো জ্বেলে তাঁবুর সামনে বসে ছুচ-সুতো বার করে তার একটা পুরনো ঘাগরা সেলাই করতে বসল।

আর ইরানিটা শুয়ে রইল বাইরে ঘাসের ওপর। পোষা বাঁদরটা ইরানিটার বুকে পিঠে, কখনও বা ছাগলটার পিঠে বসতে লাগল। আবার মাঝে মাঝে কুকুরটারিও লেজ টেনে দিয়ে পালিয়ে এসে কুকুরটাকে রাগিয়ে দিতে লাগল। তার মানে যত রকমের বাঁদরামো আছে তাই করতে লাগল বসে বসে।

বাবলু বলল, আর যে ধৈৰ্য ধরতে পারছি না। কী করি বল তো?

বিলু বলল, সাড়ে সাতটা হয়ে গেছে। মাস্টারমশাইয়েরও আসবার সময় হয়ে গেছে।

ভোম্বল বলল, আজ আর ও-আক্ষেপ করে লাভ নেই।

এমন সময় দেখা গেল। ইরানিটা উঠে দাঁড়াল। তারপর কী যেন বলল জিপসি মেয়েটাকে। বলে বাঁদরটাকে কঁধে বসিয়ে রাস্তায় এল। ওর কোমরে জড়ানো একটা নাইলনের মোটা দড়ি।

বিলু বলল, এই তাল। জিপসিটা তাঁবুতে ঢুকলেই—।

বাবলু বলল, না। আগে এই ব্যাটার পিছু নিই। দেখি ব্যাটা কোথা যায়। তারপর ফিরে এসে তাঁবুতে ঢুকে শুলে গভীর রাতে কাজ করব। বাচ্ছু-বিচ্ছু বরং বাড়ি চলে যাক।

বাঙ্গুচু-বিচ্ছু বলল, কখনওই না। যা করার সবাই একসঙ্গে করব। এর জন্যে বাড়িতে বকুনি খেতে হয় খাব।

পাণ্ডব গোয়েন্দারা সত্যিকারের গোয়েন্দাদের মতো পিছু নিল ইরানিটার।

ইরানিটা রাতের অন্ধকারে এ-পথ সে-পথ করে একটা গলির ভেতর ঢুকল।

ওরাও দেওয়াল ঘেঁষে গিয়ে অনুসরণ করতে লাগল তাকে। একেবারে অন্ধকারে মিশে এমনভাবে রইলা যাতে ও দেখতে না পায়।

ইরানিটা থমকে দাড়িয়ে এদিক ওদিক করে তাকিয়ে দেখল দু-একবার। তারপর সেই নাইলনের দড়িটা বাঁদরটার হাতে দিয়ে ছেড়ে দিল। পরীক্ষণেই দেখা গেল বাঁদরটা ওপর থেকে ঝুলিয়ে দিল দড়ি। ইরানিটা তাই ধরে উঠে গেল বাড়ির ছাদে এবং বেশ কিছুক্ষণের মধ্যে একটা ঝোলায় করে কী সব যেন নিয়ে নেমে এল। এসে দড়িটা ধরে নাড়া দিতেই বাঁদরটা ওপর থেকে দড়ি খুলে দিল। তারপর আবার ফিরে চলল যে পথে এসেছিল। সেই পথে।

বাবলু বলল, এইবার বুঝেছি ঘুঘু তুমি কী করে ধান খাও।

বিলু বলল, এ যে ম্যাজিকের পর ম্যাজিক রে ভাই।

বাবলু বলল, এই জন্যেই ঘরের ভেতরে বা ছাদে পায়ের ছাপ পাওয়া যায় কিন্তু অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। ফ্যাক্টরির খুনের ব্যাপারটাও ঠিক এইভাবেই ঘটেছে। বাগানের দিক থেকে বাঁদরটা দোতলার ছাদে বা বারান্দায় হুক আটিা দড়িটা আটকে দিয়েছে। আর তাই ধরে ও ব্যাটা ওপরে উঠেছে। তারপর চুরি করতে গিয়ে হয় বেগতিক দেখে ও ব্যাটা খুন করেছে না হয় খুন করেই চুরি করেছে। নীচে মেশিনের শব্দে খুন হওয়ার চিৎকার কানেও যায়নি। কারও। তারপর বাঁদরটাও ওই দড়ি হুক সমেত আবার লাফিয়ে এসে গাছের ডালে আটকে অথবা বেঁধে দিলে সেই দড়ি ধরে বারান্দা থেকেই ব্যাটা এধারে আসে। কাজেই ছাদ বা বারান্দায় ছাড়া আর অন্য কোথাও পায়ের ছাপ পাওয়া যায়নি ওর।

ইরানিটার পিছু পিছু আবার ওরা সেই মাঠের কাছে এল। যেখানে ওরা তাঁবু খাঁটিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। জিপসি মেয়েটা তখন কাঠাকুটো জ্বেলে রান্না চাপিয়েছিল। একটু পরেই রান্না শেষ করে কুকুরটাকে ছেড়ে দিয়ে তাঁবুর ভেতরে ঢুকে পরদা নামিয়ে দিল।

ভোম্বল তখন মুখে নাকে রুমাল জড়িয়ে ন্যাকড়ায় ক্লোরোফর্ম ঢেলে ছুড়ে দিল কুকুরটার দিকে। যেই না দেওয়া কুকুরটা আমনি ছুটে এসে শুকতে লাগল সেটা। তারপর বার বার সেটা নিয়ে কামড়া কামড়ি করতে করতে নিস্তেজ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

পাণ্ডব গোয়েন্দারা নিশ্চিন্ত হয়ে মাঠে ঢুকল এবার।

তাঁবুর ভেতর আলো জুলছে। এর মধ্যেই ওরা ঘুমিয়ে পড়েনি নিশ্চয়ই। বাবলু চুপি চুপি উকি মেরে ভেতরটা দেখল। বিলু, ভোম্বল, বাচ্ছু, বিচ্ছু দেখল।

একটা আয়নার সামনে দাড়িয়ে জিপসি মেয়েটা কী যেন দেখছে। আর সেই ইরানিটা একটা ঢোলের ভেতর অনেক কিছু লুকিয়ে রাখছে। রেখে আবার ছাউনি পরিয়ে দিল এমনভাবে যে ওর ভেতরে যে কিছু থাকতে পারে তা কেউ ধারণাও করতে পারবে না।

বিলু হঠাৎই বলল, জিপসি মেয়েটার গলায় একটা হিরের নেকলেশ রয়েছে মনে হচ্ছে না?

বাবলু অবাক হয়ে বলল, আরে তাই তো!

এই নেকলেশ কাউকে খুন করে নিয়ে এসেছে।

ভোম্বল বলল, এবার তা হলে পুলিশে খবর দিই?

বাবলু বলল, আর একটু পরে।

জিপসি মেয়েটা অনেকক্ষণ ধরে নেকলেশটা পরে আয়নায় নিজেকে দেখতে লাগল। তারপর সেটা খুলে রেখে মাথায় বালিশের নীচে চাপা দিয়ে শুয়ে পড়ল।

ইরানিটাও ঢোলটা টাঙিয়ে রেখে শুয়ে পড়ল একপাশে। ছোট্ট লণ্ঠনটা সমানে জুলতে লাগল। দু’-পাঁচ মিনিট বিরতি। তারপরই ভয়ংকর নাক ডাকার শব্দ। ভোম্বল আবার একটু ন্যাকড়াতে ওষুধ ঢেলে সেটা চেপে ধরল। ইরানিটার নাকে। দেখতে দেখতে নাক ডাকা থেমে গেল। তারপর যেই না সেটা জিপসি মেয়েটার দিকে নিয়ে যাবে আমনি সে লাফিয়ে চিৎকার করে উঠে দাঁড়াল। ওর এক হাতে লকলক করছে একটা ধারালো ছোরা। মেয়েটার চোখদুটোও যেন ইস্পাতের ফলার মতো বেঁকে গেল। সে হাত উচিয়ে ছোরাটা যেই না বাবলুকে মারতে যাবে পঞ্চু অমনি এক লাফে মেয়েটার হাত শক্ত করে কামড়ে ধরল।

পঞ্চুর কামড়ে হাত বেঁকে গেল মেয়েটার।

বাবলু কেড়ে নিল ছোরাটা। তারপর সেই ছোরাই ওর বুকের কাছে ঠেকিয়ে ভোম্বলকে বলল, ভেম্বল পুলিশ।

ভোম্বলকে থানা পর্যন্ত যেতে হল না। পথেই পুলিশের ভ্যান দেখতে পেয়ে সব কথা খুলে বলল। হাওড়া থানার দারোগীবাবু ওকে ভালই চিনতেন। এটা শিবপুর থানার এলাকা। ফোনে কথা হয়ে যেতেই ভ্যান বোঝাই পুলিশ সব হইহই করে এসে হাজির হল। সেইসঙ্গে এলাকার অনেক লোক।

পঞ্চু তখনও জিপসি মেয়েটার হাত কামড়ে ধরে বসে আছে। আর বাবলু সেই ছোরা ঠেকিয়ে রেখেছে। ওর বুকে।

বিলু, বাছু আর বিচ্ছু পাহারা দিচ্ছে ঘুমন্ত ইরানিটাকে।

পুলিশ এসেই হাতে হাতকড়া লাগাল দু’জনের। তারপর সমস্ত মালপত্তর উদ্ধার করে পাণ্ডব গোয়েন্দাদের বুদ্ধির প্রশংসা করে ওদের প্রত্যেককে গাড়িতে তুলে নিল।

সবাই অবাক হয়ে গেল এই অদ্ভুত ব্যাপার দেখে। কয়েকটা ছোট ছোট ছেলেমেয়ে যে এইসব কাণ্ডকারখানা করে এত বড় একটা খুনি ও চোরকে ধরিয়ে দেবে তা কেউ ভাবতেও পারেনি।

গাড়িতে উঠে বাবলু আনন্দে বলে উঠল—থ্রি চিয়ার্স ফর পাণ্ডব গোয়েন্দা।

অন্যরা বলল—হিপ হিপ হুরর রে।

পঞ্চু ডেকে উঠল-ভৌ। ভৌ ভৌ।

Super User