পরদিন সকালে তাড়াতাড়ি নাস্তা সেরে সাইকেল নিয়ে স্যালভিজ ইয়ার্ডে চলে এল মুসা। সবুজ ফটক এক-এর কাছাকাছি এসে দেখল, বেড়ার ধারে ঘাপটি মেরে রয়েছে রবিন।

কিশোর ফোন করেছিল তোমাকে? চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা।

না, ফিসফিস করে জবাব দিল রবিন। হেডকোয়ার্টারের কাছে ঘুরঘুর করছে। কে যেন।

রবিনের পাশে এসে বসে পড়ল মুসা। দেখল, ট্রেলারটা লুকানো রয়েছে যেসব জঞ্জালের তলায় তার কাছে নড়ছে কে যেন। ছায়ার জন্যে ভালমত দেখা যাচ্ছে না। জঞ্জাল সরিয়ে কিছু দেখার চেষ্টা করছে।

কিশোর কি ভেতরে? ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা। ওকে সতর্ক…

দেখ!

মুসাও দেখল, দুই সুড়ঙ্গের পাইপের মুখ দিয়ে উঁকি দিচ্ছে কিশোরের মুখ।

ও-ও শুনতে পেয়েছে, আবার বলল রবিন।  তার কথা কানে গেল কিশোরের। ঝট করে এদিকে মুখ ফিরিয়ে ঠোঁটে আঙুল রেখে কথা না বলার ইশারা করল। তারপর দেখাল জাংকইয়ার্ডের পেছন দিকে।

ঘুরে যেতে বলছে আমাদের, মুসার কানে প্রায় ঠোঁট ঠেকিয়ে বলল রবিন। ধরার চেষ্টা করতে বলছে।

নিঃশব্দে ঘুরে পেছনের বেড়ার কাছে চলে এল দুজনে। মস্ত একটা পুরানো ওয়াশিং মেশিনের আড়ালে লুকিয়ে সাবধানে মুখ বাড়াল। এখনও আগের জায়গায়ই রয়েছে ছায়াটা, নড়ছে।

হঠাৎ দৌড় দিল মুসা। চেঁচিয়ে বলল, খবরদার, যেখানে রয়েছ দাঁড়িয়ে থাক। নড়লে মাথায় বাড়ি মারব, একটা লোহার ডাণ্ডা তুলে নিয়েছে সে।

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল ছায়াটা। পাঁই করে ঘুরল। একটা ছেলে।

ধর, ধর ওকে! চিৎকার করে বলল রবিন।

ভয়ে চেঁচিয়ে উঠে ওয়ার্কশপের দিকে দৌড় দিল ছেলেটা। তাড়া করল দুই গোয়েন্দা। বার বার পেছনে তাকাচ্ছে ছেলেটা, কল্পনাই করল না সামনেও কেউ অপেক্ষা করছে। গিয়ে পড়ল সোজা কিশোরের হাতের মধ্যে।

ছাড়া পাওয়ার জন্যে মরিয়া হয়ে ঝাড়া মারল ছেলেটা। ছাড়, ছাড় আমাকে!

বয়েস আটের বেশি না। রোগা জিরজিরে শরীর। মাথা ভরা আঁকড়া কালো চুল, আর বড় বড় টলটলে দুটো চোখ। গায়ে কালো সোয়েটশার্ট, পরনে নীল জিনস, পায়ে কালো স্পীকার।

কি করছিলে তুমি ওখানে? ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা বাদ দিয়েছে ছেলেটা। বড় বড় চোখ মেলে কিছুটা অবাক হয়েই তিন কিশোরকে দেখছে। তোমরা তিন গোয়েন্দা, না! ইস, কি ভয়ই পাইয়ে দিয়েছিলে!

কি করছিলে তুমি? আবার জিজ্ঞেস করল কিশোর।

তোমাদের কথা শুনেছি, ছেলেটা বলল। জঞ্জালের মধ্যে নাকি হেডকোয়ার্টার লুকানো আছে তোমাদের। সেটাই খুঁজছিলাম। রকি বীচেই থাকি। আমিও ডিটেকটিভ, চোখ নামিয়ে জুতোর ডগায় লেগে যাওয়া মাটি দেখল সে। মানে, ডিটেকটিভ হতে চাইছি আরকি। চেষ্টা করছি।

আমাদেরকে খুঁজছিলে? রবিন প্রশ্ন করল।

জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল ছেলেটা। তোমাদের সাহায্য…আমার মা চায়। তাই আমি…

চত্বরের ওদিক থেকে শোনা গেল এক মহিলার ডাক, নরি? এই নরি? গেল কোথায়? এ-জুন্যেই আনতে চাইনি…

বলতে বলতে এসে দাঁড়াল এক অল্পবয়েসী মহিলা। পরনে উজ্জ্বল নীল পোশাক। লম্বা কালো চুল, বাদামী চোখ। চেহারায় উদ্বেগের ছাপ। তার পেছনে এসে দাঁড়াল একজন লোক, তারও বয়েস কম। চুল বাদামী, পরনে হালকা নীল সুট। কুঁচকে রয়েছে ভুরু, সব সময়ই ওরকম থাকে মনে হয়।

কারমল? উজ্জ্বল হল কিশোরের চোখের তারা। মিস্টার অ্যান্ড মিসেস কারমল?

আমি এলসা কারমল, মহিলা জবাব দিল। আমার স্বামী মারা গেছে। ও  আমাদের বন্ধু, উকিল রস উড।

আমাদের কাছে কেন এসেছেন? মুসা জিজ্ঞেস করল।

ভাড়া করতে! চেঁচিয়ে উঠল নুরি। দাদার গুপ্তধন খুঁজে দিতে।

হেসে উঠল উড। নরি, তোমাকে আমরা বলিনি কাউকে ভাড়া করতে যাচ্ছি। মিস্টার ক্রিস্টোফার অবশ্য তিন গোয়েন্দার কথা বলেছেন, ছেলেদের দিকে তাকাল সে, তোমরাই নাকি? পুরো ব্যাপারটা একটা রসিকতা, বুঝেছ। যা রায় দেয়ার কোর্টই দেবে। ক্যালিফোর্নিয়ার আইনে নরিরই পাবার কথা, যদি না আসল উইলটা পাওয়া যায়, যেটাতে এলসা আর নরির নামে সম্পত্তি লিখে দেয়া হয়েছে।

পাওয়া যায় মানে? কিশোরের প্রশ্ন। কেন, উইলটা আপনার অফিসে নেই নাকি?

ছিল। হারিয়ে গেছে। দেখা যাক বুড়ো কারমলের বাড়িতে পাওয়া যায় কিনা।

খোঁজা তো হল অনেক, পাওয়া গেল না, ফস করে বলল নরি। গুপ্তধন কোথায় লুকানো তা-ও জানি না। আপনিও তো বললেন, যে আগে খুঁজে পাবে, ওগুলো তার।

নরি ঠিকই বলেছে, এলসা বলল। খুঁজে বের করে সহজেই চুরি করে নিয়ে যেতে পারবে।

সহজে চুরি বলছেন কেন? জানতে চাইল কিশোর।

চট করে পরস্পরের দিকে তাকাল এলসা আর উড। যাগ করল উকিল। বলল, বুড়ো কারমল ছিল এক আজব মানুষ। সুন্দর একটা কটেজ আছে তার, ওটাতে থাকতে দিয়েছিল এলসা আর নরিকে, অথচ নিজে থেকেছে একটা পুরানো জরাজীর্ণ বাড়িতে। দুটো বাড়ি একই জায়গায়। পোশাকে আশাকে মনে হত ভিখিরিরও অধম, একটা পয়সা খরচ করতে চাইত না, অথচ আমরা জানি অনেক টাকার মালিক ছিল সে। কোন ব্যবসায় খাটায়নি ওই টাকা, ব্যাংকে রাখেনি। ঘরেও না, অন্তত তা-ই মনে হয়। রোববারে সে মারা যাবার পর তন্ন তন্ন করে বাড়িটা খুঁজেছি, কিছুই পাইনি। ব্যাংকের কোন চেকবই নেই। তারপর গতকাল জানলাম, সমস্ত টাকা দিয়ে পাথর কিনেছে বুড়ো। লাখ লাখ ডলারের উপল, চনি, পান্না আর নীলকান্ত মণি।

তার কারণ, বুঝতে পারছে কিশোর, দামের তুলনায় অনেক কম জায়গা দখল করে পাথর। লুকানো সহজ, চুরি করাও সহজ।

গভীর হয়ে মাথা ঝাঁকাল উড। তাড়াতাড়ি ওগুলো খুঁজে না পেলে আর কোনদিন আমাদের পাওয়ার আশা বাদ। অবশ্যই যদি এজটাররা পেয়ে যায়। এলসা আর নরির জন্যে থোড়াই কেয়ার করে ওরা।

এজটাররা কে? রবিন প্রশ্ন করল।

বুড়োর ভাগ্নে-ভাগ্নি। লণ্ডনে বাস। কারমলের বোন অনেক বছর আগেই মারা গেছে। ওদেরকে পছন্দ করত না বুড়ো, দেখা-সাক্ষাৎও ছিল না অনেকদিন। কিন্তু দুদিন আগে রকিবীচে এসে হাজির হয়েছে ওরা। গুপ্তধনের জন্যে পাগল হয়ে গেছে।

আচ্ছা, এরকম একটা অদ্ভুত উইল করতে গেলেন কেন মিস্টার কারমল? জানতে চাইল কিশোর। বলতে পারেন?

কারণ, কাটা জবাব দিল উকিল, লোকটা ছিল আস্ত পাগল।

বিষণ্ণ ভঙ্গিতে বলল এলসা, আত্মীয়-স্বজন কাউকে দেখতে পারত না। এমনকি আমাকে আর নরিকেও না। সেজন্যেই এই রসিকতা।

আর রসিকতাও জবর রসিকতা! মাথা দুলিয়ে বলল মুসা।

হ্যাঁ, ধাঁধা বানিয়ে উইল লিখে যাওয়া রসিক মনের পরিচয়ই দেয়, কিশোর বলল। আমার বিশ্বাস, ধাঁধার সমাধান পাওয়া গেলে রুহ পাওয়া যাবেই। আপনার কি মনে হয়?

জানি না, জবাব দিল উড। তবে সূত্রটুত্র কিছুই নেই হাতে। বুড়োর বাড়িতে নেই। অন্য কোথাও লুকিয়ে ফেলেছে, বুড়োর যেরকম স্বভাব…।

তাহলে কি আমরা খুঁজে বের করে দেব? ভুরু নাচাল কিলোর। আমরা অভিজ্ঞ গোয়েন্দা…

সরি, বয়েজ, বাধা দিয়ে বলল এলসা। কোন আসল গোয়েন্দা সংস্থা হলে… ওরা আসলই, মা, চেঁচিয়ে বলল নরি, কিশোর, তোমাদের কার্ড দেখাও তো!

মুহূর্তে তিন গোয়েন্দার কার্ড বের করে মিসেস কারমলের নাকের নিচে ধরল কিশোর।

পুলিশ চীফ ইয়ান ফ্লেচারের সার্টিফেকেটটাও দেখিয়ে দাও না, হাত নেড়ে বলল মুসা।

কার্ড, সার্টিফিকেট দেখে সলজ্জ হাসল এলসা, সরি, বয়েজ, তোমরা সত্যিই গোয়েন্দা।

এবং তোমাদের মত লোকই বোধহয় আমাদের দরকার, বলল উড। নরির কাছে শুনলাম, কয়েকটা জটিল রহস্যের সমাধান নাকি তোমরা করেছ। এলসা, ওদের কার্ড, সার্টিফিকেট দেখে অবাকই লাগছে, তাই না? এই বয়েসে পুলিশ চীফের সার্টিফিকেট পাওয়া…ভাড়া করা যায় ওদেরকে, তাই না?

হ্যাঁ, যায়।

হাততালি দিয়ে লাফিয়ে উঠল নরি। ভাল হয়েছে, খুব ভাল! আমিও ওদের সঙ্গে থাকতে পারব, না মা?

নিশ্চয়ই না। তুমি ওদের চেয়ে অনেক ছোট। ওদের মত ছোটাছুটি করতে পারবে না।

কেন পারব না? আট বছর বয়েস আমার। ছোট রয়েছি নাকি এখনও?।

শুরু করে দাও তাহলে তোমরা, উকিল বলল তিন গোয়েন্দাকে। সময় নষ্ট করা উচিত হবে না। যা করার গোপনে করবে, কেউ যাতে টের না পায়।

খাইছে! ঘুড়ি দেখে আঁতকে উঠল মুসা। ইস্কুলে যেতে হবে আমাদের।

গোপনে করার কথা কেন বলছেন? রবিন ধরল কথাটা। ব্যাপারটা কারমলই তো গোপন রাখেননি, পেপারে ছাপিয়ে দিয়েছেন। আজকের কাগজেই বের হবে।

সর্বনাশ! গুঙিয়ে উঠল এলসা। আজকেই! গুপ্তধনের খোঁজে মৌমাছির চাকের মত ভেঙে পড়বে সারা শহর! জলদি করতে হবে তোমাদের!

তাড়াহুড়ো করে বাঁধার সমাধান করতে পারবে না কেউই, সবারই সময় লাগবে। এক ধাপ এক ধাপ করে এগোতে হবে, কাজেই ভয়ের কিছু নেই। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে সমাধান করতে বসব। প্রথম ধাপ থেকে শুরু করতে হবে প্রথমে।

সেটা কি? উড জানতে চাইল।

অবশ্যই বুনো কুকুরেরা যেখানে বাস করে, হেসে বলল গোয়েন্দাপ্রধান। পকেট থেকে উইলের একটা নকল বের করে পড়ল, হোয়্যার দ্য ওয়াইল্ড ডগস লিভস, দ্য বটল অ্যাণ্ড স্টপার, এক মুহূর্ত বিরতি দিয়ে পড়ল, শোজ দ্য ওয়ে টু দ্য বিলাবং। হাসল সে। নিশ্চয়ই জানেন, ঝর্না, ডোবা কিংবা ছোট জলাশয়কে অস্ট্রেলিয়ানরা বলে বিলাবং। ওয়াইল্ড ডগ বলে নিশ্চয় নিজেকে বোঝাতে চেয়েছেন কারমল, কারণ তিনি অস্ট্রেলিয়ান। নিজেকে ওয়াইন্ড ডগ বা ডিংগো ভাবতে পছন্দ করতেন। হোয়্যার দ্য ওয়াইল্ড ডগস লিভস, অর্থাৎ যেখানে বুনো কুকুরেরা বাস করে বলে নিশ্চয় নিজের বাড়ি বুঝিয়েছেন। সুতরাং ওখানে গিয়ে দেখতে হবে ছিপি লাগানো একটা বোতল কোন জলাশয়ের দিকে মুখ করে রয়েছে কিনা।

<

Super User