মানুষ অমানুষ- ইসলামিক উপন্যাস – কাসেম বিন আবুবাকার
গ্রীষ্মের দুপুর। প্রখর সূর্য-কিরণে ঢাকা শহরের পীচঢালা পথ তেতে আগুনের মত গরম হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও পীচ গলতে শুরু করেছে। অবশ্য তাতে শহরের লোকের চলাফেরার অসুবিধে হচ্ছে না। কারণ গরিব-ধনী সবার জন্য সব রকমের যানবাহন রয়েছে। নিতান্ত যাদের হাঁটা ছাড়া কোন উপায় নেই, তারাই শুধু হাঁটছে। তাও সবার পায়ে জুতো। তবে খালি পায়ে যে কেউ হাঁটছে না, তা নয়। তারা হল, ফকির-মীসকিন ও ঠেলাওয়ালাদের কিছু লোক।
বেলা তখন একটা। আরিফ মহাখালী কলেরা হাসপাতালের ভিতরের গেটের বাইরে বন্ধু আবসারের পাশে বসে আছে। গরমে গায়ের জামা-কাপড় ঘামে ভিজে যাচ্ছে। যেখানে রুগীদের লোকজন বসে অপেক্ষা করে, সেখানে কয়েকটা বেঞ্চ থাকলেও ফ্যান নেই। মেয়েদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা না থাকায়, একজায়গাতেই সবাই বসে আছে। এখানে যারা রয়েছে, তাদের কারো না কারো আত্মীয়ের ডাইরিয়া অথবা কলেরা হয়েছে।
এক সময় আরিফ আবসারকে বলল, তুই বাসায় গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করে ভাবীর ও খালা-আম্মার ভাত নিয়ে আয়। চিন্তা করিস না, আমি তো আছি।
আবসার বলল, তাই যাই, যা গরম পড়েছে, আর একবার গোসলও করব। তারপর সে চলে গেল।
আজ ভোর থেকে আবসারের বাবা খায়ের সাহেবের বেশ কয়েকবার পাতলা পায়খানা ও বমি হয়েছে। বাসায় ডাক্তার এনে চিকিৎসা করানোর পরও যখন পাতলা পায়খানা ও বমি বন্ধ হল না তখন ডাক্তার মহাখালী কলেরা হাসপাতালে নিয়ে যাবার পরামর্শ দেন। কিন্তু খায়ের সাহেব রাজি হননি। বললেন, এই অসুখে আমার মৃত্যু লেখা থাকলে, হাসপাতালে নিয়ে গেলেও তা হবে। সেখানে ডাক্তার-নার্সদের হাতে আমি মরতে চাই না। শেষে বেলা এগারটার পর যখন পায়খানা ও বমি ঘন ঘন হতে লাগল এবং হাতে-পায়ে খিচুনী এসে গেল তখন বড় ছেলে আবসার ও তার স্ত্রী রীমা তাকে জোর করে হাসপাতালে নিয়ে আসে। সঙ্গে আবসারের মা আকলিমা বেগমও এসেছেন।
ভার্সিটিতে জুওলজীতে অনার্স পড়ার সময় আরিফের সঙ্গে আবসারের বন্ধুত্ব হয়। অনার্স পাস করে আবসার বাবাকে আর্থিক সাহায্য করার জন্য চাকরি করছে। আর আরিফ মাস্টার্স করছে।
খায়ের সাহেব গাইবান্ধার লোক। ঢাকায় একটা প্রাইভেট ফার্মে ভাল পোষ্টে আছেন। কিন্তু সৎ হওয়ার কারণে ফ্যামিলীসহ ঢাকায় থাকা এবং চার-পাঁচটা ছেলেমেয়ের পড়াশুনার খরচ চালাতে খুব হিমশিম খাচ্ছিলেন। আবসার চাকরিতে ঢুকতে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন।
আকলিমা বেগম হার্টের রুগী। আজকাল শহরে কাজের মেয়ে পাওয়া যায় না। কিশোরী, তরুণী ও যুবতীরা গার্মেন্টসে চাকরি করে। অসুস্থ শরীর নিয়ে আকলিমা বেগম সংসারের সব কাজ করেন। তাই খায়ের সাহেব আবসারের বিয়ে দিয়েছেন। আবসারের এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করার ইচ্ছা ছিল না। মায়ের জন্য একরকম করতে বাধ্য হয়েছে। তবে বাবা-মা বিয়ে দিলেও পাত্রী নিজে সিলেক্ট করেছে। অফিসে যাবার পথে প্রায় মেয়েটির সাথে আবসারের দেখা হত। কোন কোন দিন ফেরার সময় তাকে তাদের বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখত। তখন আবসারের মনে হত, মেয়েটি যেন তাকে দেখার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। কয়েক বার চোখে চোখও পড়েছে। প্রথম দিন আবসার লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে হাঁটতে থাকে। কিছু দূর আসার পর আবসারের মনে হল, মেয়েটি তার দিকে চেয়ে আছে। অনুমানটা যাচাই করার জন্য ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, সত্যিই তাই। আবসার ঘাড় ফিরিয়ে নিয়ে চলে আসে। কয়েক বছর কলেজ-ভার্সিটিতে পড়লেও কোন মেয়েকে নিয়ে তেমন কিছু ভাবেনি। অফিসে জয়েন করার পর এই মেয়েটা তাকে মাঝে মাকে ভাবায়। মেয়েটার গায়ের রং ফর্সা হলেও ফেস কাটিং ভাল নয়। চোখ দুটো কেমন ভাসা ভাসা-নাক চেপটা-ঠোঁট মোটা। তবে শরীরের বাঁধন ভাল, সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা, দোহারা শরীর। সর্বোপরি তার উন্নত বক্ষ দুটো দারুণ। হাঁটার সময় ভারী নিতম্বের উত্থান-পতন যে কোন বয়সের পুরুষের মনকে নাড়া দেয়। বন্ধু আরিফের কাছে শুনেছে, যে সব মেয়েদের ফেসকাটিং খারাপ কিন্তু দেহের গঠন ভাল, তারা সাধারণত ঠাণ্ডা মেজাজের হয়, এবং খুব স্বামীভক্ত হয়। মেয়েটিকে দেখার পর থেকে আবসারের প্রায় মনে হয়, একে বিয়ে করলে মন্দ হয় না। আবার চিন্তা করে, এরকম মেয়েকে কি মা-বাবা পছন্দ করবে? একদিন অফিসে যাবার সময়ে এইসব ভাবতে ভাবতে একসময় নিজে নিজে শব্দ করে হেসে উঠল।
একজন বয়স্ক পথিক পাশ দিয়ে যাবার সময় আবসারের হাসি শুনে জিজ্ঞেস করলেন, কি হল দাদু, একা একা হাসছেন যে?
আবসার লজ্জা পেয়ে হাসি থামিয়ে বলল, না দাদু, কিছু হয়নি, একটা হাসির কথা মনে পড়ল, তাই হাসলাম।
পথিক বললেন, এখনই তো আপনাদের হাসবার বয়স।
আবসার আর কিছু না বলে হাঁটতে শুরু করল।
এভাবে ছয় মাস কেটে গেল। একদিন আকলিমা বেগম আবসারকে বললেন, এই শরীর নিয়ে আমি আর তোদের সংসার টানতে পারছি না। তুই এবার বিয়ে কর। মায়ের কথা শুনে আবসার চিন্তা করল, চাকরি করে বাবাকে সাহায্য করছি, বিয়ে করে একটা মেয়েকে আনলে মাকেও সাহায্য করা হবে। তখন তার ঐ মেয়েটির কথা মনে পড়ল। একদিন মেয়েটির ব্যাপারে আলাপ করার জন্য আরিফের বাসায় গেল।
সালাম ও কুশলাদি বিনিময়ের পর আরিফ জিজ্ঞেস করল, কিরে চাকরি জীবন কেমন কাটছে?
আবসার বলল, কাটছে এক রকম। তা তুই আর আমাদের বাসায় যাস না কেন?
আজ যাব মনে করেছিলাম। তুই যখন এসে পড়লি তখন আর যাব না।
আমি এসেছি তো কি হয়েছে, আমার সনেই না হয় যাবি।
তা না হয় যাব; কি তুই হঠাৎ কি মনে করে এলি?
কেন, তোর কাছে কি আগে কোন দিন আসিনি?
এসেছিস; চাকরি করার পর আজ প্রথম এলি তো, তাই বললাম। এবার আসার কারণটা বলে ফেল দেখি?
আমি তো কারণ ছাড়াই কতবার এসেছি, তবু জিজ্ঞেস করছিস কেন?
তা এসেছিস; কিন্তু আজ কোন কারণে যে এসেছিস, তা আমি হলফ করে বলতে পারি।
সত্যি আরিফ, তোর কথা শুনে মাঝে মাঝে আমি খুব অবাক হয়ে যাই। কি করে যে তুই মানুষের মনের কথা জানতে পারিস? ভার্সিটিতে পড়ার সময় যেদিন ইলেকসন হল, তার দুদিন আগে যখন ছাত্র লীগের নেতা বাসিত ভাই ইলেকসনের ব্যাপারে কথা বলে চলে যেতে উদ্যত হল তখন দুই তাকে বললি, বাসিত ভাই, ইলেকশনে ইন্শাআল্লাহ আপনি জিতবেন। একটা অনুরোধ রইল, ঐদিন আপনি একাকী কোথাও যাবেন না। বাসিত ভাই ধন্যবাদ জানিয়ে চলে গেল। কিন্তু এ দিন বাসিত তাই একাকী কোথায় যেন যাছিলেন, সেই সময় অন্য পার্টির ছেলেদের আক্রমণে বাসিত ভাই একটা পা হারালেন এবং ইলেকসনে জয়ীও হলেন। আরো এমন অনেক কথা তুই মাঝে মাঝে আমাকে বলেছি, যেগুলো সত্যি ঘটেছে। কি করে জানতে পারিস- বলবি?
আরিফ একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, কি করে বলি আমি নিজেই জানি না, তোকে বলব কি করে? এসব কথা বাদদে, আজ মনটা ভাল নেই তাই তোদর বাসায় যাব মনে করেছিলাম। এবার তোর আসার কারণটা তাড়াতাড়ি বলে ফেল।
আগে তুই বল, তোর মন খারাপ কেন?
গতকাল চিঠি এসেছে, আম্মার শরীর খারাপ। আব্বা যেতে বলেছে। ভাবছি, দুএক দিনের মধ্যে যাব।
তাই যাস। এখন আমাদের বাসায় যাবি, না বকবক করবি?
আজ আর তোদর বাসায় যেতে মন চাইছে না, তার চেয়ে দুজনে বোটানিক্যাল গার্ডেনে বেড়াতে যাই। আচ্ছ, তুই আসল কথাটা বলছিস না কেন?
তুই অন্যের মনের কথা জানতে পারিস, আমারটা পারছিস না?
দেব এক থাপ্পড়, এমন কথা আর বলবি না। মানুষের মনের কথা একমাত্র আহপাক ছাড়া আর কেউ জানতে পারে না। এই কথা বলে একটা হাত তুলে এগিয়ে এল।
আবসার সরে গিয়ে বলল, সত্যি সত্যি তুই থাপ্পড় মারবি নাকি? তোর ক্যারাতি হাতের থাপ্পড় খেলে হাসপাতালে যেতে হবে। আরিফ যে ক্যারাতে পারদর্শী, আবার তা জানে।
আরিফ হেসে উঠে হাত নামিয়ে বলল, তুই এখনো তীতুই রয়ে গেলি।
তা না হয় আমি ভীতু; কিন্তু মাঝে মাঝে যা বলিস, তা তো সত্যি হয়।
আরিফ হাসতে হাসতেই বলল, আরে বোকা, আমি আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ি, আর সেটা ঠিক জায়গায় লেগে যায়। নে এবার বলে ফেল।
আবসার বলল, একটা মেয়ের প্রতি দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছি। তাকে যত মন থেকে সরাতে চাই, তত জেকে বসে যাচ্ছে।
আরিফের ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠে মিলিয়ে গেল। বলল, তাই নাকি! তা মেয়েটার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে?
না
নাম-ধাম জানিস?
না।
নাম জানি না। তবে ধাম জানি। তাদের বাসার সামনে দিয়ে আমার অফিসে যাবার রাস্তা।
মেয়েটাকে যখন পছন্দ তখন তার সবকিছু জেনে তোর বাবা-মাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে বল। তা হাতে, মেয়েটা নিশ্চয় দেখতে-শুনতে ভাল?
দেখতে ভাল নয়; তবে রং ফর্সা। আর দেহের গঠন খুব সুন্দর।
আমাকে দেখাতে পারবি?
কেন পারব না। প্রতিদিন অফিসে যাবার পথে দেখা হয়। কোন কোন দিন ফেরার সময় বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি।
কাল সকালে তোদের বাসায় যাব। এখন চল বেড়াতে যাই। ওমরকে দুকাপ চা আনতে দেখে আবসারকে জিজ্ঞেস করল, নাস্তা দিতে বলব নাকি?
নাস্তা খেয়ে বেরিয়েছি, শুধু চা হলেই হবে।
চা খেয়ে দুজনে বেরিয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ চিড়িয়াখানা ঘুরে ঘুরে দেখল, তারপর বোটানিক্যাল গার্ডেনে ঢুকে একটা গাছের ছায়ায় বসল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আরিফ বলল, তোর মানসীর কথা বল।
তার সম্বন্ধে যা বলেছি, তার বেশি কিছু জানি না।
তুই তো বললি, মেয়েটা দেখতে ভাল নয়; তবু তাকে তোর পছন্দ হল কেন?
তা বলতে পারব না। সে যদি সুন্দরী হত, তাহলেও হয়তো পছন্দ হত। মেয়েটার ফেসকাটিংটাই যা খারাপ; অন্যান্য সবকিছু সুন্দর। তুই তো একদিন বলেছিলি, যে মেয়ে দেখতে খারাপ, সে সাধারণত ঠাণ্ডা মেজাজের হয়, খুব স্বামীভক্ত হয়।
তা অবশ্য বলেছিলাম, তাই বলে সবাই যে এরকম হবে, তা ঠিক নয়। এক কাজ কর, তুই দুএকদিনের মধ্যে তার সঙ্গে আলাপ করে তার মনোভাব বোঝার চেষ্টা কর। তারপর না হয় একদিন তোদের বাড়িতে যাব। মেয়েটা যদি তোকে পছন্দ না করে, তাহলে আমি আর তাকে দেখে কি করব?
কথাটা তুই মন্দ বলিসনি, ঠিক আছে, আমি তার সঙ্গে আলাপ করে দেখি, তারপর তোকে জানাব।
হ্যাঁ তাই কর। আমার মনে হয় সেটাই ঠিক হবে। ততদিনে আমিও বাড়ি থেকে ঘুরে আসি।
তাই ঘুরে আয়। এবার চল ফেরা যাক।
পরের দিন আবার অফিসে যাবার সময় মেয়েটিকে নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, তার কাছে এসে বলল, কিছু যদি মনে না করেন, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
মেয়েটি এক পলক আবসারের দিকে চেয়ে দৃষ্টি নত করে বলল, বলুন কি বলবেন।
আপনি প্রতিদিন ঠিক এই সময়ে এখানে দাঁড়িয়ে থাকেন কেন?
মেয়েটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনিই বা আমাকে এই কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?
প্রথমে আপনার অনুমতি নিয়ে আমি প্রশ্ন করেছি, আমার উত্তরটা আগে দিন, পরে আপনারটা দেব।
যদি না দিই?
না দিলে তো জোর করতে পারব না, তবে আশা করেছিলাম দিবেন।
মেয়েটি মৃদু হেসে বলল, আশা যখন করেছিলেন তখন নিরাশ করা ঠিক হবে না। একজনের জন্য প্রতিদিন অপেক্ষা করি। এবার আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।
আমি এই উত্তরটাই অনুমান করেছিলাম, তাই জিজ্ঞেস করলাম। আপনার নামটা জানতে পারি?
নাম জানার কি দরকার?
দরকার থাকতেও তো পারে।
অপরিচিত কোন মেয়ের নাম জানতে চাওয়া কি অভ্রতা।
তা ঠিক, তবে পরিচয় হবার পর নাম জানতে চাওয়া অপ্ৰতা নয়।
আপনার কথাও ঠিক; কিন্তু আমাদের মধ্যে তো এখনো পরিচয় হয়নি।
আলাপের মধ্যে দিয়েই পরিচয় হয়। অবশ্য আপনি যদি পরিচয় করতে না চান, তাহলে অন্য কথা। আমি বোধ হয় অন্যায় করে ফেললাম, মাফ করবেন। এবার আসি তাহলে, বলে আবসার চলতে শুরু করল।
দাঁড়ান চলে যাবেন কেন? মনে হচ্ছে রাগ করেছেন?
আবসার দাঁড়িয়ে পড়ল।
মেয়েটি এগিয়ে এসে বলল, চলুন যেতে যেতেও আমরা পরিচিত হতে পারি। আক্ষণ হাঁটার পর আবসার বলল, আপনি কি এখনো নাম বলেননি।
রীমা। আপনার?
আবসার নাম শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে তার মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল।
কি হল? ওভাবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন কেন? নাম বলবেন না? আবসার মৃদু হেসে নাম বলে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল।
কিছু বললেন না যে?
আপনার নামের অর্থ জানেন?
না।
আবসার আবার মৃদু হেসে চুপ করে হাঁটতে লাগল।
রীমা তাকে দুবার হাসতে দেখেছে। জিজ্ঞেস করল, আমার নাম শুনে হাসলেন কেন?
আপনার ভাল নাম কি?
আসমা হোমায়রা।
আবসার এবার শব্দ করে হেসে উঠে বলল, ওটারও নিশ্চয় মানে জানেন না?
না, জানি না। মনে হলো, আমার নামের মধ্যে কিছু ব্যাপার-স্যাপার আছে। তা হলে দুটো নাম শুনেই হাসবেন কেন?
তা আছে। তবে শুনলে আপনি মাইন্ড করবেন।
না মাইন্ড করব না, আপনি বলুন।
আপনার ডাকনামের অর্থ হল–সুন্দরী স্ত্রী। আর ভাল নামের অর্থ হল–অতুলনীয় সুন্দরী।
এবার রীমা তার পথ আগলে বেশ রাগের সঙ্গে বলল, সত্য বললেন, না বিদ্রূপ করছেন?
জানতাম আপনি মাইণ্ড করবেন। সত্য মিথ্যা জানতে হলে কষ্ট করে কারো কাছ থেকে জেনে নিতে হবে। তবে একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেন, আপনাকে বিদ্রূপ করিনি।
আপনার নামের অর্থ নিশ্চয় জানেন?
আমার পুরো নাম রাগীব আবার। তার অর্থ হল—আকাঙ্খিত দৃষ্টি।
রীমা কিছু না বলে চলতে শুরু করল।
আবসারও চলতে শুরু করে বলল, কিছু বলছেন না যে?
আপনি বোধ হয় কোন অফিসে চাকরি করেন?
হ্যাঁ। আপনি?
একটা গার্মেন্টসের সুপারভাইজার।
কোথায়?
বাস স্ট্যান্ডের অপজিট গলিতে। আপনি তো বাসে উঠবেন?
ততক্ষণে তারা বাস স্ট্যান্ডে এসে পড়েছে।
হ্যাঁ। তারপর একটা বাস আসতে দেখে বলল, আজ তাহলে আসি, কাল আবার দেখা হবে। এমন সময় বাস এসে থামলে আবসার আল্লাহ হাফেজ বলে বাসের দিকে এগোল।
রীমাও আল্লাহ হাফেজ বলে তার দিকে চেয়ে রইল। বাসটা চলে যেতে সেও নিজের পথে রওয়ানা দিল।
ঐদিন ফেরার পথে আবার দেখল, রীমা তাদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে চেয়ে আছে। সেদিকে তাকাতে চোখে চোখ পড়ে গেল। আবসার দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে চলে এল।
পরের দিন অফিস টাইমের কিছু আগে আবার রওয়ানা দিল। ভাবল, আজ রীমাকে তার মনের কথা জানাবে। নিদি জায়গায় এসে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাছে এসে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?
রীমা সালামের উত্তর দিয়ে হাঁটতে শুরু করল।
আবার তার পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল, আমার উপর রেগে আছেন মনে হচ্ছে?
কি করে বুঝলেন?
কিছু বলছেন না বলে।
বললে শুনবেন?
বলেই দেখুন।
আপনার ক্ষতি হতে পারে।
তা হোক তবু বলুন।
তাহলে আসুন আমার সঙ্গে। তারপর একটা খালি রিক্সা দাড় করিয়ে বলল, এই রিক্সা, রমনা পার্কে যাবে?
রিক্সাওয়ালা না বলে চলে গেল।
আবসার বলল, আমরা তো এক রিক্সায় যেতে পারি না।
রীমা বেশ অবাক হয়ে বলল, কেন?
পাশাপাশি বসার অধিকার এখনো আমাদের প্রতিষ্ঠা হয়নি।
আমি তো সে অধিকার আপনাকে দিচ্ছি।
আপনি দিলে তো হবে না। অধিকার দিতে হলে আইনের মাধ্যমে দিতে হবে।
এমন সময় একটা খালি বেবী আসতে দেখে আবার হাত বাড়িয়ে থামাল। তারপর রীমাকে বলল, নিন উঠুন। বেবীতে বসে ড্রাইভারকে বলল, রমনা পার্কে চল। পার্কের গেটে বেবী বিদায় করে রীমাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকল। এ সময় পার্কে ভীড় একটু কম থাকে। তারা একটা গাছের তলায় বসল।
রীমা বলল, তখন আইনের কথা কি বললেন, বুঝলাম না।
আবসার বলল, না বোঝার তো কথা নয়। যদি সত্যি সত্যি বুঝতে না পেরে থাকেন, তাহলে না বোঝাই ভাল।
কেন?
গতকালের মত মাইণ্ড করবেন।
মাইণ্ড করলে আজ আপনার সঙ্গে দেখাই করতাম না। এখন বলন কি বলতে চাচ্ছেন?
আইন বলতে আমি বিয়ের কথা বলতে চাচ্ছি। একমাত্র নিজের স্ত্রী ছাড়া বেগানা নারী-পুরুষ পাশাপাশি বসতে পারে না।
রীমা বলল, আপনি কতদূর লেখাপড়া করেছেন?
বি, এ, পাস করেছি। আরো পড়ার ইচ্ছা থাকলেও উপায় ছিল না।
তবু একথা বলতে পারলেন?
এটা আমার কথা নয় আলাহ ও তাঁর রসুল (দঃ)-এর। কোন মুসলমানের তাদের আইন অমান্য করা উচিত না।
এবার আমি একটা প্রশ্ন করব, মাইন্ড করবেন না তো?
না করব না, বলুন কি বলবেন?
কোন মেয়ের সঙ্গে প্রেম করেননি?
আগে কখনো করিনি। তবে ইদানিং একটা মেয়েকে ভালবেসে ফেলেছি।
মেয়েটা জানে?
তা এখনো বুঝতে পারিনি। আচ্ছা, আমি যদি আপনাকে ঐ একই প্রশ্ন করি?
তা করতে পারেন। কিন্তু আমার মত মেয়ের দিকে কে নজর দেবে?
যদি কেউ দেয়?
তাহলে ভাববো, তিনি অনুগ্রহ দেখানে। আমি কারো অনুগ্রহের পাত্রী হতে চাই না।
যদি সত্যি সত্যি কেউ ভালবাসে?
সে রকম হলে ভাববো সেটা আমার সৌভাগ্য।
যদি বলি আমি আপনাকে ভালবাসি।
বিদ্রূপ, না ঠাট্টা?
কোনটাই নয়, সত্যি বললাম।
প্রমাণ দেখাতে পারবেন
নিশ্চয়। বলুন কি প্রমাণ দেখতে চান?
এক্ষুনি আমাকে বিয়ে করতে পারবেন?
আবসার এতটা আশা করেনি, কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে হাসিমুখে বলল, আমার কোন আপত্তি নেই, তবে তার আগে বাবা-মাকে জানাতে হবে।
কেন? আপনার ব্যক্তিত্ব নেই?
আছে বলেই তো এক কথায় রাজী হয়ে গেলাম।
তাহলে বাবা-মার কথা বললেন কেন? তারা যদি আমাকে দেখে অপছন্দ করেন?
তারা তো বিয়ে করছে না, করছি আমি।
তবু তাদেরকে জানাতে চাচ্ছেন কেন?
এটা জানান সন্তানের কর্তব্য।
তারা যদি রাজী না হন?
রাজী হবার চান্স নব্বই পার্সেন্ট।
রীমা কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, আমার মত মেয়ের পেছনে লাগলেন কেন? আপনার আত্মীয়রা ছি-ছি করবেন।
সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
ব্যক্তিগত ব্যাপারটাই আমি জানতে চাই।
আমার কাছে তুমি, সরি, আপনি আপনার নামের মত অতুলনীয় সুন্দরী।
আমাকে তুমি করেই বলবেন। তারপর একটা দীর্ঘ নিঃশাস ফেলে বলল, জানি আমার ভাগ্যে কি আছে।
ভাগ্যে যা আছে তা হবেই। সেটাকে নিয়ে অত দুশ্চিন্তা করছ কেন? আমাকে কী বিশ্বাস করতে পারছ না?
সে কথা পরে বলব, আপনি কি আমাদের ফ্যামিলির খোঁজখবর নিয়েছেন?
না, নিইনি। কারণ সে সবের প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনি।
কথাটা কি ঠিক বললেন? যাকে জীবন সঙ্গিনী করতে চাচ্ছেন, তার সবকিছু জানা উচিত।
তাহলে আমারও সবকিছু তোমার জানা উচিত? প্রথমে তোমারটা বল তারপর আমারটা বলব।
রীমা বলতে শুরু করল, আমার বাবারা পাঁচ ভাই। বড় আর ছোট বেঁচে আছেন। আমার বাবা সকলের ছোট। আমাদের দেশের বাড়ী কিশোরগঞ্জে। বাবা বি.এ. পাস করে স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। জমি-জায়গা যা ছিল তাতে বেশ ভালভাবে সংসার চলে। যাচ্ছিল। আমরা পাঁচ বোন তিন ভাই। দুবোন সবার বড়। তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। তারপর বড় ভাই। সে প্রেম করে বিয়ে করেছে। ভাবীর সঙ্গে মায়ের বনিবনা হয় না। তাই সে অন্য জায়গায় বাসা ভাড়া করে থাকে। সেজ বোনেরও বিয়ে হয়ে গেছে। তারপর আমি। আমার পর ছোট দুটো ভাই এক বোন আছে। তারা লেখাপড়া করছে। সংসার বেড়ে যাওয়ার ফলে সংসারে আর্থিক অনটন দেখা দেয়। সেই সময় বাবা তার এক বন্ধুর কথায় ঢাকাতে এসে কন্ট্রাকটারী শুরু করেন। টাকার প্রয়োজনে দেশের বাড়ীর অনেক জমি-জায়গা বিক্রি করে দেন। কিন্তু সেই বন্ধুর খপ্পরে পড়ে বাবা কন্ট্রাকটারী করতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। আমি এস. এস. সি. পাস করেছিলাম। ভাগ্যচক্রে এই চাকরিটা পেয়ে যাই। এখন আমার উপার্জনে কোন রকমে সংসার চলে যাবে। অবশ্য বড় ভাই আমাদের বাসাভাড়ার টাকাটা দেয়। মেজ ভাইটাকে পড়া ছাড়িয়ে কয়েক মাস হল আমি আমাদের গার্মেন্টসে লাগিয়েছি। আমার পরিচয় তো শুনলেন, এখন ভেবে দেখুন কি করবেন।
আবসার বলল, আমার ভাববার কিছু নেই। আমি তো তোমার পরিচয় না জেনেই তোমার কথায় রাজি হয়েছি। এবার আমারটা শোন, আমার বাবা একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করেন। আমরা চার ভাই দুবোন। আমিই বড়। বি. এ. পাস করার পর চাকরি করে বাবাকে সাহায্য করছি। আমার ছোট যে বোন তার বিয়ে হয়ে গেছে। আর বাকি তিন ভাই ও সকলের ছোট বোন সবাই পড়ানা করছে। মা একা সংসার টানতে পারছে না বলে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। মায়ের মুখে বিয়ের কথা শুনে তোমার কথা আমার মানসপটে ভেসে উঠে। তখনই সিদ্ধান্ত নিই তোমাকে বিয়ে করব।
রীমা বলল, আপনার মত ছেলের কথা শুনলে অনেক ভাল মেয়ের বাবা বিয়ে দিতে আগ্রহী হবে। তাদের কোন মেয়েকে বিয়ে করলে, সুন্দর মেয়ের সঙ্গে আরো অনেক কিছু পাবেন। অপর পক্ষে আমি দেখতে খারাপ এবং আমার বাবা গরিব। তিনি তো কিছুই দিতে পারবেন না।
আবসার বলল, তোমার কথা অবশ্য ঠিক। কিন্তু ওর বাড়ী থেকে কিছু পাওয়ার কথা কোন দিন চিন্তা করিনি। মনে মনে জীবন সঙ্গিনী করার জন্য যে মেয়েকে খুঁজছিলাম, সে তুমি। ব্যাস, তোমাকে ছাড়া আর কিছু চাই না। তোমাকে পছন্দ হবার পর আমার এক বন্ধুকে জানাই। সে শুনে আমাকে তোমার সনে আলাপ করতে বলে মতামত জানতে বলল। মতামত জানার পর সে তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চায়।
রীমা বলল, আপনার বন্ধুর নাম কি?
আরিফ, তুমি এখনো আমাকে আপনি করে বলছ কেন?
রীমা তার কথার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, তিনি কি করেন?
এ বছর জুওলজিতে মাস্টার পরীক্ষা দিবে।
বাড়ী কেথায়?
সিরাজগঞ্জ জেলার সমেশপুর গ্রামে। খুব বড়লোকের ছেলে। একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে।
তিনি আমার সঙ্গে আলাপ করতে চান কেন?
তোমার কথা বলে আমিই তাকে তোমাকে দেখাতে চেয়েছিলাম। শুনে ঐ কথা বলল।
তিনি বড়লোকের ছেলে, আমাকে দেখলে এক কথায় নাকচ করে দিবেন।
বড়লোকের ছেলে হলেও তাকে দেখলে কেউ তা ভাবতে পারবে না। খুব সিম্পল থাকে। গরিবদের প্রতি খুব সহানুভূতিশীল। অনেক গরিব ছাত্রকে সাহায্য করে। ভার্সিটিতে অনার্স করার সময় তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়। যেমন চেহারা তেমনি তার চরিত্র। এরকম ছেলে হঠাৎ দেখা যায় না। ওর মধ্যে এমন কিছু গুণ আছে, যা তুমি শুনলে খুব অবাক হবে।
যেমন?
ও অনেকের সম্বন্ধে এমন কমেন্ট করে, যা দুদিন আগে হোক আর পরে হোক ঘটবেই। তবে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে খুব রেগে গিয়ে বলেন, আল্লাহ ছাড়া কেউ ভবিষ্যতের কথা বলতে পারে না। কিন্তু মাঝে-মধ্যে ও নিজেই বলে ফেলে। তোমার কথা বলতে বলল, মনে হচ্ছে মেয়েটা ভালই হবে। তাকে বিয়ে করলে তুই সুখী হবি।
: তাই নাকি? তাহলে তো তার সঙ্গে আলাপ করতেই হয়।
তুমি না চাইলেও সে করবে বলেছে। একদিন আলাপ করার ব্যবস্থা করব। এখন তোমাকে একটা কথা বলি- শোন। আমি কিছুদিনের মধ্যে তোমাকে ঘরে নিতে চাই, তোমার কি মত বল?
আমার মতের আগে আপনার বাবা-মা আমাকে দেখে কি বলেন দেখুন।
তুমি তাহলে আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না?
আমাকে ভুল বুঝবেন না। উনাদের মতামতেরও একটা দাম আছে।
তা আছে। তবে সেটা আমি বুঝব। আমি শুধু তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই, তুমি রাজী আছ কি না।
বেশ আপনার কথাতে আমি রাজি। কিন্তু ভবিষ্যতে আমাকে নিয়ে সংসারে অশান্তি হবে কিনা সে ব্যাপারে আপনাকে একটু চিন্তা করার জন্য অনুরোধ করছি।
তুমি অবশ্য ভাল কথা বলে। তবে আমি আগেই সবকিছু চিন্তা-ভাবনা করে তোমার কাছে প্রস্তাব রেখেছি। চল, এবার তাহলে উঠা যাক।
হ্যাঁ, তাই চলুন—বলে রীমা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনার তো অফিস কামাই করে দিলাম। কোন অসুবিধা হবে না?
না হবে না। তোমার সঙ্গে কথা বলব বলে আজ ছুটি নিয়েছি। কিন্তু তোমার তো অফিস কামাই হল।
তা হল, তবে তেমন অসুবিধা হবে না।
একটা কথা বললে রাগ করবে না তো?।
রীমা অল্পক্ষণ তার মুখের দিকে চেয়ে বোঝার চেষ্টা করল, তার কোন খারাপ উদ্দেশ্য আছে কি না। কিন্তু সফল হল না। বলল, রাগের কথা শুনলে রাগ করাই তো স্বাভাবিক।
তা ঠিক, বলছিলাম তুমি পাশে বসার অধিকার দিতে চেয়েও আমাকে দূরে সরিয়ে রেখেছ।
রীমা যেন তার কথার মধ্যে নোকামির গন্ধ পেল। ভাবল, আজকালের সব ছেলেরাই কি মুখে মিষ্টি কথা বলে ধোকা দিয়ে নারীদেরকে ভোগ করতে চায়? তার মনে প্রচ মৃণা জন্মাল। সেই সঙ্গে খুব রাগও হল। রাগের সঙ্গেই বলল, আপনাকে অন্য দশটা ছেলের চেয়ে আলাদা মনে করেছিলাম। কিন্তু সে ধারণাটা আমার ভুল। যাক, আর কখনো আমার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করবেন না। এতক্ষণ একটা জানোয়ারের সঙ্গে কথা বলছিলাম জেনে ঘেন্না পালে। কথা শেষ করে সে হনহন করে চলে যেতে লাগল।
আবসার তার কথা শুনে প্রথমে বেশ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। তাকে চলে যেতে দেখে দ্রুত হেঁটে এসে তার পথ রোধ করে বলল, আমি কি অন্যায় করলাম, তা না বদলে যেতে দিচ্ছি না।
রীমা রাগে লাল হয়ে বলল, পথ ছাড়ুন, নচেৎ চিৎকার করে লোকজন ডাকব। যারা ছোট লোক, ইতর, তারা লেখাপড়া করলেও তাই থেকে যায়।
আবসার রেগে গেলেও ধৈর্য হারল না। সংযত রে বলল, তুমি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছি। তবু বলব, আমি কি ইতরামি করলাম, তা তোমাকে বলতেই হবে।
আবসারের কথায় রীমার রেগে যাবার কারণ হল- সে দেখতে খারাপ হলেও ছোট বেলা থেকে বেশ স্বাস্থ্যবতী। কিশোর বয়সেই তাকে তরুণী আর তরুণী বয়সে তাকে যুবতী দেখাত। যখন সে ক্লাস টেনে পড়ে তখন বাবা-মার সঙ্গে মাঝে মাঝে দেশের বাড়ী যেত। তখন তারই চাচাতো ভাই জামাল কে বিয়ে করার প্রলোভন দেখিয়ে প্রথমে চুমু খেত। জামাল তখন ভার্সিটিতে পড়ে। সে সময় রীমা তার প্রলোভনে পড়ে কোন বাধা দেয়নি। কিন্তু একদিন যখন জামাল তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে খেতে এক হতে বুকে হাত দিয়ে অন্য হাতে সালওয়ারের ফিতে খুলতে উদ্যত হল, তখন রীমা তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে বলেছিল, তুমি এত নিচ জামাল ভাই, ছি, ছি, এ আমি কোনদিন ভাবিনি। তুমি একটা জঘন্য ইতর ছেলে বলে ছুটে পালিয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে তার ধারে-কাছে আর ঘেষেনি।
আজ আবার আবসারের মুখে সেই রকম ইঙ্গিত পেয়ে রীমার সেই কথা মনে পড়তে ভীষণ রেগে গেছে।
রীমাকে এতক্ষণ তার দিকে চেয়ে ভাবতে দেখে আবসার বলল, মনে হলে আমি কোথাও একটু ভুল করে ফেলেছি। যার ফলে তুমি রেগে গেছ এবং আমার প্রতি তোমার ঘৃণা জন্মেছে। প্লীজ রীমা, শেষবারের মত তোমার কাছে অনুরোধ করছি, আমার সেই ভুলটা তুমি ধরিয়ে দাও। ও রীমা তার কথা শুনে ভাবল, সেদিন জামালও ভুল স্বীকার করে বিয়ের আগে আর কখনো এরকম করবে না বলে ওয়াদা করে আবার কাছে টানতে চেয়েছিল। এখন আবসারের কথাগুলো তার ঐ রকম মনে হল। কোন উত্তর না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে
আবসার তার একটা হাত খপ করে ধরে বলল, জানি না কি কারণে তুমি আমাকে ইতর ভাবছ। তুমি না চাইলে…..।
আবসার কথাটা আর শেষ করতে পারল না, ততক্ষণে রীমা অন্য হাতে খুব জোরে তার গালে চড় মেরে বলল, অসভ্য, ছোট লোক, ইতর, মেয়েদের পাশে বসতে নেই বলে ভালমানুষ সেজে নির্জনে পেয়ে তার সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করতে চাচ্ছ। হাত ছাড়াবার চেষ্টা করার সময় আবসার বলল, হেড়ে দিন বলছি, নচেৎ চিৎকার করে লোজন ডেকে হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করব।
আবসার রীমার কথা শুনে ও তার স্পর্ধা দেখে যেমন ভীষণ রেগে গেল তেমনি মর্মাহত হল। চিন্তা করল, সে এই সামান্য কথায় আমাকে ইতর ভেবে রেগে গেল কেন? হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলল, জানি না কেন তুমি আমার সঙ্গে এরকম দুর্ব্যবহার করলে। তবু আমি কি বলতে চাচ্ছিলাম তা বলে চলে যানি তুমি আমাকে আপনি সম্বোধনে কথা বলছিলে, তাই তুমি করে বলার জন্য অনুরোধ করতে চাচ্ছিলাম। এতে যদি আমি ইতর, অভদ্র ও ছোট লোক হয়ে থাকি, তাহলে আর কিছু বলার নেই। আজ থেকে কোন দিন এতটুকু তোমাকে আর বিরক্ত করব না। আসি, আল্লাহ হাফেজ। কথা শেষ করে সে হন হন করে পার্কের গেটে এসে একটা রিক্সায় উঠে বাসার ঠিকানা বলল।
আবসারের কথা শুনে রীমার হুশ হল। সে এতক্ষণ আগের জীবনের কথা ভেবে বাস্তবে ছিল না। আবসারকে চলে যেতে দেখেও তাকে বাধা দেবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলল। নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগল। একবার তার মনে হল, ছুটে গিয়ে আবসারের কাছে অপরাধের কথা স্বীকার করে ক্ষমা চাইবে। কিন্তু তা কাজে। পরিণত করতে পারল না। স্থানুবত দাঁড়িয়ে তার চলে যাওয়া দেখল। তারপর ধীরে ধীরে পার্কের গেটের দিকে আসতে লাগল। গেটের বাইরে এসে এদিক-ওদিক তাকিয়ে তাকে দেখতে না পেয়ে নিশ্চিত হল, সে চলে গেছে। তখন অনুশোচনায় তার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। কিছুক্ষণের মধ্যে সামলে নিয়ে একটা রিক্সায় উঠে বাসার পথে রওয়ানা হল।
আবসার বাসায় ফেরার পথে চিন্তা করতে লাগল, রীমা নিশ্চয় এর আগে কোন ছেলের কাছে দুর্ব্যবহার পেয়েছে। তাই সে আমার কথা বুঝতে না পেরে আমাকে ভুল বুঝল। অপেক্ষা করে দেখা যাক, এরপর সে কি করে।
এদিকে রীমা ফেরার পথে ভাবল, আমি দেখতে খারাপ বলে কেউ আমাকে বিয়ে করতে না চাইলেও আমার স্বাস্থ্য ভাল বলে সবাই আমাকে ভোগ করতে চায়। রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করার সময় আবাল বৃদ্ধ আমার শরীরের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। এমন কি আমার অফিসের কলিকদেরকেও লোভাতুর দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে দেখি। কিন্তু আবসারের চোখে সে রকম কিছু দেখিনি। তার সঙ্গে মাত্র দুদিনের পরিচয় তাতেই মনে হয়েছে, অন্যদের মত তার দৃষ্টিতে সেরকম কিছু দেখিনি। যদি তা না হত, তাহলে এক কথায় বিয়ে করতে রাজী হত না। আমি ভুল বুঝে তার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছি। আম, সে যে বলল, আর আমাকে বিরক্ত করবে না। -তাহলে কি সত্যি সত্যি আমার সঙ্গে আর দেখা করবে না? আমাদের বাসার সামনে দিয়ে তো তার অফিসে যাওয়ার রাস্তা, দেখা নিশ্চয় হবে। তবে সে হয়তো না দেখার ভান করে চলে যাবে। আমি যদি তার কাছে অন্যায় স্বীকার করে ক্ষমা চাই, তাহলে কি সে আমাকে ক্ষমা করবে না? বাসায় এসে ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিল, কয়েকদিন অপেক্ষা করে দেখবে সে কি করে। তারপর না হয় একদিন তার কাছে ক্ষমা চাইবে।
পরের দিন থেকে আবার অফিসে যাবার রাস্তা পরিবর্তন করল। যদিও এই রাস্তায় তার সময় বেশি লাগে তবু সে আগের রাস্তায় যাতায়াত বন্ধ করে দিল।
রীমা কয়েকদিন নির্দিষ্ট জায়গায় অপেক্ষা করে আবসারকে দেখতে না পেয়ে ভাবল, সে নিশ্চয় অন্য পথে যাতায়াত করছে। তাই একদিন বাসষ্ট্যান্ডে এসে অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণ পর আবারকে আসতে দেখে তার দিকে এগিয়ে গেল।
আবসার প্রথমে রীমাকে দেখতে পায়নি। রীমা কাছাকাছি এলে দেখতে পেয়েও না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। এমন সময় রীমার গলা শুনতে পেল, এই যে আবসার সাহেব, একটু দাঁড়ান না।
আবার অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে পড়ল।
রীমা তার সামনে এসে বলল, সেদিনের দুর্ব্যবহারের জন্য আমি খুব দুঃখিত। যা করেছি তা ক্ষমার অযোগ্য। তবু ক্ষমা চাইছি, দয়া করে ক্ষমা করে দিন।
আবসার কোন কথা বলল না। এমন সময় বাস আসতে বাসের দিকে চলে গেল।
রীমা নিশ্চল হয়ে তার দিকে চেয়ে রইল। বাস চলে যাবার পর সে নিজের অফিসের দিকে রওয়ানা দিল।
পরের দিন রীমা অফিস টাইমের একটু আগে বাসা থেকে বেরিয়ে যেদিক থেকে গতকাল আবসারকে আসতে দেখেছিল, সেদিকে ধীরে ধীরে হেঁটে এগিয়ে যেতে লাগল। এক সময় আবসারকে আসতে দেখে পথ আগলে দাঁড়িয়ে রইল। কাছে এলে সালাম দিয়ে বলল, আবসার সাহেব একটু দাঁড়ান, কথা আছে।
আবসার সালামের জবাব দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ইতর ও ছোটলোকদের সঙ্গে কথা বলা উচিত নয়। বলা তো যায় না, কখন ইতরামি করে ফেলি।
রীমা লজ্জা পেয়ে বলল, আপনার কথাটা সত্য। তবে যে তা নয়, তা কেউ যদি ভুল করে তাকে তাই মনে করে, এবং সে তার ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চায়, তাহলে তাকে ক্ষমা করা মহৎ গুণের পরিচয়, আপনি কি আমাকে ক্ষমা করতে পারেন না? যদি ক্ষমা করার আগে প্রতিশোধ নিতে চান তাতেও আমি রাজি। তবু ক্ষমা পেতে চাই।
ইতরদের ক্ষমা করার মহৎ গুণ নাও থাকতে পারে।
তা হয়তো ঠিক। কিন্তু সত্যি সত্যি যে ইতর নয়, সে পারে।
তারপর রীমা এগিয়ে এসে তার দুটো হাত ধরে হুলছল চোখে বলল, সেদিন থেকে অনুশোচনার আগুনে জুলছি। আপনার কাছ থেকে ক্ষমা না পাওয়া পর্যন্ত সে আগুন নিভবে না।
আবসার বলল, ক্ষমা তোমাকে করতে পারি। তার আগে তুমি আমাকে তুমি করে বলবে, আর সেদিন তুমি যে কারণে রেগে গিয়ে ঐসব বলেছ তা বলতে হবে।
রীমা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, বেশ তাই হবে। সে সব বলার জন্য। সময়ের দরকার। সময় মত একদিন বলব। এবার বলুন ক্ষমা করেছেন?
আবসার বলল, সেদিন খুব মর্মাহত হয়েছিলাম ঠিক কথা, তবে তোমার ব্যবহারের কথা চিন্তা করে বুঝতে পেরেছিলাম, এর পিছনে নিশ্চয় কোন কারণ আছে। তাই সেদিনই মনে মনে ক্ষমা করেছি। তবে কারণটা জানার জন্য মন খুব উদগ্রীব হয়ে আছে।
রীমা ডিজে গলায় বলল, তোমার অনুমান ঠিক। আমার জীবনে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেছে, সে কথা মনে পড়লে আমি বিবেক হারিয়ে ফেলি। একদিন তোমাকে সে কথা বলব।
আবার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, এবার চল, নচেৎ অফিসে পৌঁছতে দেরি হয়ে যাবে। কাল শুক্রবার। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে সেই বন্ধুর বাসায় যাব। সেই সময় তোমার সব কথা শুনব।
রীমা বলল, ঠিক আছে, তাই হবে।
<