বেগুনী জলদস্যু – ভলিউম১৩ রকিব হাসান
প্রথম প্রকাশ ও অক্টোবর ১৯৯১

০১.

ঘড়ির অ্যালার্মের তীক্ষ্ণ শব্দে ঘুম ভেঙে গেল মুসার। চোখ মেলে গুঙিয়ে উঠলো সে। গরমের ছুটির দ্বিতীয় সপ্তাহ সবে শুরু হয়েছে। এরই মাঝে বিরক্ত হয়ে উঠেছে কাজ করতে করতে। মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে এখন। ইস, কেন যে। পড়শীদের বাগান সাফ করার দায়িত্বটা নিলো! না নিয়েও অবশ্য উপায় ছিলো না। রবিন আর কিশোরের সঙ্গে ডিজনিল্যাণ্ডে যাবার কথা, অথচ তিন গোয়েন্দার ফাণ্ড প্রায় শূন্যের কোঠায় ঠেকেছে। ডিজনিল্যাণ্ডে যাওয়ার খরচই নেই, তার ওপর পড়ে আছে লম্বা ছুটিটা। টাকা খুব দরকার। অন্য দুজনও বসে নেই। রবিন লাইব্রেরিতে ওভারটাইম করছে। কিশোর খাটছে ওদের ইয়ার্ডে, বাড়তি সময়।

আরেকবার গুঙিয়ে উঠে বিছানা থেকে নামলো মুসা। তাড়াহুড়ো করে কাপড় পরে নিচে রান্নাঘরে এসে দেখলো টেবিলে বসে গেছেন তার বাবা মিস্টার আমান।

কিরে, এতো তাড়াতাড়ি? হেসে জিজ্ঞেস করলেন বাবা।

আর কি! বাগান সাফ! গোঁ গোঁ করে বলে রেফ্রিজারেটরের দিকে এগোলো মুসা, কমলার রস বের করবে।

টাকার দরকার, না? সহজ একটা উপায় বাতলে দিতে পারি। হলদে একটা কাগজ টেবিলের ওপর দিয়ে ঠেলে দিলেন মিস্টার আমান। গতরাতে মেলবক্সে ফেলে গেছে এটা।

চেয়ারে বসলো মুসা। কমলার রস খেতে খেতে চোখ বোলালো কাগজের লেখায়। একধরনের বিজ্ঞাপন। স্থানীয় বিজ্ঞাপন কোম্পানি বাড়ি বাড়ি দিয়ে যায়। পড়তে পড়তে উত্তেজিত হয়ে উঠলো মুসা। লেখা রয়েছেঃ

আপনি কি অভিযানপ্রিয়? ঐতিহাসিক?
বইয়ের পোকা? জলদস্যুদের বংশধর? তাহলে
আপনার জন্যে সুখবর আছে!
ডাকাত, জলদস্যু, ছিনতাইকারী, ঠগ, চোর,
এদের ব্যাপারে কি কোনো গল্প জানা আছে আপনার?
সত্যি ঘটনা? তাহলে আসুন আমাদের কাছে।
প্রতিটি গল্পের জন্যে ২৫ (পঁচিশ) ডলার। করে পাবেন।
তবে শুধু ক্যালিফোর্নিয়ার কাহিনী বলতে
হবে, আর কোনো জায়গার হলে চলবে না। এবং
এই গল্প নেয়া হবে জুন ১৮ থেকে ২২ তারিখ,
সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত।
যোগাযোগের ঠিকানাঃ ১৩১২ ডি লা ভিনা স্ট্রীট।

 খাইছে! বলে উঠলো মুসা। টাকা দিয়ে ভরে ফেলা যাবে! অনেক গল্প জানি আমরা। বিশেষ করে কিশোর আর রবিন। এখুনি যাচ্ছি, দেখাতে। আজ আঠারো, আটটা বেজে গেছে।

আরে বসো, বসো, হাত তুললেন মিস্টার আমান। কোটিপতি পরেও হতে পারবে। নাস্তাটা আগে শেষ করো।

বাবা, অনেক কাজ! আগে লনে পানি দিতে হবে

পেট খালি থাকলে কোনো কাজই করা যায় না। শেষ করো। তোমাকে তো খাওয়ার কথা এতো বলতে হয় না…

 কিন্তু বাবা…, থেমে গেল মুসা। হাল ছেড়ে দিয়ে বললো, আচ্ছা, ঠিক আছে।

বাবার ঠেলে দেয়া ভাজা গরুর মাংসের প্লেটটা টেনে নিলো সে। দ্রুতহাতে রুটি কেটে খাওয়া শুরু করলো। দেখতে দেখতে শেষ করে ফেললো পুরো প্লেট। এরপর ডিম ভাজি। চোখের পলকে উধাও হয়ে গেল চারটে ডিম। একটা ফুটকেকের অর্ধেকটা শেষ করে ঢকঢক করে পানি খেলো এক গেলাস। উঠে দাঁড়িয়ে ঝুড়ি থেকে একটা আপেল তুলে নিতে নিতে বললো, হয়েছে তো?

মা কাজ করছেন রান্নাঘরে। খুটখাট আওয়াজ হচ্ছে। সেদিকে একবার তাকালো মুসা। এখন পালাতে পারলে বাঁচে। বেরিয়ে এসে যদি আবার কোনো কাজ চাপিয়ে দেন?

মুচকি হাসলেন মিস্টার আমান। হ্যাঁ, চলবে। দুপুর পর্যন্ত থাকতে পারবে।

বিজ্ঞাপনটা হাতে নিয়ে প্রায় ছুটে ঘর থেকে বেরোলো মুসা। পাশের বাড়ির লনে পানি দিলো। অধৈর্য হাতে সাফ করলো মরা পাতা আর শুকনো ডাল। তারপর সাইকেল নিয়ে চললো কিশোরদের বাড়িতে, অর্থাৎ স্যালভিজ ইয়ার্ডে। সবুজ ফটক এক দিয়ে ঢুকলো ভেতরে, কিশোরের ব্যক্তিগত ওয়ার্কশপে আরও দুটো সাইকেল দেখা গেল, তার মানে রবিন আর কিশোর আছে। ওগুলোর পাশে নিজেরটাও রেখে দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে হেডকোয়ার্টারে ঢুকলো সে। হাতের কাগজটা নেড়ে চেঁচিয়ে বললো, এই দেখো, কি এনেছি!

 বলেই চুপ হয়ে গেল। ডেস্কের কাছে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর। রবিন হেলান দিয়ে রয়েছে একটা ফাইলিং কেবিনেটে। দুজনের কাছেই দুটো হলদে কাগজ, একই রকম।

পাঁচ মিনিট আগে এসেছি আমি, সেকেণ্ড, রবিন বললো। তোমার মতোই। সাংঘাতিক খবর নিয়ে!

আমি সকালেই পেয়েছি, কিশোর জানালো, ডাকবাক্সে। মনে হচ্ছে টাকা, কামানোর আগ্রহ আমাদের তিনজনের একই রকম।

একটা আর্মচেয়ারে প্রায় এলিয়ে পড়লো মুসা। আল্লাহ কাজ করতে করতে বিরক্ত হয়ে গেছি।

সত্যি সত্যি কাজ করলে কখনও বিরক্তি আসে না কারও, শুধরে দিলো কিশোর। চেয়ারে বসলো। বড়জোর ক্লান্তি আসে। সেটাই হয়েছে আমাদের। বুঝতে পারছি, জলদস্যুরা উদ্ধার করবে এবার।

সহজ পথে টাকা উপার্জন, বিড়বিড় করলো রবিন।

 কাদের গল্প বলবো? মুসা জিজ্ঞেস করলো।

কেন, অনেকেই তো আছে, জবাব দিলো কিশোর। ফরাসী জলদস্যু ডা বুচার্ডের কথা বলা যায়। ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে সে।

মাথা দোলালো মুসা। হ্যাঁ। এল ডিয়াবলোর কথাও বলতে পারি আমরা।

পারি, একমত হলো রবিন। এরপর আছে ডন সেবাসটিয়ান অ্যালভারো।

বিখ্যাত আরেকজন আছে, কিশোর বললো। ডা বুচার্ডের পর উদয় হয়েছিলো। উইলিয়াম ইভানস, বেগুনী জলদস্যু নামেই বেশি পরিচিত। মেরামত করে চালানো পুরনো গ্র্যাণ্ডফাদার ঘড়িটার দিকে তাকালো সে। তবে এসব গল্প এখানকার অনেকেরই জানা। বলতে হলে তাড়াতাড়ি যেতে হবে আমাদের। কেউ বলে ফেলার আগে।

আবার ওয়ার্কশপে বেরিয়ে এলো ওরা। বেরিয়েই শুনলো ডাক, কিশোর, ও কিশোর, কোথায় গেলি?

মেরিচাচী! আঁতকে উঠলো রবিন।

নিশ্চয় অনেক কাজ জমিয়েছে! চেঁচাতে গিয়েও কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে ফেললো মুসা।

ফ্যাকাশে হয়ে গেছে কিশোরের মুখ। আজ আর কিছু করতে পারবো না! জলদি পালাও! মেরিচাচী ওয়ার্কশপে ঢোকার আগেই সবুজ ফটক এক দিয়ে। বেরিয়ে পড়লো তিনজনে।

সাইকেল চালাতে চালাতে রবিন বললো, চিনি জায়গাটা। পুরনো স্প্যানিশ স্টাইলের চত্বর ঘিরে ইটের দেয়াল। একধারে কয়েকটা দোকান আছে। বেশির ভাগই এখন খালি।

সেজন্যেই হয়তো জায়গাটা বেছে নিয়েছে ওরা, বিজ্ঞাপন দিয়েছে যারা তাদের কথা বললো কিশোর। সস্তায় পাবে। তাছাড়া ভিড়টিড়ও কম। আরামে ইন্টারভিউ নিতে পারবে।

ডি লা ভিনা স্ট্রীটে উঠলো ওরা। ১৩০০ নম্বর ব্লকের কাছে থাকতেই চোখে পড়লো জনতার ভিড়। প্রতি মিনিটে বাড়ছে। রবিন যে দেয়ালটার কথা বলেছে, তার ভেতরে ঢোকার কাঠের গেটটা বন্ধ। দেয়ালে বড় করে নম্বর লেখা রয়েছেঃ ১৩১২।

চিন্তিত ভঙ্গিতে ভিড়ের দিকে তাকিয়ে কিশোর বললো, বড় মানুষ খুব কমই আছে। আজ কাজের দিন, অফিস-আদালত সব ভোলা। আসবে ওরাও, ছুটি হলে। আমাদের জন্যে এই সময়টাই সুবিধে।,

পথের পাশের একটা লোহার রেলিঙে শেকল ঢুকিয়ে সাইকেলে তালা দিলো তিনজনে। খুলে গেল কাঠের দরজা। বেরিয়ে এলেন একজন চটপটে মানুষ। শাদা চুল। পুরু গোঁফ দেখলে মনে হয় নাকের নিচে ছোটখাটো দুটো ঝোঁপ ঝুলে রয়েছে, মানুষটার ছোট্ট শরীরের তুলনায় বেঢপ আকার। গায়ে টুইডের জ্যাকেট, পরনে ঘোড়ায় চড়ার উপযোগী পাজামা, পায়ে বুট, গলায় বাঁধা সিল্কের রুমাল, হাতে একটা বেত-ঘোড়া চালানোর সময় প্রয়োজন হয়। সব কিছু দেখে মনে হয়। প্রাচীন অশ্বারোহী বাহিনীর একজন সৈনিক জ্যান্ত হয়ে উঠে এসেছে। ভিড়ের দিকে তাকিয়ে চাবুকটা তুললেন তিনি, চুপ করার নির্দেশ।

আমার নাম মেজর নিরেক। পাইরেটস সোসাইটি অভ জাস্টিসে আসার জন্যে স্বাগত জানাচ্ছি সবাইকে। সবার কথাই শুনবো আমরা। তবে আজ এতো বেশি চলে এসেছো, শুনে শেষ করতে পারবো না একদিনে। যারা কাছে থেকে এসেছে, তারা ফিরে যাও। আরেক দিন এসো। রকি বীচের বাইরে থেকে যারা এসেছে, তারা শুধু থাকো।

হতাশার তীব্র গুঞ্জন বয়ে গেল জনতার মাঝে। ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে গেল। দরজার কাছে পিছিয়ে গিয়ে পাল্লাটা লাগিয়ে দিলেন মেজর নিরেক। দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কথা বলার চেষ্টা করলেন তিনি, কিন্তু। কেউ শুনতে চাইলো না। ভীষণ হৈ-হট্টগোলে চাপা পড়ে গেল তার কথা।

নানারকম প্রতিবাদঃ

ইয়ার্কি পেয়েছো?

আসতে বলে এখন চলে যাওয়ার কথা!

শয়তানি ঘুচিয়ে দেবো, বেশি বেশি করলে!

এসেছি ফিরে যাওয়ার জন্যে?

আরও নানারকম কথা, গালাগাল হজম করতে হলো মেজরকে। সতেরো আঠারো বছরের ছেলেগুলোই বাড়াবাড়ি করছে। তাদের দিকে বেত তুলে চেঁচিয়ে। উঠলেন তিনি, এই ভাগো, ফাজিলের দল!

আরও রেগে গেল ওরা। একটা ছেলে এসে টান দিয়ে বেতটা কেড়ে নিতে চাইলো। আরও কয়েকজন এগিয়ে এলো তিনদিক থেকে, মেজরকে মারার জন্যে। রক্ত সরে গেল তার মুখ থেকে। চিৎকার করে সাহায্য চাইলেন, বাঁচাও, রিগো, বাঁচাও!

দেয়ালের ভেতর থেকে কেউ বেরোলো না।

 তিনদিক থেকে চেপে আসছে রেগে যাওয়া, উত্তেজিত জনতা।

.

০২.

বাঁচাও! আবার চিৎকার করলেন মেজর। এগিয়ে আসছে জনতা। রিগো, বাঁচাও?

কিশোরের দিকে তাকালো মুসা। দেরি হয়ে যাচ্ছে। মেজরকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া দরকার! বলেই আর দাঁড়ালো না সে। ছুটে গিয়ে একলাফে চড়লো পার্ক করে রাখা একটা গাড়ির ছাতে। চেঁচিয়ে বললো, পুলিস। পুলিস আসছে!

ঝট করে ফিরে তাকালো গেটের কাছে চলে যাওয়া কয়েকটা ছেলে। কিশোর। আর রবিন ততোক্ষণে প্রায় পৌঁছে গেছে মেজরের কাছে।

চলো, ভাগি! বলেই ছাত থেকে লাফিয়ে নেমে রাস্তার দিকে দৌড় দিলো। মুসা। কয়েকটা ছেলে ছুটলো তার পেছনে, বাকিরা দাঁড়িয়ে রইলো, দ্বিধা করছে। ধাক্কা দিয়ে কাঠের গেটটা ফাঁক করে ফেললো রবিন।

আসুন, স্যার, বলে ঠেলে মেজরকে সেই ফাঁকের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলো কিশোর।

মেজরকে নিয়ে চত্বরে ঢুকে পড়লো দুজনে। খানিক পরেই সেখানে এসে হাজির হলো মুসা। আর কেউ ঢুকে পড়ার আগেই ঠেলে বন্ধ করে দিলো, ভারি গেটটা। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছেন নিরেক।

রিগো! গর্জে উঠলেন তিনি। গেল কোথায় শয়তানটা!

অনেক কাল আগে বড় বড় পাথর বসিয়ে তৈরি করা হয়েছিলো এই চত্বর। মাঝে মাঝে ফাঁক, সেখানে লাগানো হয়েছিলো পিপুল আর জ্যাকারাণ্ডা গাছের চারা, সেগুলো বড় হয়েছে এখন। ফুলের ঝড়ে প্রায় ঢাকা পড়েছে উঁচু দেয়াল। উজ্জ্বল রঙের ফুল ফুটেছে। চত্বরের দূর প্রান্তে একসারি দোকান। সবগুলোই খালি এ মনে হচ্ছে। নিঃসঙ্গ, ছোট একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে ওগুলোর সামনে।

 জ্যাকেটের পকেট থেকে লাল একটা রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলেন মেজর। অনেক ধন্যবাদ তোমাদেরকে। পুলিসও চলে এসেছে। ধরে নিয়ে গিয়ে এখন গারদে ভরবে ব্যাটাদের।

হাসলো মুসা। পুলিস আসেনি, স্যার। ফাঁকি দিয়েছি ওদের। ভয় দেখিয়ে তাড়ানোর জন্যে।

তাই নাকি? সাংঘাতিক চালাক ছেলে তো তুমি! ভালো। তোমার গল্পই আগে শুনি। যেখানেই থাকো না কেন। রিগো! গেল কোথায় গাধাটা! এই রিগো, শুনে যাও!

ওদের গল্প শুনতে রাজি হওয়ায় তাকে ধন্যবাদ দিলো রবিন আর মুসা।

কিন্তু কিশোর তেমন খুশি হতে পারলো না। ভুরু কুঁচকে বললো, বাইরের ওরা খুশি হবে না একথা শুনলে।

না হলে না হোক। কয়েকটা বাচ্চার ভয়ে কাবু হয়ে যাবে? অসম্ভব! রিগো! বলদটাকে নিয়ে আর পারা গেল না! কোথায় গেল?

ঝটকা দিয়ে খুলে গেল একটা দোকানের দরজা। বেরিয়ে এলো বিশালদেহী এক লোক, যেন একটা ছোটখাটো হাতির বাচ্চা। বিচিত্র ভঙ্গিতে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে এলো মেজরের দিকে। শোফারের পোশাক পরনে, লাগেনি ঠিকমতো, ছোট হয়েছে। গোল মুখটা দেখে বয়স বোঝার উপায় নেই। লালচে ঘন চুলের ওপর। বসানো শোফারের টুপিটাও ঠিকমতো লাগেনি, যেন অসহায় ভঙ্গিতে আঁকড়ে ধরে আছে চুল, পড়ে যাওয়ার ভয়ে। নীল চোখে ভয়। স-স-সরি, মে-মে-মেজর!

এই গরু, ছিলে কোথায়? আরেকটু হলেই তো মেরে ফেলেছিলো আমাকে!

ছিলাম না…মানে এখানে ছিলাম না! কাজ করছিলাম! টেপ রেকর্ডারটা ঠিক করে রাখছিলাম। অযথা গালাগাল করছিলো টনি। আপনার ডাক শুনতে পাইনি…

তা শুনবে কেন! খেঁকিয়ে উঠলেন মেজর। এখন যাও। গিয়ে বলো ওদেরকে, দশ মিনিটের মধ্যেই গেট খুলছি। লাইন দিয়ে দাঁড়াতে বলো। ভালো করে বুঝিয়ে বলে দেবে, শহর এলাকার মধ্যে থাকে এমন কারো ইন্টারভিউ নেয়া হবে না আজ। শুধু শহরের সীমানার বাইরের…

বাধ্য ছেলের মতো হেলেদুলে গেটের দিকে এগোলো রিগো। দরজা খুলতেই হৈ হৈ করে উঠলো জনতা। মেজর আবার বেরোচ্ছেন ভেবে ছুটে আসতে যাচ্ছিলো, কিন্তু রিগোকে দেখে থমকে গেল। হাসলেন নিরেক। ওকে দেখলেই অনেক গোলমাল থেমে যায়।

থামবেই, বললো রবিন।

আমার তো মনে হয়, ট্যাংক থামিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে, মুসা বললো।

তা বোধহয় পারে, নাক দিয়ে খোতখোত করলেন মেজর। এসো আমার সঙ্গে।

মাঝখানের একটা দোকানের কাছে ওদেরকে নিয়ে এলেন তিনি। বাইরের। খালি ঘরের পেছনে ছোট আরেকটা ঘর। জানালা দিয়ে পেছনের চত্বর চোখে পড়ে, জংলা হয়ে আছে, তার ওপাশে উঁচু দেয়াল। সব কটা জানালাই বন্ধ, কাঁচ লাগানো। একটা জানালার নিচে বসানো এয়ার কনডিশনার মৃদু ঝিরঝির করছে। একটা ডেস্ক,আর কয়েকটা ফোল্ডিং চেয়ার ছাড়া আর কোনো আসবাব নেই ঘরে। ডেস্কের ওপর রাখা একটা টেলিফোন। একটা টেপ রেকর্ডার নিয়ে ব্যস্ত একজন লোক। মাথায় কালো চুল। পরনে শ্রমিকের পোশাক।

দেরি আছে? জিজ্ঞেস করলেন মেজর।

 মুখ না তুলেই মাথা ঝাঁকালো শুধু লোকটা।

ও ওটা ঠিক করুক, নিরেক বললেন, এসো ততোক্ষণ গল্প করি আমরা। আমাদের পাইরেটস সোসাইটির কথা শুনবে? বেশ। ডেস্কের এক কোণে উঠে বসলেন তিনি। টেবিলে বুকলেন বেতটা। এই সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আমার এক দাদা, আমার আপন দাদার ভাই। মস্ত ধনী ছিলেন তিনি। মূল লক্ষ্য, জলদস্যুদের নিয়ে গবেষণা করা, তাদেরকে সাহায্য করা, তাদের পরিবারের উন্নতি করা। আমাদের এক পূর্ব পুরুষ হামফ্রে নিরেকের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে গিয়েই এই সোসাইটি প্রতিষ্ঠার ইচ্ছে জাগে তাঁর মনে। হামফ্রের নাম দিয়েছিলো লোকে টাইগার নিরেক। প্রাইভেটিয়ার ছিলেন তিনি। ঔপনিবেশিক আমলে জাহাজ নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে। প্রাইভেটিয়ার কাদেরকে বলে জানো তো?

জানি, মাথা ঝাঁকালো রবিন। বেসরকারী লোক, তবে সরকারী ভাবে অনুমতি দেয়া হতো যাদেরকে, শত্রু জাহাজ লুট করার জন্যে। তা, টাইগার নিরেকের নাম কিন্তু কখনও শুনিনি।

আমিও না, বিড়বিড় করলো কিশোর। কোনো কিছু জানে না বলতে খুব। খারাপ লাগে তার। ওই এলাকার সবচেয়ে বিখ্যাত একজনের নামই জানি আমি, জেনারেল জঁ ল্যাফিটি।

টাইগার নিরেকও তারচেয়ে কম বিখ্যাত নন। মেজর নিরেক বললেন, ল্যাফিটির মতোই দেশপ্রেমিক। আঠারোশো বারো সালে রেভলুশনারি ওঅরে তিনিও যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু ইতিহাস মনে রাখেনি তার কথা। দুজনেই প্রাইভেটিয়ার ছিলেন। নিরেক ইংরেজ জাহাজকে আক্রমণ করে তাদের অস্ত্রশস্ত্র, রসদ কেড়ে নিয়ে গিয়ে জমা করতেন বিদ্রোহীদের ভাঁড়ারে। আর জেনারেল হামলা চালাতেন স্প্যানিশ জাহাজের ওপর। অ্যানড্র জ্যাকসনের দলে থেকে ইংরেজদের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন তিনি। নিরেক বা ল্যাফিটি, কেউই কম ছিলেন না, অথচ একজনের কথা লোকে মনে রাখলো, আরেকজনের কথা বেমালুম ভুলে গেল। ইতিহাস যে কেন এই গোলমালটা করে, বুঝি না! এই ব্যাপারটাই খারাপ লেগেছিলো আমার দাদার। লাখ লাখ ডলার খরচ করে এই সোসাইটি প্রতিষ্ঠা। করলেন। বই, পুস্তিকা প্রকাশ করলেন। সেসব বইতে লেখালেন সেই সব লোকদের কথা, যাদেরকে এড়িয়ে গেছে ইতিহাস।

কিন্তু… শুরু করতে যাচ্ছিলো কিশোর। তার কণ্ঠে সন্দেহের সুর।

থামিয়ে দিয়ে মেজর বললেন, শুনলে অবাক হবে, ইয়াং ম্যান, বছরের পর। বছর আমার দাদা সারা দুনিয়া চষে বেড়িয়েছেন ওরকম মানুষের খোঁজে। তাদেরকে অনেক বড় করে তুলে ধরেছেন। তার সেই অসমাপ্ত কাজটাই চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি। আমি বুঝেছি, ক্যালিফোর্নিয়ায় ওরকম হিরো অনেক আছে, দেশের জন্যে যারা ডাকাত হয়েছে।…এই টনি, হলো? মাথা। ঝাঁকালো লোকটা। মেজর বললেন, কে আগে শোনাবে?

আমি! মুসা বললো। ডাকাত এল ডিয়াবলোর গল্প বলবো আমি।

আগে বলার ইচ্ছে ছিলো কিশোরের, থেমে গেল। বসে পড়লো রবিনের পাশের চেয়ারটায়। মুসার মুখে আরেকবার শুনতে লাগলো মেকসিকান দস্যু ডিয়াবলোর বীরগাথা, মেকসিকান যুদ্ধের সময় কি করে আমেরিকান অনুপ্রবেশ কারীদের বাধা দিয়েছিলো। কিন্তু মুসা অর্ধেকও বলে সারতে পারলো না, তাকে থামিয়ে দিয়ে মেজর বললেন, ভালো। আমাদের সোসাইটির জন্যে চমৎকার সিলেকশন। কাজে লাগবে এল ডিয়াবলো, তাকে তুলে ধরা উচিত। এরপর কে বলবে?

শুরু করে দিলো কিশোর, আমি দুজনের কথা বলবো। একজন, ফরাসী প্রাইভেটিয়ার হিপোলাইট ডা বুচারড। আরেকজন তার চাকর উইলিয়াম ইভানস, পরে যার ডাক নাম হয়ে যায় বেগুনী জলদস্যু। ফরাসী জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন। ডা বুচার্ড, পরে আরজেনটিনা সরকারের চাকরি নিয়ে নেন। আঠারোশো আঠারো। সালে যুদ্ধে নেমেছিলো দেশটা। তার জাহাজের নাম ছিলো সান্তা রোজা, মাঝিমাল্লা আর যোদ্ধা মিলিয়ে লোক ছিলো দুশো পঁচাশিজন। দশটা দেশ থেকে যোগাড় করেছিলেন ওদেরকে। স্প্যানিশ জাহাজ আর ঔপনিবেশিকদের ওপর হামলা চালাতে পাঠানো হয়েছিলো তাঁকে। আলটা ক্যালিফোর্নিয়ার স্প্যানিশ ঔপনিবেশিকদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিলেন তিনি। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেন মনটিরে অঞ্চল, পাবলো সোলার গভর্নরকে পরাজিত করেন, তারপর আসেন লস অ্যাঞ্জেলেসে হামলা চালাতে…

গুড! ভেরি গুড! হাততালি দিলেন মেজর। রবিনের দিকে ফিরে বললেন, তুমি কিছু বলবে?

হঠাৎ বাধা পেয়ে থমকে গেল কিশোর। চোখ মিটমিট করছে। মেজরের এই আচরণে খুবই অবাক হয়েছে সে। মুসার দিকে তাকালো। সে-ও তাকিয়ে আছে তার দিকে।

ডন স্যাবাসটিয়ান অ্যালভারোর গল্প আরম্ভ করলো রবিন। কিন্তু মাঝপথে আসার অনেক আগেই হাত তুললেন মেজর। দারুণ! চমৎকার! ভালো ভালো গল্প নিয়ে এসেছে তোমরা। টেপে রেকর্ড করে রেখেছে নিক। পরে আবার বাজিয়ে শুনবো আমরা। তারপর যোগাযোগ করবো তোমাদের সঙ্গে।

যোগাযোগ করবেন? ভুরু কোঁচকালো মুসা।

কিন্তু বিজ্ঞাপনে লিখেছেন…

হেসে কিশোরকে থামিয়ে দিলেন মেজর। আমরা ওটুকু শুনেই ঠিক করবো, কার গল্প নেয়া যায়। তারপর পুরোটা শোনার জন্যে ডেকে পাঠাবো। এক ঘন্টার জন্যে পঁচিশ ডলার, কম তো না। ভালোমতো না শুনে দিই কি করে, তোমরাই বলো? ও হ্যাঁ, যাওয়ার সময় রিগোকে বলো পরেরজনকে পাঠিয়ে দিতে, প্লীজ।

মেজরের ব্যবহারে থ হয়ে গেছে তিন গোয়েন্দা। গেটের বাইরে বেরিয়ে রিগোকে জানালো তার মনিবের নির্দেশ। সারি দিয়ে অপেক্ষা করছে গল্প বলিয়েরা, তাদের পাশ দিয়ে ধীরে ধীরে এগোলো ওরা। সাইকেলগুলো ঠিকমতোই রয়েছে।

প্রথমে মুখ খুললো মুসা, বিষ ঝাড়লো, আমাদেরকে ঠকিয়েছে!

জ্বলে উঠলো রবিন, বিজ্ঞাপনে বলেছে অন্য কথা! যে কেউ গল্প শোনালেই টাকা দেবে বলেছে!

হুম! আনমনে মাথা নাড়লো কিশোর। ভাবছে কিছু।

প্রতিবাদ করা উচিত ছিলো! রবিন বললো।

শুরু করেছিলাম তো, বললো মুসা। পাত্তাই দিলো না!

হ্যাঁ। বড়দেরকে এভাবে ঠকাতে পারতো না। আমরা ছেলেমানুষ বলেই…

বড়দেরকে টাকা দিলে তখন গিয়ে ধরবো মেজরকে! দুই সহকারীর মুখোমুখি হলো গোয়েন্দাপ্রধান। চলো, মেজরের ওপর নজর রাখবো।

.

০৩.

সাইকেলগুলো যেখানে আছে সেখানেই রেখে, দৌড়ে দেয়াল ঘুরে চত্বরের পেছনে চলে এলো তিন গোয়েন্দা। দেয়ালে চড়ে বসলো। দোকানগুলোর পেছনে। পুরনো একটা ওক আর একটা জ্যাকারাণ্ডা ডালপালা ছড়িয়েছে, ওসবের আড়ালে মোটামুটি লুকিয়ে থেকে দৃষ্টি দিলে মেজরের ঘরে। আরেকটা ছেলের সাক্ষাৎকার নেয়া হচ্ছে। জানালা বন্ধ, তার ওপর এয়ারকুলারের গুঞ্জন, ভেতরের কথা কিছুই। শুনতে পেলো না গোয়েন্দারা। তবে কি ঘটছে, আন্দাজ করতে একটুও অসুবিধে হলো না।

দেখো! নিচু গলায় বললো মুসা।

তিনজনেই দেখলো, ঘরের ছেলেটার চোখে হঠাৎ বিস্ময় দেখা দিয়েছে। তর্ক শুরু করলো। একরকম জোর করেই তাকে ঠেলে বের করে দিলেন মেজর।

হু, মাথা দোলালো রবিন, শুধু আমাদের সঙ্গেই এরকম করেনি।

কিশোর বললো, এই, টনির ওপর চোখ রাখো!

রাখছিই তো, মুসা বললো। আর কি দেখবো?

দেখোই না কি করে।

পনেরো-ষোল বছরের একটা ছেলে ঘরে ঢুকলো। কথা বলতে আরম্ভ করলো। কয়েক মিনিট শুনেই তাকে বের করে দিলেন মেজর। ছেলেটা বেরিয়ে যেতেই টেপ রেকর্ডারের একটা বোতাম টিপলো টনি। কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবার আরেকটা বোতাম টিপে মাইক্রোফোনটা রেডি করলো। পরের ছেলেটা যখন এলো, আবার ঘুরতে শুরু করেছে মেশিনের টেপ।

রিওয়াইন্ড করে নিয়ে আবার রেকর্ড করছে, মুসা বললো ধীরে ধীরে। কি দেখতে বললে বুঝলাম না…

বুঝেছি! বলে উঠলো রবিন। বার বার একই কাজ করছে। একটা। ফিতাকেই টেনে টেনে বার বার তাতে রেকর্ড করছে!

এবং, যোগ করলো কিশোর, আগের বার যেটা রেকর্ড করছে, পরের বারই সেটা মুছে ফেলছে।

মুছে ফেলছে? হাঁ হয়ে গেছে মুসা। তারমানে আমরা যা বলে এসেছি, সেসবও মুছে ফেলেছে?

কারো কথাই রাখছে না, সেকেণ্ড, সব মুছে ফেলছে।

তাহলে আবার ডাকবে কিভাবে?

 ডাকবে না, জবাব দিলো রবিন।

ভালো প্রশ্ন করেছো, কিশোর বললো। কেন…, সতর্ক হয়ে গেল সে। এই একজন বড় মানুষ! দেখা যাক, এবার নতুন কিছু করে কিনা?

একই ভঙ্গিতে, একই হাসি দিয়ে লোকটাকে স্বাগত জানালেন মেজর। টেপ রিওয়াইও করেছে টনি। লোকটাও বেশিক্ষণ গল্প বলতে পারলো না, ছেলেদের মতোই বের করে দেয়া হলো তাকেও।

আসলে, মেজর যে মিছে কথা বলছেন কেউই বুঝতে পারছে না, বিড়বিড় করে বললো কিশোর। সবাই ভাবছে, আবার ডাকা হবে তাদেরকে।

তার মানে ফাঁকিবাজি, রবিন বললো। কিন্তু কেন?

মাথা নাড়লো কিশোর। বুঝতে পারছি না। বিজ্ঞাপন করে ডেকে নিয়ে আসা হলো সবাইকে। টেপে কথা তুলে আবার মুছে ফেলছে! অবাক কাণ্ড! নিচের ঠোঁটে ঘন ঘন চিমটি কাটতে লাগলো সে।

একসাথে দুজন ঢুকলো মেজরের ঘরে। একজন লম্বা, রোগা, দাড়ি আছে। পরনে জাহাজ ক্যাপ্টেনের ইউনিফর্ম। ছোট একটা ছেলের হাত ধরে ঢুকেছেন। হতিনি। ওঁদেরকে দেখে চঞ্চল হয়ে উঠলেন মেজর, হঠাৎ যেন বড় বেশি আগ্রহী। মনে হলো তাকে। ক্যাপ্টেনের সাথে হাত মেলালেন তিনি, বাচ্চাটার গাল টিপে আদর করলেন। দুজনকেই আদর করে এনে বসালেন চেয়ারে। মাইক্রোফোন মুখের কাছে এনে যখন কথা বলতে লাগলেন ক্যাপ্টেন, উৎসুক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন মেজর।

নবাগতদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রবিন বলে উঠলো, ছেলেটাকে চিনতে পেরেছো? আমাদের ইস্কুলে পড়ে, নিচের ক্লাসে। ক্যাপ্টেন নিশ্চয় তার বাবা।

জাহাজের ক্যাপ্টেন মনে হচ্ছে? মুসা বললো।

অনেকটা তা-ই। পাইরেটস কোভে বেগুনী জলদস্যুর আড্ডার নাম শুনেছো?

শুনেছি, ডিজনিল্যাণ্ডের মতোই অনেকটা। তবে খুব সামান্য ব্যাপার। জাহাজে করে যেতে হয়, জলদস্যুদের কি কি সব দেখায়, ব্যস।

মাথা ঝাঁকালো কিশোর। আমিও শুনেছি। কবছর হলো খুলেছে। এখনও। তেমন পরিচিত হয়নি।

ব্যবসাও হচ্ছে না, রবিন বললো। বেগুনী জলদস্যুর বিশেষজ্ঞ বলা হয়। ক্যাপ্টেন ফিলিপকে। একবার আমাদের ইস্কুলে লাইব্রেরীতে একটা ছোটখাট লেকচার দিয়েছিলেন তার ওপরে, তোমরা সেদিন ছিল না।

আরে, মেজর বেরিয়ে যাচ্ছে! মুসা বললো।

মাইক্রোফোনের সামনে বসে তখনও গল্প বলে যাচ্ছেন ক্যাপ্টেন ফিলিপ। পাশে বসে আছে তার ছেলে পিটার। মিনিটখানেক পরে রাস্তার দিক থেকে শোনা গেল সম্মিলিত চিৎকার। আবার কোনো কারণে রেগেছে গল্প বলিয়েরা। দেয়াল। থেকে নেমে পড়লো মুসা। ঝোঁপের আড়ালে থেকে দেয়াল ঘেঁষে এগোলো কি হয়েছে দেখে আসার জন্যে। কয়েক মিনিট পরেই ফিরে এলো উত্তেজিত হয়ে।

সবাইকে ভাগিয়ে দিচ্ছেন মেজর। গেটের ওপর নো মোর ইন্টারভিউ লেখা সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে রিগো। আজ আর কোনো সাক্ষাৎকার নেয়া হবে না। আবার ফাঁকি দেয়া হলো গল্প বলিয়েদের। ফিরে এলেন মেজর। পেছন পেছন এলো হাতির বাচ্চা রিগো–অন্তত মুসার কাছে লোকটাকে সেরকমই লাগছে। ইশারায় তাকে কথা বলতে মানা করলেন। নিরেক।

খাইছে! ক্যাপ্টেনের গল্প ঠিকই রেকর্ড করা হচ্ছে! পুরোপুরি!

বুঝেছি! আচমকা চেঁচিয়ে উঠেই কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে ফেললো রবিন। কেউ শুনে ফেললো কিনা তাকিয়ে দেখলো আশেপাশে। ক্যাপ্টেন ফিলিপ বেগুনী জলদস্যুর বিশেষজ্ঞ। নিরেক শুধু বেগুনী জলদস্যুর গল্পই চান, সেজন্যে আর সবাইকে ভাগিয়ে দিয়েছেন।

না। মনে করিয়ে দিলো কিশোর, বেগুনী জলদস্যুর গল্প আমিও বলতে চেয়েছিলাম। শোনেননি।

হয়তো খেয়ালই করেননি, মুসা যুক্তি দেখালো।

কিংবা গুরুত্ব দেননি, বললো রবিন। কারণ মেজর জানেন, ক্যাপ্টেন ফিলিপ বললে অনেক বেশি বলতে পারবেন। তাকেই তার দরকার ছিলো।

তাহলে তাঁর বাড়িতে গিয়ে কেন বললেন না, যে গল্প শুনতে চাই? কিশোরের জিজ্ঞাসা। কেন এতোসব ঝামেলা করতে গেলেন?

কি জানি…, গাল চুলকালো রবিন।

টাকা বাঁচানোর জন্যে, কিশোর, মুসা বললো। বাবা বলে, যদি শস্তায় কিছু। পেতে চাও, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দাও। অনেকে হাজির হবে, দামদর করার সুযোগ পাবে। রবিনের কথাই ঠিক, ক্যাপ্টেনের মুখেই গল্পটা শুনতে চেয়েছেন নিরেক। কায়দা করে ডেকে এনেছেন পুরো গল্পটা শোনার জন্যে, কম পয়সায়।

 এটা অবশ্য হতে পারে। এই যুক্তিটাও তেমন জোরালো মনে হলো না কিশোরের।

সাক্ষাৎকার ওদিকে চলছে। সাড়ে এগারোটায় ঘড়ি দেখলেন ক্যাপ্টেন। চেয়ার থেকে উঠতে গেলেন। তাকে আবার বসিয়ে দিলেন নিরেক। পকেট থেকে টাকা বের করে দিলেন। নিতে আপত্তি করলেন ফিলিপ। জোর করেই তাঁর হাতে টাকাটা গুঁজে দিলেন মেজর। বার বার হাত ধরে ঝাঁকালেন। পিটারের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন। এগিয়ে দিতে গেলেন দুজনকে।

টপাটপ লাফিয়ে দেয়াল থেকে নেমে পড়লো তিন গোয়েন্দা। ঝোঁপের। আড়ালে আড়ালে ছুটলো চত্বরের সামনের দিকে।

গেটের ফাঁক দিয়ে দেখলো, রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা পুরনো একটা পিকআপ ট্রাকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন ফিলিপ আর পিটার। গাড়িটার রঙ বেগুনী। পাশে সোনালি অক্ষরে বড় করে লেখা রয়েছেঃ

বেগুনী জলদস্যুর আড়া
একদিনের জন্যে জলদস্যু হোন!

গেটের কাছে দাঁড়ানো মেজরের দিকে ফিরে বললেন ফিলিপ, তাহলে রাতে। দেখা হচ্ছে। নটায়।

বেগুনী পিকআপে করে চলে গেলেন ফিলিপ আর পিটার।

 আজ রাতে? ফিসফিস করে বললো মুসা।

 নিশ্চয় বেগুনী জলদস্যুর সমস্ত গল্পটা শুনতে চান মেজর, অনুমান করলো রবিন।

কিন্তু…, থেমে গেল কিশোর।

চত্বরে দাঁড়ানো একটা ছোট ট্রাকের এঞ্জিন গর্জে উঠেছে। চালিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল উনি। গেটটা লাগিয়ে দিয়ে দোকানের পেছনের ঘরে ফিরে এলেন মেজর আর রিগো।

ঝোঁপের আড়ালে আড়ালে আবার আগের জায়গায় চলে এলো তিন গোয়েন্দা। দেখলো, টেবিলে কি যেন রেখে ঝুঁকে দেখছেন মেজর আর রিগো।

দলিল, না ছবি? মুসার প্রশ্ন।

নকশা-টকশা হতে পারে, রবিন বললো।

আরো কাছে থেকে দেখতে যাবে ছেলেরা, এই সময় চত্বরে গাড়ির এঞ্জিনের শব্দ হলো। নতুন আরেকজন লোক এসে ঢুকলো দোকানে। খাটো, মোটা, মাথায় একটা রোয়াও নেই, পুরোপুরি টাক। নাকের নিচে মস্ত, বেমানান গোফ। উত্তেজিত ভঙ্গিতে মেজরের পাশে দাঁড়িয়ে আঙুল দিয়ে টেবিলে রাখা জিনিসটা দেখাতে লাগলো। খানিক পরেই হাসতে শুরু করলো। তাতে যোগ দিলেন মেজর। রিগোকেও খুশি দেখাচ্ছে।

বন্ধ জানালার কারণে এবারেও ভেতরের কথা শুনতে না পেরে হতাশ হয়ে পড়লো তিন গোয়েন্দা। এগিয়ে গিয়ে বোতাম টিপে টেপ রেকর্ডারে লাগানো ক্যাসেটের ফিতা রিওয়াইও করতে লাগলেন মেজর।

কিশোর? মুসা বললো। এটাতেই রেকর্ড করেছিলো না ক্যাপ্টেনের কথা?

মুসার মুখের দিকে তাকালো একবার কিশোর আর রবিন, পরক্ষণেই মাথা ঘোরালো টেপ রেকর্ডারের দিকে। রিওয়াইণ্ডিং চলছে এখনো।

 ওটাই হবে! রবিন বললো উত্তেজিত কণ্ঠে। টনি ক্যাসেটটা বের করেনি, আমি খেয়াল রেখেছি। ক্যাপ্টেনের সাথে সাথে তিনজনেই বেরিয়ে গিয়েছিলো, ঘরে আর কেউ ছিলো না। মেজর আর রিগো ফিরে এসেও মেশিনটার কাছে যায়নি। চোখ মিটমিট করলো বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে। ক্যাপ্টেনের কথাও মুছে ফেলছে!

তারমানে, গম্ভীর হয়ে বললো কিশোর, বেগুনী জলদস্যুর কাহিনীও চায় না ওরা।

কিন্তু ক্যাপ্টেনের গল্প তো শুনলো, মুসা বললো।

 তার কথা শোনার জন্যে ভাগিয়ে দিলো সবাইকে, বললো রবিন।

এমনকি টাকাও দিলো, কিশোর বললো। উদ্দেশ্য যা-ই হোক, সেটার সঙ্গে ক্যাপ্টেন ফিলিপ আর পিটারের সম্পর্ক আছে।

কিন্তু উদ্দেশ্যটা কী?

ঘটছেই বা কী? রবিনের সুরে সুর মেলালো মুসা।

সেটাই, কিশোর বললো, জানার চেষ্টা করবো আমরা। চলো, বাড়ি যাই। খিদে পেয়েছে। বিকেলে আবার আসবো, নজর রাখবো মেজর আর তার। লোকজনের ওপর। ক্যাপ্টেন ফিলিপের সঙ্গেও কথা বলবো। হাসি ফুটলো তার মুখে। মনে হচ্ছে, নতুন আরেকটা কেস পেয়ে গেল তিন গোয়েন্দা!

.

০৪.

সেদিন আর মেজরের ওখানে যেতে পারলো না তিন গোয়েন্দা। ইয়ার্ডে ফিরতেই রাশেদ পাশা বললেন, তাঁর সঙ্গে যেতে হবে কিশোরকে। স্যান লুইস। অবিসপোতে অনেক পুরনো মাল দেখে রেখে এসেছেন। সেগুলো কিনবেন। রবিনকেও আটকে দিলেন লাইব্রেরিয়ান, যেখানে সে পার্টটাইম চাকরি করে। একজন কর্মচারি অসুস্থ হয়ে পড়ায় বাড়তি কাজ করতে হলো রবিনকে। মুসাকে আটকালেন তার মা। গ্যারেজ আর তার আশপাশটা পরিষ্কার করা হয় না অনেকদিন। লাগিয়ে দিলেন সেই কাজে। দুই দিন পর রেহাই পেলো তিনজনেই ওরা। সকাল এগারোটায় এসে মিলিত হলো হেডকোয়ার্টারে। মেজর নিরেকের বেঅদ্ভুত আচরণের ব্যাপারে আলোচনার জন্যে।

কাল রাতে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম, কিশোর জানালো। গিয়ে দেখি ক্যাপ্টেন ফিলিপ আর পিটারের কথা রেকর্ড করছেন মেজর।

দ্রুত আলোচনায় ঠিক হলো, সাইকেল নিয়ে পাইরেটস কোভে যাবে কিশোর আর মুসা। আর তিন গোয়েন্দার নতুন, আজব আবিষ্কারটা বয়ে নেবে রবিন।

এটা একটা অদৃশ্য অনুসরণের যন্ত্র, বললো কিশোর। যাকে চাই, সে চোখের আড়ালে থাকলেও খুঁজে বের করে ফেলতে পারবো।

ছোট্ট যন্ত্রটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগলো মুসা। একটা পকেট রেডিওর সমান। ভেতরে একটা ধাতব পাত্র রয়েছে, তাতে ঘন এক ধরনের তরল পদার্থ ভরা। নিচের দিকে একটা সরু টিউব, চোখে ওষুধ দেয়ার ড্রপারের মতো জিনিস। ড্রপারের ভেতরে একটা খুদে ভালভ আছে। বাক্সের একপাশে একটা শক্তিশালী। চুম্বক লাগানো।

কি করে কাজ করে এটা, কিশোর? রবিন জিজ্ঞেস করলো।

অদৃশ্য চিহ্ন রেখে যাবে এটা, বুঝিয়ে বললো কিশোর। আমাদের ছাড়া আর কারও চোখে পড়বে না। যে কোনো যানবাহনের ধাতব বডিতে চুম্বকের সাহায্যে আটকে দিতে পারবো যন্ত্রটা। ভেতরের তরল কেমিক্যাল সাধারণ ভাবে দেখা যায় না, অতিবেগুনী আলো ফেলতে হয়। আলট্রাভায়োলেট লাইট যাকে বলে। ড্রপারের মাথার কাছে লাগানো ভালভটা নির্দিষ্ট সময় পর পর সরে গিয়ে একফোঁটা করে কেমিক্যাল ছেড়ে দেবে বাইরে। মাটিতে পড়বে জিনিসটা, আর সুন্দর একসারি চিহ্ন রেখে যাবে। হাতে আলট্রাভায়োলেট টর্চ থাকলে ওই চিহ্ন ধরে অনুসরণ করে যাওয়া খুবই সহজ।

তারমানে আলট্রাভায়োলেট টর্চও আছে আমাদের কাছে?

নিশ্চয়ই, হেসে বললো কিশোর। ছোট একটা টর্চ বের করে দিলো রবিনের হাতে। সাধারণ টর্চের মতোই দেখতে, শুধু বা অদ্ভুত।

এটা থেকেই বেরোবে আলট্রাভায়োলেট লাইট? উসখুস করে জিজ্ঞেসই করে ফেললো মুসা, ওটা কি ধরনের আলো, কিশোর? ক্লাসে নিশ্চয় পড়িয়েছে, আমি বোধহয় অ্যাবসেন্ট ছিলাম।

সাধারণ আলোর চেয়ে এই আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য খাটো, ব্যাখ্যা করলো রবিন। ব্ল্যাক লাইট বা কৃষ্ণ আলোকও বলা হয় একে। অন্ধকারে কোনো কিছুর ওপর এই আলো ফেললে একধরনের বিচিত্র আভা দেখা যায়, নামটা হয়েছে সে-কারণেই। আরেকটা ব্যাপার, যে জিনিসের ওপর ফেলবে, সেই জিনিসটা দেখা যাবে, কিন্তু আলোক রশ্মি দেখা যাবে না।

ইনফ্রারেড লাইটের মতো, তাই না? তবে ওটা শুধু রাতে কাজ করে। আলট্রাভায়োলেট কি দিনেও কাজ করবে, মানে দেখা যাবে এটা দিয়ে?

যাবে, তবে রাতের মতো অতো উজ্জ্বল হবে না চিহ্নগুলো, স্পষ্ট হবে না। এতে বরং সুবিধেই। আশপাশে কেউ থাকলে তার চোখ এড়ানো সহজ হবে। রবিন, মেজরের গাড়িতে যন্ত্রটা লাগিয়ে দেবে। তারপর সাইকেল নিয়ে অনুসরণ করবে চিহ্ন। যন্ত্রের কনটেইনারে লিকুইড কেমিক্যাল যা ভরা আছে, তাতে অন্তত দুঘন্টা চলবে। তার মানে বহুদূর পর্যন্ত অনুসরণ করতে পারবে গাড়িটাকে।

বসে আছি কেন তাহলে?

হ্যাঁ, চলো।

যন্ত্র আর টর্চ একটা ব্যাকপ্যাকে ভরে ব্যাগটা পিঠে বেঁধে নিলো রবিন। দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে বেরিয়ে এলো তিনজনে। সাইকেল রাখা আছে ওয়ার্কশপে। নিয়ে। বেরিয়ে পড়লো ওরা। রবিন রওনা হয়ে গেল শহরের দিকে। কিশোর আর মুসা চললো উত্তরে, শহরের প্রান্তসীমার দিকে, সাগরের সীমানাও শুরু হয়েছে ওখান থেকেই।

মনের ভাবনাটা মুসার কাছে প্রকাশ করে ফেললো কিশোর, ব্যাপারটা কাকতালীয় মনে হচ্ছে আমার কাছে, বুঝলে। শহরের ভেতরের কারো গল্প শুনতে চাইলেন না মেজর, শুধু শহর এলাকার বাইরে…

আরেকটা সেটআপ। চালাকি। ক্যাপ্টেন ফিলিপকে ধরার জন্যে। ঠিক না?

হতে পারে।

.

রকি বীচের কয়েক মাইল উত্তরে উপকূলরেখা বরাবর একটা ছোট খাড়ির নাম। পাইরেটস কোভ। ছোট্ট একটা গ্রাম আছে ওখানে, অল্প কয়েকটা ঘর আর দোকানপাট আছে। কিছু মাছধরা নৌকা আর জাহাজ আছে। আর আছে একটা এয়ার ট্যাক্সি সার্ভিস। সাইকেল চালিয়ে সাগরের তীরে চলে এলো কিশোর আর মুসা। খাড়ির কাছাকাছি আসতে চোখে পড়লো কাঁচাহাতে আঁকা একটা সাইনবোর্ডঃ

বেগুনী জলদস্যুর আড্ডা
ছোট-বড় সবার জন্যেই চমৎকার অ্যাডভেঞ্চার।

একটা কারখানা বাড়ির পরেই এই টুরিস্ট অ্যাট্রাকশন। আড্ডাটা গড়ে তোলা হয়েছে খাড়ির মাঝের একটা ছোট উপদ্বীপে। মূল ভূখণ্ডের দিকটায় কাঠের পুরনো বেড়া। বেড়ার বাইরে দুটো জায়গায় গাড়ি পার্ক করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যে পথ ধরে চলেছে কিশোররা, তার ডানে ঘন গাছের একটুকরো জঙ্গল, তার ওপাশেও বেড়া।

দুটো পার্কিং লটেই প্রচুর ধুলো। অল্প কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে এই সকাল বেলা। গেটের বাইরে টিকেট বুদের কাছাকাছি বসে সোডা খাচ্ছে কয়েক জোড়া দম্পতি। তাদের বেয়াড়া বাচ্চাগুলো চেঁচামেচি করছে,মারামারি করছে। দুটো ছেলে একে অন্যকে ল্যাং মেরে ফেলে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। বুদের ওপরে একটা কাঠের সাইনবোর্ডে পাইরেট শো-এর সময় লেখা রয়েছেঃ

ব্লাক ভালচার-এর যাত্রার সময়
প্রতিদিন ১২টা, ১টা, ২টা, ৩টা, ৪টা।

বুদের ভেতরে বসে আছে একজন গাঁট্টাগোট্টা লোক। অনবরত বাতাসের মধ্যে কাটিয়ে মুখের চামড়ার এমন অবস্থা হয়েছে, দেখে আর এখন বোঝার উপায়। নেই বয়েস কতো। ডোরাকাটা একটা নাবিকদের শার্ট পরেছে সে। চোখে লাগিয়েছে কালো কাপড়, অন্ধরা যেমন লাগায়। মাথায় লাল রুমাল বাঁধা। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে চলেছে, ভাবলেই গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়, দর্শকবৃন্দ। কল্পনাই করতে পারবেন না কতোখানি রোমাঞ্চকর এই অভিযান। নিশ্চয় লিখে মুখস্থ করে নিয়েছে এই বক্তৃতা, ভাবলো কিশোর। লোকটা বলছে, বেগুনী জলদস্যুর আড্ডায় এসে একদিনের জন্যে জলদস্যু হয়ে যান সবাই। জাহাজে পাল তুলে দিয়ে বেরিয়ে পড়ুন পাইরেটস কোভে। মাথার ওপর দুলবে কালো পতাকা, তাতে মড়ার খুলির নিচে হাড়ের ক্রস আঁকা। অদ্ভুত দেখতে একটা স্কোয়ার-রিগার টাইপের জাহাজ। জলদস্যুরা যেরকম পছন্দ করতো। আবার তার নামেরই বা কি বাহার দেখুন, ব্ল্যাক ভালচার। কালো শকুন। কেমন গা ছমছম করে না? দ্বীপে দ্বীপে দেখবেন লড়াই চলছে। বারুদের গন্ধ ভাসে বাতাসে, আপনিও পাবেন সেই গন্ধ। নিজের চোখে দেখবেন কি করে আক্রমণ করে জলদস্যুরা। আর মাত্র কয়েকটা টিকেট বাকি। বিশ মিনিটের মধ্যেই ছাড়বে ব্ল্যাক ভালচার। পেছনে পড়ে থাকবেন না। হেলায় সুবর্ণ সুযোগ হারাবেন না। আসুন, জলদি আসুন।

অবাক হয়ে এদিক ওদিক তাকালো দম্পতিরা, এতো টিকেট কারা কিনে ফেললো যে মাত্র অল্প কয়েকটা বাকি আছে? কাউকেই চোখে পড়লো না, শুধু ওর ছাড়া। তবে দেরিও করলো না। উঠে গিয়ে লাইন দিলো টিকেট কাউন্টারে সামনে। দলে গিয়ে দাঁড়ালো কিশোর আর মুসা। যখন কিশোরের পালা এলো। জানালার কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললো সে, ক্যাপ্টেন ফিলিপের সঙ্গে দেখা করতে চাই, ভাই, খুব জরুরী।

লোকটার একটামাত্র চোখ তাকিয়ে রয়েছে কিশোরের দিকে। শো-এর সম ক্যাপ্টেন কারো সঙ্গে দেখা করেন না।

কিন্তু, তর্ক শুরু করলো কিশোর, শো তো এখনও…

ক্যাপ্টেন এখন জাহাজে। মারিয়া!

উঠে পড়লো কানা নাবিক। চলে গেল বুদের পেছনের ঘরে। প্রায় দৌড় এসে তার জায়গায় বসলো আঠারো-উনিশ বছরের একটা মেয়ে। জলপাই রঙের চামড়া মুখের। কালো চুল, বেণি করেছে।

কটা? কিশোরকে জিজ্ঞেস করলো মারিয়া। কথায় স্প্যানিশ টান।

ক্যাপ্টেন ফিলিপকে দরকার, মিস। এখুনি।

বুঝলাম না। কটা টিকেট? দুটো? কেমন যেন অনিশ্চিত শোনালো মেয়েটার কণ্ঠ।

ওভাবে বলে হবে না, কিশোর, পেছন থেকে বললো মুসা। কি করবে?

আর কি করবো? টিকেটই কাটতে হবে। জাহাজে উঠে ক্যাপ্টেনের সঙ্গে দেখা করতে হবে আরকি।

.

টিকেট কেটে, চওড়া একটা গেটের দিকে এগোলো দুজনে। কাঠের ফ্রেমে কাঁটাতারের বুনন দিয়ে তৈরি হয়েছে পাল্লা। দুটো পাকা নিচু বাড়ির মাঝখান দিয়ে চলে গেছে পথ, একেবারে ডক পর্যন্ত। ডকে বাঁধা রয়েছে জাহাজটা, ব্ল্যাক ভালচার। কাঠের সিঁড়ি নামিয়ে দেয়া হয়েছে যাত্রীদের জন্যে। দুই মাস্তুলের। পালতোলা প্রাচীন স্কোয়ার-রিগার জাহাজের মতো করে তৈরি করা হয়েছে। কালো রঙ। প্রধান মাস্তুলে উড়ছে কালো জলি রোজার পতাকা, তাতে জলদস্যুদের কুখ্যাত চিহ্ন আঁকা রয়েছেঃ মড়ার খুলি আর হাড়ের ক্রস।

 গেটের অন্যপাশে চলে এলো দুই গোয়েন্দা। নিচু বাড়িগুলো বোধহয় আস্তাবল ছিলো একসময়, পরে গ্যারেজ হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। বাঁয়ের বাড়িটায় এখন তিনটে দোকান। একটাতে আইস ক্রীম আর কোল্ড ড্রিংকস বিক্রি হয়। আরেকটায় ভনির। আর তৃতীয়টাতে বিক্রি হয় কফি আর হট ডগ। ডানের বাড়ির সামনেটা পুরো খোলা। মিউজিয়ম করা হয়েছে। তাতে জাহাজী আর জলদস্যুদের ব্যবহৃত নানা জিনিসের প্রদর্শনী চলছে। দুটো বাড়ির মাথায়ই জলি। রোজার পতাকা উড়ছে। তৃতীয় আরেকটা উড়ছে গেটের ওপর। সব কিছুই কেমন। মলিন। ঠিকমতো রঙ করা হয়নি। পুরনো, ক্ষয়া চেহারা।

ডানে, মিউজিয়মের পেছনে অনেকগুলো ওকগাছের পেছনে দেখা গেল বোটহাউস। তারও পরে পাথরের একটা টাওয়ার। ওদিকে পানির একটু পর থেকেই শুরু হয়েছে একসারি দ্বীপ, মোট চারটে। এতোই ছোট, ঘর বানিয়ে মানুষ বাসেরও অনুপযুক্ত। দ্বীপ ছাড়িয়ে, খাড়ির অপর পারে দেখা গেল এয়ার ট্যাক্সি সার্ভিসের একটা প্লেন উঠে গেল রানওয়ে থেকে।

আহামরি কোনো জায়গা নয়, আনমনে বললো কিশোর। দেখার তেমন কিছু নেই।

রবিন তো বললোই, ব্যবসায় সুবিধে করতে পারছেন না ক্যাপ্টেন ফিলিপ, মুসা বললো। হয়তো এই দুর্বলতাটাকেই কাজে লাগিয়ে কিছু করতে চাইছেন মেজর নিরেক।

তা হতে পারে।

দুটো বিল্ডিঙের মাঝের চওড়া প্রমেনাড় ধরে হেঁটে চললো ওরা। ডানের মিউজিয়মের দিকে তাকালো। ধুলোয় ঢাকা তলোয়ার, মরচে পরা কামান-বন্দুক, মোমে তৈরি জলদস্যু আর নাবিকদের মূর্তি, আর জাহাজীদের নানা-রকমের পোশাক সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সেগুলোও তেমন মনোযোগ আকর্ষণ করে না দর্শকদের, বুঝতে পারলো কিশোর। ডকের কাছে পৌঁছে একটা ছেলেকে দেখতে পেলো। ঢলঢলে শার্ট গায়ে, পরনে ঢেলা, ফোলা প্যান্ট, জলদস্যুরা যেরকম পরতো।

পিটার ফিলিপ! বলে উঠলো মুসা।

বেশ জোরেই বলেছে সে, কিন্তু ছেলেটা শুনলো বলে মনে হলো না। দ্রুত এগিয়ে গেল ব্ল্যাক ভালচারের সিঁড়ির দিকে। জাহাজের পেছনের কোয়ার্টারডেকে পায়চারি করছেন ক্যাপ্টেন ফিলিপ। কালো, লম্বা ঝুলওয়ালা কোট গায়ে। গোড়ালি ঢাকা উঁচু বুট পরেছেন। কোমরে চওড়া চামড়ার বেল্ট, তাতে ঝুলছে ভোজালি। ছেলের মতোই তিনিও একটা ট্রাইকর্ন হ্যাট মাথায় দিয়েছেন, তাতে লাল পালক গোঁজা। বাঁ হাতের তালু আর আঙুল যেখানে থাকার কথা, সেখানে দেখা গেল বাঁকা একটা স্টীলের হুক। লাগিয়ে নিয়েছেন জলদস্যুর ভয়ংকরতা বোঝানোর জন্যে। টুরিস্টদের দিকে তাকিয়ে গর্জে উঠলেন, ইয়ো হো হো, অ্যাণ্ড আ বটল অভ রাম! জলদি করো, জলদি করো, উঠে এসো! ব্যবসায়ীদের একটা জাহাজ দেখতে পাচ্ছি! স্রোতও চমৎকার! এখুনি নোঙর তুলে তাড়া করবো ওটাকে!

এমন ভঙ্গিতে কথাগুলো বললেন ক্যাপ্টেন, মুসার মনে হলো এটা অভিনয় নয়, সত্যি সত্যি। রোমাঞ্চিত হলো সে। নীরবে জাহাজে উঠে গেল দুই গোয়েন্দা। হঠাৎ গান গেয়ে উঠলো একদল জলদস্যু, বুনো চিৎকারে ঝালাপালা করে দিলো কান। চমকে ওপর দিকে তাকালো মুসা। লাউডস্পীকারে বাজছে ওসব। ঝট করে ডেকের দুই পাশে লাফিয়ে উঠলো অনেক জলদস্যু, কানা চোখে কালো পট্টি লাগানো, দাঁতে কামড়ে ধরে রেখেছে ছুরি, যেন অন্য জাহাজের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত। কার্ডবোর্ডে তৈরি ওগুলো। সামনের মাস্তুলে পতপত করছে একটা পাল। ঢিলে ভাবে। চলতে আরম্ভ করলো ব্ল্যাক ভালচার। বাতাসের সঙ্গে ওটার যাত্রাপথের কোনো সম্পর্ক নেই। এঞ্জিনে চলছে।

দূর, বিরক্ত হয়ে হাত নাড়লো মুসা, মজাটাই নষ্ট করে দিলো ওই লাউডস্পীকার আর এই এঞ্জিন! বেশি মেকি হয়ে গেল।

দর্শক বেশি না। বিষণ্ণ চোখে দেখছে ওরা পাল আর হার্ডবোর্ডের মানুষগুলোকে। হঠাৎ ঝড়ো বাতাস আর উত্তাল ঢেউয়ের ভারি শব্দ যেন ছিটকে বেরিয়ে এলো লাউডস্পীকার থেকে। জলদস্যুদের গান আর চেঁচামেচি বন্ধ হয়নি। এরই মাঝে এঞ্জিনের ভটভট-ভটভট আওয়াজটা ভারি বেমানান। পাইরেটস কোভের দিকে এগিয়ে চলেছে জাহাজ।

 বাজে। আবার বিরক্তি প্রকাশ করলো মুসা। একেবারেই বাজে! কিন্তু এ জিনিসের ওপর এতো আগ্রহ কেন মেজর নিরেকের?

জানি না, কিশোর বললো। দেখে যাও।

.

০৫.

ডি লা ভিনা স্ট্রীটের দেয়ালে ঘেরা চত্বরের কাছে এসে পৌঁছলো রবিন। কাঠের উঁচু গেট বন্ধ। ঘুরে পেছন দিকে চলে এলো সে, আগের বার যেখানে উঠে বসেছিলো তিন গোয়েন্দা, সেখানে উঠলো। দোকানের পেছনের ঘরটার দিকে তাকালো। কেউ নেই। অপেক্ষা করতে লাগলো সে।

পনেরো মিনিট পর কিচকিচ করে খুলে গেল গেটের ভারি পাল্লা। চত্বরে ঢুকলো একটা গাড়ি। দোকানের পেছনের ঘরটায় এসে ঢুকলেন মেজর। হাতে একটা প্রাস্টিকের ব্যাগ। মনে হয় একাই এসেছেন। ব্যাগ থকে কফির সরঞ্জাম বের করে খেতে বসলেন তিনি। খাওয়া শেষ করে পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা কাগজ বের করে খুলে বিছালেন টেবিলের ওপর।

ছোট একটা রুলার বের করে কাগজটার ওপর রেখে মাপজোক করলেন। সন্তুষ্ট মনে হলো তাকে। ছোট একটা নোটবুকে কিছু লিখলেন। উঠে দাঁড়িয়ে কিছু শোনার জন্যে কান পাতলেন। রবিনও শুনতে পেলো শব্দটা। আরেকটা গাড়ি ঢুকলো চত্বরে। দোকানের সামনের দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন মেজর। ডালপালার আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে দেখছে রবিন। গেট দিয়ে ঢুকছে আরও একটা মোটরযান, বড় ট্রাক।

এটাতে করেই দুদিন আগে চলে গিয়েছিলো টনি।

মোট তিনটে ট্রাক এখন চত্বরে। একটা, টনির ট্রাক। দ্বিতীয়টা একটা আইস ক্রীম ভ্যান। আর তৃতীয়টা বিরাট এক লরি, পেছনে প্ল্যাটফর্ম লাগানো রয়েছে ইচ্ছেমতো নামানো যায়, ওঠানোও৷ যায়। পাশে বড় করে লেখা রয়েছেঃ হ্যারিসনস ট্রী সার্ভিস। দুজন ট্রাক ড্রাইভারের একজনের পরনে আইস ক্রীম বিক্রেতার শাদা ইউনিফর্ম। আরেকজনের পরনে মালির পোশাক। কোমরের ভারি বেল্ট থেকে ঝুলছে নানারকম যন্ত্রপাতি। রবিনের দিকে পেছন করে রয়েছে ওরা। মেজর নিচু গলায় কথা বলছেন ওদের সঙ্গে। দুটো লোককেই চেনা চেনা লাগছে। রবিনের। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও মনে করতে পারলো না কোথায় দেখেছে। কথা শেষ করে যার যার ট্রাকে গিয়ে উঠলো ওরা। বেরিয়ে গেল। ভোলাই রইলো। গেটটা।

আবার আগের ঘরে ফিরে এলেন মেজর নিরেক।

দেয়াল থেকে নেমে পড়লো রবিন। গুঁড়ি মেরে চলে এলো দোকানের সামনের দিকে। কানে এলো মেজরের কথা, হ্যাঁ, বুঝেছি, গাধা কোথাকার! দশ মিনিট সময় দিলাম! খটাস করে রিসিভার আছড়ে রাখলেন ক্রেডলে।

তাড়াতাড়ি পকেট থেকে কিশোরের দেয়া যন্ত্রটা বের করে চত্বরে দাঁড়ানো ট্রাকটার দিকে চললো রবিন। নিচের ইস্পাতের ফ্রেমে এমন ভাবে লাগালো ওটা, যাতে ড্রপারের মুখটা নিচের দিকে থাকে। লাগিয়ে আর এক মুহূর্ত দেরি করলো না, এক দৌড়ে এসে ঢুকলো ঝোঁপের ভেতর।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। দোকান থেকে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠলেন মেজর। গেটের বাইরে ট্রাকটা বের করে থামালেন। নেমে এসে লাগিয়ে দিলেন গেটটা।

ট্রাকটা চলে যাওয়ার শব্দ শুনলো রবিন। দৌড়ে এলো দেয়ালের কাছে। দেয়াল টপকে ওপাশে নেমে চলে এলো একটা টেলিফোন পোস্টের কাছে, যেটাতে সাইকেল বেঁধে রেখে গিয়েছিলো। তাড়াতাড়ি খুলে নিয়ে তাতে চড়ে এলো গেটের কাছে। আলট্রাভায়োলেট টর্চ বের করলো।

সহজেই খুঁজে বের করলো চিহ্ন। অতিবেগুনী রশ্মি পড়ে জ্বলজ্বল করছে। বেগুনী ফোঁটাগুলো। আপনমনেই হাসলো রবিন। এগিয়ে চললো ওই ফোঁটা অনুসরণ করে।

প্রথমে সাগরের দিকে গেছে চিহ্নগুলো, তারপর গিয়ে উঠেছে হাইওয়েতে। উদ্বিগ্ন হলো রবিন। গাড়িতে করে গেছেন মেজর। এই খোলাপথে গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাইকেলে করে অনুসরণ করা অসম্ভব। খানিক দূর এগিয়ে আবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে। চিহ্নগুলো হাইওয়ে থেকে আরেক দিকে মোড় নিয়েছে, চলে গেছে বড় একটা শপিং সেন্টারের দিকে।

অনেক গাড়ি পার্ক করা রয়েছে বাজারের পার্কিং লটে। ওগুলোর ভেতর দিয়ে চললো রবিন। চোখ খুঁজছে ভ্যানটাকে। এই দিনের আলোয় মাটির দিকে আলো জ্বালার ভঙ্গিতে টর্চ ধরে রাখতে সঙ্কোচ লাগছে তার, বোকা ভাবতে পারে লোকে। তবে বাইরে লোকজন তেমন নেই, বেশির ভাগই ভেতরে, কেনাকাটায় ব্যস্ত।

ভ্যানটা চোখে পড়লো না। টর্চ দিয়ে না খুঁজে উপায় নেই। যে যা খুশি ভাবুকগে, বলে মন থেকে জোর করে অস্বস্তি দূর করে দিলো রবিন। চিহ্ন ধরে ধরে এগোলো আবার। একটা হার্ডওয়্যারের দোকানের পাশ দিয়ে চলে গেছে। ফোঁটাগুলো।

 সাইকেল থেকে নেমে সাবধানে দোকানটার কোণায় দাঁড়িয়ে উঁকি দিলো সে। দোকানের পাশের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভ্যানটা। পেছনের দরজা খোলা। একটু পরেই দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন মেজর। পেছনে হস্তীদেহী রিগো। হাতে কয়েকটা বস্তা, আলুর বস্তার মতো।

বস্তাগুলো ভ্যানে তুললো সে। আবার দুজনে গিয়ে ঢুকলো দোকানে। ভ্যানের ভেতরে উঁকি দেয়ার ইচ্ছেটা অনেক কষ্টে ঠেকালো রবিন। বেশি ঝুঁকি নেয়া হয়ে। যাবে। যে-কোনো মুহূর্তে বেরিয়ে আসতে পারেন মেজর আর রিগো। এবং তা-ই করলো ওরা। এবারও আগে আগে বেরোলেন মেজর। পেছনে রিগো বেরোলো হাতে কতগুলো ব্যাটারির মতো জিনিস নিয়ে। ওগুলোও ভ্যানের পেছনে। তুলে দরজা লাগিয়ে দিলো।

এত ঢিলা, ছাগল! ধমক লাগালেন মেজর। জলদি ওঠো। আমার খিদে পেয়েছে।

ভ্যানের সামনের সীটে উঠলো দুজনে।

চট করে সরে গেল রবিন। মেজরের চোখে পড়তে চায় না।

বেগুনী ফোঁটা ধরে ধরে আবার ভ্যানটাকে অনুসরণ করলো সে। এতো জোরে চলেছে, পার্কিং লটের মোড় ঘুরে আরেকটু হলেই গিয়ে পড়েছিলো ভ্যানটার গায়ে। একটা রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়েছে গাড়ি। কাঁচের দরজার ওপাশে মেজর আর রিগোকে দেখতে পেলো সে। খেতে গেছে, বেরোতে সময় লাগবে। এটাই সুযোগ!

ভ্যানের পেছনের দরজা খুলে ভেতরে তাকালো রবিন। আলুর বস্তাগুলো দেখলো। ব্যাটারিগুলো দেখলো। আরও জিনিস পড়ে আছে মেঝেতে। কতগুলো বেলচা আর গাইতি। মাটি লেগে আছে ওগুলোতে। সদ্য খোঁড়া মাটি!

Super User