কিশোর ইকবাল আব্বার হাতে মার খেয়ে সুস্থ হওয়ার পর প্রতিজ্ঞা করল, যেমন করে হোক রুকসানাকে বিয়ে করে এর প্রতিশোধ নেবে। তাই সুস্থ হওয়ার পর মায়ের জমানো সামান্য কিছু টাকা নিয়ে বাবা মাকে না জানিয়ে ঢাকা চলে এল। শহরে কয়েকটা বাসায় লজিং এর চেষ্টা করে বিফল হয়ে ভাবল, শহরের কাছাকাছি কোনো গ্রামে চেষ্টা করতে হবে। তারপর লোকজনকে জিজ্ঞেস করে মাণ্ডা হায়দার আলী উচ্চ বিদ্যালয়ে এসে বারান্দায় বসেছিল।

স্কুলের ঘণ্টা পড়ার পর যখন ছেলেরা সব ক্লাসে গেল তখন হেড মাস্টারের কাছে গিয়ে বলল, আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। আমার রোল নাম্বার এক। ফাঁইভে বৃত্তি পেয়েছি। সব ক্লাসেই আমার রোল নাম্বার এক ছিল। আমার আব্বা খুব গরিব। আমাকে পড়াতে চায় না। তাই পড়াশোনা করার জন্য বাড়ি থেকে চলে এসেছি। আপনি দয়া করে আমাকে স্কুলে ভর্তি করে নিন। তারপর হেডমাস্টারের দু’পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল।

হেডমাস্টারের মনে দয়া হল। ভাবলেন, রোল নাম্বার যখন এক এবং ফাঁইভে বৃত্তি পেয়েছে তখন নিশ্চয় ভালো ছাত্র। বললেন, কাঁদছ কেন উঠে দাঁড়াও।

ইকবাল দাঁড়িয়ে চোখ মুছল।

হেড মাস্টার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কি?

ইকবাল হোসেন।

বাড়ি কোথায়?

গোপালগঞ্জ জেলায়।

কোন স্কুলে পড়তে?

ফুকরা হাইস্কুলে।

স্কুলে না হয় ভর্তি করে নিলাম; কিন্তু তুমি থাকবে কোথায়?

কয়েক দিন স্কুলে থাকার অনুমতি দিন, তারপর লজিং খুঁজে নেব।

হেড মাস্টার তাকে সঙ্গে নিয়ে শিক্ষকদের কমনরুমে এলেন। তখনও তারা ক্লাসে যায় নাই। ইকবালকে দেখিয়ে তাদেরকে বললেন, গোপালগঞ্জ জেলার ফুকরা হাই। স্কুলের সেভেনে পড়ে। বাবা খুব গরিব। পড়াতে চায় না। তাই ঢাকায় এসেছে। পড়াশোনা করার জন্য। রোল নাম্বার এক এবং ফাঁইভে বৃত্তি পেয়েছে বলছে। আমরা যদি ওকে একটু সাহায্য করি, তাহলে হয়তো ছেলেটা উন্নতি করবে।

কেউ কিছু বলার আগে এ্যাসিসটেন্ট হেড মাস্টার বললেন, এরকম ছেলেকে সাহায্য করা আমাদের সকলের কর্তব্য। আপনি ওকে ভর্তি করে নেন।

হেড মাস্টার বললেন, শুনে খুশি হলাম। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ও থাকবে কোথায়? খাবে কি?

সেখানে দপ্তরী খালেক ছিল, বলল, ও আমার কাছে আপাতত থাকুক। পরে একটা লজিং ঠিক করে দেব।

হেডমাস্টার হাসানকে ভর্তি করে বই খাতার ব্যবস্থা করে দিলেন।

দপ্তরী খালেকের অবস্থা মোটামুটি স্বচ্ছল। রাস্তার ধারে চার পাঁচটা দোকানের ভাড়া পায়। পৈত্রিক সূত্রে যে জায়গা পেয়েছে সেখানে টিন সেডে চার কামরা ঘর করেছে। দু’কামরা ভাড়া দিয়েছে। বাকি দু’কামরায় নিজেরা থাকে। তার স্ত্রী ফরিদা একটু মুখরা হলেও আচার ব্যবহার ভালো। তাদের এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলেটা বড়। নাম রেফাত। মেয়ের নাম মালেকা। রেফাত ফোরে আর মালেকা টুয়ে পড়ে।

ছুটির পর খালেক ইকবালকে বাড়িতে নিয়ে এসে ছেলেদের পড়ার রুমে বসাল। তারপর স্ত্রীর কাছে গিয়ে ইকবালের সব কথা বলে বলল, পোলাডা খুব ভালা, তাই। লইয়া আইলাম। রেফাত ও মালেকাকে পড়াইব আর আমাদের লগে থাকবো। তুমি। তো ওদের লাইগ্যা মাস্টার রাখনের কথা কইছিলা। পাঁচশ টাকার কমে কেউ বাড়িতে পড়াইবার আইত চায় না। লজিং মাস্টার বাড়িতে রাখলে তিন বেলা ভালামন্দ খাওন দেওয়া লাগবো, থাকনের রুম লাগবো। এই পোলাড়া কতই বা আর খাইবো? রেফাতের লগে একরুমে থাকবারও পারবো।

স্বামীর কথা শুনে ফরিদা বলল, কইলাতো ভালাই, চলো তো দেহি। তারপর স্বামীর সঙ্গে এসে ইকবালের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আহারে, পোলাডা বুঝি হারাদিন খায় নাই। মুখ শুকিয়ে তুলসী পাতার ল্যাহান হইছে। তারপর স্বামীকে বলল, তুমি পোলাডারে কলতলায় লইয়া যাও। হাতে পায়ে পানি দিয়া নিয়া আইস, আমি ভাত নিয়া আহি।

সেইদিন থেকে ইকবাল খালেকের বাড়ি থেকে পড়াশোনা করতে লাগল। সেই সাথে রেফাত ও মালেকার সাথে প্রতিদিন সকালে ফোরকানিয়া মাদ্রাসায় কুরআন পড়া শিখতে লাগল। খালেক ও ফরিদা তাকে ছেলের মতো দেখে। আর ইকবালও তাদেরকে চাচা চাচির মতো দেখে। রেফাত ও মালেকাকে নিজের ভাইবোনের মতো দেখে। ক্রমশ সে বাড়ির ছেলের মতো হয়ে গেল। সেভেন থেকে ফার্স্ট হয়ে এইটে উঠার পর মাস্টারদের নজরে পড়ে গেল। পরের বছর এইটে বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে টেলেন্টপুল বৃত্তি পাওয়ার পর সবার কাছে প্রিয় পাত্র হয়ে উঠল। ইকবালকে রাখার ফলে মালেকের ছেলে মেয়ে রেফাত ও মালেকা ভালো রেজাল্ট করতে লাগল। নাইনে উঠার পর ইকবাল বিকেলে খেলাধুলা না করে ক্লাস সিক্সের দুটো ছেলেকে প্রাইভেট পড়িয়ে যা পেত তা খরচ না করে জমাতে লাগল। ব্যাপারটা খালেকরা কেউ জানতে পারল না। তারপর এস. এস. সিতে পাঁচটা বিষয়ে স্টার মার্ক নিয়ে ফার্স্ট ডিভিসনে। পাশ করল।

খালেক ও ফরিদা এতদিন তার সমস্ত পড়ার খরচ জুগিয়েছে। খালেক স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করেছে ইকবালকে উচ্চ শিক্ষা দিয়ে জামাই করবে। তাই এস. এস. সি পাশ করার পর বলল, তুমি কলেজে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা কর, টাকা পয়সার চিন্তা করো না, আমরা দেব।

ইকবাল বলল, কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে আমি আব্বা আম্মার সঙ্গে দেখা। করার জন্য দেশে যাব।

খালেক বলল, এটা তো খুব ভালো কথা। যাতায়াতের খরচ আমার কাছ থেকে নিও।

.

প্রায় আড়াই বছর প্রাইভেট পড়িয়ে ইকবাল প্রায় পাঁচ হাজার টাকা জমিয়েছিল। সেই টাকা নিয়ে একদিন দেশের বাড়ি রওয়ানা হল। গোপালগঞ্জে বাস থেকে নেমে চৌধুরীদের বাগান বাড়িতে গিয়ে নতুন দারোয়ানের কাছে জানতে পারল, প্রায় চার পাঁচ বছর আগে তার আব্বা চাকরি ছেড়ে দিয়ে আম্মাকে নিয়ে নিজেদের গ্রামে দক্ষিণ ফুকরায় চলে গেছে। ইকবাল চৌধুরী বাড়ির সবার অলক্ষে যেমনভাবে বাগান বাড়িতে গিয়েছিল, তেমনিভাবে সবার অলক্ষে সেখান থেকে দক্ষিণ ফুকরা গ্রামে এসে একজন লোককে জিজ্ঞেস করল কাজেম শেখের বাড়ি কোনটা বলতে পারেন?

লোকটার নাম গেঁদু মুন্সী। বললেন, কাজেম ছেলের শোকে পাগল হয়ে দু’বছর আগে মারা গেছে। তার বৌও বছর খানেক হল মারা গেছে। তার ঘরে কাজেমের এক বুড়ি চাচি তার নাতিকে নিয়ে থাকে। এমন সময় একটা যুবককে খালি গায়ে গামছা কাঁধে আসতে দেখে বললেন, ঐ তো বুড়ির নাতি দাইহান আসছে। কাছে এলে গেঁদু মুন্সী ইকবালকে দেখিয়ে তাকে বললেন, এই ছেলেটা তোমার কাজেম চাচার খোঁজ করছে। তারপর কাজ আছে চলি বলে চলে গেলেন।

দাইহানের বাবা ফজল কাজেমের চাচাতো ভাই। দাইহানকে ছোট রেখে তার মা মারা গেছে। ফজল আবার বিয়ে করেছে। সেই স্ত্রীর গর্ভে পাঁচ ছটা ছেলে মেয়ে হয়েছে। দাইহানকে সত্য একদম দেখতে পারে না। ফজলের মা রহিমন নাতিকে মানুষ করে। যখন কাজেম ও তার স্ত্রী মারা যায় তখন দাইহান পূর্ণ যুবক। সৎ মায়ের সঙ্গে তার প্রায় ঝগড়া হত। তাই কাজেম ও তার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তাদের ঘরে দাদিকে নিয়ে থাকে।

গেঁদু মুন্সী যাওয়ার পর দাইহান ইকবালের দিকে তাকিয়ে তার জামা কাপড় দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কে তুমি? কোথা থেকে আসছ?

আমি ইকবাল ঢাকা থেকে আসছি।

কাজেম চাচা যে তার ছেলে ইকবালকে হারিয়ে পাগল হয়ে গিয়েছিল তা জানে। তাই নাম শুনে চমকে উঠল বলল, তুমিই তাহলে কাজেম চাচার ছেলে ইকবাল?

হ্যাঁ লেখা পড়া করার জন্য আমি ঢাকায় চলে গিয়েছিলাম। ঐ লোকটা বলল, তারা দু’তিন বছর আগে মারা গেছে। কথা শেষ করে মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

দাইহান বলল, কেঁদে আর কী করবে? চল ঘরে চল।

তারপর যেতে যেতে বলল, তুমি হারিয়ে যাওয়ার পর চাচা চাকরি ছেড়ে দিয়ে চাচিকে নিয়ে চলে আসে। তারপর কিভাবে তারা মারা গেল বলে বলল, আমি তোমার আব্বার চাচাতো ভাইয়ের ছেলে। দাদিকে নিয়ে এখন তোমাদের ঘরে থাকি। তুমি ঢাকায় এতদিন কি করতে?

একজনের বাড়িতে থেকে এস.এস.সি পাশ করেছি।

তাই নাকি? তাহলে তো খুব ভালো কথা। দাদি তোমাকে দেখলে খুব খুশি হবে। ঘরের উঠানে এসে দাইহান বড় গলায় বলল, দাদি কে এসেছে দেখবে এস।

কাজেমের ঝুপড়ির মতো একটা ঘর ছিল। দাইহান সেটাকে মেরামত করে দাদিকে নিয়ে থাকে। ঘরের বাইরে দরজার পাশে তালপাতার বেড়া দিয়ে অল্প একটু জায়গা ঘিরে দিয়েছে। সেখানে রহিমন দাদি মাটির চুলোতে রান্না করে। একটু আগে মোড়লদের পুকুর থেকে কলমী শাক তুলে এনে চুলোর কাছে বসে কুটছিল। নাতির গলা পেয়ে মুখ বাড়িয়ে সাথে একটা ভালো জামা কাপড় পড়া ছেলে দেখে বলল, কে রে ছেলেটা?

ততক্ষণ তারা তার কাছে চলে এল। দাইহান বলল, যে ছেলের শোকে কাজেম চাচা পাগল হয়ে মারা গেল, এই সেই ইকবাল।

রহিমন কী বললি বলে বেরিয়ে এসে ইকবালের মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, হ্যাঁ তাই তো, দেখতে ঠিক কাজেমেরই মতো? তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে দাইহানকে জিজ্ঞেস করল, তুই একে পেলি কোথায়?

দাইহান বলল, কাজ না পেয়ে ফিরে আসছিলাম। দেখি মুন্সী চাচার সঙ্গে কথা বলছে। সে ইকবালকে চাচা চাচির মরণের কথা বলেছে। আমাকে দেখে মুন্সী চাচা বললেন, “এই ছেলেটা কাজেমের খোঁজ করছে।” আমি ওর সঙ্গে কথা বলে কাজেম চাচার ছেলে জেনে নিয়ে এলাম।

রহিমন আঁচল দিয়ে নিজের চোখ মুছে বলল, এতদিন কোথায় ছিলিরে ভাই? দু’তিন বছর আগে এলে মা-বাপকে দেখতে পেতিস।

ইকবাল কিছু বলার আগে দাইহান বলল, জান দাদি, ওনা ঢাকায় একজনের বাড়িতে থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেছে।

আহারে কাজেম ও তার বৌ বেঁচে থাকলে কত্তো খুশি হত। তারপর ঘরে বসিয়ে মুড়ি খেতে দিয়ে বলল, আমরা ভাই গরিব মানুষ, এগুলো খেতে খেতে দাইহানের সাথে গল্প কর। ও তোমার বড় ভাই লাগে, আর আমি তোমার দাদি। যাই রান্না করি বলে রহিমন বেরিয়ে এসে শাক কুটতে লাগল।

কাজেমের ছেলে ইকবাল এসেছে শুনে গ্রামের ছোট বড় সব ধরনের মেয়ে পুরুষ তাকে দেখে যেতে লাগল।

ইকবাল আব্বার হাতে মার খেয়ে যে প্রতিজ্ঞা করে ঢাকা চলে গিয়েছিল, সে কথা এক মুহূর্তের জন্যও ভুলেনি। তাই আল্লাহর দেওয়া মেধাকে কাজে লাগিয়ে এত ভালো রেজাল্ট করেছে। গ্রামের বাড়িতে এসে মা-বাবার পরিণতির কথা শুনে যত দুঃখ পেয়েছে সেই প্রতিজ্ঞার প্রতি ততো কঠোর হয়েছে। তাই রুকসানার খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য কয়েকদিন থাকার মনস্থ করল। তারপর হিসাব করে দেখল, রুকসানা। এ বছর টেনে উঠেছে।

ইকবাল যে পাঁচ হাজার টাকা এনেছিল, তা থেকে আব্বা আম্মার রুহের মাগ ফেরাতের জন্য পাঁচশ টাকা মসজিদে ও পাঁচশ মাদ্রাসায় দান করল। আর দাইহানের সামনে দাদিকে এক হাজার টাকা দিয়ে বলল, আমি ছাত্র পড়িয়ে কিছু টাকা রোজগার করে এনেছিলাম আব্বা আম্মাকে দেওয়ার জন্য। তাদেরকে আল্লাহ দুনিয়া থেকে তুলে নিয়েছে। সেই টাকা থেকে কিছু টাকা আব্বা আম্মার নামে মসজিদে ও মাদ্রাসায় দিয়েছি, এটা আপনারা রাখুন। আমি চার পাঁচদিন পর চলে যাব।

রহিমন ইকবালের মাথায় চুমো খেয়ে ভিজে গলায় দোয়া করল, আল্লাহ তোকে সহি সালামতে রাখুক। আমার মাথায় যত চুল, তত হায়াৎ দিক। তারপর দাইহানকে টাকাগুলো দিয়ে বলল, তুলে রাখ।

গেঁদু মুন্সীর অবস্থা খুব ভালো। গ্রামে প্রতিপত্তিও আছে। কিন্তু ভীষণ কৃপণ। তার এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলের নাম শাকিল। মোটা বুদ্ধির কারণে ফেল করে করে ফাঁইভ পর্যন্ত পড়ে আর পড়েনি। বাপের বিষয় সম্পত্তি দেখাশোনা করে। দাইহানের সঙ্গে তার খুব বন্ধুত্ব। দাইহান বছরের বেশির ভাগ সময় তাদের ক্ষেত খামারের কাজ করে। মেয়ে আসমা দেখতে তেমন ভালো না, গায়ের রং কালো, নাক ও ঠোঁট মোটা। স্থূল দেহ। চোখ দুটো ছোট। কিন্তু খুব গুণবতী। যেমন লেখাপড়াতে ভালো তেমনি সংসারের কাজে খুব পটু। নামায রোয়া ঠিকমতো করে। প্রতিদিন কুরআন তেলাওয়াত করে ও ধর্মীয় বই-পুস্তক পড়াশোনা করে।

মেয়ে দেখতে ভালো না, বিয়েতে অনেক যৌতুক দিতে হবে। তাই গেঁদু মুন্সী কৃপণ হওয়া সত্ত্বেও মেয়েকে লেখাপড়া করাচ্ছেন এই ভেবে যে, যদি শিক্ষিত করাতে পারে, তাহলে যৌতুক ছাড়াই মেয়ের বিয়ে দিতে পারবেন।

অবশ্য আসমার বাড়ন্ত চেহারা দেখে এইটে পড়ার সময় থেকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। নাইনে ওঠার পর বোরখা কিনে দিয়েছেন। কিন্তু পাত্রপক্ষ মেয়ে দেখে মোটা টাকা দাবি করে। তাই আজ বিয়ে দিতে পারেন নি।

আসমা দাইহানকে কিশোর বয়স থেকে ভালবাসে। বড় হয়ে যখন বুঝতে শিখল, দাইহান গরিবের ছেলে লেখাপড়াও বেশি করেনি, সংসারে সত্য তখন চিন্তা করল, আব্বা জানতে পারলে যা রাগী মানুষ মেয়ে বলে ছেড়ে দেবে না। কেটে দু’টুকরো করে ফেলবে। এইসব চিন্তা করে ও দাইহানকে ভুলতে পারেনি। সুযোগ পেলেই তার সঙ্গে কথা বলে। দাইহানও আসমাকে ভালবাসে। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। কোনোদিন সেকথা তাকে জানতে দেয়নি। যেদিন আসমা তাকে মনের কথা জানায়, সেদিন ভয়। পেয়ে বলেছিল, একথা ভুলেও আর মুখে এনো না। তোমার আব্বা জানতে পারলে আমাকে তো জানে শেষ করে ফেলবেই, তোমাকেও ছেড়ে কথা বলবে না। তারপর থেকে দাইহান খুব সজাগ থাকে, আসমা যেন একাকী তার সঙ্গে দেখা করতে না পারে। তবু আসমা সতর্কতার সাথে দাইহানের সঙ্গে দেখা করে। দাইহান নিষেধ করলে বলে, তুমি পুরুষ হয়ে এত ভয় পাও কেন? একটা কথা মনে রেখ, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। তাতে যদি আব্বার হাতে মরতে হয় তাতেও রাজি। এই কথায় দাইহান আরো ভয় পেয়ে অনেক কিছু বলে বোঝাবার চেষ্টা করে। তখন আসমা আরো রেগে গিয়ে বলে, আমাকে বুঝিয়ে কোনো লাভ হবে না। তবে যেদিন। শুনব তুমি অন্য মেয়েকে বিয়ে করেছ, সেদিন বৌ দেখতে গিয়ে তোমাদের দু’জনের সামনে বিষ খাব।

এইকথা শোনার পর থেকে দাইহান আসমাকে এড়িয়ে চলে। যখন সে গোপনে দেখা করে তখন কিছু না বলে চুপ করে থাকে।

কিছুদিন আগে বোধহয় তার মা ফজিলা বেগম টের পেয়ে স্বামীকে দাইহানের কথা না বলে শুধু বলেছিলেন, মেয়েকে বেশি লেখাপড়া করিয়ে কি হবে? তাছাড়া দিন দিন যে ভাবে গা-গতরে বেড়ে যাচ্ছে, বেশি দিন ঘরে রাখা ঠিক হবে না। দিনকালও ভালো না। মেয়ের বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা কর।

গেঁদু মুন্সী বললেন, সে কথা আমিও চিন্তা করেছি। কিন্তু ভালো ছেলে পাওয়া। যাচ্ছে না।

ফজিলা বেগম কৃপণ স্বামীর স্বভাবের কথা ভালো ভাবেই জানেন। বললেন, তুমি সোনা-দানা টাকা-পয়সা ছাড়া মেয়ের বিয়ে দিতে চাও। আজকাল ঐ সব না দিলে মেয়ের বিয়ে দিতে পারবে? তাছাড়া মেয়ে দেখতেও তেমন সুন্দরী না।

গেঁদু মুন্সী রেগে উঠে বললো, আমাকে জ্ঞান দিতে হবে না। ঐ সব ছাড়াই মেয়ের বিয়ে দিতে পারি কিনা দেখিয়ে দেব। তারপর গজগজ করতে করতে সেখান থেকে চলে গিয়েছিলেন।

দাইহানকে ফজিলা বেগমের খুব পছন্দ, কিন্তু তাই বলে কামলার ছেলে কামলাকে তো আর জামাই করতে পারেন না। মেয়েকে একদিন সন্ধ্যের পর বৈঠকখানার পিছনে হেসে হেসে কথা বলতে দেখে ও তাদের কথা বার্তা আড়াল থেকে শুনে বুঝতে পেরেছিলেন। দুজনের সম্পর্কের কথা। তাই মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য স্বামীকে বলেছিলেন স্বামীর কথা শুনে আতঙ্কিত হয়ে চিন্তা করলেন, আল্লাহ না করুক, যদি কোনো অঘটন ঘটে যায়, তা হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তাই মেয়েকে একদিন দাইহানের কাছে যেতে নিষেধ করে চোখে চোখে রাখেন। কিন্তু আসমা অশিক্ষিত মায়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে দাইহানের সঙ্গে দেখা করে।

ইকবাল দু’দিন দাইহানের সঙ্গে গ্রাম দেখে বেড়াল। তার পরের দিন খুব সকালে দাইহান বাসি ভাত খেয়ে কাজে গেল। একটু বেলাতে রহিমন ইকবালকে নাস্তা খাওয়াচ্ছিল। এমন সময় আসমা এসে রহিমনকে বলল, দাদি, আব্বা আপনাকে দেখা করতে বলেছে।

রহিমন বলল, বলিস বিকেলে যাব।

কাজেম চাচার ছেলে ইকবাল এসেছে শুনে আসমা কাল সকালে এসেছিল। কিন্তু ইকবাল ঘরে ছিল না। তাই দেখা হয়নি। রহিমন দাদির কাছে তার সব কিছু শুনে স্কুলে গিয়ে রুকসানাকে বলল, জানিস, কাজেম চাচার ছেলে ইকবাল এস.এস.সি পাশ করে মা-বাবাকে দেখার জন্য কাল এসেছে। রহিমন দাদি বলল, মা-বাবা মারা গেছে শুনে নাকি খুব কেঁদেছে। দু’চার দিন থেকে চলে যাবে।

রুকসানা চমকে উঠে বলল, সত্যি বলছিস? হারে সত্যি।

আমি তাকে দেখব বলে আজ সকালে গিয়েছিলাম, তখন ঘরে ছিল না, তাই দেখা হয়নি।

ইকবাল এস.এস.সি পাশ করে এসেছে শোনার পর থেকে রুকসানার সমস্ত শরীরে এক ধরনের অজানা আনন্দের স্রোত বইতে শুরু করল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুই তার সঙ্গে দেখা করে বলবি, কাল স্কুল ছুটির সময় এসে যেন আমার সঙ্গে দেখা করে।

আসমা বলল, ঠিক আছে বলব।

তাই আজ রহিমন দাদিকে আব্বার কথা বলতে এসে অচেনা একটা ছেলেকে দেখে ভাবল, এ নিশ্চয় ইকবাল। তার মুখের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করতে লাগল; কিভাবে রুকসানার কথাটা তাকে বলবে।

আসমাকে ইকবালের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রহিমন বলল, তোর কাজেম চাচার ছেলে। এর কথাই কাল তোকে বলেছি। তারপর ইকবালকে বলল, এ হল গেঁদু মুন্সীর মেয়ে আসমা।

ইকবাল একবার আসমার দিকে চেয়ে নিয়ে খেতে লাগল।

রহিমন আসমাকে বলল, তুই একটু বস, আমি পুকুরঘাট থেকে আসছি।

রহিমন চলে যাওয়ার পর আসমা ইকবালের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাকে বাহিরবাগ গ্রামের চৌধুরীদের রুকসানা কাল স্কুল ছুটির সময় দেখা করতে বলেছে।

ইকবাল চমকে উঠে খাওয়া বন্ধ করে তার দিকে একদৃষ্টে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থেকে বলল, বাহিরবাগ গ্রাম তো অনেক দূর, আমি এসেছি রুকসানা জানল কেমন করে? আর তোমাকে বললই বা কেমন করে?

ফুকরা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে আমরা একই ক্লাসে পড়ি। রুকসানা আমার সই। কাল আমিই তাকে বলেছি।

ইকবাল বুঝতে পারল, রুকসানা হয়তো আমাদের সবকিছু আসমাকে বলেছে। খাওয়া শেষ করে হাত মুখ ধুয়ে বলল, রুকসানাকে বলল, “আমি তাদের দারোয়ানের ছেলে। তার সঙ্গে দেখা করা আমার উচিত হবে না।” তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে। গেল।

আসমা তার পিছন দিকে তাকিয়ে ভাবল, রুকসানার কারণে মার খেয়েছিল বলে হয়তো তার উপর এখনো রেগে আছে। তাই ঐ কথা বলল।

একটু পরে রহিমন ফিরে এলে আসমা ঘরে চলে গেল।

ইকবাল আসমাকে ঐ কথা বললেও গ্রামের পথে হাঁটতে হাঁটতে চিন্তা করল, রুকসানা দেখা করতে বলল, কেন? এটা তার কৌতূহল, না অন্য কিছু? বিড়বিড় করে বলল, তুমি না ডাকলেও আজ যেতাম।

আজ আসমা স্কুলে আসার পর রুকসানা জিজ্ঞেস করল, কিরে, ইকবালের সাথে দেখা হয়েছিল?

আসমা বলল, হ্যাঁ।

আমার কথা বলেছিস?

বলেছি। শুনে বলল, “আমি তাদের দারোয়ানের ছেলে, তার সঙ্গে দেখা করা আমার উচিত হবে না।”

কথাটা শুনে রুকসানার মুখটা মলিন হয়ে গেল। কিছু বলতে না পেরে চুপ করে রইল।

আসমা তার মুখের অবস্থা দেখে বলল, তুই মন খারাপ করছিস কেন? সে তো আর জানে না, সেদিনের ঘটনার জন্য তুই দায়ী না। আমার মনে হয় তোকে দায়ী ভেবে তোর প্রতি আজও রেগে আছে।

তবু যখন রুকসানা কিছু বলল না তখন বলল, কিরে কী ভাবছিস?

কি আর ভাববো? বাদ দে তার কথা, তোর দাইহানের কথা বল।

তার কথা নতুন করে আর কি বলব? জানি না আল্লাহ আমার তকদিরে কি রেখেছে।

এমন সময় স্যারকে ক্লাসে ঢুকতে দেখে রুকসানা কুনয়ের গুঁতো দিয়ে ফিসফিস করে বলল, এই চুপ কর, স্যার এসে গেছেন।

.

দুপুরে খাওয়ার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ইকবাল স্কুলের পথে রওয়ানা দিল। যখন স্কুলের কাছে পৌঁছাল তখনও ছুটি হতে আধঘণ্টা দেরি। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক বেরিয়ে বাহিরবাগ যাওয়ার রাস্তার মোড়ে একটা মোটা কাঁঠাল গাছের তলায় বসে অপেক্ষা করতে লাগল। মিনিট পাঁচেক পর ছুটির ঘণ্টা পড়তে শুনে দাঁড়িয়ে স্কুলের গেটের দিকে তাকিয়ে রইল। গেট খুলে যাওয়ার পর প্রথমে নিচের ক্লাসের মেয়েরা হুড়হুড় করে বেরিয়ে আসতে লাগল। তারপর বড় বড় মেয়েদের বেরোতে দেখে সতর্ক দৃষ্টিতে রুকসানাকে খুঁজতে লাগল। হঠাৎ কয়েকজন মেয়ের মধ্যে দু’টো বোরখা পরা মেয়েকে বেরোতে দেখে তাদের দিকে লক্ষ রাখল। বোরখা পরা থাকলেও দুজনেরই মুখে নেকাব নেই। তাদের একজনকে চিনতে পারল, আসমা। পাশের মেয়েটার চোখে বিশেষ ধরনের সানগ্লাস দেখে অনুমান করল, নিশ্চয় রুকসানা। কথা বলতে বলতে দু’জনে রাস্তার মোড়ের দিকে কিছুটা এসে আসমাকে নিজের গ্রামের পথে চলে যেতে দেখল। আর রুকসানাকে কয়েকজন মেয়ের সঙ্গে দক্ষিণ ফুকরা গ্রামের রাস্তার দিকে এগিয়ে আসার সময় এদিক ওদিক তাকাতে দেখে ইকবাল নিজেকে গাছের আড়ালে রেখে দেখতে লাগল।

কাঁঠাল গাছের কাছাকাছি এসে রুকসানার সাথের একটা মেয়ে বলে উঠল, কিরে রুকসানা, এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিস কেন? কেউ আসার কথা ছিল নাকি?

আসমার মুখে ইকবালের কথা শোনার পর থেকে রুকসানার মন খারাপ হয়েছিল। মেয়েটার কথা শুনে বিরক্ত কণ্ঠে বলল, দেখ সালেহা, ফাজলামী করবি না।

তারপর তাদের আর কোনো কথা ইকবাল শুনতে পেল না। কারণ তারা কিছুটা দূরে চলে গেছে। রুকসানাকে যতক্ষণ দেখা গেল তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপরে ফিরে আসতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে ভাবল, রুকসানা বেশ বড় হয়ে গেছে। স্বাস্থ্যও খুব সুন্দর হয়েছে। আল্লাহকে জানাল, “আল্লাহ গো তুমি, আমার বাসনা পূরণ করো।”

.

বিকেলে রহিমন গেঁদু মুন্সীর কাছে গিয়ে বলল, কেন ডেকেছেন বলুন?

গেঁদু মুন্সী বললেন, শুনলাম, কাজেমের ছেলে নাকি ম্যাট্রিক পাশ করে ফিরে এসেছে।

রহিমন বলল, দাইহান তাই তো বলল।

কেন এসেছে?

মা-বাপের কাছে ছেলে আসবে না তো কার কাছে আসবে?

মা-বাপ মরে গেছে শুনে কি বলল?

কি আবার বলবে, কান্নাকাটি করল। মা বাপের নামে মসজিদ মাদ্রাসায় এক হাজার টাকা দান করেছে।

তা শুনেছি। এখানেই থাকবে নাকি?

আমি থাকতে বলেছিলাম। বলল, “আরো পড়াশোনা করবে। তাই দু’চার দিন পরে ঢাকা চলে যাবে। আল্লাহ যদি কোনোদিন আবার আনায় তখন থাকবে।”

কাজেম যখন ছেলের শোকে পাগল হয়ে গিয়েছিল তখন গেঁদু মুন্সী তাদের ভিটেটা নেওয়ার জন্য তাকে মাঝে মধ্যে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। কাজেম পাগল অবস্থায় হঠাৎ একদিন মারা যাওয়ায় রেজেস্ট্রি করার সুযোগ পাইনি। তারপর একদিন তার স্ত্রীকে বলেন, কাজেম ভিটেটা আমার নামে লিখে দেওয়ার কথা বলে যে টাকা নিয়েছিল, তা তুমিও জান। আর টাকাটা তুমি নিজের হাতে নিয়েছ। এখন তুমি তার সম্পত্তির মালিক। আরো কিছু টাকা দিচ্ছি, ভিটাটা আমার নামে রেজিস্ট্রি করে দাও। তোমাকে কিছু করতে হবে না, যা করার আমিই করব।

নাজমা বলল, আমার স্বামী পাগল হয়ে গিয়েছিল। আপনাকে কি বলেছে না বলেছে আমি জানি না। তবে টাকা আমার হাতে দিয়েছেন এটা ঠিক। তখন আমি মনে করেছিলাম আপনি দয়া করে আমার স্বামীর চিকিৎসার জন্য দিচ্ছেন। তার ভিটে বেঁচলে আমি থাকব কোথায়?

গেঁদু মুন্সী বললেন, তুমি যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন এখানেই থাকবে। তারপর আমি দখল নেব।

আপনি তো জানেন, আমার একটা মাত্র ছেলে ইকবাল দু’বছর হল কোথা চলে গেছে। সে যদি ফিরে আসে?

যখন ফিরে আসবে তখন যা করার করা যাবে।

না-না ভিটে আমি বেঁচব না। আপনি চলে যান। তারপর নাজমা ফুঁপিয়ে উঠে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ফোপাতে লাগল।

গেঁদু মুন্সী বললেন, ঠিক আছে এখন আমি যাচ্ছি। ভেবে চিন্তে পরে না হয় আমার কাছে যেও। কথা শেষ করে চলে গেলেন।

নাজমা এক সময় চাচাতো দেবর ফজলের কাছে গেঁদু মুন্সীর কথাটা জানাল।

ফজল বলল, গেঁদু মুন্সী কাজেম ভাইকে কত টাকা দিয়েছিল মনে আছে?

নাজমা বলল, এমনি দয়া করে দিচ্ছে ভেবে হিসেব রাখিনি। তবে যতটা মনে পড়ে শ পাঁচেক হবে।

ফজল বলল, মুন্সী ব্যাটা খুব ঘুঘু। মনে করেছিল, পাগলকে সামান্য কিছু দিয়ে ভিটেটা লিখে নিবে। যা বলছি শোন ভাবি, ইকবালকে আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে একদিন না একদিন ফিরে আসবেই। তুমি কারো কোনো কাগজে টিপ সই দিও না। কেউ যদি ভয় টয় দেখায়, আমাকে জানাবে।

তারপর নাজমার অসুখের সময় গেঁদু মুন্সী টাকা সেধে টিপ সই নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু নাজমা টাকাও নেয়নি আর টিপ সইও দেয়নি। চাচাতো দেবর ফজল গরিব। তবু যতটুকু পেরেছে চাচাতো ভাবিকে সাহায্য করেছে। নাজমা মারা যাওয়ার পর ফজলই প্রথম পক্ষের স্ত্রীর ছেলে দাইহানকে ও তার মা রহিমনকে কাজেমের ভিটেয় থাকার কথা বলে।

সে কথা জেনে গেঁদু মুন্সী ফজলকে ধমক দিয়ে বললেন, কাজেম ভিটে বিক্রি করার কথা বলে আমার কাছ থেকে অনেক টাকা নিয়েছিল। পাগল হয়ে যাওয়ার কারণে রেজেস্ট্রি করে দেয়নি। তোমরা দখল নিয়েছ কেন? ঐ ভিটে তো আমার।

ফজল বলল, কাজেমকে যে টাকা দিয়েছিলেন তার কোনো সাক্ষী আছে? যদি থাকে মামলা করে ডিগ্রি নিয়ে আসুন।

গেঁদু মুন্সী রেগে উঠে বললেন, ঠিক আছে ডিগ্রি নিয়েই আসব। তখন বুঝবে কত ধানে কত চাল।

কথাটা রাগের মাথায় বললেও গেঁদু মুন্সী টাকা খরচ হওয়ার ভয়ে মামলা করেন নি। এতদিন পরে কাজেমের ছেলে ইকবাল এসে মসজিদ মাদ্রাসায় বাপ মার নামে দান করছে শুনে মনে করেছেন, ইকবাল তা হলে অনেক টাকা এনেছে। তাই চিন্তা করলেন প্রথমে ইকবালকে দিয়ে ওদেরকে ভিটে থেকে তাড়াবে, তারপর তার বাপকে যে টাকা দিয়েছে তার তিন গুণ টাকার কথা বলে শোধ করতে বলবেন, আর টাকা দিতে না পারলে ভিটেটা লিখে দিতে বলবেন। তাই আজ রহিমনকে ডেকে পাঠিয়েছেন ইকবালের খবর জানার জন্য। এখন রহিমনের কাছে ইকবাল ঢাকায় পড়তে চলে যাবে শুনে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ইকবালকে একবার আমার সঙ্গে দেখা করতে বলো।

রহিমন বলল, তা বলব। এবার যাই তাহলে?

গেঁদু মুন্সী বললেন, ঠিক আছে যাও।

রাত্রে খাওয়ার সময় ইকবাল বলল, আমি সকালে চলে যাব।

দাইহান বলল, আর কটা দিন থাক না।

ইকবাল বলল, থাকতে পারব না, কলেজে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে হবে।

রহিমন ইকবালের দিকে চেয়ে বলল, একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। গেঁদু মুন্সী তোমাকে দেখা করতে বলেছে। দু’একদিন পরে গেলে হয় না?

ইকবাল বলল, না দাদি থাকা সম্ভব নয়। আবার যখন আল্লাহ নিয়ে আসবে তখন গেঁদু মুন্সীর সঙ্গে দেখা করব।

রুকসানা আজ স্কুলে আসার সময় ভেবেছিল, আসমার মুখে আমার কথা শুনে ইকবাল নিশ্চয় আসবে। কিন্তু আসমা যখন ঐ কথা বলল, তখন মন খারাপ হলেও কেন জানি তার মনে হয়েছিল ইকবাল আসবে। তাই ছুটির পর গেট থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে থাকে। হঠাৎ মোড়ের কাছে কাঁঠাল গাছের তলায় একটা ছেলেকে স্কুলের গেটের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইকবাল বলে সন্দেহ করে। তারপর কাছে এসে তাকে আর দেখতে পায়নি। কারণ ইকবাল খুব সতর্কতার সাথে গাছের আড়ালে ছিল। তাই রুকসানা গাছের কাছে এসে বারবার সেদিকে দেখেছে। আর সেটাই দেখে সালেহা বলে কিরে রুকসানা কারো আসার কথা ছিল নাকি? উত্তরে ফাজলামী করতে নিষেধ করলেও গাছটার কাছে এসে ছেলেটাকে দেখার ইচ্ছা প্রবল হয়েছিল। কিন্তু সাথে মেয়েরা থাকায় তা সম্ভব হয়নি। ঘরে এসে চিন্তা করল, কাঁঠাল গাছের তলার ছেলেটা যদি ইকবাল হয় তা হলে আসমাকে ঐকথা বলার পরও এল কেন? আর এলই যদি আমার সামনে এল না কেন? তা হলে কী ছেলেটা ইকবাল নয়। এইসব চিন্তা করে রাত্রে ভালো করে পড়তে পারল না। অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমাতেও পারল না। চোখ বন্ধ করলে ইকবালের কথা মনে পড়তে লাগল।

পরের দিন স্কুলে আসমা বলল, আজ সকালে ইকবাল ঢাকা চলে গেছে।

রুকসানা বলল, তোর দাইহান ভাইকে ঠিকানা দিয়ে গেছে কিনা জিজ্ঞেস করবি। যদি দিয়ে যায়, লিখে নিয়ে আসবি।

আসমা বলল, দাইহান ভাই যদি জিজ্ঞেস করে ইকবালের ঠিকানা তুমি কী করবে?

রুকসানা বলল, তুই বুদ্ধি খাঁটিয়ে পটিয়ে আদায় করবি। তারপর বলল, কিরে পিরীতের মানুষকে পটাতে পারবি না?

আসমা হেসে উঠে বলল, পারব।

ঐদিন ঘরে ফিরে নাস্তা খেয়ে আসমা দাইহানের ঘরে গেল।

দাইহান ঘরে ছিল না। আসমা জানার ভান করে রহিমন দাদিকে না বলল, দাদি, আপনার নতুন নাতিকে দেখছি না কেন?

রহিমন তার ও দাইহানের সম্পর্কের কথা জানে। তাই হেসে উঠে বলল, নতুন নাতির খোঁজ কেন লো? মনে ধরেছে নাকি? পুরোন নাতির কি হবে তাহলে?

আসমাও কম গেল না। সেও হেসে উঠে বলল, পুরোনো নাতি বেশি লেখাপড়া জানে না। তার উপর খেটে খাওয়া মানুষ। কোনোদিন ঢাকায় বেড়াতে নিয়ে যেতে পারবে না। নতুন নাতি শিক্ষিত, ঢাকায় থাকে। তাই পুরোনটাকে ছেড়ে নতুনকে ধরব। ভাবছি।

আসমা রসিকতা করছে রহিমন বুঝতে পেরে বলল, তোর কপাল খারাপ, নূতন নাতি সকালেই উড়াল দিছে।

আসমা মেকি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ম্লান মুখে বলল, কপাল যখন খারাপ তখন পুরানটাকে আঁকড়ে ধরব। সে আবার না অন্য মেয়ের জন্য উড়াল দেয়। কথা শেষ করে হাসিতে ফেটে পড়ল।

রহিমন হাসতে হাসতে বলল, বেশি লেখাপড়া করে তুই খচরী হয়ে গেছিস। দাঁড়া তোর বাপকে শায়েস্তা করতে বলব।

আসমা দাদির গলা জড়িয়ে বলল, জানি আপনি এসব কথা বলতে পারবেন না। শুধু শুধু ভয় দেখাচ্ছেন কেন? তাছাড়া আব্বা জেনে গেলে আপনার নাতিও পার পাবে না।

রহিমন দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ লো বুন, তোদের দু’জনের কথা ভেবে রাতে নিদ আসে না। তোর বাপ কী দাইহানের হাতে তোকে দেবে?

এবার আসমা দাদিকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমাদের জন্য আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আল্লাহ তকদিরে যা রেখেছে হবেই। আপনি শুধু আমাদের জন্য দোয়া। করবেন। আচ্ছা দাদি, ইকবাল ভাই ঢাকার ঠিকানা দাইহান ভাইয়ের কাছে দিয়ে গেছে কিনা জানেন?

রহিমন বলল, দাইহান ঠিকানা লিখে দিতে বলেছিল। ইকবাল দেয়নি। বলল, আমি যাদের বাড়িতে থাকি তারা ঠিকানা দিতে নিষেধ করেছে।

এখন আসি দাদি স্কুলে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে বলে আসমা ঘরে ফিরে এল। ঐদিন স্কুলে গিয়ে রুকসানাকে বলল, আজ সাকলে দাইহানের কাছে গেছলাম। সে ঘরে ছিল না। তারপর ইকবালের ঠিকানার ব্যাপারে দাদি যা বলেছে বলল।

রুকসানা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, ওর সঙ্গে যোগাযোগ করার যেটুকু আশা ছিল, তাও শেষ হয়ে গেল।

আসমা বলল, ইকবাল ভাইকে তোর ভুলে যাওয়া উচিত। ছোটবেলার কোনো দুর্ঘটনার জন্য তাকে নিয়ে সারাজীবন চিন্তা করা ঠিক নয়।

তুই দাইহানকে ভুলে যেতে পারবি?

আমাদের সঙ্গে তোদের তুলনা করা যায় না। কারণ আমরা ছোটবেলা থেকে একে অপরকে ভালবাসি। তোদের তো সেরকম না।

তাকে থামিয়ে দিয়ে রুকসানা বলল, ওসব কথা আর বলিসনি। আমার ভালো লাগছে না।

<

Super User