ডালকুত্তাদের নাকের ডগায় থাকতে কোন অসুবিধে হচ্ছে না আমার। ভয় তাড়াবার জন্যে পরস্পরের নাম ধরে ডাকাডাকি করছে ওরা, এগোবার মধ্যে গা-ঢাকা দেবারও কোন চেষ্টা নেই। ধীর গতিতে খুব সাবধানে সামনে বাড়ছে।

আমার এদিকে সংখ্যায় ওরা নয়জন। সাতজনই কৃষ্ণাঙ্গ, পরনে ন্যাভাল ইউনিফর্ম, হাতে এ. কে. ফরটিসেভেন অ্যাসল্ট রাইফেল। বাকি দুজন সিডনি শেরিডানের লোক। এদের পরনে সাদা স্যুট, হাতে স্মল আমর্স। এদের একজনকে চিনতে পারলাম, অনেকদিন আগে দেখেছি, রোভার গাড়িটা চালাচ্ছিল। আরেকজন জোড়া ইঞ্জিন সেসনার পাইলট।

মাথা গোনার কাজ শেষ করে ওদের দিকে পেছন ফিরে। দৌড়ে চলে এলাম জলার বাঁকের কাছে। অনুমান করছি, এই বাধাটার কাছে পৌঁছে ঘাবড়ে গিয়ে আরও ছড়িয়ে পড়বে দলটা, সে-সময় নিঃসঙ্গ একজনকে বাগে পেতেও পারি।

লম্বা গলার মত এক চিলতে জমি কাদার ওপর দিয়ে এগিয়ে গেছে, বুক সমান উঁচু ঘাস আর ম্যানগ্রোভ ঝোপে ঢাকা। কিনারা ধরে খানিকদূর এগিয়ে সামনে গলাটার ওপর আড়াআড়িভাবে পড়ে থাকা একটা নারকেল গাছ দেখতে পেলাম, মরা পাতা আর উঁচু ঘাসের ভেতর প্রায় অদৃশ্য হয়ে আছে। ওত পেতে অপেক্ষা করার জন্যে এমন জায়গা আর হয় না।

গাছের আড়ালে শুয়ে পড়লাম আমি। বেইট-নাইফটা বেল্টের খাপ থেকে বের করে হাতে ধরে আছি। মনে মনে শাণ দিচ্ছি ওটাতে। সুযোগ পেলেই ছুঁড়ে মারব।

ধীর কিন্তু সমান গতিতে আসছে ওরা। চেঁচামেচিটা কাছে চলে এসেছে। কিন্তু জলাটার সামনে আসতে এখনও এক-দেড় মিনিট সময় লাগবে ওদের।

আগে গেলে বাঘে খায়, কথাটা জানা নেই লোকটার। খসখস শব্দ শুনে তাকাতেই দেখি ঝোপের একটা অংশ দুলছে। সোজা। আমার দিকে এগিয়ে আসছে লোকটা।

আমার কাছ থেকে বিশ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে পড়ল। সাড়া পাবার আশায় হাঁক ছাড়ল সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে। ঠাণ্ডা স্যাতসেঁতে মাটির সঙ্গে চেপে রেখেছি মুখটা, মরা ডালপালা আর শুকনো পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছি। ঝোপের ছোট্ট একটা ফাঁকে তার পায়ের গোড়ালি আর হাঁটুর নিচ পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি। পরনে মোটা বু সার্জের ট্রাউজার, মোজা ছাড়া ভোতা চেহারার সাদা স্নিকার রয়েছে পায়ে। পা ফেলছে, প্রতিবার দেখা যাচ্ছে জুতোর ওপর আফ্রিকার কালো চামড়া।

লোকটা ক্রাশবোটের একজন নাবিক বুঝতে পেরে খুশি হয়ে উঠল মনটা, নিশ্চয়ই ওর কাছে অটোমেটিক রাইফেল আছে।

ধীরে একটু গড়ান দিয়ে ছুরি ধরা হাতটা মুক্ত করে নিলাম। দুই সেকেণ্ড এই কাজে ব্যস্ত ছিলাম। এরপর কানের এত কাছ থেকে আবার হাঁক ছাড়ল লোকটা, যে লাফ দিয়ে উঠল শরীরের পেশী। আরেকটু হলে নিজের অজ্ঞাতে আওয়াজ বেরিয়ে যাচ্ছিল গলা থেকে। অনেকটা দূর থেকে পাল্টা সাড়া দিল কেউ।

নরম বালিতে শব্দ পাচ্ছি ওর পায়ের। এখনও সোজা আমার দিকে আসছে।

হঠাৎ একটা ঝোপ এড়িয়ে বেরিয়ে এল ও। সম্পূর্ণ দেখতে পাচ্ছি ওকে। আমার কাছ থেকে দশ পা দূরে।

ন্যাভাল ইউনিফর্ম রয়েছে পরনে, মাঝখানে ছোট্ট লাল পমপম লাগানো ব্লু ক্যাপ মাথায়, স্ট্র্যাপের সঙ্গে ঝুলছে কোমরের কাছে ভয়াল চেহারার সাবমেশিন-গানটা। একহারা চেহারার লম্বা এক ছোকরা, বড়জোর বিশ বছর হবে বয়স। মুখটা নিভাঁজ, কিন্তু ভয়ে ঘেমে ভিজে আছে। কালো আঁধার মুখের ওপর চোখ দুটো অস্বাভাবিক সাদা আর উজ্জ্বল।

দেখে ফেলল আমাকে। আঁতকে উঠল, কিন্তু একটু সময় নষ্ট না করে বিদ্যুৎগতিতে ঘোরাচ্ছে আমার দিকে মেশিনগানটা। কিন্তু সেটা ওর ডানদিকের কোমরের কাছে ছিল, ঘুরিয়ে আমার দিকে আনার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াল ওর নিজের শরীরটাই। গলার নিচে দুই কলারবোন যেখানে মিলেছে, ছোট্ট গর্তটায় লক্ষ্যস্থির করছি আমি। মাথার ওপর তুলে ফেলেছি হাত। ছুঁড়ে দিচ্ছি ছুরিটা।

ছুরিটা ছেড়ে দেবার আগের মুহূর্তে জোর একটা ঝাঁকি দিলাম কব্জিতে, দ্রুত ডানা ঝাপটে পাখির মত লাফ দিয়ে বেরিয়ে গেল সেটা হাত থেকে। ঘঁাচ করে বিধল গিয়ে ঠিক জায়গায়। দুই। কলারবোনের মাঝখানে সবটুকু সেঁধিয়ে গেছে ছুরির ফলা, গলার নিচে শুধু বেরিয়ে আছে ওয়ালনাট কাঠের হাতলটা।

মুখ খুলে ফেলেছে লোকটা, জিভের ওপর দিয়ে পেছনের লালচে দেয়াল দেখতে পাচ্ছি পরিষ্কার। চিৎকার করতে চেষ্টা করছে ও, কিন্তু কোনরকম শব্দ বেরুচ্ছে না, কারণ সবগুলো ভোকাল কর্ডে পোচ দিয়েছে ছুরির ফলাটা-এবং ঠিক এটাই চেয়েছিলাম আমি।

আশ্চর্য মন্থর গতিতে হাঁটু ভেঙে ক্রমশ নিচু হয়ে যাচ্ছে লোকটা, মুখ করে রয়েছে আমার দিকে। হাঁটুর ওপর দাঁড়িয়ে। রয়েছে এখন। দুপাশে ঝুলছে হাত দুটো। বড় একটা নীল মাছি ওর মাথাটাকে দুবার চক্কর দিয়ে ফিরে এসে বসল ছুরির হাতলের ওপর। কাঁধের স্ট্র্যাপের সঙ্গে এখনও ঝুলছে কারবাইন।

সোজা আমার চোখে তাকিয়ে আছে ও। যেন চিরকালের জন্যে আটকে গেছে আমাদের দৃষ্টি। মুখটা এখনও খোলা। এরপর হঠাৎ একটা ঝাঁকি খেয়ে কাঁপতে শুরু করল সে, নাক আর মুখ দিয়ে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল রক্ত আর লাল বুদবুদ, ঝপ করে বসে পড়ল মাটিতে, সেজদার ভঙ্গিতে নেমে এল মাথাটা বালির ওপর।

উঠে দাঁড়িয়েছি আমি, মাথা নিচু করে চলে এসেছি লোকটার কাছে। মারা গেছে কিনা পরীক্ষা করা দরকার মনে করছি না। দুহাতে ধাক্কা দিয়ে চিৎ করে দিলাম তাকে, ছোট্ট একটা টানে। গলা থেকে বের করে নিলাম ছুরিটা। ওর শার্টের আস্তিনে ঘষে মুছে নিলাম ফলার রক্ত।

দ্রুত স্ট্রাপসহ কারবাইন আর বেল্টে আটকানো স্পেয়ার ম্যাগাজিনের বাণ্ডিলটা খুলে নিলাম আমি। টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে এলাম ওকে কাদার মধ্যে, বুকে একটা হাঁটু ঠেকিয়ে চাপিয়ে দিয়েছি শরীরের ভার। ধীরে ধীরে থকথকে মোটা কাদার স্তর চারদিক থেকে উঠে এসে ঢেকে দিচ্ছে শরীরটাকে। প্রথমে মাথাটা ডুবে গেল কাদার ভেতর, তারপর সম্পূর্ণ শরীর। স্পেয়ার ম্যাগাজিনের বাণ্ডিলটা কোমরে গুঁজে তুলে নিলাম সাবমেশিনগান, ছুটলাম বাকের দিকে।

ডালকুত্তারা জলার কিনারায় এসে পৌঁছুবার আগেই ঘুরপথে ছুট দিয়ে ওদের পেছনে চলে এসেছি আমি। এখনও দৌড়াচ্ছি, ক্রমশ সরে যাচ্ছি ওদের পেছন দিকে, এই ফাঁকে চেক করে নিচ্ছি এ. কে. ফরটিসেভেন। ম্যাগাজিনটা পুরো আছে এখনও, ব্রীচটাও লোডেড। স্ট্র্যাপটা আমার বাঁ কাঁধে আটকে নিলাম, কোমরের কাছে বাগিয়ে ধরে আছি অটোমেটিক কারবাইন।

শতিনেক গজ এগিয়ে থামলাম আমি, গা-ঢাকা দিলাম একটা নারকেল গাছের আড়ালে। থকথকে কাদা ভর্তি জলার মধ্যে বিপদে পড়েছে ডালকুত্তারা, ঘন ঘন হুইসেল আর খ্যাপাটে চেঁচামেচি শুনে তাই মনে হচ্ছে আমার। ওদিকে যেন ফাইনাল খেলা চলছে ফুটবল লীগ-এর।

দিক বদলে এখন আমি দ্রুত আড়াআড়িভাবে দ্বীপটাকে পেরোচ্ছি, দক্ষিণ প্রান্তের চূড়ার দিকে, সেখানে কথা হয়েছে দেখা হবে আমার সঙ্গে রডরিকের। নিচের সারির শেষ ঢালটা পেরিয়ে নারকেল গাছের বাগান থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। ঘন হয়ে জন্মেছে এদিকে বুনো ঝোপ-ঝাড়, গা ঢাকা দিয়ে আরও দ্রুত এগোতে পারছি সহজেই।

ঢালটা থেকে নেমে এসেছি, উঠতে শুরু করেছি আরেকটা ঢাল বেয়ে। মাথার দিকে প্রায় অর্ধেক দূরত্ব পেরিয়ে গেছি, ছলকে উঠল বুকের রক্ত আনকোরা নতুন একটানা বিস্ফোরণের আওয়াজে।

        চাবুকের ঘায়ে বাতাস কাটার মত গর্জে উঠল এফ, এন কারবাইনটা, সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল এ. কে. ফরটিসেভেনের প্রচণ্ড দমকা ঝড়।

বিস্ফোরণের দৈর্ঘ্য আর প্রচণ্ডতা লক্ষ করে বুঝলাম কয়েকটা অটোমেটিক তাদের ম্যাগাজিনের পুরোটা ছুঁড়েছে। তারপরই গুমোট নিস্তব্ধতা জমাট বাধল, টু-শব্দ নেই কোথাও।

এত করে নিষেধ করার পরও নিজেকে সামলাতে পারেনি রডরিক, বুঝতে পারছি। রেগে গেছি, কিন্তু সেই সঙ্গে পূর্ণ সজাগ হয়ে উঠেছি এই ভেবে যে না জানি কি ভয়ঙ্কর বিপদে জড়িয়ে ফেলেছে ও নিজেকে। একটা ব্যাপারে আমার সন্দেহ নেই, নাকের ডগার কাছে লক্ষ্যস্থির করে থাকলেও সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে ও।

হাঁটা বাদ দিয়ে ছুটতে শুরু করেছি আমি। সোজা নয়, কোনাকুনি উঠে যাচ্ছি ওপর দিকে, যেদিক থেকে শব্দটা পেয়েছি। ঝোপের ভেতর থেকে বিস্ফোরণের মত বেরিয়ে এলাম। রডরিককে জীবিত দেখতে পাব কিনা ভেবে উদ্বিগ্ন। সরু একটা প্যাসেজ দেখতে পাচ্ছি, দুই পাঁচিলের মাঝখানে ঢুকে সোজা ত্রিশ। গজ পেরিয়ে উঠে এলাম ঢালের মাথায়, আর একটু হলেই লোকটার দুই হাতের মাঝখানে সেঁধিয়ে যাচ্ছিলাম আমি। উল্টোদিক থেকে ছুটে আসছে সে, আমারই মত ঝড়ের বেগে।

একই লাইনে এর পেছনে রয়েছে আরও ছয়জন। শেষ লোকটা রয়েছে ত্রিশ গজ পেছনে, নিরস্ত্র, তাজা রক্তে ভিজে গেছে জ্যাকেটটা।

আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে আছে ওদের সবার চোখ, স্বয়ং আজরাইল যেন তাড়া করেছে ওদেরকে।

সঙ্গে সঙ্গেই বুঝলাম, রডরিকের গুলি এড়িয়ে পালিয়ে আসা দল এটা। নিশ্চয়ই এমন কিছু দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছে এদের যে ভয়ে মায়ের কোলে মুখ লুকাবার সুযোগ খুঁজছে। সম্ভবত কোন অলৌকিক উপায়ে লক্ষ্যভেদ করতে সমর্থ হয়েছে রডরিক, অনুমান করতে পারছি।

মুখোমুখি সংঘর্ষ বাধতে যাচ্ছিল, অথচ আতঙ্কে অন্ধ দলটা দেখতেই পায়নি আমাকে। সেফটি ক্যাচ অন করলাম আমি, পিঠ বাঁকা করে ঝুঁকে পড়লাম সামনের দিকে। কোমরের কাছ থেকে কারবাইনটা নাকের সামনে তুলে এনেছি। ওদের হাঁটু লক্ষ্য করে ব্যারেলটা ঘোরালাম একদিক থেকে আরেক দিকে। এ. কে. ফরটিসেভেনের বর্ষণ এত দ্রুত যে পা লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে আশা করা যায় লোকটা পড়ে যাবার সময় আরও তিন কি চারটে গুলি খাবে শরীরে।

একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল ওরা সবাই, রক্তাক্ত গায়ে গায়ে ধাক্কা খেয়ে, জড়াজড়ি করে পড়ে গেল একই সঙ্গে। 

চার পর্যন্ত গোনা শেষ করে ট্রিগার চেপে ধরা আঙুলটা ঢিল করে নিলাম আমি, লাফ দিয়ে প্রায় খাড়া নেমে যাওয়া একটা বিচ্ছিন্ন ঢালের কিনারা লক্ষ্য করে ডাইভ দিলাম। গড়িয়ে নেমে এলাম পনেরো ফুট নিচের প্রায় সমতল বালির ওপর, ঝাঁকি দিয়ে খাড়া হয়েই ঝড়ের বেগে ছুটছি আবার। পেছনে একটা সাবমেশিনগান তড়পাচ্ছে, কিন্তু আমাকে আড়াল দিয়ে রেখেছে ঘন ঝোপ, তাছাড়া এদিকে কোন বুলেট আসছে না। যতদূর বুঝতে পারছি, আচমকা এই হামলা চালিয়ে দুই কি তিনজনকে বিদায় করে দিতে পেরেছি আমি, বাকি সবাই আহত হয়েছে। যাই হোক, ভাবছি আমি, ওদের মধ্যে কেউ যদি বেঁচে ফিরতেও পারে ক্রাশবোটে, দ্বীপে ফিরতে আর সাহস পাবে না। ছোট দুটো হামলায় জিতেছি আমরা, কিন্তু ওদের হাতে এখনও আটকা রয়েছে রাফেলা। তার মানে ওদের পজিশন সব দিক থেকে ভাল। রাফেলা যতক্ষণ থাকবে ওদের হাতে ওরাই নিজেদের ইচ্ছা মত সুতো টেনে পুতুল নাচাবে।

লোকটা অমর, দিব্যি বহাল তবিয়তে চূড়ার কাছাকাছি মাথাউঁচু একগাদা পাথরের আড়ালে বসে আছে, অপেক্ষা করছে। আমার জন্যে। 

জেসাস, ম্যান! চাপা গলায় হুঙ্কার ছাড়ল ও। তোমার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে বুড়ো হয়ে গেলাম-কি করছিলে এতক্ষণ, মাসুদ?

যেখানে ফেলে রেখে এসেছিলাম সেখান থেকে আমার হ্যাভারস্যাকটা তুলে নিয়ে এসেছে রডরিক। দুটো ছিনতাই করা এ. কে. ফরটিসেভেন আর স্পেয়ার ম্যাগাজিনগুলোর পাশে পড়ে রয়েছে সেটা। পানির বোতলটা বাড়িয়ে ধরল আমার দিকে ও, এতক্ষণে টের পেলাম আমার গলা আর বুক শুকিয়ে কারবালার ময়দান হয়ে গেছে। কিন্তু মাত্র তিন ঢোক পানি বরাদ্দ করলাম। নিজেকে।

অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, মাসুদ, খুবই দুঃখিত আমি। তোমার নিষেধ অমান্য করে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছিল আমাকে। পিকনিকে আসা ছেলেমেয়েদের মত দল বেঁধে দাঁড়িয়ে ছিল ওরা, যীশুর কসম, লোভ সামলাতে পারিনি। দুজনকে সঙ্গে সঙ্গে খতম করেছি, বাকিরা মুরগির বাচ্চার মত পালিয়েছে-সোজা আকাশের দিকে গুলি ছুঁড়ছিল।

হুঁ, বললাম ওকে। ঢালে ওঠার সময় দেখা হয়েছে ওদের সঙ্গে আমার।

গুলির আওয়াজ শুনেছি। একটু পরেই যেতাম তোমার খোঁজে।

পাথরের ওপর ওর পাশে বসলাম আমি। হ্যাভারস্যাক থেকে চুরুট বের করে ধরালাম দুজন। অখণ্ড নিস্তব্ধতাটুকু উপভোগ করছি, কিন্তু রডরিক সমস্যার কথা পেড়ে নষ্ট করল সেটা।

ওদের লেজে আগুন ধরিয়ে দিয়েছি আমরা। ফিরে আসবে বলে মনে করি না। কিন্তু ওদের কাছে এখনও মিস রাফেলা রয়েছে, ম্যান। তার মানে ওরাই জিতেছে।

ওদেরকে গুণেছ, রডরিক?

চুরুটের লাল মাথার দিকে তাকিয়ে আছে। ও, বলল, দশজন। দুজনকে বাদ দাও। আরেক জনের হাত উড়িয়ে দিয়েছি বগলের কাছ থেকে, সে-ও বাদ। সাতজন।

হ্যাঁ, বললাম আমি। সাতজনকেই দেখেছি আমি। ধরো, এই দলে চারজনের বেশি নেই। ওদিকে রয়েছে আরও আটজন। এরা বারোজন ছাড়াও ক্রাশবোটে রয়েছে সাত কি আটজন। তার মানে আরও বিশটা রাইফেলের সঙ্গে লড়তে হবে আমাদেরকে।

ক্যাপটা তুলে কামানো গম্বুজটায় আদর করে একবার হাত বুলাল রডরিক। ঘাবড়াই না, চেহারাটাকে কদাকার করে তুলে বলল ও।

সবচেয়ে নতুন সাবমেশিনগানটা বেছে নিলাম আমি, সঙ্গে থাকল পাঁচটা পুরো ম্যাগাজিন। বাকিগুলো পাথরের একটা ফাটলে লুকিয়ে রাখলাম। আরও দুঢোক করে পানি খেয়ে নিয়ে উঠলাম আমরা। রডরিককে পেছনে নিয়ে সাবধানে পাথরের ওপর দিয়ে এগোচ্ছি, সামনের দিকে ঝুঁকে মাথা নিচু করে আছি, নিচ থেকে কেউ যাতে আকাশের গায়ে দেখতে না পায় আমাদেরকে। পরিত্যক্ত ক্যাম্পের দিকে ফিরে যাচ্ছি আমরা।

যেখানে দাঁড়িয়ে প্রথম আসতে দেখেছিলাম বুমেরাংকে সেখান থেকে দ্বীপের পুরো উত্তর এলাকাটার ওপর চোখ বুলাচ্ছি। যা ভেবেছিলাম, সিডনি শেরিডান আর হুমায়ুন দাদা তাদের লোকজনকে ডেকে নিয়েছে দ্বীপ থেকে। ছোট মোটর বোট আর রডরিকের হোয়েলবোট, দুটোই ভিড়েছে ক্রাশবোটের গায়ে। ডেকের ওপর লোকজনের ছুটোছুটি, ব্যস্ততা দেখতে পাচ্ছি। আহতদের নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে ওরা, কল্পনার চোখে দেখতে পাচ্ছি কেবিনের ভেতর উত্তেজিতভাবে পায়চারি করছে হুমায়ুন দাদা আর সিডনি শেরিডান।

ক্যাম্পে ফিরছি আমি, রডরিক, বললাম ওকে। দেখে আসি আমাদের জন্যে কিছু রেখে গেছে কিনা। বিনকিউলারটা ধরিয়ে দিলাম ওর হাতে। তুমি এখান থেকে পাহারা দেবে আমাকে। পরপর তিনটে গুলি মানে ওয়ার্নিং সিগন্যাল।

ঠিক আছে, সহজেই রাজি হল রডরিক। চোখে বিনকিউলার তুলে তাকাল ক্রাশবোটের দিকে। ঘুরে দাঁড়াতে যাব, এই সময় চোখ থেকে নামিয়ে নিঃশব্দে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল ও বিনকিউলারটা।

কিছু জিজ্ঞেস না করে ওর হাত থেকে নিলাম ওটা, চোখে তুলে তাকাতেই দেখতে পেলাম বিশাল চেহারার হুমায়ুন দাদাকে, কেবিন থেকে বেরিয়ে ব্রিজের দিকে এগোচ্ছে সে।

সাদা ইউনিফর্ম পরে আছে হুমায়ুন দাদা, রোদ লেগে। ঝিকমিক করছে তার প্রকাণ্ড বুক ভর্তি পদকগুলো। তার সঙ্গে। রয়েছে কয়েকজন ক্রু, পিঁপড়ের মত ঘিরে রেখেছে তাকে, দরকার হলেই যাতে সাহায্য সেবায় লাগতে পারে। 

ব্রিজে উঠছে হুমায়ুন দাদা, ক্রুরা তাকে সাহায্য করছে। ওপরে উঠে থামল সে, বিশাল একটা হাত বাড়িয়ে দিল একদিকে। তার হাতে একটা ইলেকট্রিক বুলহর্ন ধরিয়ে দেয়া হল। ঘুরে তীরের দিকে মুখ করে দাঁড়াল হুমায়ুন দাদা, মুখের। সামনে তুলল বুলহর্নটা। দেখতে পাচ্ছি, বড় কালো ঠোঁট জোড়া নড়ছে তার।

এক মুহূর্ত পরই তার কণ্ঠস্বর ভেসে এল আমাদের কানে।

মাসুদ রানা। আশা করি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ তুমি। শুধু তোমার সম্মানে আজ সন্ধ্যায় একটা বিচিত্রানুষ্ঠানের আয়োজন। করেছি আমরা। ক্রাশবোটটা দেখা যায় এমন এক জায়গায় দয়া করে থেকো তুমি। অ্যামপ্লিফায়ারের মধ্যে দিয়ে তার কণ্ঠস্বর। ভরাট আর কর্কশ হয়ে বাজছে কানে। কথা দিচ্ছি, তোমার জন্যে অনুষ্ঠানটা মনোমুগ্ধকর হবে। সন্ধ্যা নটায় এই জাহাজের আফটার ডেকে হবে অনুষ্ঠানটা। দারুণ রোমাঞ্চকর ব্যাপার, রানা। সুযোগটা হারিয়ো না।

ক্রুদের একজনকে বুলহর্নটা দিয়ে নিচে নেমে গেল প্রকাণ্ডদেহী হুমায়ুন দাদা।

রাফেলার কোন ক্ষতি করতে যাচ্ছে ওরা, বিড় বিড় করে বলল রডরিক, কোলের ওপর শুইয়ে রাইফেলটার গায়ে হাত বুলাচ্ছে।

নটার সময় জানতে পারব, ক্রাশবোটের দিকে চোখ রেখে বললাম আমি। দেখতে পাচ্ছি, ডেক থেকে মোটরবোটে নামছে বুলহর্ন হাতে নিয়ে একজন অফিসার। মোটরবোট ছেড়ে দিল একজন ক্রু, দ্বীপটাকে ঘিরে মন্থর গতিতে ঘুরতে শুরু করল সেটা। হুমায়ুন দাদার তরফ থেকে আমাকে দাওয়াত করছে ওরা। দর্শক হিসেবে আমাকে পাবার জন্যে সাংঘাতিক ব্যগ্র মনে হচ্ছে হুমায়ুন দাদাকে।

ঠিক আছে, রডরিক, রিস্টওয়াচ দেখলাম আমি। এখনও কয়েক ঘন্টা সময় আছে হাতে। ক্যাম্পে যাচ্ছি, তুমি পাহারায় থাক।

ক্যাম্পটা চরম অবহেলার সাথে তছনছ করা হয়েছে। গুহাগুলোর ভেতরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে ভাঙাচোরা সরঞ্জাম, অর্ধভুক্ত খাবার। দামী জিনিসগুলো সঙ্গে করে নিয়ে গেছে ওরা। তবু কিছু জিনিস দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে ওদের।

কাজে লাগতে পারে এমন কিছু সাজ-সরঞ্জামের সঙ্গে পাঁচ ক্যান ভর্তি ফুয়েল অন্য এক জায়গায় লুকিয়ে রাখলাম আমি। ওখান থেকে সাবধানে নেমে ঝোপের কাছে এসে উঁকি দিয়ে তাকিয়ে স্বস্তির সাথে দেখলাম সিন্দুক আর বাঘের মাথাটা যেখানে রয়েছে তার ওপরের মাটিতে কোথাও একটু আঁচড়ও পড়েনি।

পাঁচ ক্যান পানি, তিন টিন শুকনো বীফ আর দুই টিন ভেজিটেবল নিয়ে উঠে এলাম আমি। কোন কথা নয়, আগে আমরা খাওয়া সারলাম।

যদি পার খানিকটা ঘুম দিয়ে নাও, রডরিককে বললাম আমি। সামনে কঠিন একটা রাত আসছে। দুনিয়ার ঝড়ঝাপ্টা বয়ে যাবে আজ রাতে।

হু করে চাপা হুঙ্কার ছেড়ে প্রকাণ্ড কালো একটা ভল্লুকের মত। কর্কশ ঘাসে পিঠ দিয়ে চিৎ হল ও, একটু পরই মৃদু এবং নিয়মিত নাক ডাকার শব্দ পেলাম ওর।

চুরুট ধরিয়ে বুদ্ধি পাকাচ্ছি, কিন্তু লাভ হচ্ছে না কিছু। একে একে তিনটে চুরুট ধ্বংস করলাম। তারপর সূর্য যখন দিগন্তরেখা ছুঁচ্ছে, মাথায় খেলে গেল বুদ্ধিটা। একেবারে সহজ, অথচ দারুণ এক কৌশল পেয়ে গেছি আমি-এত সহজ বলেই তীব্র সন্দেহ হল আমার, তাই আরও দুবার গোটা ব্যাপারটা গোড়া থেকে আগা। পর্যন্ত ভেবে দেখে পরীক্ষা করে নিলাম।

ইতিমধ্যে নেতিয়ে পড়েছে বাতাস। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, চারদিকে এখন গাঢ় অন্ধকার। জিনিয়াস মনে হচ্ছে নিজেকে, বুদ্ধিটার কোথাও একটু গলদ নেই। নিঃশব্দে হাসছি এখন।

ক্রাশবোটের সব কটা পোর্টে উজ্জ্বল আলো জ্বলছে, এক জোড়া ফ্লাড লাইট আলোকিত করে রেখেছে আফটার ডেকটাকে। খালি একটা স্টেজের মত দেখাচ্ছে সেটাকে।

রডরিকের ঘুম ভাঙালাম আমি, তারপর খেতে বসলাম।

চল বীচে যাই, বললাম ওকে। ওখান থেকে ভাল দেখা যাবে।

ব্যাপারটা ফাঁদ হতে পারে, মাসুদ, মৃদু গলায় স্মরণ করিয়ে দিল আমাকে ও।

আমার তা মনে হয় না। দ্বীপে কেউ নেই ওদের। তাছাড়া ওরাই শক্তিশালী পক্ষ, এখনও ওদের হাতে রাফেলা রয়েছে। এধরনের কৌশল খাটাবার দরকার পড়ে না ওদের।

ম্যান, একটু যদি ক্ষতি করে ওরা মেয়েটার…, নিজেই চুপ করে গেল রডরিক। উঠে দাঁড়াল ও। বলল, ঠিক আছে, চলো যাওয়া যাক।

ঝোপের আড়ালে আবডালে থেকে খুব সতর্কতার সঙ্গে নামছি আমরা। রাইফেল কক্ করে নিয়েছি দুজনেই, আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে রেখেছি ট্রিগার।

রাতটা নিঝুম, পরিবেশটা নির্জন। সৈকতের কিনারায়, গাছের শেষ সারির পেছনে থামলাম আমরা। মাত্র দুশো গজ দূরে ক্রাশবোট। একটা নারকেল গাছে হেলান দিয়ে চোখে বিনকিউলার তুলে তাকালাম ওটার দিকে হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারব, এত কাছে চলে এল ওটা। একজন ক্রু সিগারেটের প্যাকেট বের করল পকেট থেকে, প্যাকেটের গায়ের লেখাগুলো পরিষ্কার পড়তে পারছি আমি।

সত্যি, ভয় লাগছে আমার। ঠিক কি করতে যাচ্ছে হুমায়ুন দাদা কল্পনা করতে গিয়ে আরও বাড়ছে ভয়টা, তার ইচ্ছাটাকে আন্দাজ দিয়েও ছুঁতে পারছি না আমি।

চোখ থেকে বিনকিউলার নামিয়ে নিচু গলায় বললাম রডরিককে, রাইফেল বদল করি এসো।

লম্বা ব্যারেলের এফ. এনটা আমাকে দিল ও, আমার কাছ থেকে নিল এ. কে. ফরটিসেভেন। লক্ষ্যভেদ করার বিশেষ গুণ রয়েছে এফ-এন-এর, ক্রাশবোটের ডেকে গুলি ছুঁড়তে হলে সেটা দরকার আমার। রাফেলা যতক্ষণ অক্ষত থাকবে ততক্ষণ ওদেরকে শায়েস্তা করার কোন ব্যবস্থা নিতে পারব না আমি, একথা ঠিক। কিন্তু ওর যদি কোন ক্ষতি করে ওরা-ও একা যাতে না ভোগে তার ব্যবস্থা যেভাইে হোক করতে হবে আমাকে।

নারকেল গাছটার পাশে বসে অ্যাডজাস্ট করে নিলাম রাইফেলের সাইট, লক্ষ্যস্থির করেছি একজন ডেক গার্ডের কপালের ওপর ঘামের ফোটায়। জানি এখন এই জায়গায় বসে থেকে লোকটার মগজ উড়িয়ে দিতে পারি আমি।

সন্তুষ্ট হয়ে কোলের ওপর নামিয়ে রাখলাম রাইফেলটা। অপেক্ষা করছি।

জলা থেকে প্রথম ঝকের মশাগুলো আগেই এসে পৌঁছেছে, আমাদের মাথাটাকে ঘিরে উড়ছিল এতক্ষণ, এবার হাতে আর মুখে বসতে শুরু করেছে। খুদে বেলুনের মত রক্তে ফুলে উঠছে। এক একটা, জ্বালা অনুভব করছি, কিন্তু চড়-চাপড় মেরে তাড়াতে। পারছি না ওদেরকে। একটা চুরুট ধরাতে পারলে ভাল হত, কিন্তু। ঝুঁকিটা নেয়া চলে না এখন।

ধীরে ধীরে এগোচ্ছে সময়। যত দেরি হচ্ছে ততই একের পর এক নতুন ভয় ঢুকেছে মনে। অবশেষে, নির্দিষ্ট সময়ের কয়েক মিনিট আগে, ক্রাশবোটের ওপর একটা ব্যস্ততা লক্ষ করলাম।

কেবিন থেকে আবার বেরিয়ে এসেছে হুমায়ুন দাদা। মই বেয়ে উঠতে তাকে সাহায্য করছে নাবিকরা। ব্রিজ রেইলের কাছে তার নির্দিষ্ট চেয়ারটায় বসল সে, সামনের দিকে একটু ঝুঁকে নিচের আফটার ডেকের দিকে তাকাল। দরদর করে ঘামছে সে, দুই বগলের কাছে ভিজে গেছে ইউনিফর্ম জ্যাকেট। অপেক্ষার সময়টা সম্ভবত আমাদের কাছ থেকে লুট করা স্কচ খেয়ে কাটিয়েছে সে।

তার দুপাশে দাঁড়ানো ক্রু আর নাবিকদের সঙ্গে হাসি ঠাট্টা করছে হুমায়ুন দাদা। হাতির পিঠের মত দুই কাঁধ আর ফুলে। থাকা মস্ত পেটটা কাঁপছে হাসির দমকে।

মই বেয়ে এবার উঠে আসছে সিডনি শেরিডান, লোরনা পেজকে অনুসরণ করছে সে।

সাপের মত ঠাণ্ডা একটা ভাব রয়েছে সিডনির চেহারায়। অত্যন্ত দামী কাপড়ের স্যুট পরেছে সে, দাঁড়াল সবার কাছ থেকে একটু সরে। তেমন যেন আগ্রহ নেই এসবে তার উৎসাহিত বোধ। করার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। বাচ্চাদের অনুষ্ঠানে সে যেন একমাত্র বয়স্ক লোক, মনে হচ্ছে আমার, একঘেয়ে আর একটু তিক্ত দায়িত্ব পালন করতে এসেছে।

ঠিক উল্টো ভাব দেখছি লোরনার চেহারায়। এই প্রথম যেন বাড়ির বাইরে ছেলে-বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে এসেছে সে, ছটফট করছে উত্তেজনায়, কি এক প্রত্যাশায় চকচক করছে চোখ দুটো।

কারণে অকারণে খিলখিল করে হাসছে লোরনা, মুখ আর হাত নেড়ে অনর্গল কথা বলছে হুমায়ুন দাদার সঙ্গে। কিন্তু এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই সে। চঞ্চল ভাবে এদিক যাচ্ছে, ওদিক যাচ্ছে-আগুপিছু করছে বারবার-উত্তেজনা চেপে রাখতে পারছে না কোনমতে। একবার সে রেইলের ওপর ঝুঁকে নিচের খালি ডেকের দিকে তাকাল। কিছু একটা কল্পনা করে উত্তেজনা বেড়ে গেল তার, শক্তিশালী গ্লাস দিয়ে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি গাল দুটো লাল হয়ে গেছে-রুজ নয় ওগুলো।

লোরনার দিকে তাকিয়ে আছি, তাই নিচে কি ঘটছে টের পাইনি। হঠাৎ নিঃশ্বাস আটকে ফেলল রডরিক, চঞ্চল ভাবে নড়ে উঠল ওর শরীরটা, পরমুহূর্তে আঁতকে ওঠার শব্দ করল ও। দ্রুত নিচের ডেকে তাকালাম আমি।

ওখানে দেখতে পাচ্ছি রাফেলাকে, দুজন ইউনিফর্ম পরা নাবিকের মাখঝানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওরা দুজন দুটো হাত ধরে রেখেছে রাফেলার, মাঝখানে ছোট্ট আর বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে ওকে।

আজ সকালে তাড়াহুড়ো করে পরা সেই পোশাকটাই রয়েছে রাফেলার পরনে, চুলগুলো কাকের বাসার মত জটিল একটা স্তুপ হয়ে রয়েছে মাথায়, মুখে ব্যথা আর প্রচণ্ড ক্লান্তির ছাপ। অনিদ্রার কালো ছোপ দেখতে পাচ্ছি চোখের নিচে-কিন্তু এক মুহূর্ত পরই ভুলটা ভাঙল আমার-ওগুলো আঁচড় আর ক্ষতের দাগ। রাগের ঠাণ্ডা শিহরণের সাথে দেখছি ঠোঁট দুটো বেঢপ ভাবে ফুলে আছে ওর, যেন মৌমাছি কামড়েছে। নাকের দুপাশেও আঁচড়ের দাগ দেখতে পাচ্ছি।

রাফেলাকে ওরা মারধোর করেছে। এখন যখন খুঁজছি, ওর নীল শার্টে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগও ধরা পড়ছে আমার দৃষ্টিতে। এই সময় একজন গার্ড চরম অসম্মানের সাথে ওর গায়ে হাত দিয়ে ওকে তীরের দিকে ঘুরিয়ে দিল, এখন দেখতে পাচ্ছি একটা হাতে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা রয়েছে ওর, সেটার ওপর কালচে দাগটা শুকনো রক্ত নাকি অ্যান্টিসেপটিক মলমের দাগ, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

ক্লান্ত আর অসুস্থ দেখাচ্ছে রাফেলাকে, সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। রাগটা আমার সমস্ত বিবেচনাবোধকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে দ্রুত জায়গা দখল করে নিচ্ছে মাথার ভেতর, অনুভব করতে পারছি আমি। রাফেলার এই করুণ অবস্থার জন্যে যারা দায়ী তাদেরকেও ওর মত যন্ত্রণার ভাগ দেবার জন্যে তৈরি হয়ে গেছি প্রায় নিজের অজান্তেই। কোল থেকে তুলেছি রাইফেলটা। নিজেকে প্ররোচিত করছি মনে মনে। ওদের ওপর প্রচণ্ড ঘৃণায় হাত দুটো কাঁপছে আমার। শেষ পর্যন্ত অনেক কষ্টে সামলে নিলাম নিজেকে। চোখের পাতা চেপে বন্ধ করে আছি, নিজেকে শান্ত করার জন্য গভীর একটা শ্বাস টানলাম। সময় এবং সুযোগ আসবে, জানি আমি-এখন কিছু করে বসলে সেটার সম্ভাবনাই শুধু নষ্ট করা হবে, লাভ হবে না কিছুই।

আবার চোখ খুলে বিনকিউলার দিয়ে তাকালাম আমি। দেখি, হুমায়ুন দাদা তার মুখের সামনে তুলে ধরেছে ইলেকট্রিক বুলহর্নটা।

শুভ সন্ধ্যা, রানা, আমার পরম বন্ধু! তোমার সম্মানে আমাদের বিচিত্রানুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। আমি শিওর, এই সুন্দরী মেয়েটিকে চিনতে অসুবিধে হচ্ছে না তোমার। লম্বা করে হাত নেড়ে রাফেলাকে দেখাল হুমায়ুন দাদা, আর রাফেলা অসুস্থ, মন্থর ভঙ্গিতে মুখ তুলে তাকাল তার দিকে। ওকে আমরা জেরা করেছি। অপ্রীতিকর কৌশল দুএকটা ওর ওপর ব্যবহার করতে হয়েছে বলে দুঃখিত, রানা-সিনসিয়ারলি বলছি। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত জেনেছি, আমি আর আমার বন্ধু-বান্ধবরা যে সম্পদ সম্পর্কে আগ্রহী সেটা কোথায় আছে তা ওর জানা নেই। ও বলছে, তুমি কোথাও লুকিয়ে রেখেছ। থামল হুমায়ুন দাদা, সঙ্গে সঙ্গে একজন ক্রু তার হাতে ধরিয়ে দিল একটা তোয়ালে, সেটা দিয়ে মুখের ঘাম মুছে নিল সে।

তারপর আবার বলল, তোমার এই সঙ্গিনীর সঙ্গে আমার কোন ঝগড়া নেই-ওর ওপর কোন লোভও নেই। কিন্তু ওর গুরুত্ব আর মূল্য সম্পর্কে আমি পূর্ণ সচেতন। বিনিময় ব্যবসাতে হাতে এই রকম পুঁজি থাকলে লোকসানের কোন ভয় থাকে না। ঠিক কিনা, রানা, পরম বন্ধু? তুমি রাজি? বিনিময়ের জন্যে সমান গুরুত্ব আর মূল্যের পুঁজি তোমার কাছেও তো রয়েছে। রাজি? তবে সবুর, এখনই কোন সিদ্ধান্ত নিয়ো না। আসল অনুষ্ঠান শুরুই হয়নি এখনও-আগে সেটা দেখো।

দ্রুত, বিরক্তির সঙ্গে হাত নাড়ল হুমায়ুন দাদা। সঙ্গে সঙ্গে নাবিক দুজন ধরল রাফেলাকে, একরকম ঠেলতে ঠেলতেই নিচে নামিয়ে নিয়ে গেল ওকে।

রাফেলা চলে যেতে বুকটা খালি হয়ে গেল আমার। জানি না আর কোনদিন দেখতে পাব কিনা ওকে।

খালি ডেকে উঠে এল হুমায়ুন দাদার চারজন লোক। এদের সবার কোমর থেকে ওপরের অংশটা উদোম, মসৃণ কালো চামড়ার নিচে ঢেউ জেগে রয়েছে পেশীর।

চারজনের হাতে একটা করে ছোট কুঠার রয়েছে, হাতলগুলো কাঠের, আধ হাতের একটু বেশি লম্বা। কুঠারের ফলাগুলো মোটা ইস্পাতের, আলো লেগে চকচক করছে, কিনারার দিকটা চওড়া আর ধারাল-প্রত্যেকটা চার ইঞ্চি লম্বা, ইঞ্চি দুয়েক চওড়া। খোলা ডেকের চারকোণে নিঃশব্দে পজিশন নিয়ে দাঁড়াল ওরা।

এবার দুজন গার্ড একজন লোককে পথ দেখিয়ে নিয়ে এল খোলা ডেকে, ফাঁকা মাঝখানটায় দাঁড় করাল তাকে। হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা রয়েছে লোকটার। তার দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে গার্ড দুজন। তাদের দুজোড়া হাত হঠাৎ অলস ভঙ্গিতে মাঝখানে দাঁড়ানো লোকটাকে ধরে ঘোরাতে শুরু করল। লাটিমের মত।

বুলহর্নের মধ্যে দিয়ে ভেসে এল হুমায়ুন দাদার ভারী আর। কর্কশ কণ্ঠস্বর।

কি, চিনতে পারছ ওকে, রানা?

ক্যানভাস দিয়ে তৈরি জেলখানার ওভারঅলস পরে রয়েছে লোকটা। সামনের দিকে ঝুঁকে রয়েছে সে, গার্ড দুজনের হাত দুটো এখন দ্রুত হয়ে উঠেছে। পড়ে যেতে চাইছে লোকটা, পরিষ্কার ফাঁকি দেবার মতলব। কিন্তু গার্ড দুজনের দুই জোড়া হাত তাকে পড়ে যেতে দিচ্ছে না। ঘোরাচ্ছে অবিরাম। লোকটার গায়ের রঙ সাদা ফ্যাকাসে, চোখ দুটো গর্তে ঢোকা, সোনালি জট। পাকানো চুল নেমে এসেছে মুখের ওপর, মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি।

প্রায় সব কটা দাঁত হারিয়েছে লোকটা, সম্ভবত নির্মম ঘুসি মেরে উপড়ে ফেলা হয়েছে মাড়ি থেকে।

পারছ, রানা? হো হা হো হা করে খানিক হাসল হুমায়ুন দাদা। চিনতে পারছ? এর পেশা ছিল লোকজনকে ধরে ঠেঙানো আর কয়েদ করা। দুর্ভাগ্য আর বলে কাকে, ওর নিজের কপালেও তাই জুটেছে।

এতক্ষণে লোকটাকে চিনতে পেরে আশ্চর্য হয়ে গেলাম আমি। জলকুমারী থেকে বাইরের দিকের খাঁড়িতে ফেলে দিয়েছিলাম ওকে, গানফায়ার রীফের চ্যানেল ধরে হুমায়ুন দাদাকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে আসার সময়।

হ্যাঁ, ও হচ্ছে ইন্সপেক্টর পিটার টালি, ভেসে এল হুমায়ুন দাদার কণ্ঠস্বর। এই শালা বানচোতই ডুবিয়েছে আমাকে। আমাকে যারা ডোবায় তাদেরকে আমি পছন্দ করি না, রানা। আর  আমি যাদেরকে পছন্দ করি না তাদের কপালে খারাবি আছে, এ তো জানা কথা। কি সেই খারাবি? তা তোমাকে স্রেফ নমুনা হিসেবে দেখাবার প্রয়োজন হতে পারে মনে করেই ওকে সঙ্গে করে নিয়ে আসা। এই ধরনের প্রদর্শনী সাংঘাতিক কাজে দেয় রানা। চোখে না দেখলে মানুষ শাস্তির নির্মমতা ঠিক বুঝতে পারে না। বিশ্বাস কর, তোমার স্বার্থেই ব্যাপারটা তোমাকে বোঝাতে চাই আমি।

মুখ আর ঘাড় থেকে ঘামের স্রোত মোছার জন্যে আরেকবার বিরতি নিল হুমায়ুন দাদা। একজন লোকের হাত থেকে গ্লাস নিয়ে এক চুমুকে শেষ করল রঙিন মদটুকু।

গার্ড দুজনও একটু বিশ্রাম নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। আর এই সুযোগে দুই হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে মুখ তুলে তাকিয়ে আছে পিটার টালি হুমায়ুন দাদার দিকে। আতঙ্কের রেখা আর ভাঁজ পেঁচিয়ে গিয়ে কদাকার হয়ে উঠেছে মুখের চেহারা। ঠোঁট দুটো নড়ছে তার, বোঝা যাচ্ছে, করুণা ভিক্ষা চাইছে। ঠোঁটের দুই প্রান্ত বেয়ে নেমে আসছে থুথু আর লালা।

বন্ধুবর রানা, তুমি রেডি? এবার তাহলে শুরু করতে পারি আমরা? হো হা করে হাসল হুমায়ুন দাদা।

একজন গার্ড বড় একটা কালো কাপড়ের ব্যাগ পরিয়ে দিল টালির মাথায়, গলা পর্যন্ত ঢাকা পড়ে গেল তার। ফিতেটা টান করে গলার চারদিকে এঁটে বেঁধে দিল গার্ড। তারপর ওরা দুজন মিলে টেনে দাঁড় করাল টালিকে।

বাচ্চাদের একটা খেলা, তাই না, রানা? কর্কশ কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি হুমায়ুন দাদার। এর নাম কানামাছি খেলা, তুমি জানো। অনুষ্ঠানটাকে তোমার স্বার্থে রোমাঞ্চকর করার জন্যে খেলার ধরন একটু পাল্টেছি আমরা।

ভিজে যাচ্ছে টালির ক্যানভাস ট্রাউজারের সামনেটা, চরম আতঙ্কে খালি হয়ে যাচ্ছে ওর ব্লাডার। বোঝা যাচ্ছে, জিনবালা জেলে থাকার সময় এই খেলা দেখেছে সে। 

বন্ধু রানা, আমি চাই তোমার কল্পনাশক্তিকে একটু খাটাও। এই নোংরা জীবটাকে দেখ না, ওর জায়গায় দেখতে চেষ্টা কর তোমার প্রিয় সঙ্গিনীকে। দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলছে হুমায়ুন দাদা। একজন ক্রু তার দিকে আবার বাড়িয়ে দিল তোয়ালেটা।

হাত তুলে প্রচণ্ড একটা থাবড়া মারল লোকটাকে হুমায়ুন দাদা। ছিটকে পড়ল লোকটা, ডিগবাজি খেয়ে রেলিংয়ের সঙ্গে গিয়ে ধাক্কা খেল। শান্তভাবে কথা বলে চলেছে হুমায়ুন দাদা, যেন কিছুই হয়নি। কল্পনা কর, রানা, তোমার সঙ্গিনী এই অবস্থায় কি রকম আতঙ্ক বোধ করবে, চিন্তা কর।

গার্ড দুজন আবার নিজেদের মাঝখানে ঘোরাতে শুরু করেছে টালিকে। খেলার মধ্যে ছেলেরা ঠিক এইভাবেই একজনকে ধরে ঘোরায়। কোন বিরতি নেই, ওরা তাকে দ্রুত থেকে দ্রুততর গতিতে ঘুরিয়ে যাচ্ছে। এখন আমরা টালির অস্পষ্ট চিৎকার আর গোঙানি শুনতে পাচ্ছি।

হঠাৎ গার্ড দুজন টালিকে রেখে পিছিয়ে এল দ্রুত। এবার। এগিয়ে আসছে অর্ধনগ্ন চারজন লোক। তাদের একজন হাতের কুঠারটা উল্টো করে ধরে টালির শিরদাঁড়ার শেষ গিঁটে হাতল চেপে রেখে সামনের দিকে জোরে একটা ধাক্কা মারল।

একটা ঝাঁকি খেল টালি, টলতে টলতে এগোল সামনের দিকে। সামনে কুঠার নিয়ে তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছে আরেকজন, টালির পেটে হাতল দিয়ে গুতো মারবে সে।

বারবার হাতলের গুঁতো খেয়ে আগুপিছু করছে টালি। পড়ে যাবে, সে উপায় নেই তার। হাঁটু ভাঁজ খাবার আগেই তোর ঠেলায় শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে যাচ্ছে তার, ছুটে যাচ্ছে সামনের দিকে, পরমুহূর্তে সামনে বা পাশ থেকে আরেকটা গুতো খাচ্ছেএই ভাবে চলছে তো চলছেই। অবশেষে একজন তার কুঠারটা সিধে করে ধরে মাথার পেছনে তুলল, তারপর গায়ের সবটুকু শক্তি দিয়ে নামিয়ে আনল সেটা টালির পাঁজরে। ঘ্যাঁচ করে গেঁথে গেল ফলাটা। এটা সমাপ্তি টানার একটা ইঙ্গিত।

ডেকে পড়ে গেছে টালি। চারজন ভিড় করে দাঁড়িয়েছে তার ওপর। তাদের হাতের কুঠারগুলো উঠছে আর নামছে, উঠছে আর নামছে-ভীতিকর একটা ছন্দের তালে তালে। কুঠারের কোপগুলো পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি খাঁড়ির এপার থেকে-ঘ্যাচ-ঘ্যাচ, ঘ্যাচঘ্যাচ…দ্রুত।

পালা করে একটু পর পর ক্লান্ত হয়ে পিছিয়ে আসছে ওরা। টালির শরীরটা দলা পাকিয়ে পড়ে আছে ডেকের ওপর। ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে তার হাড়গোড়।

নিষ্ঠুর, তুমি বলবে, রানা-কিন্তু সাংঘাতিক ফলপ্রসূ, এ-কথা তোমাকে স্বীকার করতেই হবে।

বর্বর কাণ্ডটা অসুস্থ করে ফেলেছে আমাকে। আমার পাশ থেকে বিড়বিড় করছে রডরিক, ও মানুষ নয়, দানব, আতঙ্কে সরল স্বীকারোক্তি বেরিয়ে এল ওর গলার ভেতর থেকে, আমার ভয় লাগছে, মাসুদ।

কাল দশটা পর্যন্ত সময় দিচ্ছি তোমাকে, রানা, যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে হুমায়ুন দাদার। ঠিক সকাল দশটায় নিরস্ত্র অবস্থায় আপোসের মনোভাব নিয়ে আমার কাছে আসবে তুমি। আমার সাধ্যমত খাতির করব তোমাকে। আমরা দুজন, তুমি আর আমি, গল্পগুজব করব, কাঁধে হাত রেখে পায়চারি করব, হাসি-ঠাট্টা করব-বিশ্বাস কর, দারুণ জমবে দুই পরম বন্ধুতে। তারপর কিছু ব্যাপারে একমত হব আমরা। কিছু বিনিময় করব। তারপর বন্ধুত্ব বজায় রেখে পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নেব আমরা। তুমি রাজি রানা?

ক্রুরা টালিকে নিয়ে আবার ব্যস্ত হয়ে উঠেছে, তা দেখার জন্যে চুপ করে আছে হুমায়ুন দাদা। দুই কব্জিতে নাইলনের রশি বেঁধে ক্রাশবোটের মাস্তুলের মাথার কাছে তুলে ঝুলিয়ে দেয়া হল টালিকে। টপ টপ করে রক্ত ঝরছে ঘেঁতলানো শরীরটা থেকে। মুখ তুলে ওপর দিকে তাকিয়ে দৃশ্যটা গোগ্রাসে গিলছে লোরনা। পেজ। মাথাটা পেছন দিকে নুয়ে পড়েছে তার, সোনালি চুলগুলো। ঝুলছে পিঠ বরাবর। পরিষ্কার দেখতে পেলাম জিভের লাল ডগা বের করে নিচের ঠোঁটটা চেটে নিল সে।

আর যদি রাজি না হও, রানা, শেষ কথাটার খেই ধরে শুরু করল আবার হুমায়ুন দাদা, ঠিক কাল দুপুরে এখন যেখানে। ঝুলতে দেখছ টালিকে সেখানে ঝুলতে দেখবে তোমার বান্ধবীকে। চিন্তা কর, রানা। তাড়াহুড়ো কোরো না, প্রচুর সময় রয়েছে তোমার হাতে। ভাল করে ভেবে দেখ ব্যাপারটা।

হঠাৎ নিভে গেল ফ্লাড লাইট দুটো। উঠে দাঁড়াল প্রকাণ্ড দানবটা। অনুচরদের সাহায্য নিয়ে মই বেয়ে নামছে সে। তাকে অনুসরণ করছে লোরনা পেজ আর সিডনি শেরিডান। মই বেয়ে নামার সময় বারবার ঘাড় ফিরিয়ে দেখছে লোরনা ঝুলন্ত মাংসপিণ্ডটাকে। কিন্তু ভুরু কুঁচকে রয়েছে সিডনি শেরিডানের, কি যেন ভাবছে সে।

আমি অসুস্থ বোধ করছি, মাসুদ, বিড় বিড় করে বলল রডরিক।

কাটিয়ে ওঠ, বললাম ওকে। কারণ সামনে আমাদের গাধার খাটুনি রয়েছে।

<

Super User