রাত শেষ হবার আগেই ঘুম ভেঙে গেল আমার। পাশে শুয়ে আছে রাফেলা, একই মাপের মৃদু নিঃশ্বাস পতনের শব্দ শুনতে পাচ্ছি ওর। আলগোছে উঠে পড়লাম বিছানা ছেড়ে। ঠাণ্ডা লাগছে, তাই শর্টস আর উলেন জার্সি পরে নিলাম।

গুহার বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি পশ্চিমা বাতাসে ভাঙন ধরেছে মেঘের স্তরে। কখন যেন থেমে গেছে বৃষ্টি, মেঘের ফাঁক ফোকর দিয়ে দেখা যাচ্ছে জ্বলজ্বলে তারা, তাদের আলোয়। চোখের সামনে হাত তুলে রিস্টওয়াচ দেখলাম আমি। তিনটে। বেজে কয়েক মিনিট হয়েছে।

পেচ্ছাব করে ফিরে যাবার সময় দেখলাম আমাদের স্টোররুমে আলো জ্বলছে, গ্যাস লণ্ঠনটা নিভিয়ে দিতে ভুলে গিয়েছিলাম আমরা। ফেরার পথে গুহার ভেতর ঢুকব বলে মুখের সামনে দাঁড়িয়েছি। খোলা সিন্দুকটা যেখানে রেখে গিয়েছিলাম সেখানেই পড়ে রয়েছে, বাঘের অমূল্য মাথাটাও রয়েছে জায়গা মত, তার কপালে আগুনের মত জ্বলছে গ্রেট মুঘল। আচমকা একটা আতঙ্কের ঢেউ বয়ে গেল আমার শরীরে। চোর সবখানেই আছে, সাবধানের মার নেই-হঠাৎ আশঙ্কাটা অস্থির করে তুলল। আমাকে।

গুপ্তধন যতটুকু উদ্ধার করা গেছে তা নিরাপদ কোথাও সরিয়ে ফেলতে হবে, দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। কাল সকালে নয়, এখনই। মদের নেশা কাটেনি আমার, মাথাটা ব্যথা করছে, কিন্তু এ কাজটা আমি ফেলে রাখতে পারি না। তবে একার কাজ নয়। এটা, সাহায্য লাগবে আমার। 

ওদের গুহার সামনে দাঁড়িয়ে মৃদু গলায় একবার ডাকতেই ডোরা কাটা পাজামা পরে নিঃশব্দে বুনো একটা ভালুকের মত বেরিয়ে এল রডরিক তারার আলোয়। সদ্য ঘুম থেকে উঠে এসেছে ও, কিন্তু ঘুমের লেশমাত্র নেই চোখে। আমার ডাক শুনেই সতর্ক, হুঁশিয়ার হয়ে উঠেছে-নিমেষে ছুটে গেছে মদের নেশা।

আমার ভয়ের কথাটা বললাম ওকে। ঘোঁৎ করে একটা চাপা হুঙ্কার ছাড়ল ও, তারপর আমার সঙ্গে রওনা হল স্টোরেজ গুহার দিকে। পাথর ভর্তি প্লাস্টিক প্যাকেটগুলো এক এক করে সিন্দুকে ভরলাম আমরা, ঢাকনিটা বন্ধ করে নাইলনের রশি দিয়ে জড়িয়ে বাঁধলাম। একটা ক্যানভাস তারপুলিন দিয়ে সোনার মাথাটাকে মুড়ে ফেলল রডরিক। বোঝা দুটো কাঁধে তুলে নিয়ে নারকেল বাগানের দিকে রওনা হলাম দুজন। এরপর আবার ফিরে আসতে হল গ্যাস লণ্ঠন আর কোদাল নিয়ে যাবার জন্যে।

লণ্ঠনের আলোয় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কাজ করছি আমরা। জেলিগনাইট আর স্পেয়ার ম্যাগাজিনসহ এফ. এন কারবাইনটা যেখানে রয়েছে সেখান থেকে কয়েক ফুট দূরে বেলে-মাটি খুঁড়ে দুটো অগভীর গর্ত তৈরি করলাম আমরা। বোঝা দুটো গর্তের ভেতর নামিয়ে মাটি চাপা দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। তারপর অত্যন্ত সাবধানে জায়গাটা থেকে আমাদের উপস্থিতির সমস্ত চিহ্ন মুছে ফেলার কাজে আধঘন্টা সময় ব্যয় করলাম।

এখন তুমি খুশি, মাসুদ? অবশেষে কথা বলল রডরিক।

হ্যাঁ, রডরিক, এখন আমি খুশি। এবার তুমি যাও, সোজা বিছানায় ফিরে গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুম দাও।

নারকেল গাছের ভেতর দিয়ে হাতে লণ্ঠন নিয়ে ফিরে যাচ্ছে রডরিক, একবারও পেছনে ফিরে তাকাল না ও।

এখন আর চেষ্টা করলেও ঘুম আসবে না আমার, মাটি কাটার খাটনি দিতে গিয়ে পরিষ্কার হয়ে গেছে মাথাটা, জেগে উঠেছে শরীরের ভেতর রক্ত। গুহায় ফিরে গিয়ে সকাল না হওয়া পর্যন্ত রাফেলার পাশে চুপচাপ শুয়ে জেগে থাকার কোন মানে হয় না।

নির্জন আর গোপন একটা জায়গা দরকার এখন আমার। নিবিষ্ট মনে কিছু চিন্তা করতে চাই। যে জুয়া খেলায় জড়িয়ে রয়েছি আমি সেই খেলার পরবর্তী চাল কি হবে তা এখন ভেবে  বের করা দরকার আমার। নিচু পাহাড় সারির মাঝখানে ঝুলবারান্দাগুলোর কথা মনে পড়তে সে-পথে পা বাড়ালাম আমি। ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করেছি, এই সময় বাকি মেঘগুলোকে ঝেটিয়ে নিয়ে গেল বাতাস, হাসতে হাসতে বেরিয়ে এল হলুদ চাঁদটা। পূর্ণ যুবতী হতে এখনও ছয়দিন বাকি ওর। ঝুলবারান্দা থেকে সবচেয়ে কাছের একটা চূড়ায় উঠলাম আমি। বাতাসের ধাক্কা লাগবে না এমন একটা জায়গা বেছে বের করে বসলাম। একটা চুরুট থাকলে ভাল হত, মাথাটা আরও হালকা হলে খুশি। হতাম-কিন্তু এসব নিয়ে দুঃখ করে লাভ নেই কোন।

আধঘন্টা পর দৃঢ় সিদ্ধান্তে পৌঁছুলাম-এ পর্যন্ত যা উদ্ধার করা গেছে তা সিডনি শেরিডানের নাগালের বাইরে সরিয়ে ফেলতে হবে। সুযোগ আর সময়ের অপেক্ষায় আছে ওরা, যে-কোন মুহূর্তে হানা দিতে পারে। তার আগেই সাবধান হওয়া উচিত আমার। ঠিক করলাম, ভোরের আলো ফুটলেই বাঘের মাথা আর সিন্দুকের পাথর হোয়েলবোটে তুলে নিয়ে রওনা হয়ে যাব সেন্ট মেরীর উদ্দেশে। সতর্কতার সঙ্গে তৈরি করা আমার প্ল্যান অনুসারেই। ওগুলোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করব।

পরে আরও অনেক সময় পাব আমরা গানফায়ার রীফে ফিরে এসে পুলের তলা থেকে বাকি যা আছে উদ্ধার করার।

সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে যেতে স্বস্তির পরশে শরীর আর মন হালকা। হয়ে গেল আমার। নতুন উদ্যমে পরবর্তী বৃহত্তম ধাধা নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করলাম আমি।

মিস রাফেলা বার্ড। অকুণ্ঠচিত্তে নিজের কাছে স্বীকার করলাম, হ্যাঁ, ওকে আমি ভালবাসি। কথাটা যখন মেনে নিচ্ছি, অদ্ভুত এক স্বর্গীয় পুলক অনুভব করলাম শরীরে। কিন্তু পরমুহূর্তে মনে পড়ল, ভালবাসি ঠিক, কিন্তু ওকে আমি আজও বুঝে উঠতে পারিনি। এখনও আমার কাছে মস্ত একটা ধাঁধা হয়েই রয়েছে ও। আর কয়েকদিনের মধ্যেই বিয়ের প্রস্তাব দেব ওকে আমি। যা কিছু আমার কাছে সাবধানে গোপন করে রেখেছে ও, তখন সবই প্রকাশ হয়ে পড়বে। ওর চোখের নীল গভীরে ওই কালো ছায়া কিসের, জানতে চাই আমি। ওকে ঘিরে রয়েছে এমন আরও অনেক রহস্যের উত্তর চাই।

এতক্ষণে আলো ফুটছে পুব আকাশে। মহাসাগরের কালো। কর্কশ শরীর আলোর ছোঁয়ায় কোমল চেহারা ফিরে পাচ্ছে। আড়ষ্ট। ভঙ্গিতে পাথর ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি, বাতাসের তোড়ের মুখে বেরিয়ে এসে ধীর পায়ে নামছি নিচের দিকে।

চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে বাতাস। পথ হারিয়ে যাতে অন্যদিকে চলে না যাই তার জন্যে মাঝে-মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ে দেখে নিচ্ছি সামনেটা। অনেকটা নিচে দেখা যাচ্ছে আমাদের ক্যাম্প এলাকা।

বাতাসের চাপে আরেকবার দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। নিচের দিকে, দূরে তাকিয়ে আছি। খাড়ির একটা বাহু দেখতে পাচ্ছি এখান থেকে। ভোরের আলো ভাল করে ফোটেনি এখনও, তবু বে-র খোলা বাহুর দিকে চোখ পড়তেই দেখতে পেলাম নিঃশব্দে গুটি গুটি এগিয়ে আসছে একটা কালো ছায়া, দুঃস্বপ্নের মত, ভয়ঙ্কর।

একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার সময় ছায়াটার বো-এর কাছে পানি ছলকে উঠতে দেখে বুঝতে পারলাম নোঙর ফেলা হল। বাতাসে ধীরে ধীরে ঘুরে যাচ্ছে সেটা, লম্বা শরীরের একটা পাশ পুরোপুরি দেখতে পাচ্ছি এখন। এখন আর কোন সন্দেহ নেই আমার। বুমেরাংই।

আমার হুঁশ ফেরার আগেই ইয়ট থেকে একটা বোট নামানো হয়ে গেল। দ্রুত সৈকতের দিকে এগিয়ে আসছে সেটা।

ছুটতে শুরু করলাম আমি।

.

পথের ওপর আছাড় খেয়ে পড়লাম একবার, কিন্তু চূড়া থেকে মাথা নিচু করে ছুটে নামার তীব্র গতি এগিয়ে নিয়ে এল আমাকে, মাত্র একটা গড়ান দিয়ে স্প্রিঙের মত আবার আমি খাড়া হয়ে গেছি, দৌড়ের মধ্যে রয়েছি এখনও, ঢিমে হয়ে পড়েনি গতি।

একটা বিস্ফোরণের মত ঢুকলাম ওদের গুহায়। প্রচণ্ড হাঁপাচ্ছি। চেঁচিয়ে উঠলাম আমি, গলার দুপাশের রগগুলো ফুলে উঠল আমার, ওঠ, রডরিক, ওঠ! এরই মধ্যে সৈকতে পৌঁছে গেছে ওরা!

হাত-পা ছুঁড়ে স্লিপিং ব্যাগের ভেতর থেকে বেরিয়ে খাড়া হয়ে দাঁড়াল ওরা। এলোমেলো হয়ে রয়েছে ল্যাম্পনির মাথার চুল, চোখে পিচুটি আর ঘুম ঘুম ভ্যাবাচ্যাকা ভাব। কিন্তু রডরিক স্থির, সতর্ক আর প্রস্তুত।

রডরিক, দ্রুত বললাম ওকে, যাও, মাটির নিচ থেকে আমাদের সবেধন নীলমণিটাকে নিয়ে এসো। কুইক, ম্যান! নারকেল গাছের ভেতর দিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে এখানে পৌঁছে যাবে ওরা।

কথা বলছি, এরই মধ্যে পোশাক পাল্টে শার্ট আর প্যান্ট পরে নিয়েছে ও, কোমরে কষে বেঁধে নিচ্ছে বেল্টটা। গুহা থেকে ভোরের ম্লান আলোয় ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে, পেছন থেকে চিৎকার করে বললাম, এক মিনিটের মধ্যে তোমার পিছু নিচ্ছি আমি।

ল্যাম্পনির কাঁধ ধরে ঝাঁকালাম ওকে। বোকার মত তাকিয়ে থেকো না। ঘুম থেকে জাগো! আমি চাই মিস রাফেলার ভার। নেবে তুমি, বুঝতে পারছ?

কাপড় পরা শেষ হয়েছে ওর, আমার প্রশ্নের উত্তরে কাত করল মাথাটা।

এসো, প্রাণপণে দৌড়াচ্ছি আমাদের গুহার দিকে, ল্যাম্পনিকে প্রায় টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসছি আমি। বিছানা থেকে। তুলে দাঁড় করিয়ে দিলাম রাফেলাকে। কাপড় পরতে শুরু করেছে। ও, কি করতে হবে বুঝিয়ে দিচ্ছি ওকে দ্রুত।

তোমার সঙ্গে ল্যাম্পনি যাচ্ছে। এক ক্যান খাবার পানি নেবে তোমরা। কোথাও না থেমে সোজা চলে যাবে দ্বীপের দক্ষিণ দিকে। তার আগে পাহাড় সারির মাঝখানের কার্নিস পেরিয়ে গা ঢাকা দিয়ে নেবে। চূড়ায় উঠে যেখানে ফার্স্ট মেট বারলোর লেখাটা দেখেছিলাম, সেই চিমনিতে লুকিয়ে থাকবে। বুঝতে। পারছ কোন জায়গাটার কথা বলছি?

পারছি, রানা, ঘাড় কাত করে বলল রাফেলা।

ওখান থেকে নড়বে না। কোন পরিস্থিতিতেই নিচে নামবে না। বা ওপরে উঠে মুখ দেখাবে না। মনে থাকবে?

কোমরে শার্ট খুঁজছে রাফেলা, আবার ঘাড় কাত করল সে।

মনে রেখ, এই লোকগুলো খুনী। এখন আর ব্যাপারটা পিকনিক বা খেলা নয়। আমরা একদল হিংস্র নেকড়ের সামনাসামনি হয়েছি।

হ্যাঁ, রানা-আমি জানি।

যাও তাহলে, জড়িয়ে ধরে চুমু খেলাম ওকে। একটু ইতস্তত করে বললাম, আবার দেখা হবে।

দ্রুত বেরিয়ে গেল ওরা গুহা থেকে। পাঁচ গ্যালনের পানি ভর্তি ক্যানটা কাঁধে তুলে নিয়েছে ল্যাম্পনি, তার পেছনে দৌড়াচ্ছে ভীত-সন্ত্রস্ত রাফেলা। নারকেল বনের ভেতর ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল দুজন।

হালকা হ্যাভারস্যাকে দ্রুত কয়েকটা জিনিস ভরে নিলাম আমি। এক বাক্স চুরুট, দিয়াশলাই, বিনকিউলার, পানির বোতল, ভারী একটা জার্সি, এক প্যাকেট চকলেট, টর্চ-এইসব। বেইটনাইফের খাপসহ বেল্টটা বেঁধে নিলাম কোমরে, হ্যাভারস্যাকের স্ট্র্যাপটা কাঁধে তুলে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে এলাম গুহার বাইরে আমিও, নারকেল সারির ভেতর দিয়ে রডরিকের পথ অনুসরণ করে সৈকতের দিকে যাচ্ছি।

পঞ্চাশ গজ দৌড়েছি, এই সময় গুলি হল। ভোরের নিস্তব্ধতাকে টুকরো করে দিল একটা পিস্তল, একটা চিৎকার ঢুকল কানে, তারপর আবার একটা গুলির আওয়াজ। আমার সরাসরি সামনের দিক থেকে আসছে এসব। খুব কাছাকাছি কোথাও থেকে।

দৌড় থামিয়ে একটা নারকেল গাছের গুড়ির পেছনে গা ঢাকা দিয়ে বসে পড়েছি আমি। উঁকি দিয়ে যেদিকটায় আলো দেখছি সেদিকে তাকিয়ে আমি। প্রথমে আওয়াজটা ঢুকল কানে। কেউ ছুটে আসছে। তারপর অস্পষ্ট আলোয় দেখতে পেলাম মূর্তিটা। সোজা আমার দিকেই চলে আসছে। দ্রুত খাপ থেকে টেনে নিচ্ছি বেইট-নাইফটা।

কয়েক সেকেণ্ড অপেক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে নিলাম, তারপর মৃদু কণ্ঠে ডাকলাম, এদিকে!

বিনন করে ঘুরে গেল আমার দিকে ছুটন্ত মূর্তিটা। দ্রুত তালে, তবে খুব কম শব্দ করে হাঁপাচ্ছে রডরিক। এফ. এন। রাইফেল আর ক্যানভাসে মোড়া স্পেয়ার ম্যাগাজিনের প্যাকেটটা নিয়ে এসেছে ও। আমাকে দেখতে পেয়ে গতি মন্থর না করেই কাছে চলে এল, একটা ঝাঁকি খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল আচমকা।

ওরা দেখে ফেলেছে আমাকে, রুদ্ধশ্বাসে বলল ও। বেজন্মারা অনেক লোক।

ওর কথা শেষ হবার আগেই গাছের ফাঁকে আরও নড়াচড়া লক্ষ্য করলাম আমি। ওই আসছে, চাপা গলায় সতর্ক করে দিলাম ওকে। চল যাই।

নির্বিঘ্নে পালিয়ে যেতে দিতে চাই রাফেলাকে, তাই পাহাড় সারির মাঝখানের পথটা এড়িয়ে গেলাম, সরাসরি ছুটছি দক্ষিণ দিকে। দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তের পানিতে ডোবা আগাছা আর কাদার বিস্তৃতির দিকে যাচ্ছি।

দেখে ফেলল আমাদেরকে ওরা। আলোছায়ায় গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে গাছগুলো, ওদের সামনে দিয়ে আড়াআড়ি ভাবে ছুটছি আমরা-চেঁচিয়ে উঠল একজন। চিৎকারটা থামার আগেই কাছেপিঠে থেকে পাঁচটা গুলির শব্দ হল, গাছের ফাঁকে পিস্তলের মাজলে আগুনের ঝলক দেখতে পেলাম। আমাদের মাথার ওপর গিয়ে ছুটে গিয়ে একটা বুলেট নারকেল গাছের গায়ে বিধল। প্রাণপণে দৌড়াচ্ছি আমরা, কিছুক্ষণের মধ্যে ওদের চেঁচামেচি অস্পষ্ট হয়ে এল আমাদের পেছনে।

পানিতে ডোবা আগাছার কিনারায় পৌঁছেছি আমরা, চটচটে কাদা এড়াবার জন্যে বাঁক নিয়ে একই গতিতে দৌড়াচ্ছি। পাহাড় সারির প্রথম ঢালের গোড়ায় এসে থামলাম, দম নিচ্ছি, কান খাড়া করে শুনছি। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে উজ্জ্বল আলো। একটু পরেই সূর্য উঠবে, তার আগে গা ঢাকা দিতে চাই আমি।

জলমগ্ন কাদার দিক থেকে হঠাৎ একটা হৈ-চৈ ভেসে এল। চেঁচামেচির মধ্যে পরিষ্কার টের পাচ্ছি হতাশার সুর। সামনে কাদা দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছে ওরা, ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারছে না আবার আমরা অন্য পথ ধরে দ্বীপের ভেতর দিকে চলে এসেছি। যে-পথে এসেছে সেই পথ ধরে ফিরে যেতে হবে ওদেরকে, ভাবছি আমি, নিঃশব্দে হাসছি।

সব ঠিক আছে, রডরিক, নিচু গলায় বললাম আমি। চলো। কথাটা শেষ করেছি, কিন্তু এখনও পা বাড়াইনি, এই সময় অন্য দিক থেকে নতুন একটা আওয়াজ ভেসে এল কানে।

অনেক দূর থেকে আসছে বলে ভোতা লাগছে শব্দগুলো কানে। আসছে দ্বীপের সাগর তীরের দিক থেকে, পাহাড় সারি টপকে। কিন্তু চিনতে ভুল হয়নি আমার, ফড়ফড় করে কাপড় ছেড়ার একটানা পরিচিত শব্দ-অটোমেটিক রাইফেলের গুলিবর্ষণ।

স্তব্ধ পাথর হয়ে গেছি আমি আর রডরিক। একই আওয়াজ আরেকবার হল। সাবমেশিনগানের লম্বা বিস্ফোরণ, সন্দেহ নেই। তারপর আবার সব চুপচাপ। তবু আরও তিন কি চার মিনিট একই জায়গায় সজাগ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

এসো, মৃদু গলায় বললাম আমি। আর দেরি করা চলে না। ঢাল বেয়ে দ্রুত উঠে যাচ্ছি দক্ষিণ প্রান্তের শেষ চূড়াটার দিকে।

পথে আর কোন চেঁচামেচি বা গোলাগুলির আওয়াজ পেলাম, কিন্তু যে-কোন মুহূর্তে গুলির আশঙ্কায় কুঁকড়ে আছে মনটা। সরু কার্নির্স ধরে সাবধানে ছুটছি, বারবার পেছনে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছি রডরিক ঠিক মত অনুসরণ করতে পারছে কিনা। অবশেষে গভীর ফাটলের ভেতর ঢুকে পড়লাম আমরা। রাফেলার সঙ্গে এখানেই দেখা করবার ব্যবস্থা হয়েছে আমাদের।

একটু শব্দ নেই। পাথর ছাড়া চিহ্ন নেই আর কিছুর। জায়গাটা অস্বাভাবিক নির্জন। অমঙ্গল আশঙ্কা করে দুর্বল হয়ে পড়ল আমার শরীর। উত্তর পাব না এই ভয়ে অন্ধকার দেখতে শুরু করেছি চোখে। তবু মৃদু গলায় ডাকলাম, রাফেলা? তুমি। আছ, ডারলিং?

অটুট নিস্তব্ধতাই প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হয়ে বাজল আমার কানে। উত্তর জানা হয়ে গেছে আমার। চরকির মত আধপাক ঘুরে তাকালাম রডরিকের দিকে।

আমাদের অনেক আগে রওনা দিয়েছে ওরা। অনেক আগেই এখানে পৌঁছে যাবার কথা ওদের, খানিক আগে শোনা অটোমেটিকের আওয়াজ নতুন অর্থ বহন করছে এখন।

হ্যাভারস্যাক থেকে বিনকিউলারটা বের করে চোখে তুলে ফাটল দিয়ে তাকালাম। খুব বেশি দূর দেখতে পাচ্ছি না, ফুলে। ওঠা পাহাড়ের গায়ে বাধা পাচ্ছে দৃষ্টি।

বিপদে পড়েছে ওরা, দ্রুত ফিরলাম রডরিকের দিকে। এসো। চলো যাই, কি হয়েছে ওদের দেখে আসি।

কার্নিস থেকে ভাঙা টুকরো আলগা পাথরের রাজ্যে নেমে এলাম আমরা। যদি হোঁচট খাই বা পায়ের চাপে আলগা পাথর পিছলে যায়, গড়িয়ে একেবারে নিচে পড়ব, রক্তারক্তি দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। রাফেলার নিরাপত্তার কথা ভেবে দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে আছি, কিন্তু পাহাড় থেকে সৈকতের দিকে নামার সময় সম্ভাব্য সবরকম সতর্কতা বজায় রাখছি। নিচের বনভূমি বা সৈকত থেকে কেউ আমাদেরকে দেখে ফেলতে পারে, মনে রেখেছি সেসম্ভাবনাটাও।

দুই পাহাড় সারির মাঝখানের একটা ফাঁকে পা দিতেই সামনে দেখতে পেলাম লম্বা সৈকত, বাঁক নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে। একদিকে, আরও দূরে দেখা যাচ্ছে গানফায়ার রীফ-এর আভাস।

সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়েছি আমরা। রডরিকের হাত ধরে দ্রুত টেনে নিয়ে এসেছি আড়ালে।

গানফায়ার রীফের ফাঁকটাকে নাগালের মধ্যে রেখে চ্যানেলের মুখে প্রহরীর ভূমিকা পালন করছে একটা ক্রাশ বোট, দেখেই চিনতে পারলাম ওটাকে আমরা। জিনবালা বে থেকে এসেছে আমার পুরানো বন্ধু হুমায়ুন দাদা। সৈকত থেকে ক্রাশবোটে ফিরছে ছোট একটা মোটর বোট, তাতে খুদে মূর্তি দেখা যাচ্ছে অনেকগুলো।

সর্বনাশ, রডরিক! হতাশা চেপে রাখতে পারলাম না আমি। বুদ্ধি খেলিয়ে প্ল্যানটা করেছে ওরা। সিডনি শেরিডান দল পাকিয়েছে হুমায়ুন দাদার সঙ্গে। এখানে পৌঁছতে সেজন্যেই এত দেরি হয়েছে ওদের। সিডনিকে দ্বীপে পাঠিয়ে দিয়ে হুমায়ুন দাদা চ্যানেল পাহারা দিচ্ছে, যাতে আগের বারের মত এবার আমরা ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যেতে না পারি।

সৈকতেও লোক পাঠিয়েছে হুমায়ুন দাদা, বলল রডরিক। ওর লোকেরাই মেশিনগানের গুলি চালিয়েছে একটু আগে। কিন্তু বোট নিয়ে আবার তারা ফিরে যাচ্ছে কেন বুঝতে পারছি না।

কেন ফিরে যাচ্ছে তা ভাবতে গিয়ে আশঙ্কায় মাথাটা ঘুরে গেল আমার।

মিস রাফেলা আর ল্যাম্পনি-ওদেরকে কি…তুমি কি মনে কর ওরা পালিয়ে যেতে পেরেছে? নাকি হুমায়ুন দাদার লোকেরা ধরে নিয়ে যাচ্ছে ওদেরকে?

বিনকিউলার চোখে তুলে মোটর বোটের দিকে তাকিয়ে আছি আমি। বাইরে খাড়ির ঘোলা পানি কেটে ক্রাশবোটের দিকে এগোচ্ছে সেটা। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি না কিছু, বললাম রডরিককে। বোটের পেছনে ভোরের সূর্য উঠছে, পানিতে পড়া রোদের প্রতিবিম্ব ধাধিয়ে দিচ্ছে আমার চোখ, বিনকিউলার দিয়েও বোটের লোকজনদেরকে আলাদা ভাবে চিনতে পারছি না। হয়ত বোটেই রয়েছে ওরা, কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না আমি।

আড়াল থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। আরও ভাল এবং উঁচু। জায়গা থেকে মোটর বোর্টটাকে দেখতে চাই। রোদের মধ্যে হাঁটছি, নিশ্চয়ই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে আমাকে ওরা।

চেনা আগুনের ঝলকটা দেখতে পেলাম, গানম্মোকের লম্বা। সাদা পালক বেরিয়ে এল ক্রাশবোটের বো-তে বসানো কুইকফায়ারার থেকে। তীব্রগতি ঈগলের ডানা বাতাস কেটে যাবার সময় যে শব্দটা হয়, শুনতে পাচ্ছি পরিষ্কার-ছুটে আসছে কামানের শেল।

শুয়ে পড়! চেঁচিয়ে উঠে ডাইভ দিলাম আমি, আলগা। পাথরের বুকের ওপর আছাড় খেয়ে পড়লাম।

কাছেই বিস্ফোরিত হল শেলটা। জ্বলে উঠেই চোখ ধাধিয়ে দিয়ে নিভে গেল একটা আগুন, মুখ আর হাতে আঁচ অনুভব। করলাম আমি। ইস্পাতের টুকরো আর পাথর কুচির ঝক ছুটে গেল আমাদের চারদিকে। লাফ দিয়ে সটান উঠে দাঁড়ালাম আমি। চেঁচিয়ে বললাম, দৌড়াও!

পাঁচ পা এগিয়ে দিগন্তরেখার নিচে আড়াল নিচ্ছি, এই সময় দ্বিতীয় শেলটা এসে গেল আমাদের ওপর। মাথার ওপর দিয়ে প্রচণ্ড শব্দে ছুটে যাচ্ছে, দুজনেই মাথা নিচু করে নিলাম আমরা।

কব্জি থেকে রক্ত মুছছে রডরিক, দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি ঠিক আছ?

ছাল উঠে গেছে একটু, ও কিছু না।

রডরিক, ওদের খবর নেবার জন্যে নিচে যাচ্ছি আমি। তুমি এখানে অপেক্ষা কর আমার জন্যে, একসঙ্গে দুজনের ঝুঁকি নেয়ার কোন মানে হয় না।

অযথা মুখ খরচা করছ। আমিও যাচ্ছি। চলো।

রাইফেলটা তুলে নিয়ে অনুমতির অপেক্ষায় না থেকে নামতে। শুরু করল রডরিক। ওকে অনুসরণ শুরু করে ভাবছি এফ. এটা ওর কাছ থেকে চেয়ে নেব কিনা। এই গুরুতর পরিস্থিতিতে চোখ বন্ধ করে গুলি করার পদ্ধতি কোন কাজে দেবে না এখন। কিন্তু ওটা চাইলে মন খারাপ হয়ে যাবে ওর।

ধীর গতিতে নামছি আমরা। আড়াল থেকে বেরুচ্ছি না কখনও, সামনে পা ফেলার আগে যতদূর সম্ভব দেখে নিচ্ছি। আগে। গোটা দ্বীপ স্তব্ধ হয়ে আছে। বাতাস আর নারকেল পাতার খসখস শব্দ ছাড়া আর কিছু শুনছি না।

প্রশস্ত একটা ঢাল বেয়ে নামছি, রাফেলা আর ল্যাম্পনির পায়ের দাগ দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়ালাম, তারপর দাগ অনুসরণ করে দ্রুত এগোলাম। ওদের ছুটন্ত পায়ের দাগ বালি ছড়ানো মাটিতে গভীর গর্ত সৃষ্টি করেছে। রাফেলার পায়ের ছাপ সরু, আর ল্যাম্পনির খালি পায়ের ছাপগুলো বড় বড়। ঢাল বেয়ে এগুলো অনুসরণ করে যাচ্ছি। আচমকা এক জায়গায় থেমে গেছে

ওরা, এখানে পানির ক্যানটা ফেলে গেছে ল্যাম্পনি, তারপর হঠাৎ বাঁক নিয়ে দুজনে পাশাপাশি ছুটে গেছে ষাট গজের মত।

ওখানে আমরা পেলাম ল্যাম্পনিকে।

বালির ওপর পড়ে আছে। ঘুমাচ্ছে। ওর এই ঘুম ভাঙায় সেসাধ্য নেই কারও। থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছি, তাকিয়ে আছি ল্যাম্পনির দিকে, কিন্তু চোখের সামনে অন্য সব দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি আমি। ল্যাম্পনিকেই দেখছি, কিন্তু এ ল্যাম্পনি বোটের দড়িদড়া ধরে ঝুলছে, আমার ব্যাগ আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে রাফেলার হাত থেকে ছোঁ মেরে কেড়ে নিচ্ছে তার ব্যাগ, গ্রেট মুঘল তার দিকে বাড়িয়ে দেয়ায় ভয়ে পেছনে লুকিয়ে ফেলছে মুঠো পাকানো হাত দুটো, শালা বস বলে চেঁচিয়ে উঠছে, আঁটো প্যান্ট পরে হৈ-হুল্লোড় করছে মেয়েদের সঙ্গে লর্ড নেলসনে। কাঁদছি না আমি, কিন্তু অনুভব করছি কাঁদতে পারলে বেঁচে যেতাম। হেভি ক্যালিবারের তিনটে বুলেট খেয়েছে ও। গায়ের মোটা শার্ট ছিঁড়ে বুক দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় বড় বড় গর্ত রেখে গেছে বুলেটগুলো।

প্রচুর রক্ত বেরিয়েছে, কিন্তু প্রায় সবটুকুই শুষে নিয়েছে বালি। থকথকে রক্তের স্তরটা ইতিমধ্যে জমাট বাঁধতে শুরু করেছে, আর চারদিক থেকে এগিয়ে আসছে পোকা-মাকড়, প্রথম দলটা এরই মধ্যে ক্ষতগুলোর মুখে জায়গা দখলের জন্যে ঠেলাঠেলি শুরু করে। দিয়েছে নিজেদের মধ্যে।

দৃষ্টি দিয়ে রাফেলার পায়ের দাগ অনুসরণ করছি আমি। বিশ পা এগিয়েছে ও, তারপর বোকা মেয়েটা ঘুরে দাঁড়িয়ে ফিরে এসেছে আবার ল্যাম্পনির কাছে, হাঁটু গেড়ে বসেছে ওর পাশে। মস্ত ভুলটা এখানেই করেছে রাফেলা, সেজন্যে প্রচণ্ড রাগ হল ওর ওপর আমার। বিপদের সময় এধরনের বোকামি না করলে বোধহয় পালাতে পারত।

হাঁটু গেড়ে বসে রাফেলা ল্যাম্পনির দিকে ঝুঁকে ছিল, এই অবস্থায় ওকে ধরেছে ওরা, টেনে নিয়ে গেছে নারকেল গাছের ভেতর দিয়ে সৈকতের দিকে। হিঁচড়ে নিয়ে যাবার লম্বা দাগ দেখতে পাচ্ছি বালিতে। বালির কোথাও কোথাও গভীর গর্ত দেখতে পাচ্ছি, এইসব জায়গায় পা আটকে ওদেরকে বাধা দিতে চেষ্টা করছে রাফেলা।

গাছের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে দিয়ে এগোচ্ছি আমি। গাছের শেষ সারিগুলোর পেছনে চলে এসেছি। নিচের দিকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে সাদা বালি। ওদের পায়ের চিহ্ন অনুরসণ করে সৈকতে তাকালাম। মোটরবোটটা যেখানে থেমেছিল, এখনও। সেখানে বালির ওপর তার কীল-এর দাগ রয়েছে।

সব বুঝতে পারছি। মোটরবোটে তুলে ক্রাশবোটে নিয়ে গেছে ওরা রাফেলাকে। তাকিয়ে আছি, এই সময় নোঙর তুলে বাক নিতে শুরু করল হুমায়ুন দাদার ক্রাশবোট। কোর্স লক্ষ্য করে বুঝতে পারছি খাড়ির ভেতর দিকে বুমেরাঙের সঙ্গে যোগ দিতে যাচ্ছে ওটা।

ঘুরে দাঁড়িয়ে ফিরে আসব, মুহূর্তের জন্যে চুপচাপ দাঁড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কি থেকে কি হয়ে গেল, ভাবতে গেলেই অপরাধবোধে জর্জরিত হচ্ছি। এর সবটুকুর জন্যে আমি দায়ী। আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল আমার। রাফেলা আর ল্যাম্পনিকে চোখের আড়াল করা মস্ত ভুল হয়ে গেছে। হু-হু করছে বুকটা।

যাই হোক, এখন আর পাথরে মাথা ঠুকলেও ভুলের প্রায়শ্চিত্ত হবে না। বরং মাথাটারই এখন সবচেয়ে বেশি যত্ন নিতে হবে–কারণ, বুদ্ধির খেলা শুরু হয়ে গেছে। ভুলের আর কোন অবকাশ নেই। বুদ্ধি দিয়ে বাঁচতে হবে আমাদেরকে, বুদ্ধি দিয়ে উদ্ধার করতে হবে রাফেলাকে, আর বুদ্ধি দিয়েই কড়ায়-গণ্ডায় প্রতিশোধ নিতে হবে ল্যাম্পনি হত্যার-এর কোনটাই কোনটার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

ধীর পায়ে ফিরে এলাম রডরিকের কাছে। কারবাইনটা একপাশে নামিয়ে রেখেছে রডরিক, ল্যাম্পনির শরীরটা দুহাতে নিয়ে বসে আছে বালির ওপর। ওর প্রকাণ্ড কাঁধের ওপর রয়েছে ল্যাম্পনির মাথা। দুলছে রডরিক। চঞ্চল, ছটফটে বাচ্চাকে মা যেন বুকে নিয়ে আদরের চাপড় মারছে, ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করছে। নিঃশব্দে কাঁদছে রডরিক, চোখের পানির মোটা ধারা গাল বেয়ে চিবুক থেকে ঝর ঝর করে পড়ছে ল্যাম্পনির কোকড়ানো চুলে।

রাইফেলটা নিঃশব্দে তুলে নিয়ে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে নিজেদের চারদিকে তাকাচ্ছি আমি। ওদের পাহারা দিচ্ছি, আর আমার এবং নিজের তরফ থেকে ল্যাম্পনির জন্যে কাঁদছে রডরিক। চোখের পানি হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ওর দুঃখ, সেজেন্য ঈর্ষা হচ্ছে আমার। ল্যাম্পনিকে ওর মতই ভালবাসতাম তো, কিন্তু তবু রডরিকের মত কাঁদতে পারছি না, তাই অন্তরের গভীর অন্তস্তলে প্রচণ্ড ভাবে খোঁচাচ্ছে ধারালো চোখা কি যেন।

রডরিক, অবশেষে মৃদু কণ্ঠে বললাম ওকে, ওঠো, চলো যাই।

ল্যাম্পনিকে দুহাতের মধ্যে নিয়েই উঠে দাঁড়াল রডরিক।

পাহাড় সারি বরাবর পথ ধরে ফিরে আসছি আমরা।

কাঁধ-সমান উঁচু ঝোপ-ঝাড়ের মাঝখানে ফাঁকা একটু জায়গা দেখে পছন্দ হল আমার। জায়গাটায় ঘাস রয়েছে দেখে খুশি হল রডরিকও। খুব গভীর করে কবর খুঁড়লাম না দুটো কারণে। এক, খালি হাত দিয়ে মাটি খোড়া কঠিন। দুই, আমাদের মধ্যে একজনও কেউ যদি বেঁচে থাকি, এখান থেকে তুলে সেন্ট মেরিতে, জুডিথের কাছে নিয়ে যাব আমরা ল্যাম্পনিকে।

আমার বেইট-নাইফ দিয়ে গাছের ডালপালা আর পাতা কেটে জড়ো করলাম। কবরের তলায় সমান করে ডাল ফেলে, তার। ওপর বিছিয়ে দিলাম পাতাগুলো। তারপর ধরাধরি করে কবরে নামালাম আমরা ল্যাম্পনিকে। ওর গায়ে মাটি চাপা দিতে হাত। উঠল না আমাদের। তাই আবার ডাল কেটে নিয়ে এলাম আমি। কবরের ওপর আড়াআড়িভাবে ফেলা হল সেগুলো, তার ওপর আবার বিছালাম গাছের পাতা। এরপর মাটি ফেলে উঁচু করলাম কবরটাকে।

হাতের তালু দিয়ে চোখ আর গাল থেকে পানি মুছে উঠে দাঁড়াল রডরিক।

রাফেলাকে ধরে নিয়ে গেছে ওরা, শান্তভাবে বললাম ওকে। ক্রাশবোটে হুমায়ুন দাদার কাছে রয়েছে এখন ও।

মিস রাফেলা আহত হয়েছেন? জানতে চাইল রডরিক।

মনে হয় না-এখনও অন্তত নয়।

কি করতে চাও তুমি এখন, মাসুদ? জিজ্ঞেস করল ও।

আমার হয়ে উত্তর দিল একটা তীক্ষ্ম হুইসেলের শব্দ।

বহুদূর ক্যাম্পের দিক থেকে এল আওয়াজটা। খানিকটা উঠে। পাহাড়ের ওপর থেকে দ্বীপের নিচের দিকে তাকাতেই খাড়ির ভেতর-বাহুটা দেখতে পেলাম।

আগে যেখানে দেখেছিলাম সেখানেই রয়েছে বুমেরাং, আর তীর থেকে একশো গজের মধ্যে নোঙর ফেলেছে জিনবালা ক্রাশবোট। দখল করে নিয়েছে ওরা আমাদের হোয়েলবোটটা, সৈকতে লোকজন নামাবার কাজে ব্যবহার করছে সেটাকে।

লোকগুলো ইউনিফর্ম পরা, সশস্ত্র। সৈকতে নেমেই ছড়িয়ে পড়ল সবাই, নারকেল বনের ভেতর ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল। হোয়েলবোট দ্রুত ফিরে যাচ্ছে আবার বুমেরাঙের দিকে।

বিনকিউলার চোখে তুলে বুমেরাঙের দিকে তাকাতেই ঘটনার পরিবর্তন লক্ষ করলাম। সাদা গলা-খোলা একটা শার্ট আর বু স্ন্যাকস পরে রয়েছে সিডনি শেরিডান, মই বেয়ে হোয়েলবোটে নামছে সে, অনুসরণ করছে লোরনা পেজকে। লোরনার চোখে গাঢ় রঙের সান গ্লাস, সোনালি চুলের ওপর হলুদ স্কার্ফ জড়িয়েছে, পরনে এমারেল্ড গ্রীন স্ন্যাক স্যুট। ওদেরকে চিনতে পারা মাত্র আমার তলপেটের ভেতর কেমন যেন কিলবিল করে উঠল।

এরপর যা ঘটছে, দেখে হকচকিয়ে গেলাম আমি। লণ্ডনের কার্জন স্ট্রীটে দাঁড়িয়ে যে লাগেজগুলো রোলস রয়েসে তুলতে দেখেছিলাম, সেগুলো শেরিডানের দুজন পাণ্ডা ডেকে নিয়ে এসে জড়ো করছে। তারপর এক এক করে সব লাগেজ নামানো হল হোয়েলবোটে।

ইউনিফর্ম পরা একজন নাবিক বুমেরাঙের ডেকে দাঁড়িয়ে স্যালুটের ভঙ্গিতে একটা হাত তুলল চোখের পাশে, উত্তরে বাতাসে হাত ঝাপটা মেরে বিদায় দিল তাকে শেরিডান।

বুমেরাঙের কাছ থেকে রওনা দিয়ে ক্রাশবোটের দিকে এগোচ্ছে হোয়েলবোট। এদিকে শেরিডান, তার রক্ষিতা, বডিগার্ড আর মালপত্তর যখন ক্রাশবোটের ডেকে উঠছে ওদিকে তখন নোঙর তুলে নিয়ে বে-এর মুখের দিকে ঘুরে গিয়ে দৃঢ় ভঙ্গিতে চ্যানেলের গভীর পানির দিকে এগোতে শুরু করেছে বুমেরাং।

চলে যাচ্ছে বুমেরাং, বিড়বিড় করে বলল রডরিক। কেন?

চলেই যাচ্ছে বুমেরাং, ঠিক ধরেছ তুমি। কেন? ওটাকে আর। শেরিডানের দরকার নেই, তাই। নতুন ইয়ার জুটেছে ওর, তার বোটে থেকেই কাজ সারবে ও। বুমেরাং পুষতে রোজ হাজার পাউণ্ড খরচ।

আবার আমি বিনকিউলার ঘোরালাম ক্রাশবোটের দিকে। সিডনি আর তার প্রেরণার উৎস কেবিনে ঢুকছে।

সম্ভবত আরও একটা কারণ আছে বুমেরাংকে বিদায় করে দেবার।

আরও একটা কারণ, মাসুদ?

ওদের কাজগুলো যত কম লোকের সামনে সম্ভব সারতে চায় ওরা।

ঠিক, বুঝতে পারছি কি বলতে চাইছ, মাথা ঝাঁকাল রডরিক।

বুঝলে, রডরিক, আমাদের সঙ্গে এমন আচরণ করতে চাইছে ওরা, তুলনা করলে যেন মনে হয় ল্যাম্পনিকে দয়া করেছে।

বোট থেকে নামিয়ে আনতে হবে মিস রাফেলাকে, মাসুদ, ল্যাম্পনির মৃত্যুর বেমক্কা ধাক্কা সামলে উঠছে রডরিক, কাজের দিকে খেয়াল ফিরে আসছে। কিছু একটা করতে হবে আমাদেরকে, মাসুদ।

ইচ্ছাটা ভাল, রডরিক, মানি আমি। কিন্তু নিজেরা খুন হয়ে গিয়ে রাফেলার খুব একটা কাজে লাগতে পারব না আমরা, পারব কি? আমার বিশ্বাস, গুপ্তধন ওরা হাতে না পাওয়া পর্যন্ত রাফেলা নিরাপদেই থাকবে।

ওর প্রকাণ্ড মুখটা উদ্বিগ্ন একটা বুলডগের মত ভাঁজ খেয়ে গেল।

আমরা কি করতে যাচ্ছি, মাসুদ?

দৌড়ানো ছাড়া আপাতত করার কিছুই নেই আমাদের।

ঠিক কি বলছ?

কান পাতো, শোনো… বললাম ওকে।

আবার দূর থেকে ভেসে এল হুইসেলের আওয়াজ, তার সঙ্গে বাতাসে ভর দিয়ে ভেসে এল অস্পষ্ট কিছু কণ্ঠস্বর।

আমাদের পেছনে ডালকুত্তা লেলিয়ে দিয়েছে ওরা, মৃদু কণ্ঠে বললাম আমি। দ্বীপটা তন্নতন্ন করে খুঁজতে শুরু করেছে দলটা।

চল নিচে নেমে ঝাঁপিয়ে পড়ি, চাপাস্বরে হুঙ্কার ছাড়ল রডরিক, এফ. এনটা কক্ করল দ্রুত। ওদেরকে দেবার জন্যে আমার কাছে একটা খবর আছে ল্যাম্পনির তরফ থেকে।

বোকার মত কথা বোলো না রডরিক, সাবধানে, ভয়ে ভয়ে বললাম ওকে আমি। জানি, একবার বেঁকে বসলে ওকে সামালানো আমার কাজ নয়। যা বলছি শোনো। সংখ্যায় ওরা কত, জানতে চাই আমি। তারপর, সুযোগ পেলে, ওদের একজনের ঘাড় মটকে কেড়ে নিতে চেষ্টা করব আমরা তার অস্ত্রটা। সুযোগের সন্ধানে থাকো, রডরিক, কিন্তু ঝাঁপিয়ে পরার ইচ্ছাটাকে চেপে রাখো আপাতত। খুব সাবধানে পা ফেলবে তুমি, বুঝতে পেরেছ? লক্ষ্যভেদ করার ব্যাপারে ওর হাস্যকর ব্যর্থতার কথা ওকে আর স্মরণ করিয়ে দিলাম না।

ঠিক আছে, মাসুদ, আমাকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়ে বলল রডরিক।

পাহাড় সারির এদিকে থাকছ তুমি। টপকে ওপারে গিয়ে আমিও খুঁজব সুযোগ। সম্মতি দিয়ে মাথা কাত করল রডরিক। ক্রাশবোটের কামান যেখানে শেল ছুঁড়েছিল সেইখানে দেখা করব। আমরা দুঘন্টা পর।

<

Super User