১৬.
মলে এসে যখন পৌঁছল সে, সারা গা বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। দাঁড়াতে পারছে না। পরিশ্রমে থরথর করে কাঁপছে শরীর। খাবার দরকার? না, খিদে তো বোধ করছে না। বুঝল, কি জিনিস দরকার তার।
ব্যাটারি! রিচার্জ করতে হবে দেহটাকে। ব্যাটারিশূন্য হয়ে গেছে একেবারে।
পথে একটা বুঁদ থেকে রবিনদের মলে আসতে ফোন করে দিয়েছে। এখানে লোকের ভিড়ে ডেরিয়াল বা তার দলের লোকেরা এসে আঘাত হানতে সাহস করবে না। নিরাপদে কথা বলা যাবে।
টলতে টলতে মলে ঢোকার গেটের দিকে এগোল রিটা। দিগন্তরেখার দিকে ঝুঁকে পড়েছে সূর্য। পার্কিং লটে বিরাট লম্বা ছায়া পড়েছে রিটার।
বিকেল শেষ হয়ে আসছে। কতক্ষণ ধরে দৌড়েছে সে? অনন্তকাল!
একটা খেলনা ঘোড়ার ওপর বসে কাঁদছে তিন বছরের একটা বাচ্চা। সারা মুখ আইসক্রীমে মাখামাখি। আরও আইসক্রীমের জন্যে কাঁদছে বোধহয়। ওকে ঘোড়ায় বসিয়ে নিশ্চয় কোন কিছু কিনতে গেছে মা। রিটার দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেল বাচ্চাটা।
কারণটা বুঝতে সময় লাগল না রিটার। খাড়া খাড়া হয়ে গেছে চুল। কাপড় ঘেঁড়া। কাদায় মাখামাখি সারা গা। হরর ছবির ভূত। নিশ্চয় বাচ্চাটা তাকে ভূতই মনে করেছে।
কেয়ার করল না রিটা। মলের দিকে এগোল। কিন্তু পা তুলতে পারছে না আর। খেলনা ঘোড়ার কয়েন বক্সটায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল।
মুহূর্তে শক্তি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল শরীরে। ছলকে উঠল রক্তস্রোত। চুলগুলো স্বাভাবিক হয়ে এল।
কয়েকবার জোরে জোরে ঝাঁকি দিয়ে আচমকা থেমে গেল ঘোড়াটা। ডেড। মেশিনের ব্যাটারি আবার রিচার্জ না করলে আর চলবে না।
ঘোড়া থামতেই আবার চিৎকার করে কেঁদে উঠল বাচ্চাটা।
হাঁটতে শুরু করল রিটা। মলে ঢুকল।
দেখল, ওর আগেই এসে বসে আছে রবিন। ভিডিও গেমের দোকানের সামনে অস্থির ভাবে পায়চারি করছে। রিটার দিকে তাকিয়ে বড় বড় হয়ে গেল চোখ। হাঁ করে তাকিয়ে রইল দীর্ঘ একটা মুহূর্ত। তারপর এগিয়ে এল।
জিনা আর মুসা, কোথায়? জানতে চাইল রিটা।
দোকানের ভেতর।
গেম খেলছে?
না। সবাই একসঙ্গে থাকিনি, নিরাপত্তার জন্যে। কে কোন্খান থেকে নজর রেখেছে বলা মুশকিল। বুঝতে পারছি শত্রুর চোখ রয়েছে আমাদের ওপর। তাই ছড়িয়ে-ছিটয়ে রয়েছি। আমি তোমার অপেক্ষাই করছিলাম। রিটার ওপর নজর বোলাল রবিন। কিন্তু তোমার অবস্থা তো শোচনীয়। কি হয়েছিল?
আগে বাথরূম থেকে আসি। লোকে কিভাবে তাকাচ্ছে দেখছ না? কাদামাটিগুলো ধুয়ে আসি।
দাঁড়াও, আমরাও আসি তোমার সঙ্গে। জিনা আর মুসাকে ডাকতে ভেতরে ঢুকে গেল রবিন।
ওরা তিনজন বেরিয়ে আসার পর পরই একটা অদ্ভুত ঘটনা। ঘটল। মিটমিট করে উঠল মলের সমস্ত আলো।
খাইছে! অবাক হয়ে রিটার দিকে তাকাল মুসা। তুমি করছ?
নীরবে মাথা নাড়ল রিটা। সে-ও অবাক।
একসঙ্গে নিভে গেল সমস্ত আলো। যে ভাবে নিভল, তাতে মনে হয় মেইন লাইন জ্বলে গেছে। কোথায় খারাপ হয়েছে, সেটা বের করে, সারিয়ে-সুরিয়ে আবার আলো জ্বালতে প্রচুর সময় লাগবে। বাইরে সূর্যও ডুবতে বসেছে। গোলাপী-কমলা আলোর খেলা ম্লান করে দিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসছে নীলচে-ধূসর গোধূলি।
বাতি নিভে যাওয়ায় মল জুড়ে শুরু হলো চিৎকার চেঁচামেচি। লুটপাটের ভয়ে তাড়াতাড়ি শাটার নামিয়ে দিতে শুরু করল দোকানদাররা। করিডরে ছোটাছুটি করছে লোকে। হলে উদ্বিগ্ন। ক্রেতার ভিড়। কি হয়েছে জানতে চাইছে সবাই।
কালো পোশাক পরা চারজন গার্ডের আবির্ভাব ঘটল এ সময়। কালো সানগ্লাস, কালো শার্ট, কালো প্যান্ট, কালো বেজবল ক্যাপ নিয়ে অন্ধকারে চমৎকার ভাবে মিশে যাওয়ার সুযোগ হলো।
ওদের। তবে হাতে টর্চ আছে চারজনেরই।
এদিক দিয়ে আসুন, প্লীজ, টর্চের আলো নেড়ে উত্তেজিত ক্রেতাদের পথ দেখাল একজন। ঘাবড়াবেন না। আসুন।
দ্রুত সাড়া দিল লোকে। পথ দেখিয়ে সবাইকে গেটের দিকে নিয়ে চলল গার্ডেরা।
সারির পেছনে রইল চার গোয়েন্দা।
গার্ডগুলোকে সন্দেহ হচ্ছে আমার, নিচুস্বরে রবিন বলল। দেখছ, কেমন টর্চের আলো ফেলছে সবার মুখে? কাউকে খুঁজছে ওরা।
আমাদের! রিটার কণ্ঠে শঙ্কা।
তাই তো! জিনা বলল। দেখো, চোখ থেকে সানগ্লাস খুলছে না ওরা। তারমানে চোখ দেখলেই চমকে যাবে লোকে। বনের মধ্যে সে-রাতে নকল কিশোরের চোখ কি রকম ছিল মনে আছে?
ঠিক, মুসাও একমত। অন্ধকারে সানগ্লাস পরে আছে কেন নাহলে?
তারমানে ওদের চোখে পড়া চলবে না, উদ্বিগ্ন, শোনাল রবিনের কণ্ঠ। পালাতে হবে। সরে যেতে হবে কোনদিকে।
কিন্তু ভেতরে তো অন্ধকার, রিটা বলল। দেখতে পাব না কিছু। তা ছাড়া আরও গার্ড থাকতে পারে। ব্লাউজ চুরি করেছি ভেবে আমাকে সেদিন যারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তাদের কেউ থাকলে মহা মুশকিলে ফেলে দেবে।
তাহলে! চিন্তায় পড়ে গেল রবিন। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছে সামনের লোকগুলো। ছোট হয়ে। আসছে সারি।
হঠাৎ একজন গার্ড আলো ফেলল ওদের দিকে। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত স্থির হয়ে রইল আলোটা। সঙ্গীদের কিছু বলল বোধহয় লোকটা। একসঙ্গে চারটে আলো এসে পড়ল ওদের মুখে।
আর কোন উপায় নেই। চিৎকার করে উঠল ররিন, পালাও!
.
১৭.
গেট ছেড়ে দৌড় দিল চার গার্ড। তাড়া করল ওদের।
ছুটতে ছুটতে রিটা বলল, ছোটাছুটি করে লাভ হবে না। পালাতে পারব না। ওদের ক্ষমতা অসীম। আমরা আছি, জেনে গেছে। না ধরে আর ছাড়বে না।
মলের মেইন গেট লাগানোর শব্দ শোনা গেল।
ওই যে, মুসা বলল, গেট লাগিয়ে দিচ্ছে। খাঁচার মধ্যে আটকে ফেলে ধরবে আমাদের।
ছুটতে থাকো, রবিন বলল। থেমো না।
কিন্তু এ ভাবে দৌড়ে কিছু হবে না তো, জিনা বলল। একটা বুদ্ধি বের করা দরকার আমাদের।
সামনে আরেকটা বড় দরজা। ওটার অন্যপাশে আসার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়াল রিটা। খেলনা ঘোড়াটার ব্যাটারি থেকে যেটুকু শক্তি সঞ্চয় করেছিল, সেটা ব্যবহার করে লাগিয়ে দিল। ইলেকট্রনিক দরজাটা। গার্ড আর ওদের মাঝে ভারী একটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হলো।
বন্ধুদের দিকে ফিরে তাকাল রিটা। এটা দিয়েও ঠেকানো যাবে না ওদের। দুমিনিট। বড় জোর তিন।
মাঝেসাঝেই মলে কেনাকাটা করতে আসে জিনা। তার দিকে–তাকাল রবিন। জিনা, পেছন দিকে বেরোনোর দরজা-টরজা আছে, বলতে পারবে?
এ তলায়? উঁহু, জবাব দিল জিনা। এসকেলেটরটা রয়েছে। মেইন গেটের দিকে।
না, ওদিকে যাওয়া যাবে না। রিকি হয়ে যাবে।
রিটাও বহুবার এসেছে এই মলে। জিনার চেয়ে কম চেনে না। বরং বেশিই চেনে। কোথায় কোথায়, কি আছে মনে করার চেষ্টা করল। পেছন দিয়ে বেরোনোর পথ নেই। তবে একটা বিকল্প আছে! প্রায় চিৎকার করে উঠল সে, শূ এলিভেটর।
কি? বুঝতে পারল না মুসা।
অনেকটা ডাম্বওয়েইটারের মত কাজ করে ওটা, জবাব দিল রিটা। জুতো বয়ে আনে।
শুধু কিছু জুতো বওয়ানোর জন্যে একটা এলিভেটর বানিয়ে ফেলেছে ওরা? অবাক না হয়ে পারল না রবিন।
হ্যাঁ, বানিয়েছে। তবে কিছু জুতো নয়, অনেক, রিটা বলল। যে জুতোটা তোমার পছন্দ, জানাবে সেলসম্যানকে, মিনিটের মধ্যে ওই মিনিএলিভেটরে করে এসে হাজির হবে তোমার
ভাল বুদ্ধি করেছে, প্রশংসা করল রবিন।
জুতো কিনতে আসিনি আমরা, মনে করিয়ে দিল মুসা। কাজেই এলিভেটরের প্রশংসা না করে ওটা দিয়ে কাজটা কি হবে সেটা জানতে পারলে ভাল হয়।
রিটার কথা বুঝে গেছে রবিন। তুড়ি বাজিয়ে বলল, ঠিক! রিটা, ঠিক! তোমার বুদ্ধি আছে!
নাহ্, নেতৃত্ব পেলেই এরা সবাই কিশোর পাশা হয়ে যায়! তিক্তকণ্ঠে বলল মুসা। দুর্বোধ্য কথাবার্তা! মূল্যবান সময় নষ্ট না করে বলেই ফেলো না ছাই কি বলতে চাও।
বুঝতে পারছ না? জুতো বয়ে আনে, তারমানে ওটার সার্বক্ষণিক অবস্থান হলো স্টোরের মধ্যে। যে তলায় স্টোর আছে সেই তলায় রাখা হয় ওটা। রিটাকে জিজ্ঞেস করল রবিন, রিটা, আমাদের ভার বইতে পারবে ওটা?
জিনাও দেখেছে এলিভেটরটা। জুতো বয়ে আনার জিনিস, মানুষের ভার বইতে পারবে না। তবে ওটা খুলে নিয়ে শ্যাফটটা ব্যবহার করতে পারব আমরা।
জলদি এসো! ছোটার গতি বাড়িয়ে দিল রবিন।
এলিভেটরটা খুঁজে পাওয়া কঠিন হলো না। ছোট বাক্সমত কারটা খোলার চেষ্টা করে দেখল সে। খুলল না। অত সহজ হবে না খোলা।
সবাই মিলে চেষ্টা করতে লাগল। খুলল অবশেষে।
খুলে ওটা নামিয়ে রাখল ওরা, এই সময় বিকট শব্দ হলো। পেছনে। কোন কিছু ভেঙে পড়েছে। ফুটখানেক পুরু, পনেরো ফুট উঁচু ভারী দরজাটাই হবে।
গেল লাখ লাখ ডলারের দরজাটা, মুসা বলল।
ভাঙল কি করে! জিনা অবাক।
ওরা মানুষ নয়, আগেই তো বলেছি, রিটা বলল। ওদের ক্ষমতা অসীম।
সামনের এলিভেটরের শ্যাফটটার দিকে তাকাল সবাই। চৌকোনা লম্বা একটা গর্ত। চওড়া খুব বেশি না। তবে একবারে একজন করে ঢুকতে পারবে।
গার্ডদের ছুটন্ত পায়ের শব্দ কানে এল।
আগে আমি যাচ্ছি, মুসা বলল। দোখ, নিরাপদ কিনা।
কে আগে যাবে সেটা নিয়ে তর্ক করার সময় নেই। নিচে নেমে আমাদের জন্যে অপেক্ষা কোরো না, রবিন বলল। দৌড়াতে শুরু করবে। ভাগাভাগি হয়ে একেকজন একেকদিকে চলে যাওয়াটাই ভাল। সবাইকে একসঙ্গে ধরা পড়তে হবে না।
আইডিয়াটা খারাপ লাগল না রিটার। কিন্তু অন্ধকারে একা হয়ে যাওয়ার কথাটা ভাবতেও ভাল লাগল না।
*
শ্যাফট বেয়ে নেমে চলেছে রিটা। দুই হাতের তালু দুই দেয়ালে এমন শক্ত করে চেপে রেখেছে যাতে পড়ে না যায়। কোন কারণে হাতের চাপ ঢিল হলেই বিশ ফুট নিচের কংক্রীটের মেঝেতে গিয়ে পড়তে হবে।
স্টোররুমে নেমে এল সে। সবাই ওর আগে নেমে গেছে। ওপরে প্রচণ্ড শব্দ। ভাঙচুর করছে গার্ডেরা। শ্যাফটটা ওদের নজরে পড়তে দেরি হবে না। পড়লেই বুঝে যাবে সব।
রবিন! অন্ধকারে, ফিসফিস করে ডাকল রিটা। মুসা! জিনা!
জবাব নেই। পরিকল্পনা অনুযায়ী যার যার পথে চলে গেছে ওরা নিশ্চয়।
ভারী দম নিল রিটা। কম্পিত নিঃশ্বাস।
হাতড়াতে হাতড়াতে এগোতে শুরু করল সে। হাতে লাগছে জুতোর সারি। অবশেষে একটা ধাতব স্পর্শ পেল। দরজা। আস্তে করে ঠেলে খুলে বেরিয়ে এল।
নিচতলাটা ওপরের চেয়ে অনেক বেশি অন্ধকার মনে হয়। তবে এতবার এসেছে এ জায়গায়, মুখস্থ হয়ে গেছে, অনুমানের ওপর নির্ভর করে এগোতে পারল তাই।
কিন্তু যাবে কোথায়?
যেখানেই যাক, সে জানে, লোকগুলো তাকে খুঁজে বের করে ফেলবে। ভেতরে খুঁজছে চারজন। মেইন গেটের কাছেও নিশ্চয় আরও অনেকে অপেক্ষা করছে।
বনবন করে ভাবনার চাকাগুলো ঘুরতে আরম্ভ করল তার।
কি করা যায়? টাইম-জাম্প করে লাভ হবে? তাহলে আর ওরা ধরতে পারবে না তাকে। তেরো বছর যদি পিছিয়ে চলে যায়, কি করে খুঁজে পাবে! কিন্তু সময়-ভ্রমণে অভ্যস্ত নয় এখনও সে। কিভাবে নিজে নিজে যাতায়াত করতে হয়, জানে না।
ব্লাউজটা দরকার। যেটাতে, প্রোগ্রামিং করা আছে ১৯৮৭ সাল। কিন্তু নেই ওটা সঙ্গে। ডেরিয়ালের সঙ্গে বেরোনোর সময় গায়ে দেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। আচ্ছা, মনোনিবেশ করার জন্যে একমাত্র ব্লাউজটাই কি দরকার? বিকল্প কিছুতে কাজ হবে না? চকিতে মাথায় এসে গেল ছবিটার কথা। চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।
করিডরের শেষ মাথায় অন্ধকারের মধ্যে আবছা ধূসর একটা চৌকোনা বস্তুর মত চোখে পড়ল মেইন গেটটা। জুতো খুলে ফেলে নিঃশব্দে পা টিপে টিপে এগোল সে। কাছে এসে দেখল, তার অনুমান ঠিক। গেটের কাছে পাহারা দিচ্ছে একজন। গার্ড।
লোকটা তাকে দেখতে পাওয়ার আগেই ইনফরমেশন কিসকের কাছে সরে গেল রিটা। হাত বাড়িয়ে খুলে আনল দেয়ালে টানানো নিজের ছবিটা। গার্ড-ইন-চার্জকে তখন পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে ইচ্ছে হলো তার, ছবিটা ওখানে টানানোর জন্যে।
এত অন্ধকার এখানে, ছবি দেখাটা খুব কঠিন। কাউন্টারের কাছ থেকে সরে এল, যেখানে কাঁচের দরজার ভেতর দিয়ে অতি সামান্য আবছা আলো চুঁইয়ে প্রবেশ করছে। দেখতে পেল ছবিটা। ব্লাউজের ওপর কেন্দ্রীভূত করল দৃষ্টি। কল্পনায় দেখতে শুরু করল। ব্লাউজ পরা অবস্থায় তার নিজের ছবি। অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো। দাঁড়িয়ে যাচ্ছে ঘাড়ের রোম।
তারমানে কাজ হচ্ছে!
মাথার ওপরে গুঞ্জন শুরু হলো।
মুখ তুলে তাকে দেখে ফেলল গার্ড।
ওয়াকি-টকিতে মুখ লাগিয়ে চিৎকার করে উঠল সে, টার্গেট এখানে!
দৌড়াতে শুরু করল লোকটা। বিশ গজ দূরে রয়েছে। দ্রুত চলে আসছে কাছে।
সময়ের দরজা সময়মত খুলবে কিনা বুঝতে পারছে না রিটা। ছবিটা শক্ত করে চেপে ধরল। গুঞ্জন বাড়ছে।
কঠিন কয়েকটা আঙুল চেপে ধরল তার কাধ। কথা বলে উঠল যান্ত্রিক একটা কণ্ঠ, এবার যাবে কোথায়!
ফিরে তাকাল রিটা। কালো সানগ্লাস খুলে ফেলেছে গার্ড। টর্চের আলোর আভায় ভয়ঙ্কর দুটো চোখ দেখতে পেল রিটা।
ছাড়ুন আমাকে, নিজের শান্ত, কণ্ঠ শুনে নিজেই অবাক হয়ে গেল সে। কিছু প্রশ্ন আছে আপনার কাছে।
কি প্রশ্নঃ ছাড়ল না গার্ড।
সময় নিতে চাইছে রিটা। গুঞ্জনটা যখন শুরু হয়েছে, জাম্প করতে পারবে বুঝতে পারছে।
দপ করে চোখের সামনে থেকে নিভে গেল টর্চের আলো।
পরক্ষণে উজ্জ্বল দিবালোকে বেরিয়ে এল সে।
চারপাশে তাকাতে লাগল রিটা। দল বেধে কেনাকাটা করতে চলেছে ক্রেতারা। কি ঘটেছে; জানা আছে তার। তারপরেও অবাক না হয়ে পারল না। আবার অতীতে চলে এসেছে। আপাতত ভিনগ্রহবাসী গার্ডদের হাত থেকে বাঁচলেও অল্পক্ষণের মধ্যেই আবার তাকে ফিরে যেতে হবে বর্তমানে। বাইরে যখন বেরোতেই পেরেছে, বাঁচার একটা উপায় করে তবেই আবার ঢুকবে ভবিষ্যতের অন্ধকার মলে।
একটা ইলেকট্রনিক জিনিসপত্রের দোকানে ঢুকল সে। মুখ তুলে তাকাল সেলসক্লার্ক। ডিসেম্বরের শীতে ওর গায়ে গরমের পোশাক দেখে অবাক হয়ে গেল। মিষ্টি করে হেসে তার অবাক। ভাবটা কাটিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল রিটা। বলল, হালো। আমি কিছু একটা কিনতে চাইছি, বাবার জন্মদিনে উপহার দেয়ার জন্যে।
*
কয়েক সেকেন্ড পরেই দোকান থেকে বেরিয়ে এল রিটা, পেছনে হাঁ হয়ে থাকা সেলস-ক্লার্ককে রেখে। হতবাক হয়ে দোকানের জিনিসপত্রগুলো দেখছে সে। বুঝতেই পারছে না, হঠাৎ কি এমন। ঘটে গেল যে বন্ধ হয়ে গেল চালু করে রাখা রেডিও-টেলিভিশন অডিও সেটগুলো!
করিডর ধরে দ্রুত এগুলো রিটা। শক্তিতে টইটম্বুর হয়ে আছে দেহ। প্রজাপতির মত পাখা মেলে উড়ে চলেছে যেন।
খেলনার দোকানের পাশ দিয়ে যেতে যেতে আরেকটা বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। থমকে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল র্যাকে রাখা আলট্রা সোকার ওয়াটার গানটার দিকে। খানিক দূরে একটা বাচ্চা ছেলে আরেকটা খেলনা হাতে নিয়ে দেখছে-একটা বড়, চকচকে সবুজ ডাবল-ব্যারেল খেলনা রাইফেল।
এগিয়ে গেল সে। হাত বাড়াল ছেলেটার দিকে, দেবে একটু? দেখব।
এক মুহূর্ত রিটার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হাত সরিয়ে নিল ছেলেটা।
দাও, খোকা, জোর দিয়ে বলল রিটা। তোমার চেয়ে বেশি প্রয়োজন ওটা আমার।
কাঁধে টোকা পড়তে ফিরে তাকাল রিটা। দোকানের ম্যানেজার। বেজির মত মুখ। সরু কুৎসিত গোঁফ। মুখটাকে গোমড়া করে রেখে জিজ্ঞেস করল, জন্মদিনে দেবে?
না।
সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। ছাতের আলোগুলোর দিকে তাকাল সে। এখনও উজ্জ্বল। মিটমিট শুরু হওয়ার আগেই যা করার করে ফেলতে হবে।
হু। …যাকগে, কি জন্যে কিনবে সেটা তোমার ব্যাপার।…পছন্দ হয়েছে? জিজ্ঞেস করল লোকটা।
মাথা ঝাঁকাল রিটা। র্যাক থেকে তুলে নিল আলট্রা সোকারটা। একটা শপিং ব্যাগ চেয়ে নিয়ে আরও কতগুলো খেলনা র্যাক থেকে নামিয়ে দ্রুত ভরে ফেলল।
এগুলোর দাম… বলতে গেল ম্যানেজার।
দরজার দিকে রওনা হয়ে গেছে রিটা। ভেতরে থাকলে আটকা। পড়তে হবে।
চিৎকার করে উঠল ম্যানেজার, আরে আরে, কোথায় যাচ্ছ…
কথা শেষ হলো না। মিটমিট করতে লাগল বাতিগুলো। সেই সঙ্গে গুঞ্জন।
দপ করে নিভে গেল বাতি।
.
১৮.
ভিন্ন আরেক নাটক চলছে তখন কাচু-পিকচুতে। ভীষণ ক্লান্ত হয়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল কিশোর। শরীরের প্রতিটি পেশিতে ব্যথা। কাপড় খুলতেও ইচ্ছে করল না তার।
এত ক্লান্তির পরেও ঘুম এল না। যতবার চোখ বোজে, গলাকাটা গরুটার চেহারা ফুটে ওঠে তার কল্পনায়। ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল গরুর চেহারা, তার জায়গা দখল করল সিসির মুখ।
সিসিকে কেন সন্দেহ করছে ওরা? জন্তু-জানোয়ারের সঙ্গে ভাল আচরণ করে সে, ওগুলোও তাকে পছন্দ করে, তার কথায় সাড়া দেয়। এর মধ্যে অশুভ ক্ষমতাটা কোথায় দেখতে পেল লোকে?
হঠাৎ ঝটকা দিয়ে উঠে বসল বিছানায়। ঘোড়ার খুরের শব্দ।
গায়ের ওপর থেকে চাদরটা টান মেরে সরিয়ে ফেলে বিছানা থেকে নেমে পড়ল। বুকের মধ্যে কাপুনিটা বেড়ে গেছে। জানালার কাছে এসে বাইরে উঁকি দিল।
চোখে পড়ল দলটাকে। দম আটকে আসতে চাইল।
সামনের আঙিনায় ঘুরে বেড়াচ্ছে ওরা। কতজন? পাঁচ…দশবারো? নাকি আরও বেশি?
রাতের অন্ধকারে ছায়ার মত নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে।
কি চায়? শেষ পর্যন্ত হুমকিটা কার্যকর করতেই কি চলে এল?
সিসিকে খুন করতে?
পেছনের কাঠের মেঝেতে শব্দ হতে পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল সে।
ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে হেনরি আর সিসি। তাকিয়ে আছে ওর দিকে। আতঙ্কিত।
ওরা এসে গেছে, তাই না? কাঁপা ফিসফিসে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল সিসি।
জোরে একবার মাথা ঝাঁকি দিল কিশোর, হ্যাঁ।
পাশে এসে দাঁড়াল দুই ভাই-বোন। একসঙ্গে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে তাকাল সবাই। ঘোড়াগুলোর ঘোরাঘুরি বন্ধ হয়েছে। লম্বা সারি দিয়ে দাঁড় করিয়েছে তাদের সওয়ারিরা।
আজ আরও অনেকগুলো গরুকে মেরে ফেলতে হয়েছে, চিৎকার করে বলল একজন।
এর জন্যে দায়ী হচ্ছে ওই ডাইনী মেয়েটা, জন ফ্রেঞ্চ বলল। ওর স্লিঙে ঝোলানো হাতটাকে লাগছে সাদা তেকোনা নিশানের। মত। ওকে নামিয়ে দাও। বাকি দুজনকে কিছু করব না।
কিশোরের গা ঘেঁষে এল সিসি। ওর গায়ের কাপুনি টের পাচ্ছে কিশোর। কাঁধে একটা হাত রেখে সান্ত্বনা দিল। তার অন্য হাতটা আঁকড়ে ধরল আতঙ্কিত হেনরি।
আপনাদের গরুগুলো মারা যাচ্ছে, এ জন্যে সত্যি দুঃখিত আমরা, জবাব দিল কিশোর। এতে সিসির কোন হাত নেই। দয়া করে চলে যান আপনারা। আমাদের একা থাকতে দিন।
সব শয়তানির মূলে ওই ডাইনী মেয়েটা, মার্ক ফ্রেঞ্চ বলল। নেকড়ে আর সাপ নিয়ে কি করেছে, সব শুনেছি আমরা। আমাদের সবারই গরু মরছে, তোমাদের একটাও মরে না কেন? … .তুমি বাইরের লোক, কিশোর পাশা, তোমার সঙ্গে আমাদের কোন শত্রুতা নেই। মেয়েটাকে পাঠিয়ে দাও এখানে, তোমার কিছু করব না আমরা।
জলদি বের করে দাও শয়তানীটাকে! বলল আরেকজন।
জীবনেও না! চিৎকার করে উঠল কিশোর। আমার প্রাণ থাকতে নয়!
বেশ, মরো তাহলে, জন ফ্রেঞ্চ বলল। তোমাকে একটা সুযোগ দিয়েছিলাম, কিশোর পাশা, নাওনি…
একটা মশাল জ্বলে উঠল। পটাপট জ্বলে উঠল আরও কয়েকটা। মশাল হাতে ঘোড়ায় চেপে বাড়ির চারপাশে চক্কর। দিতে শুরু করল লোকগুলো।
লাগিয়ে দাও! দেখছ কি? মার্কের চিৎকার শোনা গেল। পুড়িয়ে মারো ডাইনীটাকে!
বাড়ির দিকে একজনকে মশাল ছুঁড়ে দিতে দেখল কিশোর।
ওপরের বারান্দার একপ্রান্তে এসে পড়ল মশালটা। কিশোরের জানালার সামনে নেচে উঠল আগুন।
চিৎকার করে উঠল সিসি।
জলদি! বলল কিশোর, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হবে আমাদের! জানালার কাছ থেকে ঠেলা দিয়ে সিসিকে সরিয়ে দিল সে।
হেনরিকে পিঠে তুলে নিয়ে সিসির পিছু পিছু এসে ঢুকল হলওয়েতে। ঝনঝন করে কাঁচ ভাঙছে। জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরে মশাল ছুঁড়ে মারছে লোকগুলো। গুলির শব্দ হলো।
সিঁড়ি দিয়ে ধোঁয়া উঠে আসছে কুণ্ডলী পাকিয়ে। থমকে দাঁড়াল। সিসি। পেছন থেকে তাকে ঠেলা দিল কিশোর। থামলে কেন? আর কোন পথ নেই!
এলোমেলো পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল সিসি। হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল, ধরে ফেলল তাকে কিশোর। কিশোরের গলা পেঁচিয়ে ধরে পিঠের ওপর ঝুলছে হেনরি।
বাতাসের জন্যে আকুলি-বিকুলি করছে কিশোরের ফুসফুস। ধোয়া ঢুকে গেছে। চোখ জ্বালা করছে। কালো ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে কাশতে কাশতে নেমে চলল সিঁড়ি বেয়ে। এলোমেলো পা ফেলছে সে-ও। হেনরির হাতটা ঢিল করার চেষ্টা করল। বরং শক্ত হলো সেটা আরও। ধোয়া থেকে বাঁচার জন্যে মুখ চেপে ধরল। কিশোরের কাঁধে। সমানে কাশছে।
মরতেই হবে বোধহয় আজ, ভাবছে কিশোর। কিন্তু এত সহজে হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র সে নয়।
পৌঁছে গেল নিচতলায়। ঘুরছে, পাক খাচ্ছে আগুনের শিখা; ধারাল নখর বের করে থাবা মারছে যেন কাঠের দেয়ালের গায়ে। মাথার মধ্যে দপদপ করছে কিশোরের। ভয়াবহ উত্তাপ ওকে ঘিরে চক্কর দিচ্ছে।
বাঁচতে হলে এখনই বেরিয়ে যেতে হবে।
ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে গলা বাড়িয়ে তাকাতে লাগল সে। কোনদিকে যাবে? চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছে আগুন।
সামনের দিকে যাও! চিৎকার করে উঠল আচমকা। সামনের ঘরটা দিয়ে বেরোতে হবে!
পায়ের কাছে লকলক করছে আগুনের শিখা। পরোয়া করল না। সোজা দৌড় দিল হলওয়ে ধরে সামনের বারান্দার দিকে। দেয়াল থেকে লাফ দিয়ে দিয়ে সামনে এসে পড়ছে আগুন। ওগুলোর চারপাশে নাচানাচি করে বাঁচার চেষ্টা করতে লাগল। কিশোর। মুখের চামড়া ঝলসে যাচ্ছে। ঝাঝাল ধোয়া চোখ পোড়াচ্ছে।
ছেলে-মেয়ে দুটোকে বের করে নিয়ে যেতেই হবে!-বার বার নিজেকে বলছে সে। ওদের বাঁচাতেই হবে।
দাঁড়িয়ে গেছে সিসি। তাকিয়ে আছে আগুনের দিকে। দিনের আলোর মত আলোকিত হয়ে গেছে ঘর। গাল বেয়ে পানি নামছে। কেঁদে ফেলল, বেরোনোর জায়গা নেই, কিশোরভাই!
বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটাচ্ছে কিশোরের হৃৎপিণ্ড পাগলের মত চারপাশে তাকাচ্ছে সে। পিছিয়ে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে আগুনের চাদর। সামনের দরজায় লাফালাফি করছে ছোট ছোট শিখা। মড়মড় শব্দ হলো। হাতের কড়িকাঠ ভাঙতে শুরু করেছে।
বাড়িটাকে আগুনের পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলতে আর বেশি দেরি নেই। যে কোন মুহূর্তে তাসের ঘরের মত ধসে পড়বে। চিড়ে-চ্যাপ্টী করবে ওদের। তারপর পুড়িয়ে ছাই করবে।
হেনরিকে পিঠ থেকে বুকের ওপর নিয়ে এল কিশোর। সিসিকে বলল, শক্ত করে আমার শার্ট চেপে ধরো। ওই দরজাটা। দিয়ে বেরোব।
দুই হাতে কিশোরের শার্ট খামচে ধরল সিসি। ফোপানি থামাতে পারছে না কোনমতে। হেনরিকে চেপে ধরে দরজার দিকে দৌড় দিল কিশোর। কাঁধের একপাশ দিয়ে প্রচণ্ড ধাক্কা মারল পুড়তে থাকা কাঠে।
ছুটে গেল কব্জা।
বাইরে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে সামলে নিল। হেনরিকে ছাড়েনি। ওকে চত্বরে নামিয়ে দিয়ে ফিরে তাকাল সিসির অবস্থা। দেখার জন্যে। শেষ মুহূর্তে শার্ট থেকে সিসির হাত ছুটে গেছে। বাইরে বেরিয়ে এসেছে সে।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে গিয়েও পারল না কিশোর। বিপদ এখনও কাটেনি।
ঘোড়ার পিঠে চেপে ওদের তিনজনকে ঘিরে চক্কর দিতে শুরু। করল লোকগুলো।
ভেতরে থাকলেই ভাল করতে! ভয়ঙ্কর গলায় বলল মার্ক, তাড়াতাড়ি মরে যেতে। এখন মরবে ধীরে।
কাপুরুষের দল! চিৎকার করে উঠল কিশোর। আমরা কোন অন্যায় করিনি। সিসি নির্দোষ!
ঘিরে ফেলা চক্রটা ছোট করে আনতে লাগল লোকগুলো। ঘোড়ার গরম নিঃশ্বাস পড়তে লাগল কিশোরের মুখে। কাঁধে কাঁধ, গলায় গলা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়েছে ওগুলো। ঘামের গন্ধ পাচ্ছে কিশোর। পশুগুলোর নিঃশ্বাসের দুর্গন্ধ এসে লাগছে নাকে।
পালানোর পথ নেই। ঘোড়ার পায়ের ফাঁক দিয়ে দৌড়াতে গেলে মাটিতে ফেলে খুর দিয়ে মাড়িয়ে তিলে তিলে শেষ করা হবে ওদের। : খসখসে কি যেন গলায় লাগতে ফিরে তাকাল কিশোর। চামড়ার ফালির একটা ফাস তার গলায় নামিয়ে দিচ্ছে মার্ক ফ্রেঞ্চ।
একটা জানোয়ারও আর অবশিষ্ট নেই তোমাদের, বলল সে। এবার তোমাদের পালা। সব কটাকে, ফাঁসিতে ঝোলাব। ইবলিসের ঝাড়-বংশ সব সাফ করে ফেলব।
.
১৯.
খেলনার দোকানটার দিকে ঘুরে তাকাল রিটা। শাটার নামানো। নীরব। অন্ধকার। রেগে যাওয়া ম্যানেজার নেই। বাচ্চা ছেলেটা নেই। কোন লোকই নেই।
অন্ধকার করিডরে চোখ বোলাল সে। রবিন কোথায়? মুসা? জিনা?
কয়েক মিনিট পরেই জানতে পারল, তার আশঙ্কাই ঠিক। বেরোতে পারেনি ওরা। সামনের অন্ধকারে, খাবারের দোকানটাতে হুটোপুটির শব্দ। বোধহয় লড়াই করছে।
দৌড় দিল রিটা। সামনের একটা ফোয়ারা থেকে পানি ভর্তি করে নিল সোকার গানটার ম্যাগাজিনে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, কাজ শেষ হয়ে গেলেই যাদের জিনিস আবার তাদের ফিরিয়ে দিয়ে আসবে। জিনিস দিতে না পারলে, দামটা দিয়ে আসবে।
হঠাৎ থরথর করে কাঁপতে শুরু করল পুরো মল। ভূমিকম্প শুরু হলো নাকি? না, ভূমিকম্প নয়, বড় কোন জেট প্লেন যাচ্ছে। তারপর মনে হলো, উঁহু, জেট প্লেনও নয়। অন্য কিছু।
কি শুরু হলো, এই মলে!
থামল না সে। খাবারের দোকানের কাছে এসে দেখল চেয়ার টেবিল সব উল্টে পড়ে ছত্রখান হয়ে আছে। কোনদিকে তাড়া করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে রবিনদের, বোঝা যায়।
না, বেরোতে ওরা পারেনি। শেষ মাথায় নিয়ে গিয়ে কোণঠাসা করে ফেলেছে গার্ডেরা। পেছন দিকে হাত মুচড়ে ধরে দেয়ালের গায়ে চেপে ধরেছে মুসা, রবিন আর জিনাকে। নড়তেও কষ্ট হচ্ছে, ওদের। লড়াই শেষ। সবার মুখ ওপর দিকে।
কি দেখছে ওরা?
রিটাও স্কাইলাইটের দিকে মুখ তুলে তাকাল।
হাঁ হয়ে গেল মুখ।
একটা ইউ এফ ও ফুড কোর্টের ওপর নেমে আসছে।
ভয়ানক শব্দে ভেঙে পড়ল স্কাইলাইটের কাঁচ। ধীরে ধীরে নামতে শুরু করল যানটা:। বিল্ডিঙের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। ওটার ভীষণ শক্তিশালী জেট ইঞ্জিন থেকে বেরোনো বাষ্প আর আগুনের হলকায় পুড়ে, গলে পানি হয়ে যেতে লাগল প্লাস্টিক। আগুন ধরে গেল চায়না-বান স্ট্যান্ডটায়। বৃষ্টির মত চতুর্দিকে ছিটকে পড়তে লাগল কাঁচ, ধাতু আর কাঠের টুকরো। ভয়াবহ গরম হলকা এসে লাগল রিটার মুখে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সত্যি সত্যি একটা ইউ এফ ও নেমে এসেছে মলের ভেতরে।
ছয়টা ধাতব পা বেরিয়ে এল ওটার পেটের নিচ থেকে। পোড়া. মেঝেতে ছড়িয়ে বসল। খুলে গেল হ্যাচওয়ে। তীব্র সাদা আলো ছড়িয়ে পড়ল ঘরের মধ্যে। প্রায় নিঃশব্দে নেমে এল মইয়ের মত ধাতব সিঁড়ি।
ইউ এফ ও থেকে নামল একজন ভিনগ্রহবাসী। অবিকল মানুষের মতই দেখতে। তবে খুব লম্বা। চোখ দুটো কেবল অস্বাভাবিক। লাল অঙারের মত জ্বলছে ধকধক করে। রূপালী রঙের পোশাক পরনে। হাতে ছোট একটা জিনিস। কোন ধরনের
অস্ত্র। এ কথা বলে উঠল লোকটা। ভারী কণ্ঠস্বর। একেবারে যান্ত্রিক। সিনে রি রোবটেরা ওরকম করে কথা বলে। মুসা, রবিন আর জিনা ক মহাকাশযানে তোলার হুকুম দিল।
ওদেরকে কি প্রয়োজন এই ভিনগ্রবাসীগুলোর? কি করবে নিয়ে গিয়ে?
প্রায় কোন রকম বাধাই দিতে পারল না তিন গোয়েন্দা। মহাকাশযানে তোলা হলো ওদের।
অন্ধকার ছায়ার দিকে তাকিয়ে বলল নেতা গোছের লোকটা, রিটা গোল্ডবার্গ, বেরিয়ে এসো। নইলে তোমার বন্ধুদের খুন করা হবে।
মোটা থামের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে রিটা। ওখান থেকেই জবাব দিল, কি করে বুঝব, আমি বেরোলে আমাকে সহ খুন করবেন না?
ঝটকা দিয়ে তার দিকে ঘুরে গেল নেতার মুখ।
চট করে সরে গেল রিটা। ময়লা ফেলার একটা ধাতব ড্রামের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল।
কাল আমাদের ওপর বসের নির্দেশ আছে, তোমাদের জ্যান্ত ধরে নিয়ে যেতে হবে, জবাব দিল নেতা, যদি সম্ভব হয়। বেশি জ্বালাতন করলে শেষ করে দিতে বলা হয়েছে। এখন ভেবে দেখো, কোনটা তোমার পছন্দ। লাশগুলো নিয়ে গেলেও চলবে। তিনটে তাজা লাশ পেলে কম খুশি হবেন না বস।
ঢোক গিলল রিটা। চিন্তা করল এক মুহূর্ত। তারপর দুই হাত মাথার ওপর তুলে বেরিয়ে এল। এই যে, আমি এসেছি।
বুদ্ধিমতী মেয়ে! একঘেয়ে কণ্ঠস্বর লোকটার। পুরোই রোবটের মত আচরণ। খুব চালাক। বন্ধুদের জীবন বাঁচালে।
লোকটার চোখে চোখে তাকাল রিটা। ওর চেয়ে অনেক লম্বা। পারবে ওর সঙ্গে?
পারতেই হবে!
চোখ বুজল রিটা। ভয় নেই মনে।
শক্তি কেন্দ্রীভূত করছে।
বেজে উঠল সাইরেন। পুলিশের গাড়ির। ময়লা ফেলার পিপাটার কাছ থেকে বেরিয়ে এসে ফুড কোর্টটাকে ঘিরে ফেলল ডজনখানেক গাড়ি তীব্র গতিতে ছোটাছুটি শুরু করল মেঝেতে। প্রচুর বিদ্যুৎ হজম করেছে রিটা। সেই শক্তি প্রয়োগ করে চালাচ্ছে। খেলনাগুলোকে।
পায়ের কাছে রকেট-গতিতে ছোটাছুটি করতে থাকা। খেলনাগুলো রিটার প্রতি মনোযোগ নষ্ট করে দিল নেতার। এই সুযোগে পিপার আড়ালে চলে এল আবার রিটা। রাইফেলটা হাতে নিয়ে বেরোল।
খবরদার! গর্জে উঠল সে। নেতার দিকে তাক করে ধরেছে খেলনা অস্ত্র। নড়লেই গুলি করব!
দ্বিধায় পড়ে গেল নেতা। অস্ত্রটার দিকে তাকিয়ে আছে। খেলনা। ওটা তোমাকে বাঁচাতে পারবে না।
ট্রিগার টেনে দিল রিটা।
পিচকারির মত তীব্র গতিতে ছুটে গেল রূপালী পানির সরু একটা ধারা। ভিজিয়ে দিল নেতাকে। মুখের ভেতর থেকে থুথু করে পানি ফেলল নেতা। বোকা মেয়ে! তুমি ভেবেছ সিনেমার রোবটগুলোর মত পানি দিয়ে আমাকে গুলিয়ে ফেলবে!
গা বেয়ে পানি পড়ে লোকটার পায়ের কাছে জমা হলো। পায়ের কাছ থেকে পানির একটা রেখা মেঝে বেয়ে রিটার কাছে এসে থেমেছে।
গলাব কেন? জবাব দিল রিটা। কাবাব বানাব।
হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সে। পানির রেখার মাথাটার ওপর দৃষ্টি স্থির করল। ছিটকে বেরোতে শুরু করল গোলাপী ফুলিঙ্গ। পানি বেয়ে ভয়ঙ্কর ভোল্টের বিদ্যুৎ তীব্র গতিতে ধেয়ে গেল লোকটার দিকে। চোখের পলকে গিলে ফেলল তাকে গোলাপী বিদ্যুতের জাল। মাটিতে পড়ে জবাই করা ছাগলের মত ছটফট শুরু করল সে। তারপর নিথর হয়ে গেল।
চেঁচামেচি শুনে বেরিয়ে এল চার গার্ড। মই বেয়ে দ্রুত নেমে এল নিচে। নেতার দেহটা দেখল।
কে এগোবে এরপর? হুমকি দিয়ে বলল রিটা।
এক মুহূর্ত থমকাল ওরা। তারপর এগিয়ে এসে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করল ওকে।
ওদেরকে কাছে আসার সুযোগ দিল রিটা। হাসি হাসি কণ্ঠে বলল, জো-জো খেলবে? লাফ দিয়ে তার হাতে বেরিয়ে এল একটা লম্বা ধাতব স্প্রিঙের মত খেলনা। মাথার ওপর ঘোরাতে শুরু করল। গোলাপী আলোর চক্র তৈরি করল স্পিংটা।
ভয়াবহ বিদ্যুতের ছোঁয়ায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ল চার ভিনগ্রহবাসী গার্ড।
একটা সেকেন্ডও আর দেরি করল না রিটা। পাঁচ-পাঁচটা দানবকে ধরাশায়ী করে আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে তার। ওরা জ্ঞান ফিরে পাওয়ার আগেই মই বেয়ে উঠে এসে ঢুকে পড়ল ইট এফ ও-র ভিতরে।
*
মহাকাশযানের ভেতরটা আহামরি কিছু নয়। আধুনিক যাত্রীবাহী জেট প্লেনের পাইলটের কেবিনে যে ধরনের কন্ট্রোল প্যানেল থাকে প্রায় সেই রকম। কেবল ছাতটা অন্য রকম। ঝলমলে সাদা আলোকিত গম্বুজের মত।
হ্যাচটা লাগিয়ে দিল সে। দেয়ালে সুইচ রয়েছে। নিচে লেখা: হ্যাচ। সুইচটা অফ করে দিতেই লেগে গেল হ্যাচ।
ঘুরে তাকাতেই একধারে মুসা, রবিন আর জিনাকে দেখতে পেল সে। দাঁড়িয়ে আছে ওরা। কিংবা বলা যায় দাঁড়ানো অবস্থায় আটকে রাখা হয়েছে ওদের। মেঝে থেকে ছাত পর্যন্ত লম্বা, পরিষ্কার হালকা হলুদ রঙের প্লাস্টিকের মোটা টিউব খাড়া করে রাখা। তাতে ভরে রাখা হয়েছে তিনজনকে। কেমন আচ্ছন্নের মত হয়ে আছে ওরা। ল্যাবরেটরিতে মৃত প্রাণীকে যেমন করে তরল ওষুধের মধ্যে ভরে রাখা হয়, অনেকটা তেমনিভাবে। তফাৎ কেবল, ওরা জ্যান্ত।
কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকাল রিটা। আশ্চর্য আরেকটা ক্ষমতা অনুভব করছে নিজের মধ্যে। প্যানেলটা যেন তার বহু পরিচিত। কোন সুইচটা টিপলে কি হবে, প্রায় সবই বুঝতে পারছে।
একটা চারকোনা বোতাম টিপে দিতেই নিঃশব্দে ওপরে উঠে গেল টিউবগুলো। যেন ঘুম থেকে জেগে উঠে মেঝের ওপর দিয়ে তার দিকে হেঁটে এল মুসা, রবিন আর জিনা।
অনেক ধন্যবাদ, রিটা, জিনা বলল। আমি জানতাম, তুমি আসবে।
ভেন্নাগুলোর কি অবস্থা? মুসা জানতে চাইল। বিপদ কি কাটল আমাদের?
এখনও কাটেনি, জবাব দিল রিটা।
তুমি ঢুকলে কি করে? জিজ্ঞেস করল রবিন।
লড়াই করেছি ওদের সঙ্গে। ওরা হেরেছে।
খাইছে! চোখ বড় হয়ে গেল মুসার। একা ওই পাঁচ-পাঁচটা। দৈত্যকে কাবু করে ফেললে!
নইলে কি আর আমাকে এখানে ঢুকতে দিত? তোমাদের মত ধরে নিয়ে আসত। এতক্ষণে আমিও বন্দি হয়ে যেতাম কোন একটা টিউবে।
কথা পরেও বলা যাবে, তাগাদা দিল জিনা। এখান থেকে পালানো দরকার।
গর্তটার কাছে এসে দাঁড়াল আবার সবাই। সুইচটা অন করে দিল রিটা। সরে গেল হ্যাঁচের ভারী ঢাকনাটা।
নিচে দাঁড়িয়ে আছে ভয়ানক রেগে যাওয়া পাঁচজন ভিনগ্রহবাসী।
হ্যাচ লাগানোর জন্যে তাড়াতাড়ি আবার সুইচ টিপল রিটা।
আমি তো ভেবেছিলাম শয়তানগুলোকে মেরেই ফেলেছ বুঝি, ঢাকনাটা খাপে খাপে বসে যেতে বলল মুসা।
তারমানে বেহুশ হয়ে গিয়েছিল, রিটা বলল।
বেশ। কোনভাবে তাহলে ওদের মনে করিয়ে দাও, শয়তানি করতে এলে আবার বেহুশ করা হবে।
ধুড়ম ধুড়ম করে বাড়ি পড়তে শুরু করল হঠাৎ মহাকাশযানের পেটে। হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মারছে মনে হচ্ছে। ধাতুর পাত ভেঙে ঢোকার চেষ্টা করছে ভিনগ্রহবাসীরা। সে-রাতে গাড়ির মধ্যে বসে থাকার কথা মনে পড়ল রিটার। গুণ্ডা ছেলেগুলো এসে গাড়িটাকে এ রকম করে পিটাচ্ছিল। তবে সেবার জন্মদিনের কেক মুখে। মাখিয়ে দিয়ে পালানোর সুযোগ পেয়েছিল, এবার আর তত সহজ হবে না।
এই স্পেস শিপটা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ভাল চেনে ওরা, রবিন বলল। আমরা কিছু না করে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে ঠিকই ঢুকে পড়বে।
কি করব? রিটার প্রশ্ন।
এটা নিয়ে উড়ে চলে গেলেই হয়, সহজ জবাব দিয়ে দিল মুসা!
তা তো বটেই, পছন্দ হলো না জিনার। উড়ে চলে যাক। ভিনগ্রহে। শত্রুর দেশে। তারপর ফিরব কি করে?
যেতে পারলে ফিরতেও পারব, কন্ট্রোল প্যানেলে বসে পড়ল। মুসা। যা হবার হবে, সে পরে দেখা যাবে। আপাতত তো পালাই।
তা বটে, মুসার সঙ্গে একমত হলো রবিন। বাচতে হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই ফুড কোর্টটা থেকে বেরিয়ে যাওয়া দরকার। কোনমতে যদি ঢুকতে পারে ওরা, দ্বিতীয়বার আর ঠেকাতে পারব না। স্রেফ খুন করে ফেলবে।
বেশ, কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে মনোযোগ দিল মুসা, চালানো শুরু করলাম আমি।
.
২০.
রবিন, জিনা আর রিটা মহাকাশযানের গা ঘেঁষে দাঁড়াল। ধরার। মত যে যা পেল, শক্ত করে চেপে ধরল। কন্ট্রোল প্যানেলের সামনের চেয়ারে সীট বেল্ট লাগানো আছে, সেটা পরে ফেলল। মুসা।
সমানে পিটিয়ে চলেছে ভিনগ্রহবাসীরা। বিকট শব্দ। সহ্য করা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে মহাকাশযানের ভেতরেই তৈরি হচ্ছে শব্দটা। সময় বেশি নেই, বুঝতে পারছে গোয়েন্দারা। শীঘি মারাত্মক জখম করে ফেলবে মহাকাশযানের শরীরে, হয়তো আর মাটি ছেড়ে যাওয়াই সম্ভব হবে না তখন। ওড়ার সময় যে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হবে, দুর্বল জায়গা থাকলে ধ্বংস হয়ে যাবে মহাকাশযান।
সবাই রেডি? ভয়ানক শব্দকে ছাপিয়ে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল মুসা। রওনা হলাম!
কন্ট্রোলে হাত রাখল সে। কীবোর্ড নেই, স্টিয়ারিং হুইল নেই, শুধু দুটো ধাতব হাতের মত জিনিস। হাতের ছাপ নকল করে বানানো হয়েছে যেন। ওগুলোর ওপর হাত দুটো রাখল মুসা। বসে গেল সুন্দরমত। সঙ্গে সঙ্গে মনিটরে ফুটে উঠতে লাগল নানা রকম নম্বর আর লেখা।
আরও বেড়েছে বাড়ি মারার শব্দ। মরিয়া হয়ে উঠেছে ভিনগ্রহবাসীরা।
রেডি তো? জিজ্ঞেস করল মুসা। কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকিয়ে তিনজনকেই দেখল একনজর। আবার ফিরল কন্ট্রোলের দিকে। ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, সাহস জোগানোর চেষ্টা করছে নিজেকে। একটা অচেনা যানকে চালাতে ভয় যে পাচ্ছে বোঝাই যাচ্ছে। চিকন ঘাম দেখা দিয়েছে কপালে। চোখের দৃষ্টি মনিটরের ওপর স্থির। হাতের আঙুলগুলো অস্থির ভঙ্গিতে ওঠানামা করছে।
মহাকাশযানের গভীর থেকে চাপা গুমগুম শব্দ শোনা গেল। ক্রমেই বাড়তে থাকল শব্দটা। ভারী হচ্ছে। জোরাল হচ্ছে গুঞ্জন। বাইরের হাতুড়ি পেটানো থেমে গেল আচমকা। রাগে চিৎকার শুরু করেছে ভিনগ্রহবাসীরা। গোয়েন্দারা কি করতে যাচ্ছে, বুঝে গেছে।
গুঞ্জনটা তীক্ষ্ণ হতে হতে যেন আর্তনাদে রূপ নিল। দুলে উঠল মহাকাশযান। পরক্ষণে ঝাঁকি দিয়ে তীরবেগে ওপরে উঠতে শুরু করল।
কোন কিছু ধরেই দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হলো না তিনজনের পক্ষে। প্রচণ্ড গতিবেগের কারণে পড়ে গেল মেঝেতে। সেটে গেল যেন মেঝের সঙ্গে। নিজের ওজন দুই টন মনে হতে থাকল রিটার।
মাথার ওপরে গম্বুজের মত ছাতটা স্বচ্ছ হয়ে গেছে। কাঁচের বড় গামলার ভেতর দিয়ে তাকালে যেমন লাগে, তেমন লাগছে রাতের আকাশটাকে। বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে আছে রবিন, জিনা আর রিটা। কন্ট্রোল প্যানেলে ব্যস্ত থাকায় মুসা তাকাতে পারছে না। মলের ধ্বংস হয়ে যাওয়া ছাতের গর্ত দিয়ে তীব্রগতিতে বেরিয়ে এল মহাকাশযান। সোজা উঠে গেল মেঘের দিকে। জেট ইঞ্জিন। থেকে বেরোনো উজ্জ্বল রঙিন ধোয়া প্রতিফলিত হয়ে মেঘটাকেও রঙিন করে দিল। জলযান চলার সময় যেমন পেছনে দীর্ঘ একটা ঢেউয়ের রেখা সৃষ্টি করে রেখে যায়, তেমনি করে মহাকাশযানটা রেখে যাচ্ছে ধোয়ার লেজ। উজ্জ্বল লেজটা মুছে না যাওয়া পর্যন্ত রঙিন হয়ে থাকছে মেঘ, অনেকটা ধূমকেতুর পুচ্ছের মত।
মেঘ থেকে বেরিয়ে এল মহাকাশযান। আরও ওপরে উঠল। আকাশটা এখন শুধুই কালো। গম্বুজের ভেতর দিয়ে তারাগুলোকে বড় বড় লাগছে, তবে কিছুটা ঘোলাটে।
রবিন ভাবছে, পৃথিবীর সীমানা কি ছাড়িয়ে এল? মহাকাশটাকে দেখতে কি এমনই লাগে? বিমান থেকে যে রকম দেখা যায়, তার সঙ্গে এখনকার আকাশের তেমন কোন তফাৎ খুঁজে পেল না সে। হতে পারে পৃথিবীর সীমানা এখনও কাটায়ইনি। মহাকাশযান।
কখন কাটাবে? চলছে যে তাতে কোন সন্দেহই নেই।
ওপরে ওঠার সময় নিচের দিকে যেভাবে টানছিল মাধ্যাকর্ষণ, যে কারণে মেঝেতে পড়ে গিয়েছিল ওরা, সেই টানটা আর এখন নেই। উঠে দাঁড়াল রবিন। দেখাদেখি জিনা আর রিটাও উঠল।
মুসার কাছে এসে দাঁড়াল রবিন। চালাতে তাহলে পারছ।
রিটা আর জিনাও এগিয়ে এল। ঘিরে দাঁড়াল মুসাকে।
চালানো-টালানোর ব্যাপারে তুমি তো একটা জিনিয়াস, প্রশংসা করল রিটা। প্লেন চালাতে পারো জানতাম। কিন্তু ভাবতেই পারিনি স্পেস শিও চালাতে পারবে। কি করে বুঝলে?
খুব সহজ, হাসতে হাসতে জবাব দিল মুসা। কেবিনের আলোয় ঝকঝক করতে থাকল তার সাদা দাঁত। রহস্যটা ফাঁস করে দিলেই বুঝবে, একটা বাচ্চা ছেলেও চালাতে পারবে এটা। আমি শুধু অটো পাইলট চালু করে দিয়েছি।
তারমানে নিজে নিজে চলছে এখন এটা? ভুরু কুঁচকে ফেলল জিনা। কোর্স যেখানে সেট করে রাখা আছে সেখানেই গিয়ে নামবে? ও মাথা ঝকাল মুসা। তাই তো করার কথা। পৃথিবীতে মানুষের তৈরি প্লেন, জাহাজ তা-ই করে।
কাজটা কি ঠিক হবে? রিটার প্রশ্ন।
না হওয়ারই বা কি হলো? অনিশ্চিত ভঙ্গিতে জবাব দিল মুসা। প্রাণে তো বাচলাম।
কই আর বাঁচলাম, রবিন বলল। মলের লোকগুলোর হাত থেকে বেঁচেছি। কিন্তু গিয়ে তো নামতে হবে ওদেরই দেশে। অর্থাৎ, শত্রুর দেশে। কোন গ্রহে যাচ্ছি, ওখানকার কোন কিছুই না। জেনে হুট করে চলে যাওয়াটা কি ঠিক হবে?
তা তো হবেই না, হাসিটা মুছে গেল মুসার। কিন্তু আর কি করতে পারি!
কিছু একটা উপায় বের করা দরকার, বেশি দেরি হয়ে যাবার আগেই, চিন্তিত স্বরে বলল রবিন।
করো, করো, যা করার জলদি করো। ভাবাভাবিগুলো আমার কর্ম নয়। আমাকে যে ভাবে চালাতে বলবে, আমি সেভাবেই চালাব।
তারচেয়ে এক কাজ করি বরং, রিটা বলল। যে ভাবে চলছে। এটা চলতে থাকুক। দেখি না কোনখানে গিয়ে থামে। জায়গাটা দেখে নেয়া দরকার। তারপর আবার অটে। পাইলট চালু করে সহজেই পৃথিবীতে ফিরে আসা যাবে।
তা ঠিক, মাথা ঝকাল রবিন। বুদ্ধিটা মন্দ না।
হ্যাঁ, সুযোগ যখন একটা পাওয়াই গেল, জিনার কণ্ঠেও উত্তেজনা, গ্রহটা দেখে এলে মন্দ কি?
সীটে হেলান দিল মুসা, আমি রাজি।
<